প্রথমত যা ভাবনায় এসেছে তা হল আমার শরীর সম্পর্কে কতটুকু জানি, কতটা গর্বিত, কতটুকু প্রকাশ করতে পারি। ছোটবেলা থেকে পরিবার শিখিয়েছে নিজেকে ঢেকে রাখো, অন্যরা তোমার শরীর দেখলে বিশাল লজ্জা, জাহান্নামের আগুন থেকে রেহাই পাবে না। বুঝলাম, শরীর খুবই লজ্জার জিনিস, একে লুকিয়ে রাখতে হবে। আরবী শিখতাম যে হুজুরের কাছে, একদিন মসজিদে টান দিয়ে ফ্রকের চেইন খুলে বাকি বাচ্চাদের দেখিয়ে বলল এরকম পিঠ দেখিয়ে কোন জামা পড়বে না, অনেক গুনাহ হবে, অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম বার কি এগারো বছর বয়সে। জেনা নামে ভয়ঙ্কর এক শব্দ হুজুরের কাছ থেকে শিখলাম, যেটা আশি ভাগ নারীর জন্য প্রযোজ্য। বুঝলাম শরীর মানে অনেক লজ্জা, মেয়ে হলে আরো বেশী।
এরপর বয়ঃসন্ধি, একের পর এক লজ্জার আবরন দিয়ে নিজেকে ঢাকছি, কখনো আয়নায় সম্পূর্ণ নিজেকে দেখাই হয় নি। নিজের শরীর নিজের কাছেই অচেনা। যৌনতা সম্পর্কে কোন শিক্ষা পাই নি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। যেটা পেয়েছি অন্ধকারে নিঃশব্দে এগিয়ে আসা হাত, ভীড়ে ছুঁয়ে যাওয়া কিছু আঙ্গুল। নিজের উপরে ঘেন্না হত, এতো লজ্জা তার উপর ঘেন্না স্বাস্থ্যকর ছিল না মোটেও। লুকিয়ে বন্ধুর বাসায় পর্ণ দেখি কলেজে পড়ার সময়, ভালো লাগে নি পয়সা অর্জনের জন্য কিছু বিকারগ্রস্ত মানুষের পাশবিক ভালোবাসার দৃশ্য দেখে।
যৌনতা, শরীর, প্রেম, আকর্ষণ, ভালবাসা নিষিদ্ধ নগরের মধ্যে পড়ে রইলো। আমি প্লেটোনিক প্রেমিকা নই, তাই শরীর ছাড়িয়ে ভালবাসার তর্ক দয়া করে আমার সাথে করবেন না।
এখানে এসে স্বাধীনতা পেয়েছি নিজের ভাবনা গুলোকে নিজের সামনে দাঁড় করার। অনেক ভাবনাই হয়তো মাথায় ঘোরাফেরা করে, সেগুলো লিখে যখন নিজেকে পড়ে শোনাই, বেশ অদ্ভুত লাগে। মাঝে মাঝে নিজেকে অনেক সাহসী আরও বেশী সৎ মনে হয়। পড়ে শোনানো নিয়ে আমার দর্শন হলো মাথায় ঘুরতে থাকা ওই ভাবনাগুলোকে মনোযোগ দেওয়া, ভাবনা যখন লিখে ফেলি, এবং শব্দ করে নিজেকে পড়ে শোনাই, তখন সব ইন্দ্রিয় তা শোনে, দেখে, অনুভব করে, ঘ্রাণ নেয়। সমস্ত শরীর পরিচিত হয় আমার ভাবনার সাথে।
চাকুরীর সুবাদে মনোবিজ্ঞানীর কাছে যেতে হয় মাসে দুবেলা, যাওয়ায় পর আবিষ্কার করতে লাগলাম কি ভয়ঙ্কর অসুখী আমি আমাকে নিয়ে। প্রথমদিন চিকিৎসক জিজ্ঞাসা করেছিলো চোখ বন্ধ করে নিজেকে দেখতে পাই কি না। চোখ বন্ধ করে নিজেকে দেখতে পাই নি, মস্তিষ্ক জানতো কি রঙের পোশাক পরেছি, কিন্তু সে পোশাক যার গায়ে তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার চিকিৎসক পরামর্শ দিল নগ্ন হয়ে নিজেকে আয়নায় দেখতে, নিজেকে স্পর্শ করে অনুভূতি জানতে। প্রথম দিন যখন নিজেকে দেখছিলাম, সে কি লজ্জা। মেনেই নিতে পারছিলাম না নিজেকে। কি অদ্ভুত!!! নিজের শরীর সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই আমার।
