“শনিবারেও আমি ছিলাম দক্ষিণ আফ্রিকার একজন অখ্যাত সার্জন। আর পরদিন আমি হয়ে গেলাম বিশ্ববিখ্যাত একজন মানুষ।”
কথাটি বলেছিলেন ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড। কথাটি বলেছিলেন ১৯৬৭ সালের ৩ ডিসেম্বর তাঁর একটি অবিশ্বাস্য কীর্তি সম্পর্কে বলতে যেয়ে। কি ছিল সেই কীর্তি যা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল? সে সম্পর্কে জানতে আমাদের ঘুরে আসতে হবে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন হতে। সেখানকার Groote Schuur Hospital হয়ে উঠেছিল বিশ্বমানবের আগ্রহের বিষয়। কারণ ১৯৬৭ সালের ৩ ডিসেম্বর সেখানে হয়েছিল বিশ্বের প্রথম মানবদেহে হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন। এবং সেই অবিশ্বাস্য কাজটি করেছিলেন ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড।
ক্রিশ্চিয়ান নেথলিং বার্নার্ড ১৯২২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার শুষ্কভূমি ওয়েস্টার্ন কেপ প্রদেশের শহর বেউফোর্ট ওয়েস্টে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আফ্রিকানার বাবা ছিলেন একজন ধর্ম প্রচারক। তাঁরর মা ছিলেন গির্জার অরগান বাদক। বার্নার্ড ছিলেন চার ভাই। তাঁর এক ভাই আব্রাহাম পাঁচ বছর বয়সে জন্মগত হৃদযন্ত্রের সমস্যায় মারা যান। ধারণা করা হয় এই থেকেই বার্নার্ড পরবর্তীতে বিশ্ব কাঁপিয়ে দেওয়া সেই সার্জারিতে উৎসাহিত হন।
১৯৪০ সালে তিনি বেউফোর্ট ওয়েস্ট হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন এবং ১৯৪৬ সালে কেপ টাউন ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যাচেলর অফ মেডিসিন এবং ব্যাচেলর অফ সার্জারি ডিগ্রী লাভ করেন। তাঁরর পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। তাই তাঁকে বাসা থেকে পাঁচ মাইল দূরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পায়ে হেঁটে যেতে হত। তিনি তাঁর শিক্ষানবিশকাল কাটান Groote Schuur Hospital এ।
১৯৪৮ সালে তিনি এলিটা লউওকে বিয়ে করেন। তাদের দুইটি সন্তান ছিল আন্দ্রে এবং ডেইরড্রে। ১৯৫১ সাল পর্যন্ত পিকচারস্কো শহরে তিনি একজন ফ্যাম্লি ফিজিসিয়ানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫১ সালে তিনি কেপ টাউনে ফিরে আসেন এবং সিনিয়র আবাসিক মেডিকেল অফিসার এবং পরবর্তীতে রেজিস্টার হিসেবে Groote Schuur Hospital এর মেডিসিন ডিপার্টমেন্টে চাকরি করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি মাস্টার অফ মেডিসিন নামক ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে তাঁরর "The treatment of tuberulous Meningitis" বা ‘যক্ষ্মা জীবাণু দ্বারা মেনিঞ্জেসের প্রদাহের চিকিৎসা’ শীর্ষক গবেষণাপত্র যথেষ্ট প্রশংসিত হয়।
এরপর তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয় একই হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে রেজিস্টার হিসেবে প্রফেসর জে এরাস্মাসের অধীনে।
১৯৫৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দুই বছরের লেখাপড়ার জন্য তিনি চার্লিস অ্যাডামস মেমোরিয়াল স্কলারশিপ লাভ করেন। সেখানে তিনি কার্ডিওথোরাসিক সার্জারিতে প্রশিক্ষণগ্রহণ করেন। সেখানে তাঁরর থিসিসের বিষয় ছিল "The aortic valve - problems in the fabrication and testing of a prosthetic valve। ১৯৫৮ সালে তিনি মাস্টার অফ সার্জারি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য বিভাগ অনুদান দেয় যাতে তিনি কার্ডিয়াক সার্জারিতে গবেষণা অব্যাহত রাখতে পারেন।
তিনি Groote Schuur Hospital এই কার্ডিওথোরাসিক সার্জারিতে তাঁরর কর্ম অব্যাহত রাখেন। ইউনিভার্সিটি অফ কেপ টাউনে পূর্ণকালীন প্রফেসর হিসেবেও কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৬১ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ কেপ টাউনের অধীনে যত মেডিকেল কলেজ রয়েছে সেগুলোর কার্ডিওথোরাসিক সার্জারির বিভাগীয় প্রধান নির্বাচিত হন। পরের বছর তিনি সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান Groote Schuur Hospital এ।
