এ এক অদ্ভুত আদালত। শুধু সত্য উদঘাটনই এখানে একমাত্র লক্ষ্য নয়। আসলে সত্যের সংজ্ঞাটাই গেছে বদলে কারণ প্লুরালিজমের এই যুগে একটা মাত্র সত্যের পিছু ধাওয়া করাটা একটু কষ্টসাপেক্ষই। চীনের বড় একটা কারখানার অ্যাসেম্বলি লাইনে যখন লাখে লাখে হুবহু একই রকম দেখতে টেলিভিশন সেট তৈরি হয়, তখন সেখান থেকে কোনটা অরিজিনাল আলাদা করাটা অসম্ভব। আসল-নকলের সম্পর্কটাই এখানে অনেকটা ঝাপসা। বলা যেতে পারে, এই কয়েক লাখ টেলিভিশন সেটের সবগুলোই আসল। একটা হয়তো অরিজিনাল নকশা ছিলো, কিন্তু অ্যাসেম্বলি লাইনে আসার পর সেই অরিজিনালের দাম এসে ঠেকেছে তলানিতে কারণ ওখানে যা তৈরি হচ্ছে, তার সবকটাই অরিজিনালের হুবহু পুন-উপস্থাপন।
এভাবে ভেবে দেখতে গেলে, সত্য-মিথ্যার বিবাদ অনেকটাই যেন ভঞ্জন হয়ে গেছে। জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল এক্স-ফাইলসের ট্যাগলাইন ছিলো - “দ্য ট্রুথ ইস আউট দেয়ার”। সাই-ফাই মিস্ট্রি থিলার হিসেবে এই ট্যাগলাইন ভালোই মানিয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবের দুনিয়ার ট্যাগলাইনটা হবে একটু ভিন্ন। এখানে ট্রুথ কোন সিঙ্গুলার উপস্থিতি নয় - বলা যেতে পারে - “দ্যা ট্রুথস আর এভরিহোয়ার”। চীনের ওই টিভি তৈরির কারখানায় ঢুকলেই বোঝা যাবে - সত্যিটা সাজানো আছে থরে থরে। কোনটা কোনটার চেয়ে কম সত্য নয়।
একবিংশ শতকের মনকে তাই ‘সত্য’টা বোঝানো কঠিন হয়ে গেছে। কারণ সে চারপাশে যা দেখে তা সত্যের হুবহু প্রতিরূপ। ‘প্রতি’ উপসর্গটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে গবেষণা চলতে পারে। সোজা ভাষায় বললে, সত্য দেখতে দেখতে একবিংশ শতাব্দীর চোখ পঁচে গেছে। নির্জলা বা তথাকথিত সত্য দিয়ে আর সন্তুষ্ট হচ্ছে না সে। তার যেন চাই আরো বেশি কিছু - “এ মন চায় যে মোর”।
একুশ শতকের চোখ টিভি সেটের সামনে বসলেই দেখে তার আঙ্গুলের ডগায় হাজারটা চ্যানেল, তার প্রায় সবগুলোতেই চলছে একই রকম সোপ অপেরা - একইরকম সব চরিত্র, একইরকম সব সেট, একইরকম সব সংলাপ, একই অভিনেতা-অভিনেত্রী। একটা ব্যক্তিগত অ্যাসেম্বলি লাইন যেখানে থরে থরে সাজানো আছে সত্য“গুলো”। পত্রিকার পাতা উল্টোলেই একুশ শতকের পাঠক দেখে একইরকম সব খবর - লন্ডন ব্রিজ ইস ফলিং ডাউন। লন্ডনের সেই সেতু আসলে কি? সে কি আমাদের বুড়িগঙ্গা বা দ্বিতীয় হুগলি ব্রিজ বা নীলনদের ওপরকার কোন ব্রিজের চেয়ে আলাদা কিছু? সবকিছু ভেঙ্গে পড়ছে - হোক তা লন্ডন বা ভিয়েনা, এথেন্স, ঢাকা, ত্রিপোলি বা মালে - এ তালিকার কোন শেষ নেই - একটা বহুজাতিক অ্যাসেম্বলি লাইন।