হয়তো আমি বাকি সবার মত হতে পারতাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে প্রেমিকের সাথে জীবন শুরু করতাম, কিংবা বাবা মা’র পছন্দের পাত্রের সাথে। অন্ধকারে “ভালোবাসা” হতো, বছর গড়িয়ে জন্ম নিতো নতুন জীবন। অথবা যৌনতা ছাড়াই কোলে শিশু আকাশ থেকে নেমে আসবে তার অপেক্ষায় থাকতাম। কিন্তু নিজের শরীর লজ্জা সব কিছুই অজানা থেকে যেতো । কেউ অনুমুতি না নিয়ে ছুঁয়ে দিলে নিজেকে দোষারোপ করতাম, বার বার সোডিয়াম হাইড্রো অক্সাইড দিয়ে লজ্জা পরিষ্কার করতাম। নিজেকে জানতাম শুধু পোশাক দিয়ে, অনুভূতি হতো শুধু অন্য কেউ স্পর্শ করলে।
আমাদের সংস্কৃতি খুব অদ্ভুত , নিজেকে ভালবাসার সুযোগ না দিয়ে দিনের পর দিন নিজেকে ঘেন্না করতে শেখায়। ভালোবাসাকে গ্রহণযোগ্য আর যৌনতাকে নিষিদ্ধ ভাবতে শেখায়। আমি পরজন্মের জন্য বিলাসিতা রেখে দিলাম, এ জন্মে নিজেকে জানতে চাই, ভালবাসতে চাই।
ফিনিক্স
লস আলামস
মন্তব্য
আমার মার্কিন মুল্লুকে আসার পেছনে তোর একটা বেশ ভালই ভূমিকা ছিল। সেটার জন্য বাল্যবন্ধুকে গণসমাবেশে ধন্যবাদ জানানোর কিছু নেই।
নিজেকে জানার, নিজেকে বোঝার জন্য খুঁজে নেওয়া সময়টায় এই স্বাধীনতা, এই স্বনির্ধারিত নিঃসঙ্গতা মাঝেমাঝে খুব উপভোগ করি।
এত ব্যস্ততার মধ্যেও সিরিজ নিয়মিত লিখতে চেষ্টা করছিস দেখছি। সেটার জন্য ধন্যবাদ।
লেখায়
সচল শুধুমাত্র ব্লগ নয়, কমিউনিটি রাইর্টাস ফোরাম। সুতরাং সমসাময়িক অন্যান্য লেখাতেও সময় করে মন্তব্যের মাধ্যমে অংশগ্রহণের চেষ্টা করিবেন, এই আশাবাদ পোষণ করি।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ধন্যবাদ।
নিয়ম কানুন অনেক জটিল দেখছি ।
চেষ্টা করবো ।
আপনার মন্তব্য পড়ে তো লেখিকাকে চিনে ফেললাম।
লেখাটা আমার খুব ভালো লেগেছে।
ফাহিমা দিলশাদ
ধন্যবাদ
সুন্দর বিশ্লেষণ!
ধন্যবাদ
আমাদের চারপাশের মানুষ, সম্পর্ক, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম- সবকিছুই আসলে হালকা মেঘের মধ্যে আঁকা একটা ইম্প্রেশন। খুব জোরে বাতাস বইতে শুরু করলে সবটুকু মেঘ কেটে যেয়ে একটা প্রকাণ্ড 'আমি' ছাড়া আর কিছুই থাকে না। নিজেকে চিনতে পারাটা, নিজেকে বুঝতে পারাটা তাই খুব জরুরী।
আপনার লেখাটা ভালো লাগলো।
অলমিতি বিস্তারেণ
ধন্যবাদ
চমৎকার একটা লেখা, আরও বড় করলে পারতেন।
এস এম এস এর যুগে ২৫০ শব্দের বেশি কেউ আর পড়তে চায় না ঃ)
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
"হাসি" র মানে বুঝি নি, সচলে নতুন।
আমার হাসি পেয়েছে, তাই হেসেছি; আপনার কাঁদতে ইচ্ছা হলে কাঁদুন না!
মজিদের ভন্ডামি দেখে পাঠক অনেক সময় হাসে, সাহিত্য পাঠকের কাছে কিভাবে ধরা দেয়, তার কোন সার্বজনীন সূত্র নেই কিনা!
আর হাসির মানে না হয় নাই বুঝলেন, কিন্তু এর সঙ্গে সচলের নতুনত্বের সম্পর্ক কি বলুন তো? সচলে নতুন হলে হাসির মানে বোঝা যায় না, আর না হলে বোঝা যায়, এমনটাই মনে করছেন কি?
যাই হোক, আপনি ভাল থাকুন এবং এমন করে লিখুন।
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
আপনার প্রত্যুত্তরের ভঙ্গি বড়ই মনোহর।
লেখক ব্লগিঙে নূতন, লেখায়/ মন্তব্যে নানা ইমোটিকন ব্যবহার দেখে [যা পুরোনো হিসেবে আমরা হরহামেশাই করি] হয়তো কনফিউজড ফিল করছিলেন। সিম্পল।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
দুঃখিত, তিথীডোর!
