লেখকরা অনেক সময়ই লেখার প্রয়োজনে একটি ঘটনা বর্ণনার সময় মূল ভাব ঠিক রেখে নিজের মত করে রং তুলির আঁচরে লেখাটাকে ফুটিয়ে তুলেন। এখানে তা করা হয়নি। একটি সত্য ঘটনা কোনরুপ পরিবর্তন না করে উপস্থাপন করা হয়েছে)
........................................,...............................................................................................................................................................................................................................................
বছর খানেক আগের ঘটনা। রাত আনুমানিক সাড়ে দশটা। সিগারেট না থাকাতে রাতে খাওয়ার পরে নীচে নামা। সিগারেট কিনে বাসার পাশেই এলিফেন্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের কর্নারে ফুটপাথের দোকানের দিকের পাশে একটি বন্ধ দোকানের শাটারে পিঠটা দিয়ে দাড়িয়ে আয়েসী ভঙ্গীতে সিগারেট টানছি।
একজন জটাধারী, শরীরে ছালা পেঁচানো। ফুটপাথের রাস্তার দিকের কিনারা ঘেষে হেটে আসছেন। আমার কাছে আসার ঠিক আগেই একজন আমার দিক থেকে যাবার সময় উনাকে সালাম দিলেন এবং উত্তরে উনি দুবার মাথাটা ঝাকালেন শুধু। ঠিক তারপরপরই আমাকে পেরিয়ে যাচ্ছিলেন, কিছু না ভেবে আমিও সালাম দিলাম। একইভাবে মাথাটা দুবার ঝাকিয়ে একটু সামনে এগিয়ে দাড়িয়ে পরলেন। ফিরে আসলেন আমার দিকে। মাথাটা বুকের দিকে কিঞ্চিত ঝুলানো, চোখটা আমার দিকে তুলে বিরবির করে কিছু আরবীতে কোন সূরা কিংবা আয়াত হতে পারে পরছিলেন। একেবারে বুড়ো নন। বলা যায় এইসমস্ত ক্ষেত্রে কিছুটা কমবয়সই হবে। পঞ্চাশোর্ধ হবেন হয়ত।
হটাৎ করে একটু গলাটা উঁচিয়ে বললেন দুইটা টাকা দিবি? আমি মানিব্যাগ বের করে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিলাম। টাকাটার দিকে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে আবার বিরবির করে কিছু বললেন এবং একটা জোরে হাসি দিলেন। তারপর খপ করে আমার হাতটা এক হাত দিয়ে ধরে ফেললেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছুটা হলেও অপ্রসতুত এবং বাসা পাশে এবং দুই একজন লোক রাস্তায় এখনো চলাচল করছে তাই খুব বেশী একটা ভয় পেলাম না।
টাকার গরম কখনো দেখাতে নাই রে পাগল। আল্লাহ তোকে দিয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ! সবসময় শোকর গুজার করবি। টাকার গল্প করবি না আর টাকার গরম দেখাবি না। ওটা থাকবে না রে পাগল। এই বলে পঞ্চাশ টাকার নোটটা আমার হাতে দিয়ে বললেন - দুই টাকা চেয়েছিলাম রে পাগল, দুই টাকাই দিবি। এই বলে তার হাতখানা বাড়িয়ে রেখে হাতের তালুটা আমার সামনে ধরে রইলেন। আমি মানিব্যাগ খুঁজে দুই টাকা না পেয়ে বললাম নেই। বলল তাহলে পাঁচ টাকা দে। আমি আবার খুঁজে বললাম দশ টাকা হবে পাঁচ টাকা নেই। বললেন দে। দিলাম এবং নিয়ে ম্যাজিশিয়ানের মতই টাকাটাকে কয়েকভাঁজ করে হাতের মুঠের মধ্যে লুকিয়ে হাতটা আমার সামনে বাড়িয়ে রাখলেন। এরপর আবার কিছুক্ষন বিরবির করে কিছু বললেন হাতের মুঠটা খুলে বললেন টাকাটা নে। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আবার বললেন টাকাটা হাতে নে। নিলাম। এবার বললেন নাঁকের কাছে নিয়ে শুকে দ্যাখ। দেখলাম খুব সুন্দর একটা গন্ধ পুরো টাকাটার মধ্যে। এবার বললেন পরিস্কার এক টুকরা কাপড় আছে? কাপড় থাকবে কেন, বললাম নাই। পরিস্কার সাদা কাগজ আছে? বললাম নাই তবে মানিব্যাগে কোনভাবে একটি হার্ডওয়্যারের দোকানের মানি রিসিপ্ট ছিল। দেখিয়ে বললাম হবে কিনা। কোন উত্তর না দিয়ে হাতে নিলেন। আমার কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে আরো কয়েক ভাঁজ করে কাগজের ভিতর খুব সুন্দর করে ঢুকালেন ঠিক যেভাবে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তাররা তাদের ঔষধ প্যাকেট করেন। ভাঁজ করার ফাঁকেই জিজ্ঞাসা করলেন কি করিস তুই? বললাম একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করি। ফ্যামিলি আছে? হ্যাঁ বললে জিজ্ঞাসা করলেন তোর মা কোথায়? বললাম এখন আমার বাসায় কিন্তু গ্রামের বাড়ীতে থাকেন। মারে মা জননী বলে জোরে একটা আহাজারি করলেন ও বললেন মা যে কত আপনজন দুনিয়াতে কেউ বুঝে নারে পাগল।
কাগজে মোরানো টাকাটা হাতে দিয়ে বললেন - কিছু চাস? আমার কাছে নয়রে বোকা, আল্লাহর কাছে। উত্তর দেবার সময় না দিয়ে বললেন - জগতে এমন কেউই নাই যার আল্লাহর কাছে চাবার কিছুই নেই। শোন, এই কাগজটা (দশ টাকা মোড়ান) বাসায় কোন ভাল ও পরিস্কার জায়গায় রাখবি। মনে মনে ভাল কিছু আল্লাহর কাছে চাইবি, দেখিস চৌদ্দ দিনের মধ্যেই তোর মনের আশা পূর্ণ হবে। তবে, এই ব্যাপারটা একমাত্র তোর মাকে বলতে পারবি, অন্য কাউকে ভুলেও বলবি না। আর টাকার ব্যাপারে কখনো গরম দেখাবি না। এই বলে আবার কিছুক্ষন বিরবির করে দোয়া পড়ে বলল পেছনের পকেটে কাগজটা রাখিস না, সামনে রাখ আর আবারো বলি মা ছারা অন্য কাউকেই দেখাবি না। যা চাইবি আল্লাহর কাছে খাস দিলে চাইবি। বলে তার হাতটা আমার বুকে রেখে বলল - দিল খাস হোক তোর, সবকিছু খাস দিলে চাইবি আর কাউকে কিছু দিলেও খাস দিলেই দিবি। এই বলে চলে যেতে উদ্যত হয়ে আবার এসে বলল খাস দিল আর টাকার গরম দেখাবি না। বলে তিন চার কদম হেঁটে আবার ফিরে এসে বলল আমরা পাঁচ জন মানুষ ঢাকা শহরে ঘুরে বেরাই যাদের দিল বহুতি খাস তাদের খেদমত করতে। তোর দিলটা বহুত খাস আছে। আজকে আমরা পাঁচজন খাস দিলে বিরিয়ানি খাব। তোকে একটা সুযোগ দিলাম আমাদের খাওয়ানোর। দে - খাস দিলে পাঁচশ টাকা দে।
আমার মাথার ভেতরের ক্যালকুলেটরটা মুহুর্তের মধ্যে জটিল সরল অংকটা করে ফেলল এবং উত্তর এল এক। সরল অংকের উত্তর এক বা শূণ্য হলে আর উত্তর না দেখলেও চলে। বোঝা যায় অংক ঠিক হয়েছে।
যেভাবে অংকটা করলাম -
প্রথমে প্রথম বন্ধনী - উড়ন্ত পাখী শিকার করা যায় না। তাই হেটে যাওয়া যে লোকটা আমার আগে সালাম দিয়েছিল তাকে টার্গেট না করে যে পাখী গাছের ডালে আয়েশী ভঙ্গীমায় বসে আছে আর মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছারছে তার থেকে ভাল টার্গেট আর কি হতে পারে?
