আমার ভাগনের মতো এমন বিচ্ছু ছেলে আর আছে কিনা সন্দেহ। তের মাস বয়সে ও যখন মাত্র অল্প অল্প হাঁটতে শিখলো তখনি ও ঘরের সবকিছু ফেলতে শুরু করলো। আর যখন ও দৌড়াতে শিখলো তখন ঘরের সব বয়সের লোকজনও ওর পিছু পিছু দৌড়াতে শুরু করলো। ঘরের কারো কোন নিস্তার নেই। চায়ের কাপ, গ্লাস, বাবার চশমা এমন কোন জিনিস নেই যে ও ভাংগে নি। কেউ আদর করে কোলে নিলে হয় নাকে বা গালে রাম খামচি দেবে বা যদি দাঁড়ি গোফ থাকে তো তা ধরেই জোরে টান দেবে। পরে এমন একটা ব্যাপার হল যে কেউ আর ওকে কোলে নিতে সাহস করে না।
অমির বয়স এখন পাঁচ বছর। হুম, আমার ভাগনে বিচ্ছুটার নাম অমি। মাস দুয়েক হলো ওকে স্কুলে ভতি করানো হয়েছে। প্রথম যে স্কুলটাতে ওকে ভতি করানো হয়েছিলো সে স্কুলটা নাকি ওর একেবারেই ভালো লাগেনি। প্রথম দিনেই ওর ক্লাসের এক মেয়ের সাথে তুমুল মারামারি করলো। এক ম্যাডাম যখন ওদের থামাতে এলো তখন ও ম্যাডামের গাল ও খাঁমচে দিলো। সেদিনই সে স্কুলের শুরু আর সেদিনই তার শেষ।
আমি আপাকে বললাম, “ তোমার এই বিচ্ছু ছেলের কপালে যে কি আছে !”
আপা রেগে বললেন, “ এই আমার ছেলেকে বিচ্ছু বলবিনা। আসলে ওর স্কুলটাই পছন্দ হয়নি।“
“তাই বলে অন্য বাচ্চার সাথে মারামারি করবে! ম্যাডামের গাল খাঁমচে দিবে!”
“দিবে নাতো কী। ঐ স্কুলের আসলে কিছুই ভাল নয়। “
আমি অন্যদিকে তাকিয়ে একটা দীঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “ ও তাই! তাহলে ভতি করাও অন্য স্কুলে।“
“হুম তাই করবো।“
সাতদিনের মধ্যে অমিকে অন্য একটা স্কুলে ভতি করানো হলো। শুনলাম এই স্কুলটা নাকি ওর পছন্দ হয়েছে। আর পছন্দ হয়েছে তার কারন নাকি স্কুল ড্রেস। কমলা রংগের হাফপ্যান্ট, লাল মোজা, সাদা সু, নীল সাট আর সাথে লাল টাই। প্রতিদিন স্কুলে যাবার আগে দেখি ও বেশ উৎসাহ নিয়ে স্কুল ড্রেস পরে, স্কুল থেকে ফিরেও অনেকক্ষণ পযন্ত কাপড় চোপর খুলে না।স্কুল ড্রেস পরেই এ ঘর ও ঘর ঘুরে বেড়ায়। কখনো কখনো স্কুলের এই পোশাকেই মাঠে চলে যায়, অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলাধূলা করে।
তবে কেন জানি না ও আমাকেই (আমার দূভাগ্যক্রমে) সবচেয়ে বেশী পছন্দ করে। সবসময় আমার ঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করে। আমার ঘরে এসে এটা নাড়ে , ওটা নাড়ে। কাগজ প্ত্র এলোমেলো করে। বিরক্ত হয়ে অনেক সময় বকাঝকা করি। বকাতে অল্প সময়ের জন্য হয়ত কিছুটা কাজ হয়, চুপচাপ বসে থাকে, কিন্তু কিচুক্ষন পরেই আবার যে বিচ্ছু সেই।