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
আমার খুব সময় নেই কথার ঠোকাঠুকি খেলার। পরবর্তীতে সোজাসুজি মন্তব্য করলে ভালো লাগবে।
ফিনিক্স হে আমি তো কুপোকাত হয়ে গেলুম!
লেখার খাপ খুলে বেরিয়ে আসা চিন্তা, সৎসাহসটুকুর প্রতি অনেক ভালোলাগা, ভালোবাসা।
আরো অনেক অনেক লিখুন
সাহসটাই সম্বল ।
আপনার রোববারের কফিগুলো সোমবারে আসে কেনো?
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
সম্ভবত মডারেটর ঘুমিয়ে পড়েছিলেন
আমাগো রবিবার তো দ্যাশে কিম্বা ইউরোপে সোমবার ই।
লেখাটা খুবই চমৎকার হয়েছে। কফি পর্ব ১ খুঁজে পড়তে হবে। লেখা জারি থাকুক। সচলায়তনে স্বাগতম।
শুরু করলেন এক গুরুত্বের কাজ - ১. যৌনতা নিয়ে খোলামেলা, বিজ্ঞানমনস্ক আলোচনা ২. নিজেকে ভালবাসার শিক্ষা
আরো চলুক!
(কিছুদিন আগে অনু তারেকের লেখায় যৌন শিক্ষা নিয়ে আমাদের সমাজের সীমাহীন অনগ্রসরতার কথা, ও লিভিং টুগেদার জাতীয় বিষয়গুলি, যেগুলি নিয়ে আমাদের সমাজ ভয়াবহ শুচিবায়ুগ্রস্ত তা নিয়ে লিখেছিলেন সচলেই। আপনার লেখায় আরেকটু সমাজের কথা আসলে আরো ভালো লাগবে)
কবে আমাদের বোধ, বুদ্ধি আসল কাজে লাগবে, পশ্চাদগামী যৌন ও ধর্মীয় সংস্কার/দর্শন থেকে মুক্ত হয়ে!
-আনন্দময়ী মজুমদার
লেখাটা পড়ে নেবো । আমার মতো করে আরও কেউ ভাবছে , ভাবতে ভালো লাগে
আপন অনুভূতির সুন্দর বর্ণনা। ভালো লাগলো। সাহসী সত্যকথনের মাঝ দিয়ে আক্ষেপ উঠে এলো!!
____________________________
আক্ষেপ প্রকাশ করতে অনেক বেশী সময় লেগে গেলো , তাই মাঝে মাঝে নিজেকে অসৎ মনে হয়।
একেবারে শৈশবে আমাদের দলটা ছিল ছেলেমেয়ের মিশেলে একটা বৈষম্যহীন সমাবেশ। বৈষম্যহীন হলেও পার্থক্য ছিল, সে পার্থক্য আমরা বুঝতাম ছেলে এবং মেয়েদের জনন অঙ্গের পার্থক্য দেখে। কিন্তু আমাদের দলের মেয়েদের মধ্যে কোন বিষয়েই কোনরকম হীনমন্যতা ছিল না, দেহগত পার্থক্যটা নিয়ে আমরা সমবেতভাবে ঔৎসুক্য বোধ করতাম, বিষয়টা নিয়ে নানা ভাবনা আমাদের মধ্যে এক ধরনের আনন্দেরও সঞ্চার করতো। এরপর যতই বয়স বাড়লো, দলের মেয়েরা গুটিয়ে গেল, আমরা ছেলেরা হয়ে উঠলাম এক একজন দস্যু, তস্কর, লুটেরা, বিজেতা। আমরা অর্জন করলাম ঔদ্ধত্য আর দুর্বিনয়, তার আবর্তে আমাদের নির্দোষ খেলার সাথীরা হারিয়ে গেল চিরদিনের জন্য।
আমার দস্যু, তস্কর, লুটেরা, বিজেতা বন্ধুদের খুঁজছি
সাবধান বন্ধুরা, খুঁজে পেলে কিন্তু তোমাদের খবর আছে।
এত সুন্দর করে লিখলেন নিজের ভাবনাটুকু, সত্যি কথাগুলো! চমৎকার লাগল। আরো লিখুন, নিয়মিত লিখুন।
এই সিরিজটা বেশ হচ্ছে। পরের লেখার অপেক্ষায় রইলাম।
শুভকামনা
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
ধন্যবাদ
সচলে স্বাগতম। ভালো লাগলো লেখাটা।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
ধন্যবাদ
ভালো লাগল। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নিয়মিত হতে চেষ্টা করব
মনের মাঝে ঘুরপাক খেতে থাকা ভাবনাগুলো সৎ আর সাহসী লেখনীতে দেখতে ভালো লাগে খুব। রবিবার এবং কফি-১ খুঁজে পেলাম না। লিঙ্কটা দেবেন?
____________________
আলসেবুড়ি
নতুন মন্তব্য করুন