১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত যখন তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করছিলেন এক্সপেরিমেন্টাল সার্জারির কিংবদন্তী প্রফেসর ওয়াগেনস্টেইনের সাহচর্য লাভ করেন। হার্ট লাং মেশিন (ওপেন হার্ট সার্জারিতে হার্টকে পুরোপুরি থামিয়ে দেওয়া হয় এবং অস্ত্রোপচারকালীন হার্ট-লাং মেশিন হার্ট ও ফুসফুসের কাজ চালিয়ে নেয়।) দেখে তাঁর মাথায় চিন্তা জাগে হার্ট বা হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা কি সম্ভব। ১৯৫৩ সালে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে দেশে ফিরেই তিনি কার্ডিয়াক বাইপাস সার্জারি শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি ইমিউ নোলজির উপর কাজ করেন। অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পর যাতে দেহের প্রতিরোধ শক্তি প্রতিস্থাপিত অঙ্গকে রিজেক্ট বা বর্জন না করতে পারে সে জন্য এমন সব ঔষধ ব্যবহার করতে হয় যা দেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাঁরকে কমিয়ে দেয়। এদের ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট ড্রাগ বলা হয়।
এই মেধাবী সার্জন ইবস্টেইন এনোমালি নামে হৃদযন্ত্রের আরও একটি সমস্যা সমাধানের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এই সমস্যায় নতজাতকের ট্রাইক্যাসপিদ ভাল্ভ ডান অলিন্দ এবং নিলয়ের মাঝে না থেকে ডান অলিন্দে থাকে। এর ফলে ডান অলিন্দ বড় হতে থাকে এবং রোগীর মৃত্যু ঘটায়। এর সমাধান এই ভাল্ভ সরিয়ে সেখানে কৃত্রিম ভাল্ভ লাগাতে হয়। ১৯৬২ সালে বার্নার্ড UCT prosthesis নামের নতুন ভাল্ভ উদ্ভাবন করেন যা আজও ব্যবহৃত হচ্ছে সাফল্যের সাথে।
ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচার করেন। তখন তাঁর মাথায় চিন্তাভাবনা কাজ করছিল বিশ্বের ইতিহাসের প্রথম হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা নিয়ে যা তখন পর্যন্ত ছিল এক কল্পবিজ্ঞানের নাম। ১৯৬৩ সাল থেকেই কুকুরের উপর তিনি এই নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন।
অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৬৭ সালের ৩ ডিসেম্বর।
স্থানঃ কেপ টাউনের Groote Schuur Hospital।
১৯৬৭ সালে ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ডের একজন রোগী ছিলেন ৫৫ বছর বয়স্ক লুইস ওয়াসকানস্কাই। তাঁর ছিল ডায়াবেটিস। এর থেকেও বড় কথা তাঁর ছিল অনিরাময়যোগ্য হৃদযন্ত্রের সমস্যা। ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড তাঁকে বললেন হৃদযন্ত্রের প্রতিস্থাপন করা হলে তাঁর বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা ৮০%। লুইস ওয়াসকানস্কাই রাজি হলেন। ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড পরে লিখেছিলেন, "For a dying man it is not a difficult decision because he knows he is at the end. If a lion chases you to the bank of a river filled with crocodiles, you will leap into the water convinced you have a chance to swim to the other side. But you would never accept such odds if there were no lion."
১৯৬৭ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় দিন ডেনিশ ডারভাল নামে এক তরুণী সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হলেন এবং হাসপাতালে আনার পর মারা গেলেন। লুইস ওয়াসকানস্কাই আর ডেনিশ ডারভালের রক্তের গ্রুপ ছিল এক। ৩ ডিসেম্বর বার্নার্ড ৫ ঘণ্টা অপারেশনের পর লুইস ওয়াসকানস্কাইের রোগাক্রান্ত হৃদয় ডারভালের সুস্থ হৃদয় দিয়ে প্রতিস্থাপন করলেন। বার্নার্ড বুঝলেন তাঁর অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে যখন তিনি রোগীর হৃদপিণ্ডে ইলেকট্রোড বসালেন এবং হৃদপিণ্ড কাজ করতে শুরু করল।
লুইস ওয়াসকানস্কাইকে ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট ড্রাগ দেওয়া হয়। এতে তাঁরr রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং ১৮ দিন পর নিউমোনিয়াতে তাঁরr মৃত্যু হয়। তবুও এটি ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক বিস্ময় এবং নতুন মাইলফলক। ১৯৬৮ সালের ভিতরই বিশ্বের ২৪ টি দেশে ১০৭ টি হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচার হয়। কিন্তু মিডিয়ার অতিরিক্ত চাপের মুখে অনেক সার্জন ব্যর্থ হন। বিষয়টা অনেকটা সার্কাসের পর্যায়ে চলে যায় যখন লন্ডনে দক্ষিণ আফ্রিকান এক সার্জন ডোলান্ড রস ক্যামেরার সামনে অস্ত্রোপচার করেন একটি ইউনিয়ন জ্যাক পতাকা এবং একটি পোস্টার নিয়ে যাতে লেখা ছিল, ‘আমরা ব্রিটেনকে সাহায্য করছি।’ অস্ত্রোপচার ব্যর্থ হয়। আসলে মিডিয়া বিষয়টা এমন করে তুলেছিল যাতে জনগণ ভাবতে শুরু করে হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন করলেই রোগী বেঁচে যাবে। আস্তে আস্তে এই ভুল ধারণা কেটে যায়।
১৯৬৯ সালে তাঁরr প্রথম স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স হয় এবং ১৯৭০ সালে তিনি বারবারা জোয়েলনারকে বিয়ে করেন। এই পক্ষে তাঁর দুইটি ছেলে রয়েছে। এরপর বার্নার্ডের সেলিব্রেটি জীবন শুরু হয়। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে এমন কি পোপ পর্যন্ত তাঁরr সাথে দেখা করলেন। অনেকে তাঁরকে ঈর্ষা করতেন। কিন্তু অনেকেই যেটা জানে না সেটা হচ্ছে তিনি বিশ্বের অনেক দেশের মানুষকে বিনামূল্যে সেবা দিয়েছেন। ১৯৭২ সালে ইউনিভার্সিটি অফ কেপ টাউনে সার্জারির পূর্ণকালীন প্রফেসর হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৮২ সালে তাঁর আবার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৮৩ সালে তিনি কার্ডিওথোরাসিক সার্জারির বিভাগীয় প্রধান পদ থেকে অবসরগ্রহণ করেন। এরপর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা সিটিতে ওকলাহোমা ট্রান্সপ্ল্যান্টেসন ইন্সটিটিউটে সায়েনটিস্ট ইন রেসিডেন্স হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি প্রফেসর এমিরেটস সম্মান লাভ করেন।
১৯৮৮ সালে তৃতীয়বারের মত বিয়ে করেন তিনি। এবার কনে কারিন সেটযকর্ণ। সুন্দরী মডেল সেটযকর্ণ ছিলেন তাঁর নাতনীর বয়সী। এই পক্ষেও তাঁর দুটি সন্তান রয়েছে। ২০০০ সালে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এর কারণ অনেকে ধারণা করেন শেষ দিকে বার্নার্ডের নিজের ভিতর গুঁটিয়ে যাওয়াকে।
এই মহামানব ২০০১ সালের ২ সেপ্টেম্বর সাইপ্রাসের পাপোশে অবকাশযাপনকালে অ্যাসমার আক্রমণে পরলোকগমন করেন।
২০০১ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে ১ লাখ হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। এর এক বছরের সারভাইভাল রেট ৮৫% এবং পাঁচ বছরের সারভাইভাল রেট ৭৫%। ১৯৬৭ সালের ৩ ডিসেম্বর সে অস্ত্রোপচার থিয়েটারে এই বিস্ময়কর অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়েছিল তা আজ জাদুঘরে রুপান্তরিত করা হয়েছে।
তথ্যসূত্রঃ
১। http://www.pbs.org/wgbh/aso/databank/entries/bmbarn.html
২। http://www.westerncape.gov.za/general-publication/chris-barnard-performs-worlds-first-heart-transplant
৩। http://en.wikipedia.org/wiki/Christiaan_Barnard
৪। http://www.allsands.com/entertainment/people/christiaanbarna_aoi_gn.htm
৫। http://www.nytimes.com/2001/09/03/world/christiaan-barnard-78-surgeon-for-first-heart-transplant-dies.html
৬। http://en.wikipedia.org/wiki/Heart_transplantation
৭। http://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/15983715
৮। http://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC1121917/
৯। http://www.health24.com/Medical/Heart/Heart-transplants/Chris-Barnard-profile-of-a-pioneer-20120721
একাকী মানব
মন্তব্য
অসাধারণ লিখেছ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে কোন চর্চাই দেখা যায় না, উলটো ক্লাসে শিক্ষার্থীদের এই চর্চায় নিরুৎসাহিত করা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞান এর মুখস্থসর্বস্ব বিদ্যায় রূপান্তরের জন্য আমাদের এই মানসিকতাই দায়ী।
অলয়দা অনেক অনেক ধন্যবাদ। একবার এক 'বিখ্যাত' সার্জনের কাছে গিয়েছিলাম সার্জারি ওয়ার্ডে পেসেন্ট ভর্তি থেকে শুরু করে ডিসচার্জ পর্যন্ত কত সময় লাগে এই নিয়ে গবেষণা করব বলে অনুমতি চাইতে। উনি বলে এই সব করে কি হবে। এতে পড়াশুনার ক্ষতি হবে। আমি বললাম বিদেশেও অনেকে গবেষণা করে ছাত্রাবস্থায়। উনি বলেন ওরা তো মদও খায়। তুই খাবি? চিন্তা করেন এখানকার অবস্থা। সেই সার্জনকে আপনি চিনেন।
একাকী মানব
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
খুব ভালো লিখেছেন।
ভালো লাগল, সেই হাসপাতালটি দেখেছি বাহির থেকে।
facebook
দাদা, আপনার না দেখা কি কিছু আছে?
____________________________
২০০১ সাল পর্যন্ত ১ লাখ হৃৎপিন্ড প্রতিস্থাপিত হয়েছে এবং তারপর আরো এক যুগ চলে গেছে। বাংলাদেশের খবর কি? ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ডকে শ্রদ্ধা।
গোঁসাইবাবু
নতুন মন্তব্য করুন