দ্বিতীয় বন্ধনী - দুই টাকার পরিবর্তে পঞ্চাশ টাকা দেয়াতে বুঝে গিয়েছিল টাকা দেবার হাত আছে এবং তার বেশভূষা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
তৃতীয় বন্ধনী - তার হাতে আগে থেকেই আতর মাখানো ছিল। তাই যখন জোরে টাকাটা চেপে ধরে ছিল তখন টাকায় স্বাভাবিকভাবে গন্ধটা চলে আসে।
চতুর্থ বন্ধনী - বারবার মায়ের কথা বলে মনটাকে নরম করবার চেস্টা করছিল। পৃথিবীতে মাই একমাত্র মানুষ যার কথায় প্রত্যেকের মন নরম হতে বাধ্য।
পঞ্চম বন্ধনী - কিছু পাবার লোভ দেখিয়েছিল চৌদ্দ দিনের মধ্যে যেটা অনেকে পাঁচশ টাকার বিনিময়ে সন্দেহ থাকলেও রিস্ক নিতে পারে।
এরপর উপরের সংখ্যাগুলিকে সাধারন যোগ বিয়োগ করলে ফল দাড়ায় এক - মানে একজন ভন্ড।
বল এবার আমার কোর্টে। এতক্ষন অপার্থিব কিছু একটার কারণে মনটা কিছুটা দূর্বল ছিল, এখন সেটি নেই।
আমি তেজোদ্দীপ্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে খুব ঠান্ডা গলায় বললাম - আপনি তো খাস দিলের কথা বলছিলেন বারবার। পাঁচশ টাকা তো খাস দিলে দিতে পারব না, তাই দিলেও আপনারও নেয়া ঠিক হবে না। খাস দিলে পঞ্চাশ টাকা দিয়েছিলাম, আবার দিচ্ছি - নিবেন? বলল দেন। দিলাম।
যেটার জন্য একেবারেই অপ্রস্তুত ছিলাম সেটা হচ্ছে - পঞ্চাশ টাকা নিয়ে বলছে ঐ দশ টাকাটা দেনা। দশ টাকার নোটটা কাগজ থেকে বের করবার ফাঁকে আমার মস্তিস্ক নয় এবার সহজ অংকটা মুখে বলেই করলাম -
দশ টাকার নোটটা যে আমার কোন আশাই পুর্ণ করবে না, এটা মনে হয় আমার থেকে আপনিই ভাল জানেন আর সেই জন্যই ফেরত চাইছেন। প্রথমেই তো ভাই পঞ্চাশ টাকা দিয়েছিলাম। এতক্ষন সময় নস্ট করলেন এইজন্য আপনাকে দশটা টাকা বাড়তি দিতে আমার কোন আপত্তি নাই। টাকাটা দেবার সময় তার চোখের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম, যে দৃস্টির দিকে সে তার দৃস্টি রাখতে না পেরে চোখটা নামিয়ে আস্তে আস্তে হেটে চলে গেল।
মুসাব বিন খন্দকার
মন্তব্য
সচলায়তনে ইংরেজি লেখার শিরোনাম দৃষ্টিকটু লাগছে।
আমি আপনার সাথে একমত। নিজের সাথে অনেক ফাইট করে তারপর রেখেছি। আসলে ঘটনার সাথে একদম মানানসই এই বহুল প্রচলিত ইংরেজি প্রবাদটি। হয়তোবা এর থেকে আরো ভাল মানানসই হতে পারত বাংলায় সেইভাবে নামটা লিখতে পারলে।
আমার সীমিত জ্ঞানভান্ডারে ভাল কিছু মাথায় আসেনি। তবে নীতিগত ভাবে আমি
আপনার অভিমতের সাথে একমত পোষন করছি। ধন্যবাদ!