কখনো কখনো ওকে নিয়ে বিকেলে বেড়াতে বের হতে হয়। ও যখন বলে, মামা তোমার সাথে বাহিরে যাব, তখন আর কার সাধ্য যে ওকে না নেয়। নিতে হবেই। প্রায় সময়েই বিকেলে বন্ধুদের সাথে মজার আড্ডা বাদ দিয়ে বিচ্ছুটাকে নিয়ে বের হতে হয়। সেদিন বিকেলে বের হয়ে ঘটলো এক অঘটন। শহরের একটা রেললাইনের পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। জায়গাটা ছিল ছোট একটা বাজারের মতো। রেললাইনের দুপাশে তরিতরকারি , ফলমূল আরও অনেক দোকানপাট।
আমার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফলের দোকান দেখে অমি বলল, “ মামা কমলা খাব।“
কমলা ফলটা আমারও খুব পছন্দের। সতি বলতে কি আমারও কমলা খেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। অমি বলার পরে আমার সে ইচ্ছেটা আরো প্রবল হয়ে উঠলো। বললাম , “কমলা খাবি, চল।“
দোকানদার খুব সুন্দর করে কমলা সাজিয়ে রেখেছে। কমলা একটার উপর আরেকটা রেখে রেখে বিশাল এক পিরামিড তৈরী করেছে। কাছে গিয়ে দোকানদার কে জিজ্ঞাসা করলাম , “ কমলার হালি কত ?”
দোকানদার আমার কথার উত্তর না দিয়ে উল্টো জিজ্ঞাসা করলো, “ দাদা নিবেন কয় হালি?”
“যত হালিই নেই, আগে বলেন দাম কতো।“ ফলওয়ালা আমার কথার ধার দিয়েও গেল না। বলতে লাগলো , “ আমার এই কমলা দাদা বাইরের মাল, একেবারে মধুর মতো মিষ্টি, একটা খাইয়া দেহেন। পয়সা লাগবো না...।“
দোকানদার আর আমার সাথে যখন কথা হচ্ছিলো তখন কোন ফাঁকে যেন আমার বিচ্ছু ভাগনে তার ক্ষুদে থাবায় খুব সূক্ষতার সাথে কমলার পিরামিডের ঠিক নীচ থেকেই একটা কমলা টেনে নিলো। আর তার সাথে সাথেই যে এক ঘটনা ঘটলো তার জন্য আমি বা দোকানদার কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। চোখের পলকে ফলওয়ালার সে কমলার পিরামিড ভেঙ্গে গেল। একটা একটা করে সব কমলা বাজারের রাস্তায় গড়াগড়ি খেতে লাগলো। আমি আর দোকানদার দুজনেই হায় হায় করতে থাকি। সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার! দোকানদার এর কাছে অনেকবার করে ক্ষমা চেয়ে, কোন দরদাম না করে চার হালি কমলা কিনে সেদিন বাসায় ফিরলাম। সেই থেকে কান ধরেছি এই বিচ্ছুটাকে নিয়ে আর কখনো বের হব না।
কিন্তু না চাইলেও পারা যায় না আসলে। সেদিন আমিকে দাঁতের ডাক্তার দেখানোর জন্য ঢাকায় যেতে হল। ডাক্তার দেখিয়ে বিকেলে ট্রেনে করে বিচ্ছুটাকে নিয়ে নারায়নগঞ্জ ফিরছি। ট্রেনে প্রচণ্ড ভীড়। বাসের ভাড়া অনেক বাড়াতে বেশীরভাগ লোকজন ট্রেনের দিকে ঝুকে পরেছে। ভাগ্যক্রমে ট্রেনে একটা সীট পেয়ে গেলাম। আমিকে কোলে নিয়ে চুপচাপ বসে পড়লাম। একটু পরে দেখলাম ট্রেনে দাড়াঁনোর জায়গাটুকুও নেই। সাথে প্রচণ্ড গরম। এর মধে আবার দুইজন লোক কি একটা ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে। মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচি, ভীরের ধাক্কাধাক্কি আর বিশ্রী গরম- সব মিলিয়ে ট্রেনের ভিতর খুব বাজে এক অবস্থা।
ট্রেনটা ছাড়ার পর পরিবেশ কিছুটা ঠাণ্ডা হল। লোকজন সব চুপ করে গেলো। কয়েকজন আবার দাঁড়ানো অবস্থাতেই ঝিমুতে শুরু করলো। মাঝে মাঝে ট্রেনের ঝাকুনিতে পাশের জনের উপর গিয়ে পরছে, সাথে সাথে পাশের জনও জোরে ধ্মক লাগাচ্ছে। অমি দেখলাম এই ব্যাপারটাতে খুব মজা পাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর খিলখিল করে হেসে উঠছে। আমি বললাম, চুপ হাসে না।
অমি একটু পরেই আমার কোল থেকে নেমে গেলো। অনেকক্ষণ ধরে ঝাপটে ধরে রাখাতে ও আসলে আশপাশ করছিলো। সামনের অল্প একটু জায়গাতে দাঁড়িয়ে ও দুষ্টমি করতে লাগলো। একবার ট্রেনের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকায়, এটা জিজ্ঞাসা করে, ওটা জিজ্ঞাসা করে। আশেপাশের লোকজনও বিরক্ত হয়ে গেলো। প্রচণ্ড গরম আর ঠেলাঠেলিতে মানুষ আসলে আস্থির, তার উপর আবার ছোট বাচ্চার দুষ্টমি। বিরক্ত হবারই কথা। কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে ধ্মকও দিয়ে বসলো।
ট্রেন ফতুল্লা পৌঁছতে লাগলো একঘণ্টা। তারপরের স্টেশানেই আমি নামবো। ফতুল্লা আসতে আসতে ট্রেন অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেলো। তবে তখনও অনেক যাত্রী দাঁড়িয়ে। ফতুল্লা থেকে দেখলাম এক বৃদ্ধ মহিলা উঠলেন। সাথে তের-চৌদ্দ বয়সের এক মেয়ে। মহিলার গলায় পৈতা জড়ানো, পরনে সাদা কাপড়। মহিলার বয়স প্রায় আশির কাছাকাছি। এক পলক দেখেই আন্দাজ করা যায় এরা হিন্দু। ছোট মেয়েটা বৃদ্ধ মহিলাকে নিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো। দেখে কেমন জানি মায়া হয়। ট্রেনের ঝাকুনিতে বৃদ্ধা ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ছোট মেয়েটি অনেক কষ্ট করে ধরে রাখার চেষ্টা করছে, কিন্তু মাঝে মাঝে প্রচণ্ড ঝাকুনিতে পারছে না।
আমি আর আশেপাশের লোকজন ব্যাপারটা দেখেও না দেখার ভান করছিলাম। আমি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলাম। এই সময় অমি একটা কাণ্ড করলো। বৃদ্ধাকে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে আমাকে বলতে লাগলো, “ মামা ওকে বসতে দাও।“ আমি না শোনার ভান করে বাহিরেই তাকিয়ে রইলাম। অমি এবার আমার মুখ ধরে জোরে জোরে বলতে লাগলো, “ মামা ও বসবে না? ওকে বসতে দাও।“
আমি কেন জানি না প্রচণ্ড লজ্জা পেলাম। সীটটা ছেঁড়ে দিয়ে বৃদ্ধ মহিলাকে বসতে দিলাম। ট্রেনে বসে থাকা আর অন্য কোন যাত্রী লজ্জা পেলো কিনা জানি না, তবে অমি তারপরেও আরও অনেক দুষ্টমি করলো, কিন্তু ট্রেনের কোন যাত্রী আমির দিকে তাকিয়ে আর টু শব্দটিও করলো না।
পরদিন সকালে বাজার থেকে ফিরে দেখি বিচ্ছুটা আমার বিছানায় ঠিক পিংপং বলের মতো লাফাচ্ছে। ঘরের অনেক জিনিসপত্রও এলোমেলো। প্রচণ্ড রাগ হল। একটা রাম ধ্মক দিব দিব অবস্থা। কিন্তু কেন জানি ধ্মক দিতে গিয়েও থমকে গেলাম, দিতে পারলাম না। মনে মনে ভাবলাম, লাফা বিচ্ছু লাফা। যতো পারিস লাফা। zahidsajal
মন্তব্য
এই বাক্যটার প্রয়োজনীয়তা বোধগম্য হল না।
সাইদ
সুন্দর হয়েছে। একটানে পড়ে ফেললাম। বিচ্ছুটাকে আমার তরফ থেকে আদর দিয়েন।
---------------------------
এডিটঃ উপ্স! এটাতো দেখি 'গল্প' ট্যাগ করা! আচ্ছা ঠিক হ্যায়, গল্পের পিচ্চি বিচ্ছু চরিত্রটাকেই বরং গাল্পিকভাবেই আমার তরফ থেকে আদর দিয়েন।
****************************************
@ Rashid Alam: লেখকের ঐ বাক্য ব্যবহার করার প্রয়োজন ছিল না মোটেও- এটা ঠিক। লেখকের অসাবধানতা কোন পাঠাকের কষ্টের কারণ হতে পারে।
একই সাথে, আপনার আক্রমণটাও একটু বেশি হয়ে গেল না?
আমার 'এক পলক দেখেই আন্দাজ করা যায় এরা হিন্দু' এই লাইনে আপত্তিকর কিছু চোখে পড়ল না, কেননা আমরা বাহ্যিক চেহারার বৈশিষ্ট্য দিয়ে হিন্দু ,মুসলমান , শিখ তফাৎ করতে অভ্যস্ত। কিন্তু যেটা বলার তা হল হিন্দু মহিলারা পৈতে পরেন না, লালন বলেছেন 'বামুন চিনি পৈতে প্রমান বামনি চিনি কি প্রকারে'।
প্রিয় জাহিদ সজল,
আপনার লেখায় একটি বাক্য পড়তে গিয়ে পাঠকরা বারবার হোঁচট খাচ্ছেন। আমরা মনে করি বাক্যটিতে সরাসরি কোনো সাম্প্রদায়িক চেতনা প্রকাশ না পেলেও বিষয়টি প্রকাশ করতে আরো সাবধানী হবার দরকার ছিলো। আমরা এটাও বুঝতে পারছি, আপনি আপনার ভাগ্নের অসাম্প্রদায়িক এবং উদার মানসিকতার উদাহরণ হিসেবে প্রসঙ্গটির সুত্রপাত করেছেন।
সাম্প্রদায়িক বিষয়ে সচলায়তনে অবস্থান সর্ম্পকে নীতিমালাটি পড়ে দেখতে পারেন। ভবিষ্যতে আপনাকে এ ব্যাপারে আরো সর্তক থাকতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
মডারেটর প্যানেল থেকে কথা বলাটা ভালো হইছে।
তবে, ২ নং এ রশিদ আলমের বক্তব্যের শেষ লাইন বমি আসার মত।
অনেক অনেক ধন্যবাদ সবাইকে। আমার ঐ বাক্যটা যদি কোন পাঠকের মনে আঘাত দিয়ে থাকে তাহলে তার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। আসলে গল্পটা লেখার সময় একটানে লিখে গেছি। এতো কিছু ভাবিনি। তবে ভাবা উচিত ছিল।
কাউকে হেয় করার কোন উদ্দেশ্যই ছিল না। ভবিষ্যতে অবশ্যই সাবধান থাকব লেখালেখির ব্যাপারে।
নতুন মন্তব্য করুন