পিনহোল ক্যামেরার যুগে ছবি তোলা ছিলো রীতিমত যুদ্ধ। একটা ছবি ঠিকঠাক তুলতে পারলে যুদ্ধ জয়ের আনন্দ পেতেন ফটোগ্রাফাররা। মেকানিকাল ক্যামেরা এবং ফিল্ম রিলের যুগে যখন ছত্রিশের বাঁধনে বাঁধা ছিলো আলোকচিত্রীর সৃজনশীলতা, তখন প্রতিটি ছবিকেই হতে হতো একেটা ভিন্ন ভিন্ন সত্যি। কিন্তু আজকের এই ডিজিটাল ফটোগ্রাফির যুগে, ঘুঁচে গেছে সেই পরাধীনতা। স্বাধীন ফটোগ্রাফার এখন তাঁর ডিজিটাল সিংগেল লেন্স রোটেশন ডিএসএলআর ক্যামেরায়, একটা মাত্র বোতামের আলতো ছোঁয়ায়, সিকোয়েন্স ফটোগ্রাফিতে এক ক্লিকে এক-দুই সেকেন্ডে তুলে নেয় অনেক ছবি। সেখান থেকে বেছে নেয় সেরাটা। এও যেন একটা ব্যক্তিগত অ্যসেম্বলি লাইন। থরে থরে সাজানো আছে প্রায় হুবহু এক দেখতে অনেকগুলো ছবি। সাদামাটা অনভ্যস্ত চোখে সেসব ছবির ভেতর তফাত করাটা খড়ের গাঁদায় সূঁচ খোঁজার মতোই দূরহ। যন্ত্রকে ধন্যবাদ, ধন্যবাদ প্রযুক্তিকে। যন্ত্রের তো আসলে ওইটুকুই ক্ষমতা। সত্যটা তার কাছে সত্যই। যন্ত্রের কাছে সত্যের বিশেষ কোন মাজেজা নেই কারণ যন্ত্র তো মিথ্যে বোঝেনা তাই অক্লান্তভাবে সত্যকে জাতিস্মর হবার প্রেরণা যুগিয়ে যেতে থাকে সে। কিন্তু আশারাফুল মাকলুকাতের তো এতো অল্পতে চলে না। ভিলেন না থাকলে নায়কের জীবন তো পানসে। রাত না থাকলে কি দিন এত পাত্তা পেত? একুশ শতকের মননের কাছে তাই সত্যের এই মচ্ছব একঘেয়ে লাগে।
রিয়ালিসম - বাস্তববাদী আদর্শবাদ
১৯ শতক পর্যন্ত, পশ্চিমা চিত্রকলায় ছিলো উচ্চমার্গীয় বা গ্র্যান্ড স্টাইলের দাদাগিরি। এরপর, স্বভাববাদ বা ন্যাচরালিসমের হাত ধরে শিল্প-সাহিত্যে প্রবেশ ঘটে বাস্তববাদের। ১৮৪০-এর দশকে, ফরাসী ঔপন্যাসিক শমফ্লরি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন ‘বাস্তববাদ’ শব্দটি। সেসময়ের পর থেকে ধীরে ধীরে শিল্প সাহিত্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে জীবনধর্মী থিম। চালর্স ডিকেন্স এবং জর্জ এলিয়টের চরিত্রদের সবাই জীবন থেকে নেয়া সাধারণ সব মানুষ।
গুস্তাভ কর্বেট, এডওয়ার্ড মনে, জুল ব্রেতো, প্রমুখ শিল্পীদের ছবিতে উঠে আসতে শুরু করে ঘর-বাড়ি, গাছপালা, ক্ষেত-খামার, হোটেল রেস্তোরাঁ - এমনি সব সাধারণ বিষয়।
[img] http://www.artchive.com/artchive/c/courbet/bonjour.jpg[/img]
সেসময় থেকে অন্তত একশ বছর পর্যন্ত যারা বাস্তববাদের চর্চা করেছেন, তাঁরা স্টাইলের দিক থেকে একে অপরের থেকে আলাদা হলেও, একটা ক্ষেত্রে মোটামুটি একই জমিতে দাঁড়িয়ে কাজ করেছেন। নিজেদের শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে, শিল্প ও নান্দনিকতার বাইরে এক ধরণের নৈর্ব্যাত্ত্বিক বাস্তবতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন তাঁরা। একটা আদর্শ পৃথিবীর ছবি তাঁরা আঁকতে চেয়েছেন তুলির আঁচড়ে যা সাধারণ মানুষের ক্ষুদ্র চেতনা সত্ত্বার চেয়ে ঢের বেশি বড় এলাকাজুড়ে অবস্থান করে। যা মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, এঁকেছেন তার ছবিই। তবে ইঙ্গিত করেছেন এমন এক আদর্শ পৃথিবীর দিকে যা ব্যক্তি চেতনার উপর একদমই নির্ভরশীল নয়। ১৮৪৮ সালটার গুরুত্ব অপরিসীম কারণ সে বছর দুটো বড় ঘটনা ঘটে - বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সে প্রতিষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং কার্ল মার্ক্স ও অ্যাঙ্গেলস সাহেব যৌথভাবে প্রকাশ করেন তাদের কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো।
সুররিয়ালিসম - নতুন বোতলে বাস্তবতা
প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে হয়েছিলো সুররিয়ালিস্ট আন্দোলন। বাস্তববাদের পর, ফভিজম, এক্সপ্রেশনিসম, ফিউচারিসম, কিউবিসম এবং ডাডাইসমের সেতু পার হয়ে, বিশ্ব চিত্রকলা এসে থামে সুররিয়ালিসম-এর স্টেশনে। ফরাসী প্রতিকী উচ্চারণ থেকে এর উদ্ভব, অব্যবহিত আগে বীজ পড়েছিলো ডাডাবাদের। ১৯২৪ সালে তাত্ত্বিক দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন আঁদ্রে ব্রেতো। কিউবিসমের অতিরিক্ত বিধিনিষেধ থেকে চিত্রকলাকে মুক্তি দিয়েছিলো সুররিয়ালিসম। আধুনিক চিত্রকলায় যোগ করেছিলো নতুন বিষয়বস্তু - অযুক্তি ও অবচেতন।
[img] http://upload.wikimedia.org/wikipedia/en/2/2b/The_Elephant_Celebes.jpg[/img]
এদিকে, ১৯৮০ সালে এসে জার্মানির হাবারমাস সাহেব দাবি করে বসলেন যে পরাবাস্তবাদী শিল্প আন্দোলনের মৃত্যু ঘটেছে ১৯৭০ সালেই। তার দাবি, আধুনিকতার কাজ তখনো শেষ হয়নি। ডাডা বা পরাবাস্তব নামের ‘হাবিজাবি’ বিষয় মাঝখানে এসে ঝামেলা পাকালেও, ‘আধুনিকতার অসমাপ্ত প্রকল্প’ ঠিকই তাদের ঝেটিয়ে বিদেয় করবে। কিন্তু পৃথিবীতে কি ঘটছে সে সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল কমই - তিনি তখনো একমনে অধুনিকতার কলসীতে একের পর এক নুড়ি ফেলেই যাচ্ছেন।
জ্যঁ বদরিলার - ‘দ্য হাইপাররিয়ালিসম অফ সিমুলেশন’
’৭০-এর দশকে, ফরাসী চিন্তাবিদ জ্যঁ বদরিলার বলেছিলেন, অবাধ তথ্য প্রবাহ এবং মিডিয়া নিয়ন্ত্রিত ইন্দ্রিয়ের যুগে, ‘অরিজিনালিটি’র মৃত্যু হয়েছে। যেসব চিহ্ন দেখে আমরা এতকাল বাস্তবতাকে চিনে এসেছি, সেসব চিহ্নের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে বাস্তবতা। তাই বাস্তবতা এখন আর কতগুলো প্রতীক বা চিহ্নের সমষ্টি নয়। প্রতিটি চিহ্ন বা প্রতীক নিজেরাই হয়ে উঠেছে একেকটি স্বকীয় বাস্তবতা। তারা নিজেরাই নিজেদের বাস্তব বলে দাবি করা শুরু করেছে। অনুমেয়ভাবেই, বদরিলার তার উদাহরণগুলো টেনেছিলেন পরাবাস্তববাদ, নুভো রোমান, অ্যান্ডি ওয়ারহল, পপ সংস্কৃতি এবং ফটোগ্রাফির ভেতর থেকেই। তিনি বলেছিলেন, আমরা বাস করছি একটা বিমূর্ত পৃথিবীতে যেখানে বাস্তবতা বিদায় নিয়েছে আর তার জায়গা নিয়েছে কতগুলো ‘সিমুলাকরাম’। এই সিমুলাকরাম আর কিছুই না - সত্যের কপি-পেইস্ট। সত্যের সঙ্গে এদের কোন তফাৎই নেই।
ফোটোরিয়ালিসম থেকে হাইপাররিয়ালিসম
পরাবাস্তববাদীরা বাস্তবের সঙ্গে স্বপ্ন আর অবচেতন মিশিয়ে তবেই জন্ম দিতে পেরেছেন নতুন ধারার। পরাবাস্তবতায় বাস্তব আছে, তবে বাস্তবের প্রতি দৃশ্যমান এবং নান্দনিক দায়বদ্ধতা সামান্যই। অধিবাস্তববাদীদের কাজটা কিন্তু এতো সোজা নয়। বাস্তবের প্রতি তারা পুরোপুরি দায়বদ্ধ। অর্থাৎ, বাস্তবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনকিছু তাঁরা করতে পারেন না। এতে করে নতুন দ্যোতনা তৈরীর কাজটা কঠিন হয়ে পড়ে আরো। বাস্তবের প্রতি পূর্ণাঙ্গ দায়বদ্ধতা বজায় রেখে, বাস্তবকে আরো বেশি বাস্তব করে ফুটিয়ে তোলার কাজটা করে যান অধিবাস্তববাদী শিল্পীরা।
কোনকিছুর সত্যতা বোঝাতে ইংরেজিতে একটা কথা আছে - “অ্যাজ রিয়েল অ্যাজ ক্যামেরা ফোটো”। তবে সত্যিটা হলো, ক্যামেরা যা বলে আসলে তো তা মিথ্যা। মার্কিন ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক সুস্যান সন্ট্যাগ তার বিখ্যাত প্রবন্ধ অন ফোটোগ্রাফি-তে বলেছেন, ক্যামেরায় তোলা ছবির পক্ষে আসলে বাস্তবকে পুরোপুরি তুলে আনা সম্ভব না। বাস্তব একটি অতীব জটিল এবং গভীর অবস্থা যার একটিমাত্র মুহুর্তকে হুবহু পূণউপস্থাপন (অ্যারিস্টটলের ভাষায় রিপ্রেসেন্ট) করে দাবি করা সম্ভব নয় যে তাকে পুরোপুরি ফুটিয়ে তোলা গেছে। বাস্তব ক্রমপরিবর্তনশীল একটি অবস্থা যার রয়েছে নিজস্ব গতি ও রূপান্তরের ধারা। ফোটোগ্রাফির একটি স্থির ও বিবশ মুহুর্ত - তা সে যতই জীবন্ত হোক না কেন - কোনভাবেই বাস্তবের সেই গতিশীলতার কণামাত্রও ফুটিয়ে তুলতে পারে না।
পৃথিবীর সব অধিবাস্তববাদী শিল্পীকেই ফোটোরিয়ালিস্টের তকমা লাগানো যায়। কারণ হাইপাররিয়ে এবং ফোটোরিয়েল - এই দুধরণের শিল্পীরাই সৃষ্টির মূল মালমসলা নিয়ে থাকেন ফোটোগ্রাফ থেকে। তবে ফোটোরিয়ালিস্টদের সঙ্গে অধিবাস্তববাদীদের তফাৎটা তৈরি হয় দক্ষতার ক্ষেত্রে। বিশ্বজুড়ে অনেক শিল্পীই ফোটোরিয়ালিসমে উৎকর্ষ অর্জন করেছেন। কিন্তু যারা সত্যিকার অর্থেই প্রতিভাধর, তারা এগিয়ে গেছেন আরো কয়েক ধাপ। ফোটোরিয়ালিস্টরা মূলত ক্যামেরায় তোলা ছবির বাস্তবতা, হুবহু তুলি দিয়ে ফোটানোর চেষ্টা করেন ক্যানভাসে। সে কারণে, ক্যামেরায় তোলা ছবির যেসব সীমাবদ্ধতা যেমন বাস্তবের চেয়ে কম ডেপথ অফ ফিল্ড, ফোকাসিং-এর চিরন্তন সমস্যা এবং দৃষ্টিকোণের রকমফের, এই সমস্যাগুলোও তারা তাদের আঁকা ছবিতে এড়িয়ে যেতে পারেন না।
কখনো কখনো ফোটোরিয়েলিস্ট শিল্পী বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ডেপথ নিয়ে এমন সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা তারা চালান যে ভুল হলে ঘটতে পারে বিপর্যয়। কিন্তু যদি ঠিকঠাক লেগে যায়, তাহলে যা দাঁড়ায়, তার একটা নমুনা হলো ক্যানাডিয়ান শিল্পী জেসন ডি গ্রাফের অধিবাস্তব ছবি ওশান ভিউ। এক্ষেত্রে রেফারেন্স মেটেরিয়ালের প্রতি শিল্পীর সততা শতভাগ নয়। শিল্পী এখানে ছবির বিষয়বস্তুকে ব্যবহার করেছেন তার নিজের দক্ষতাকে আরো উঁচুতে উঠিয়ে নেয়ার একটা সিঁড়ি হিসেবে।
এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে, মার্কিন হাইপাররিয়ালিস্ট ডেনিস পিটারসন প্রথম ফোটোরিয়ালিসমের চর্চা শুরু করেছিলেন একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। তিনি মনে করেন, গণহত্যার মতো একটি ঘটনার সত্যিকার ভয়াবহতা ফোটোগ্রাফির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব না। তাই তিনি চেষ্টা করেছেন ফোটোরিয়ালিসমের যন্ত্রপাতিগুলো ব্যবহার করে, তুলির আঁচড়ে, গণহত্যার ভয়াবহতা ফুটিয়ে তুলতে। আমরা অনেক সময় বলি যে ছবিতে দেখে আসলে বোঝা যাচ্ছে না লোকটা কত লম্বা, বা মেয়েটা কত সুন্দর বা লাশগুলো কত ভয়ংকর। পিটারসন চেয়েছিলেন, ফোটোগ্রাফের এই যে আবেগীয় সীমাবদ্ধতা, একজন শিল্পী হিসেবে তা কাটিয়ে উঠতে। সেটা এখনো করে উঠতে না পারলেও, নিউ ইয়র্কের গৃহহীনদের নিয়ে আঁকা তাঁর একটি আলোচিত সিরিজ ব্যপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলো।
অধিবাস্তববাদের টেকনিক
হাইপাররিয়ালিসম একটি প্রযুক্তিবান্ধব এবং অনেকটাই প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পমাধ্যম। স্কেইল্ড অপ্টিক্স, টোনাল পার্সপেক্টিভ, একাধিক ডেপথ অফ ফিল্ড, ওভারল্যাপিং কালার মেট্রিক্স - এ সবই হাইপাররিয়ালিস্ট শিল্পীর অন্যতম অস্ত্র। একজন ফোটোগ্রাফারের কাছে এসব খুবই পরিচিত এবং সাধারণ বিষয়। তবে যেসব বিচিত্র উপায়ে হাইপাররিয়ালিস্ট শিল্পীরা এসব ব্যবহার করেন, তা দেখে একজন ফোটোগ্রাফারের অদ্ভুত লাগাটা খুবই স্বাভাবিক। অধিবাস্তববাদী শিল্পী চান, তথাকথিত বাস্তবের বাইরে, নতুন এক বাস্তবতা সৃষ্টি করতে, বিকল্প সত্যের জন্ম দিতে। তিনি চান, তাঁর আঁকা ছবির বাস্তবতা যেন মানুষের চেতনাকে চ্যালেঞ্জ জানায়। একজন অধিবাস্তববাদী শিল্পীর প্রাথমিক অস্ত্র হলো ক্যামেরা, অর্থাৎ তাঁর মূল রেফারেন্স মেটেরিয়াল আসলে একটি ফোটোগ্রাফ। কোন কোন অতিরিক্ত খুঁতখুঁতে এবং পার্ফেকশনিস্ট অধিবাস্তববাদী আঁকিয়ে সত্তর-আশি হাজার ডলার দামের সর্বশেষ প্রযুক্তির ক্যামেরা ব্যবহার করে তাঁর রেফারেন্স ম্যাটেরিয়ালটি সংগ্রহ করে থাকেন। এ ধরণের ব্যয়বহুল এবং পেশাদারী ক্যামেরায় তোলা ছবিতে একেবারে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রতম এবং পুঙ্খাণূপুঙ্খতম বিষয়টিও তোলা যায় নিখুঁতভাবে এবং ডিটেইলের উপস্থিতি থাকে সবচেয়ে বেশি। সুতরাং বলা যেতে পারে, ভালো একটি অধিবাস্তব ছবি আঁকতে হলে, ভালো ফোটোগ্রাফার হতে হবে। তবে শিল্পে অধিবাস্তববাদী ধারার পথিকৃত ডেনিস পিটারসন নিজে মাত্র দুইশ ডলার দামের একটা সস্তা পয়েন্ট-অ্যান্ডÑশুট ক্যামেরা ব্যবহার করেন। তিনি মনে করেন, যত ডিটেইলেই তোলা হোক, অধিবাস্তববাদী শিল্পী তো আসল ক্যারিশমা দেখাবে ক্যানভাসে।
গত শতাব্দীর ৬০ এবং ৭০-এর দশকে, প্রথম দিককার ফোটোরিয়ালিস্ট শিল্পীরা সরাসরি ফোটোগ্রাফ দেখে ক্যানভাসে হুবহু প্রতিরূপ আঁকার চেষ্টা করতেন। মসৃণ কোন পৃষ্ঠে আলোর যে প্রতিফলন হয়, তেলরং ব্যবহার করে তা ফুটিয়ে তোলাটা ছিলো দুঃসাধ্য। এরপর আস্তে আস্তে অ্যাক্রিলিকের ব্যবহার বাড়তে থাকে এবং এসব সমস্যাও অনেকটাই কাটিয়ে ওঠেন অধিবাস্তববাদীরা।
এরপর প্রযুক্তি যতই এগোতে থাকলো, ফোটোরিয়ালিস্টরা এগোতে থাকলো হাইপাররিয়ালিসমের দিকে। শিল্পীর প্রথম কাজ হলো, ফোটোগ্রাফটিকে ক্যানভাসে স্থানান্তর করা। প্রথম দিককার ফোটোরিয়ালিস্টরা এই কাজটি করতেন লাইন ড্রয়িং-এর মাধ্যমে। তারপর শুরু হয় মাল্টিমিডিয়া প্রোজেক্টার ব্যবহার করে ছবিটা ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার কাজ। কখনো কখনো গ্রিড ব্যবহার করে সেই ছবিগুলোকে স্কেলের হিসেবে আকারে বড় করে নেন শিল্পী। একবিংশ শতাব্দীতে এসে, অনেক শিল্পী শিখে নিলেন কম্পিউটারে ফোটোশপের কাজ। ছবিটিকে ক্যানভাসে প্রোজেক্ট করে তুলি চালানোর আগেই, কম্পিউটারে ফোটোশপ ব্যবহার করে নিজের প্রয়োজনমত ‘পরিমার্জন ও পরিবর্ধন’-এর কাজ করে নেন তিনি।
ভাস্কর্যে অধিবাস্তবতা
লাইফ-সাইজ ভাস্কর্য নতুন কিছু নয়। একদম মানুষের শরীরের আকার-আকৃতি-রং ইত্যাদি হুবহু বাস্তবের মত করে ফুটিয়ে তুলতে পারেন, ইতিহাস এমন অনেক ভাস্কর দেখেছে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে যে অধিবাস্তব তাহলে কোন দিক থেকে আলাদা?
অধিবাস্তববাদী ভাস্কর্য শিল্পীদের অনেকেই মনে করেন, মানুষের শরীরটা আসলে নরম খোলসের ভেতর শক্ত শ্বাসের মতোই একটা ব্যপার - তবে আরো অনেক জটিল এবং বিভ্রান্তিকর। সাধারণ অনভ্যস্ত চোখে তাকালে হয়তো বোঝা যাবে না কিন্তু মানুষের শরীরের দিকে ভালো করে যদি শিল্পীর চোখ নিয়ে তাকানো যায় তাহলে ভেতরে যেসব জটিল জৈবিক-রাসায়নিক-আবেগীয় কা-কারখানা চলছে তার একটা আভাস পাওয়া যেতে পারে। মানব শরীরের ভেতরকার সেই জটিলতার আভাস বড় পরিসরে ফুটিয়ে তুলতে চান অধিবাস্তববাদী ভাস্কররা। মানুষের শরীরের এই যে গতিশীলতা এবং অতিনাটকীয়তা, সেটাকে ফুটিয়ে তুলতে পারার মধ্যেই সার্থ্যকতা খোঁজেন তারা। ভালো করে খেয়াল করলে লক্ষ্য করবেন যে ইভান পেনির ভাস্কর্যে, একেকটি চুল এবং দাঁড়ি প্রচুর সময় এবং যতœ নিয়ে বসানো হয়েছে।
অনেক সময় সরাসরি মানব শরীরে পলিয়েস্টার বসিয়ে শেইপ বা মোল্ড বানিয়ে থাকেন অধিবাস্তববাদী ভাস্কররা। অস্ট্রেলীয় ভাস্কর স্যাম জিংক্স সিলিকন এবং পলিয়েস্টারের সঙ্গে ফাইবার গ্লাস মিশিয়ে ম- তৈরি করেন। তাঁর ধারণা, সিলিকনের কারণে ভাস্কর্যে অনেকটা প্রাকৃতিক চামড়ার রং আনা সম্ভব হয়। মানুষের চামড়ার রং-এর যত কাছাকাছি যাওয়া যায়, ভাস্কর্যকে তত বেশি বাস্তব মনে হয়। যিনি দেখছেন, তার মনের মধ্যে আবেগের একটা তাৎক্ষণিক ঢেউ তৈরী করা যায়, ছুঁয়ে দেয়া যায় তার অবচেতনকে। সেই তাৎক্ষণিক ঢেউয়ের কারণেই ভাস্কর্যটির কাছে এগিয়ে এসে একদম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার প্রয়াস পান দর্শক। আর এটাই তো চান অধিবাস্তববাদী ভাস্কর। চোখ যত তার ভাস্কর্যের কাছে এগিয়ে আসবে, ততই ডিটেইলগুলো আরো ভালোভাবে তার কাছে ফুটে উঠবে, সার্থক হবে তার সমস্ত শ্রম। আর এভাবেই তৈরী হয় অধিবাস্তব আবহ। ব্রোঞ্জের মত ভাস্কর্য বানানোর চিরাচরিত উপাদান ব্যবহার করলে সেটা খুব একটা করা যায় না বলেই মনে করেন অধিবাস্তববাদী শিল্পীরা।
সবিশেষ পরিশেষ
জৈবিক প্রয়োজনে মানুষ যা বানায়, তার প্রাথমিক রূপ খুব সরল। প্রকৃতির বৈরিতা থেকে বাঁচতে মানুষ বানিয়েছিলো ঘর - এর রূপ সব জায়গাতেই সরল। আপাত সরল রূপের এই সৃষ্টিগুলি যখন মানুষের সৌন্দর্যবোধ বা রুচিবোধকে তৃপ্ত করতে যায়, এর রূপ হয় ভিন্ন। এই পরিশীলিত রূপ সৃষ্টি শিল্পের কাজ। একবার শুরু হলে এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে - কারণ মানুষের রুচি বা সৌন্দর্যবোধ কোন নির্ধারিত বস্তু নয়। পৃথিবীতে যত মানুষ তত তার ভিন্ন প্রকাশ। শিল্পের এই বহুবিস্তৃত পেক্ষাপট থাকায় এর এক বিশালতা আছে, ব্যপ্তি-গভীরতা আছে। কোন বিশেষ আলোচনায় শিল্পের স্বরূপ উদঘাটন অসম্ভব ব্যপার, কোন দার্শনিক, শিল্পী বা চিন্তাবিদ শিল্প সম্বন্ধে শেষ কথা কোনদিনই বলতে পারবেন না। এজন্য নন্দনতত্ত্ব প্রাচীন শাস্ত্র হয়েও চিরকালই প্রাসঙ্গিক। মানুষের হৃদয়ের প্রকাশের সঙ্গে এর যোগ, মানুষের সৃষ্টির সঙ্গে এর সম্পর্ক এবং মানুষের কর্মকা-েই এর বৈধতা।
মন্তব্য
ছবি গুলোর (এবং তাদের শিল্পীদের) সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো। ছবির নিচে মিডিয়া উল্লেখ না করলে তো বোঝাই যেত না, এগুলো আলোকচিত্র না।
আপনি প্রতিটা ছবির নিচে রেফারেন্স দিয়েছেন, এটা খুবই ভালো একটা চর্চা। কয়েকটা ছবির, লিংক এসেছে কিন্ত লেখায় ছবিটা দৃশ্যমান না, মডারেরটরকে অনুরোধ করতে পারেন এটা ঠিক করে দেবার জন্য। পরের লেখায় প্রিভিউ দেখে নেবেন।
লেখার নিচে নিজের নাম/নিক ছোট করে দিয়ে দিন। এবেলা, মন্তব্যে উল্লেখ করুন।
শুভেচ্ছা
প্রবন্ধ ভালো লেখেন আপনি। নিয়মিত থাকবেন আশা করি।
_____________________
Give Her Freedom!
novice-ও নয়, অজ্ঞ লোকের উপলব্ধিঃ
আমি যা কিছু দেখলাম/শুনলাম/ভাবলাম তা নিজে যা কিছু বুঝলাম সেটা আমি আমার সাধ্য ও রুচি মতো যেভাবে মূর্ত করলাম ও উপস্থাপন করলাম সেটাকে আমি শিল্প বলে দাবি করতে পারি। আমার দাবি তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে যখন দর্শক/শ্রোতা সেটার উপস্থাপনকে শৈল্পিক বলে মানবেন। এখানে আমি আসলে কী করলাম? আমি কি আমার নিজস্ব ভাবনাকে দর্শক/শ্রোতার ওপর চাপিয়ে দিলাম না? আমার সাপেক্ষে যা বাস্তব/সঠিক একজন দর্শক/শ্রোতার সাপেক্ষে তা বাস্তব/সঠিক নাও হতে পারে। দুই জন ভিন্ন ভিন্ন দর্শক/শ্রোতার সাপেক্ষে সেটা ভিন্ন ভিন্ন রকম হতে পারে। তাছাড়া আমি আসলে আমার ভাবনাকে কতটুকু বিমূর্ত করতে পারলাম? আমার ভাবনা ও প্রকাশের মধ্যকার খামতি আমার সৃষ্ট শিল্পকে কি আমার সাপেক্ষে বাস্তব/সঠিকের মাত্রায় পৌঁছাতে পারলো?
শিল্পের গায়ে 'ইজম'-এর তকমা সাঁটানোর পেছনে গোষ্ঠী ভাবনা আর বৈশ্যচিন্তা কাজ করে। এইসব দলবাজ আর বণিকেরা সাধারণ দর্শক/শ্রোতাকে তাদের নির্দেশিত পথে ভেড়ার পালের মতো খেদিয়ে নিয়ে গিয়ে প্রশংসা/স্তুতি/সুবিধা/অর্থ কামায়। এতে শিল্পের উপকার হোক বা না হোক দর্শক/শ্রোতার স্বাধীন শিল্পভাবনা দম আটকে মারা যায়। হামবাগরা হয়তো বলবে - এইসব অশিক্ষিত দর্শক/শ্রোতার আমি থোড়াই পরোয়া করি, আমি তাই করি যা করতে আমার ভালো লাগে। আমি বলি - আজ্ঞে, তা যা বলেছেন। তাহলে আপনার উৎপাদিত সাপব্যাঙকচুঘেঁচু আপনার ঘরের ভেতরেই রাখেন। খামোখা জাহির করে পাবলিককে বিরক্ত করেন কেন! ইজমের সবচে' খারাপ ব্যাপারটা হচ্ছে এটা একজন শিল্পীর চিন্তার নিজস্বতাকে খেয়ে ফেলে।
শিল্পাচার্য নাকি তাঁর শিক্ষার্থীদের বলতেন - রিয়াল ছবি আঁকো মিয়ারা! যেইটা যেমন ঠিকঠাক অইরকম। তাইলে পরে নিজেরাই ফর্ম ভাঙতে পারবা।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
সদ্য তরুণ বয়সে এসবের কিছু কিছু চেখে দেখবার সুযোগ করে দিয়েছিল আব্দুল মান্নান সৈয়দের 'পরাবাস্তব কবিতা' ও 'মাছ সিরিজ' নামের গ্রন্থ দুটি। সে সময় আদ্রে ব্রেতোর পরাবাস্তব ইশতেহার পড়ে কিছুই বুঝি নি। বুড়োকালে যখন বীতাধুনিকতা নিয়ে আরো কিছু গ্রন্থ নেড়েচেড়ে বুঝলাম, আমার ভাঙা ঘরে চাঁদের আলোই ঢের আপন, তখন লিখলাম, 'পরম্পরার খোঁজে'
আপনার আলোচনা ভালো লাগলো।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
সহমত
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
লেখা চলুক।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নতুন মন্তব্য করুন