আমি আপনার সাথে একমত। নিজের সাথে অনেক ফাইট করে তারপর রেখেছি। আসলে ঘটনার সাথে একদম মানানসই এই বহুল প্রচলিত ইংরেজি প্রবাদটি। হয়তোবা এর থেকে আরো ভাল মানানসই হতে পারত বাংলায় সেইভাবে নামটা লিখতে পারলে।
আমার সীমিত জ্ঞানভান্ডারে ভাল কিছু মাথায় আসেনি। তবে নীতিগত ভাবে আমি
আপনার অভিমতের সাথে একমত পোষন করছি। ধন্যবাদ!
চমৎকার লেগেছে ঘটনাটা। এভাবে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে এরকম যুক্তি দাঁড় করিয়ে কাজ খুব বেশী মানুষ করে না। এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে আপনার ভেতরের যুক্তিবাদি, মুক্তমনা মানুষটাকে দেখতে পেলাম।
সরল অংক করার স্টাইলে মজা পেয়েছি। আর পরীক্ষার খাতায় সরল অংক মিলে গেলে যেমন আনন্দ হয়, পড়ে সেরকম আনন্দ পেয়েছি।
আপনার লেখার ভক্ত হয়ে যাচ্ছি দিন দিন মুসাব ভাই। আরো লেখা দিন।
কয়েকটা টাইপো ছিল, আসলেই টাইপো, মানে কী বোর্ডের কারণে হয়েছে মনে হচ্ছে-
দাড়িয়ে ->দাঁড়িয়ে, পরছিলেন->পড়ছিলেন, বিরবির ->বিড়বিড়, হটাৎ->হঠাৎ, মোরানো->মোড়ানো,
____________________________
অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার লেখা টাইপো ভুল গুলি যখন দেখি তখন কিছু কিছু ভুলের ক্ষেত্রে মনে হয় আমার লেখা আমার থেকেও মনোযোগ দিয়ে পড়েছে। আসলেই ভাল। ধন্যবাদ।
অসাম সালা!!
ধন্যবাদ।
লোকটিকে যখন বুঝতে পারলেন ভন্ড তখন টাকা টা দিলেন কেন?
মাসুদ সজীব
হ্যাঁ, কেন? ৫০ টাকায় পুরাতন ২টা বই কেনা যায়
facebook
টাকা দেয়ার ব্যাপারে একটা ব্যাখ্যা পূর্বে দিয়েছি। মনে হয় নিজেকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করেছি। তবে এটি ভুল কিনা জানি না। অনেক সময় কিছু কিছু ভুল আপেক্ষিক মনে হয়।
বই কিনতে পয়সা লাগে না, বই পড়তে সময় লাগে না। ইচ্ছেটা কখনো কখনো কেনা যায় কিন্ত তাতে ইচ্ছেপূরন হয় না। অসংখ্য ধন্যবাদ।
এইগুলো কোন লাইনের কথাবার্তা কিছুই তো বুঝলাম না?
মাসুদ সজীব
আসলে মন থেকে প্রথমে যেহেতু টাকাটা দিয়েছিলাম, তাই পাপকে ঘৃনা কর পাপীকে নয়, হয়তোবা সেই কারনে দিয়েছিলাম। আর ঐ পরের দশ টাকাটা ওনাকে যে কথা বলে দিয়েছিলাম, সেটা মূল কারন নয়। ঐ ভন্ডামোর গন্ধযুক্ত টাকাটা সাথে রাখতে মন চায়নি। অনেক কিছুই করা যেত। আটকিয়ে পুলিশে দেয়া, লোকজনকে ডেকে লোকজনের হাতে ছেড়ে দেয়া। ঐ সময় কেন জানি ঘৃনা আর করুণা কাজ করেছিল, ঘৃনা ও রাগ নয়। ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন