বাঙলা ভাষার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। হিন্দুয়ানী ভাষার অভিযোগ গেলেও, বর্তমানে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, এটি অত্যন্ত দুর্বল (!)। কারন এতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল বিষয় সাবলীলভাবে প্রকাশ করা যায় না। আর অতি নব্য প্রজন্মের কাছে তো বাঙলা অত্যন্ত 'খ্যাত'। (এই "ইয়ো ড্যুড, তুমি বাংলায় টক করো? ইয়াক!" প্রজন্মের অভিযোগের সমাধান কেউ দিতে পারবে বলে মনে হয় না)
আমি থাকি দেশের বাইরে, এমন এক দেশে যেখানে বাঙলা বলার লোক খুজে পাওয়া আর অমাবস্যার চাঁদ সমার্থক। এর মধ্যেই ইউটিউবে দেখলাম এক ফ্রেঞ্চ মহিলার আক্ষেপ, বাঙ্গালিরা বাঙলা বলার সময় অনেক বিজাতীয়/ বিদেশি শব্দ (বিশেষত ইংরেজি) ব্যবহার করে। (উনি বাংলাদেশে থাকেন এবং এটি মনে হয় পয়লা বৈশাখ বা ফেব্রুয়ারি মাসের কোন নিউজ রিপোর্ট হবে)
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, সৈয়দ মুজতবা আলির সাথে সুর মিলিয়ে, ভাষা বাবদে ফ্রেঞ্চরা সোজা বাংলায় উন্নাসিক। একটা বাইরের শব্দও নেয় না। দিলদরিয়া ব্রিটিশরা, কারন তাদের ভাষাটাকে সারা দুনিয়ায় চালাতে হয়েছে। এছাড়াও এখনো তারা তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে ভুল-ভাল ইংরেজিকেও আজকে ইন্ডিয়ান ইংলিশ, আফ্রিকান ইংলিশ ইত্যাদি বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে।
এদের তুলনায় বাঙলা কোথায় দাঁড়িয়ে? বাঙলাকে বেশ দিলদরিয়াই বলতে হবে। সে আরবি-ফার্সি-ইংরেজি সব থেকে নেয়, নিয়েছে, নিচ্ছে। কারন কি? কারন প্রয়োজন, দরকার, নইলে কাজ চলে না আর বিদেশি শাষণ। জমি-জিরাত, ব্যবসায়িক ও হিসাব বিষয়ক মোটামুটি সব শব্দই আরবি-ফার্সি। আর প্রশাসনিক ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, যন্ত্রপাতি ইংরেজি। আমরা ইংরেজি যে শব্দগুলোর বাঙলা করি, বা করি বলে মনে করি, আসলে সেগুলোও অনেক ক্ষেত্রে বিদেশি। যেমনঃ (Lawyer=উকিল, Court=আদালত ইত্যাদি)
সুতরাং আমরা যখন কথা বলি, নিজেদের অজান্তেই অসংখ্য বিদেশি শব্দ চলে আসে, হয়তো দেশি, তৎসম, অর্ধ-তৎসম বা তদ্ভব থেকে বেশিই (ধরে নিলাম এটা। কথার কথা আর কি! তদ্ভব থেকে বিদেশি শব্দ বেশি বলা, কখনোই সম্ভব না)। তার উপর বাংলায় একটি মৃত রূপ আছে, যা এদেশের 'আঁতেল' এবং কিছু অদ্ভুত ধারণাবিশিষ্ট লোকজনের অতি প্রিয় প্রাচীনকাল থেকেই, যার নাম সাধু ভাষা। নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এটি বেশ পবিত্র জিনিশ, যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করা যায় না (ইত্তেফাক নামক একটি বুড়োদের প্রগতিবিমুখ পত্রিকা একে এখনো ধরে আছে)। সরকারি অফিসে এখনও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে, কারনটা অবশ্য জানা যায় না। আভিজাত্যের প্রকাশ? আমার তাই মনে হয়।
সাধু ভাষা সংস্কৃত/ তৎসম শব্দে ভরপুর, ছত্রে ছত্রে মধু বা বঙ্কিমবাবুর স্বাদ আস্বাদন করা যায়, অনিচ্ছাস্বত্তেও। এটি সাহিত্যে ব্যবহারের উপযোগী হলেও, প্রতিদিন তো দূরের কথা, অফিস-আদালতে ব্যবহারেও অযোগ্য (যদিও আমলারা একে আঁকড়ে আছেন। অনেক কষ্টে ইংরেজি যদিওবা তাড়ানো গেছে কিছুটা, এটা গেলে মনে হয় তারা ন্যাংটো হয়ে যাবেন)
গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, বাংলার শব্দ সম্ভারের প্রায় পুরোটাই সংস্কৃত/ তৎসম ও তদ্ভবের উপর ভিত্তি করে তৈরি। সাধু ভাষায় কথা বলা যায় না, কারন সেটা অনেক বেশি সংস্কৃতকে অনুসরণ করে, শব্দচয়ন থেকে শুরু করে বাক্যগঠণ পর্যন্ত। বলা যেতে পারে, একটা ভাষা যত বেশি মৃত ভাষার (সংস্কৃত, ল্যাটিন ইত্যাদি) কাছাকাছি, সেটি দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করা তত কঠিন। এটি কিন্তু কোন ভাষার দুর্বলতা না, পৃথিবীর অনেক ভাষার দুটি রূপ আছে (কথ্য ও লেখ্য বা নতুন ও পুরনো)।
তবে যে তদ্ভব (বা বাংলা) শব্দগুলো আমরা প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছি, তার উৎসও কিন্তু সংস্কৃত। এখন আমরা যারা শহরে থাকছি, ইংরেজি ব্যবহার করছি, পড়ালেখা করছি তাতে, বিদেশে থাকছি, তারা কিন্তু অনেক অনেক বেশি কারিগরী শব্দ ব্যবহার করছি। আর এই শব্দগুলো প্রায় সবই ইংরেজি। তার উপর সারা বিশ্বের ভাষা এখন ইংরেজি, শুধু বিজ্ঞান না, ব্যবসার জন্যেও তা দরকার। বলছি না, ইংরেজি জানতেই হবে, দোভাষী দিয়ে বেশ কাজ চলে যায়। ফ্রেঞ্চ, জার্মানরা তো করে খাচ্ছে, তাই না?
আমি বেশ ভালো ইংরেজি জানি, নিজের ঢোল নিজেই বাজালাম। কিন্তু প্রাগ, প্যারিস, বার্লিন, ভিয়েনা, বুদাপেস্টে ও পুরো পোল্যান্ডে তা বিন্দুমাত্র কাজে আসে নি। শপথ করে বলছি, ফ্রেঞ্চ বা জার্মানটা যদি জানতাম, তাও কাজে আসতো! সুতরাং, বিদেশে থাকতে হলে ইংরেজি জানাটা সবসময় পূর্বশর্ত নয়। কিন্তু, জ্ঞান ও ব্যবসার বিষয়টা আলাদা, ইংরেজি এসব ক্ষেত্রে প্রায় অপরিহার্যই বলা চলে। ইংরেজির মত এত বিশাল শব্দসম্ভার আর কোন ভাষার নেই, কারন তারা অকাতরে অন্য সব ভাষা থেকে গ্রহণ করে (এটা ইংরেজির/ ইংরেজদের আধিপত্য বজায় রাখার একটা ধান্ধাও হতে পারে। তবে যাই হোক, কথা সত্য)। আর এত শব্দ থাকার জন্যেই, ইংরেজি অনেক বেশি পোষাকী (Formal), ধোয়াশা সৃষ্টি করতে, বা ভন্ডামিতে এর জুড়ি নেই, তাই ব্যবসার ভাষাও সেটা। এছাড়াও, সবচেয়ে বড় কারণ তো সারা দুনিয়া ইংরেজিতে চলে, আমেরিকা ইংরেজি বলে। আর কিছু কি লাগে?
তার উপর ইংরেজি এদেশে এখনো আভিজাত্যের লক্ষণ, শক্তিকেন্দ্রের ভাষা, যে কেউ এই ভাষায় কথা বলতে পারে না, শুধু প্রভুরাই পারেন। বাংলা সিনেমার অশিক্ষিত রিকশাচালক নায়কও খেপে গেলে বলে শাট আপ, গেট আউট! ইংরেজির মোহতে আমরা এখনো আছন্ন, যদিও তা হয়ত আমাদের ৯০% জনগোষ্ঠীর হয়তো কোন কাজেই আসে না (কজনই বা বিদেশে কাজকর্ম বা লেনদেন চালায়?)। যা হোক, বিদেশি ভাষা শেখা খারাপ না, তার উপর সেটা যদি হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভাষা। এখন আমরা কথায় কথায় ইংরেজি ব্যবহার করি, তার কতটুকু যৌক্তিক? এখানে আমি আরজে বা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া উচ্ছিষ্ঠদের গোণায় ধরছি না, এরা মোটামুটিভাবে বাংলাকে ধর্ষন করার উদ্দেশ্য নিয়েই জন্ম নিয়েছে বলে মনে হয়।
যা হোক, আলোচনার জন্যে একটা বাক্য নেই, "বাঙলা ভাষা অনেক বেশি রিজিড বা ফ্লেক্সিবল না, তাই সবক্ষেত্রে ইউজ করতে পারি না"। অত্যন্ত ইংরেজি-ভারি একটি বাক্য। কিন্তু এর বাঙলা কি হবে? "বাঙলা ভাষা অনেক বেশি আড়ষ্ট (রিজিড) বা পরিবর্তনশীল/ নমনীয় (!) (ফ্লেক্সিবল) না, তাই সবক্ষেত্রে ব্যবহার (ইউজ) করতে পারি না" আমরা কি এভাবে কথা বলি বা বলতে পারি? আড়ষ্ট, পরিবর্তনশীল, ব্যবহার- তৎসম শব্দ, আমি যখন লিখবো, তখন 'খাটি বা বিশুদ্ধ বাংলা'টাই লিখবো। কিন্তু যখন বলবো, তখন না চাইলেও, অসচেতনভাবে ইংরেজি শব্দগুলো চলে আসবে। কারন আর কিছুই না, বলা সোজা, অনায়াসে বলা যায়। আমরা চাইনা তৎসম বলতে, 'অনায়াস' শব্দটাই কে ব্যবহার করেন? আমরা বলি সহজ/ সোজা/ ইজি (!)।
আরেকটা বাক্য বলি "আপনার বিশস্ত সঙ্গী", Your trusted companion. এটা মনে হয় কোন একটি বিজ্ঞাপণের ভাষা। এখানে কিন্তু বাংলাটা বেশ সুন্দর, আমরা কি এটা প্রতিদিনকার জীবনে ব্যবহার করি? না, করি না। বলি, 'তোমার বিশস্ত বন্ধু', 'দোস্ত' বলি না, কারন শ্রুতিকটু লাগে (বাংলায় বললে, শুনতে ভালো লাগে না)। মজার ব্যাপার এখানে পর পর দুটি সংস্কৃত শব্দ, কিন্তু তারা খুব সুন্দর মানিয়ে গেছে। আচ্ছা, কেউ কি বাঙলা বাদ দিয়ে, ইংরেজিটা বলবে, যেকোন সময় ভাব প্রকাশের জন্যে? উত্তর, আবারো না। কেন? কারন ইংরেজিটা কঠিন, ট্রাস্টেড শব্দটা যদিও জিভের ডগায় আসে (কারণ ট্রাস্ট বেশ বহুল ব্যবহৃত), কিন্তু কম-প্যা-নিয়নঃ ৩ সিলেবলের শব্দ বলার মানেই হয়না! বরং, ফ্রেন্ড বলি আমরা, কিন্তু শুদ্ধ ইংরেজি Companion বলেই তো মনে হচ্ছে।
সঙ্গী শব্দটার সঙ্গেই যেন পথ চলার সম্পর্ক আছে বলে মনে হতে থাকে আমাদের। 'সফরসঙ্গী' (সফর বিদেশি শব্দ! সঙ্গী তৎসম), বাঙলা দাঁড়ানো উচিত 'চলার পথের সাথী'। আমরা যদি জিজ্ঞেস করি, 'তোমার সাথে কে যাবে?', ইংরেজিতে হতে পারে, "Who will accompany you?". Accompany>>Companion, সম্পর্কিত। তবুও আমরা বন্ধু বলি, ফ্রেন্ড বলি।
ভাষা সময়-নদীর (সময় রূপ নদী) মত, এর শেষ নেই, শুরু নেই, শুধু বয়ে চলে। কিভাবে চলে, কোন পথে, এবং কোন দিকে, তা বলা কঠিন। মানুষের যা ভাল লাগে শুনতে, বলতে এবং সহজ হয় উচ্চারণ, তাই সে বলে। সে ভাবে না, কিভাবে শব্দটা এলো, কোথা থেকে এলো, দেশি না বিদেশি। তবে হ্যা, মাত্রাতিরিক্ত ইংরেজির ব্যবহার দুঃখজনক। 'কাজটা অনেক কঠিন/ টাফ', 'তোমার প্রব্লেম/ সমস্যা কি?', 'তোর/ তোমার দোষ' না বলে 'তুই কালপ্রিট/ গিলটি'; এমন অনেক উদাহরণ দেয়া যায়, যেসব ক্ষেত্রে প্রায় একই রকম অর্থ প্রকাশ বাংলাতে সম্ভব হলেও, মানুষ ইংরেজি ব্যবহার করে। এই ক্ষেত্রে সচেতন হওয়ার প্রয়োজন আছে, কিন্তু উপায় কি?
আমি বিজ্ঞানের দিকের মানুষ, স্পেসিফিকালি বললে ইঞ্জিনিয়ার। (আমার মাথায় যেভাবে বাক্যটা আসলো, ঠিক সেভাবে লিখলাম)। স্পেসিফিকের বাঙলা কি হবে? "আমি বিজ্ঞানের দিকের মানুষ, 'আরো পরিষ্কার করে' বললে প্রকৌশলী।" এভাবে আমি লিখতে পারি, কিন্তু বলার সময় তো মুখে আসবে না। তো সেই আমি কিভাবে অন্যকে বলতে পারি, আপনি বাঙলা শব্দ ব্যবহার করেন না কেন? চেষ্টা করি যতটা সম্ভব বাঙলা শব্দ ব্যবহার করতে, এবং আমি মনে করি, এ ব্যাপারটা উৎসাহিত করা উচিত। আর বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে মনে করি, গবেষণা হওয়া উচিত বাংলায়, অন্তত অনুবাদ তো করা উচিত, না পারলেও চেষ্টা করা উচিত (এটা নিয়েও একটা লেখা লেখার ইচ্ছা আছে)। তাও না পারলে, ক্ষান্ত দিলাম আমি!
ধ্রুব আলম
মন্তব্য
সাধু ভাষা এক সময় বাংলার প্রমিত লিখিত রূপ ছিলো। আমরা এখন লিখিত ভাষার যে প্রমিত রূপটি ব্যবহার করি, সেটি সাধু ভাষার জায়গা নিয়েছে, কিন্তু সাধু ভাষাকে তাই বলে "মৃত" বলা ঠিক নয়। আপনি সাধু ভাষায় আজ একটা বই লিখে ফেললেই সেটি আর মৃত থাকবে না। সাধু ভাষার বাক্যগঠনও সংস্কৃতের মতো নয় (সংস্কৃত একটা সম্পূর্ণ অন্যরকম ভাষা, এর ব্যাকরণবিধি বাংলার চেয়ে অনেকখানিই ভিন্ন)। সাম্প্রতিককালে সাধু ভাষায় রচিত বহুলপঠিত গল্পের উদাহরণও পাবেন এখানে।
বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দের শ্রুতিকটু ব্যবহারের কারণ সম্পর্কে আপনার লেখায় পরিষ্কার কিছু পেলাম না। আমার কাছে মনে হয়েছে, হালজমানার পণ্ডিত ব্যক্তিরা বাংলা ভাষায় তাঁদের নিজস্ব বিষয়ে খুব বেশি লিখছেন না। এ কারণে যে নতুন শব্দগুলো আমাদের প্রতিদিনের জীবনে যোগ হচ্ছে, সেগুলোর বাংলা পরিভাষা নির্মিত হচ্ছে না। যেগুলো নির্মিত হচ্ছে, সেগুলোকে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী সহজে গ্রহণ করছে না। গ্রহণ না করার পেছনে তারা যেসব কারণ দাঁড় করাচ্ছেন, সেগুলো এক সঙ্গে দেখতে পেলে হয়তো আমরা ব্যাপারটা আরেকটু স্পষ্টভাবে দেখতে পেতাম।
জার্মান ভাষায় উপস্থাপনা করতে গিয়ে জার্মান ছাত্রছাত্রীরাও হোঁচট খায়, কিন্তু এ নিয়ে তাদের অভিযোগ করতে শুনিনি। আমরা বাংলা ভাষায় কোনো শব্দ একটু কঠিন হলে চট করে অভিযোগের দিকে চলে যাই, বলি অমুক শব্দটা খুব "কঠিন"। মাতৃভাষার সব শব্দই খুব "সহজ" হবে, এরকম ভেবে নেওয়ার কারণটা কী, আমি জানি না। এই অভিযোগী অংশটিকেই আবার কড়া কড়া ইংরেজি শব্দ শিখে প্রয়োগ করে আত্মপ্রসাদ পেতে দেখি। এই স্ববিরোধিতা আর নিজেকে লঘু করে অন্যকে গুরু হিসেবে দেখার প্রবণতার কারণে বাংলা ভাষায় নতুন শব্দ যোগ করলেও তার প্রচলন অনেক মন্থর।
কোনো জনগোষ্ঠীর শিক্ষিত অংশ যদি যে কোনো ঘটনা নিজের ভাষায় বর্ণনা করতে গিয়ে আটকে যায়, তাহলে বুঝতে হবে কোনো না কোনো পণ্ডিত নিজের কাজে ফাঁকি দিয়েছেন। যে যার গণ্ডির ভেতরে থাকা বিদেশি শব্দগুলোর বাংলা বিকল্প নির্মাণে যদি এগিয়ে না আসি, তাহলে বাংলা ভাষাও সংস্কৃতের মতো মৃত ভাষা হয়ে যাবে। ভাষার পরিণতি সেটাই।
ইংরেজি ভাষার শক্তি শুধু সাম্রাজ্যবাদ আর অর্থনীতির কারণেই নয়। নতুন যে কোনো ধারণাকে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ করা হচ্ছে। বিদেশি (বিশেষ করে গ্রীক আর ল্যাটিন) থেকে ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন ধাতুর সঙ্গে উপসর্গ অনুসর্গ যোগ করে প্রচুর শব্দ নির্মাণ করা হয়েছে, যা ভাবের আরো সূক্ষ্ম, সুবেদী প্রকাশকে সহায়তা করেছে। গ্রীক আর ল্যাটিন থেকে এসেছে বলে ইংরেজিভাষীরা কোনো শব্দকে কার্পেটের নিচে পাঠিয়ে দিচ্ছে না, যেটা আমরা তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে করি।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। তবে আমি দ্বি-মত পোষণ করছি, সাধু ভাষা বিষয়ে। এটি মৃত, খিচুড়ী করে বললে "সিম্পলি জাস্ট ডেড"। এ ভাষায় আপনি কথা বলতে পারবেন না, চাইলেও না (টোলের পণ্ডিত হলে অন্য কথা, হা হা!)
এই ভাষার কি মূল্য আছে? আছে, এটি মূল্যবান। কারন? সাহিত্যিক। বাংলাকে মধুসূদন কিন্তু সাহিত্য সৃষ্টির উপযোগী মনে করেননি, তিনি যা করেছিলেন তা আরো মহান, তিনি হাল ছাড়েননি, তাকে ফেলে দেননি। তিনি গায়ের জোরে তৎসমকে ডেকে এনেছেন, বিদেশি বাক্যগঠন ব্যবহার করেছেন, বাংলাকে মুক্তি দিয়েছেন ছন্দোবদ্ধ পদ্য থেকে। তাকে সাহায্য করেছে সাধু ভাষা।
এই ভাষা এখনো সেই কাজই করে যাচ্ছে, সাহিত্যের ময়দানে। কিন্তু প্রাত্যহিক জীবনে? না। আমরা কি বলি, আমার পিতা, আমার মাতা? না, আমরা বলি আমার বাবা, আমার মা। অন্তত আমি তাই বলি। মা-বাবা, এই শব্দ দুটোর সাথে যেন আমার আত্মিক সম্পর্ক, সাধু ভাষা তা গড়ে তোলে না।
কিন্তু খেয়াল করেন, আমার লেখা গুছিয়ে সুন্দর করে বলার জন্যে, আমি সাধু ভাষার কাছে কতটা ঋণী? তাই বলে অফিসিয়াল লেখ্য ভাষা কি সাধু হবে? অবশ্যি না। আমি এটাকে ঘৃণা করি, নিজে সরকারি চাকুরি করি বলেই। দেশের মানুষ যখন চলিততে কথা বলে, তখন আমরা কেন এই পুরনো ঐতিহ্যের নামে, এই প্রায় অকথ্য ভাষাটাকে নাকের ডগায় ঝুলিয়ে রাখবো। রবিবাবুই ৭০-৮০বছর পূর্বে যাকে কবর দিয়ে গেছেন, ত্রিশের কবিরা যাকে অত সম্মান করে বিদায় না দিয়ে, লাথি মেরে ফেলে দিয়েছেন (কিন্তু মধুসূদনের মত অপূর্ব সুন্দর শব্দচয়ন শিখে গেছেন), আমরা তাকে কেন বাচিয়ে রেখেছি? আমার একটাই উত্তর, নিজেকে অভিজাত প্রমাণ করতে, অসাধারণ বলে প্রচার করতে।
ত্রিশের মুসলমান কবিরা কিন্তু এই ভাষায় ভয়ানক ক্লান্ত ক্লিশে রচনা করে চলেছিলেন, কারণ তারা ছিলেন পশ্চাৎমুখী। আধুনিকতার আলো তাদের গায়ে এসে পড়েনি। "স্তনচূড়া দিল ক্ষীন কটিদেশে ছায়া" তোবা তোবা! ব্যতিক্রমঃ শিখাগোষ্টী। আর দেখবেন, অত্যন্ত মজার একটা বিষয়, মোল্লা-মৌলভি- হুজুরেরা সাধু ভাষায় কথা বলেন (আরবি-ফার্সি মিশ্রিত, শুনতে বিচ্ছিরি লাগে)! কারণ সে একটাই, তারা একটি জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্টী। আরো মজার ব্যাপার, তারা বর্তমানে, তাদের বিদ্যার বহর জারি করতে অনেক ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন! ওয়াজ শুনলে খেয়াল করবেন।
"অনিবার্যকারণবশত আগামীকালের পরীক্ষা স্থগিত করা হইলো"।
"অনিবার্যকারণে আগামীকালের পরীক্ষা স্থগিত করা হলো"।
শব্দের কি পার্থক্য? কিছুই না। শুধু ক্রিয়ার পরিবর্তন। এটুকুই দরকার, তার থেকে বেশি কিছু না। আর কেউ যদি 'অনিবার্যকারণে'-র চেয়েও শ্রুতিমধুর কিছু ব্যবহার করেন, তাহলে তো আরো ভালো (তবে তা আপাতত সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না)।
আর বিদেশি শব্দ বাংলাকে মোটেই শ্রুতিকটু করে না, অন্তত তাদের পরিমিত ব্যবহার। আমি একটা তৎসম বা বাঙলা শব্দের বদলে মোক্ষম বিদেশি শব্দ এলেও তা মেনে নেবো। 'মোক্ষমে'র বিদেশি বদলী কি দেবেন? পার্ফেক্ট? উহু শব্দটা এক্কেবারে খাপে খাপে মিললো না। 'মোক্ষম' মোক্ষমই!
আবার "লোকটা 'পার্ফেকসনিস্ট'", এর বাঙলা কি হবে? লোকটা খুতখুতে? একদমই চললো না, কিন্তু আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে কেন জানি এই শব্দটাই মাথায় আসলো। লিখতে বসলে, আমি অতি অবশ্যই এর একটা বাঙলা হয়তো বের করবো। কিন্তু বলতে গেলে? তখন তো আমার হাতে অভিধান নেই, বই নেই, দুম করে বলে ফেলেছি! আর বাঙলা কেন এটা মাথায় এসেছে? কারণ শব্দটা একটু হলেও 'নাইভ', যে লোক পার্ফেকসনিস্ট, সে একটু বিরক্তিকর ও খুতখুতে!
কিন্তু আমি মনে করি, এইযে লিখতে বসে, একটু সময় নিয়ে কষ্ট করে বাঙলা একটা শব্দ আবিষ্কার, এটা কেউ করছেন না (আমিও এখন করিনি)। আমার দাবি, আবদার ও অনুরোধ, এই চর্চাটা করা উচিত। আর বাঙলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব না, এর থেকে বাজে কথা আর হতে পারে না। যারা এটা বলে, তাদের এই মুহূর্তে বাঙলা বলাও বন্ধ করে দেয়া উচিত।
ধ্রুব আলম
আমি আবারও দ্বিমত পোষণ করছি। সাধু ভাষা একটা লিখিত প্রমিত রূপ, কথ্য রূপ না। সাধু ভাষায় অতীতেও কেউ কারো সঙ্গে কথ্য যোগাযোগ চালাতো না। ফরাসিতে যেমন আছে পাসে স্যাম্প্ল, বাংলায় তেমনই আছে সাধু ভাষা। আলাদা একটা ভাষা যদি হতো, তাহলে একে মৃত বলার প্রসঙ্গ তৈরি হতো।
ভাষার কোনো একটা রূপকে সজ্ঞানে পুঁতে ফেলার জন্য যে পরিমাণ সময় পার করতে হয়, ততটা সময় আমরা আসলে পার করতে পারিনি। সাধু ভাষায় লিখলেই কেউ অসাধারণ হয়ে যাবে, এই অনুমিতিই বা কেন গ্রহণযোগ্য হবে?
সৈয়দ শামসুল হক কিছু উপন্যাস লিখেছিলেন যুক্তরাজ্যের পটভূমিতে। সেখানে তিনি ইংরেজের মুখে ইংরেজি সংলাপকে পৃথক করার জন্যে সেগুলোকে সাধু ভাষায় লিখেছিলেন। চমৎকার উতরে গিয়েছিলো। কেবল সরকারি কাজে কিছু আমলা ব্যবহার করে বলেই সাধু ভাষার সকল উপযোগিতা হারিয়ে যাবে, এমনটা ধরে নেওয়ার কি কোনো কারণ আছে?
আমি বলছি না, পুঁতে ফেলতে। ভাষাটি অতীতমুখী, রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাঙলা চালু করতে হলে, চলিত করা উচিত। সাধু ভাষা কেন থাকবে না? অবশ্যি থাকবে। সময় বলে দিবে, তা বিলুপ্ত হবে কি হবে না।
কিন্তু সাহিত্য আর বৈষয়িক কাজ তো এক না। আমরা আমাদের নথিপত্রে বর্তমানকে ধারণ না করে, যে রূপটি দৈনন্দিন কাজে লেখ্য হিসেবেও বাতিল হয়ে গেছে, সেই অতীতকে ধরে আছি।
ধ্রুব
সেক্ষেত্রে দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষার চলিত প্রমিত লিখিত রূপটি চর্চার ওপর জোর দিতে বলা যায়। সাধু ভাষাকে "ঘৃণা" করার তো কিছু নাই। সাম্প্রতিক সময়ে সলিমুল্লাহ খানকে সাধু ভাষায় প্রবন্ধ লিখতে দেখছি, যেগুলো চলিত ভাষায় লিখিত অনেক একাডেমিশিয়ালের লেখার চেয়ে সহজবোধ্য আর সুপাঠ্য।
লেখাটা ভাবনার খোরাক যুগিয়েছে।
ও, হ্যাঁ, শিরোনামের 'অত্যাধিক' শব্দটি সম্ভবত 'অত্যধিক হবে।
ধন্যবাদ। এই আ-কার টাইপিং মিস্টেক! এখন কি ঠিক করে নেয়া যাবে? গেলেও কিভাবে আমি জানি না!।
এতো বিদেশী শব্দের ব্যবহারের অন্যতম কারণ আমার মনে হয় আমাদের বিনোদনের মাধ্যম গুলো। আমরা বের না হতেই হিন্দী আর ইংরেজি ছায়াছবি দেখে ফেলে জাতে উঠে যাই, কিন্তু ভালো বাংলা ছবি বানানাও হয় না তাই দেখা হয় না, দেখা হয় না দেখে বানানো হয় না। বাংলা বইপড়ুয়া মানুষ কয়জন আছে? আর যে কোন কিছু ইংরেজিতে বলতে, লিখতে পারাটা এখন একটা জাতে উঠার লক্ষণ। একসময় বাংলা ছাড়া অন্য শব্দ ব্যবহার করতে অনীহা ছিল। এখন বাইরে থাকার সুবাদে সব সময় ইংরেজিতে কথা বলতে বলতে বা লিখতে লিখতে অনেক সময় কথায় অনেক ইংরেজি শব্দ চলে আসে। সেটা বাংলায় ভাব প্রকাশ কম করা যায় বলে না, আমার অভ্যাস পরিবর্তন হচ্ছে বলে।
--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।
সম্পূর্ণরূপে সহমত।
তবে আমি কিন্তু ইংরেজি-বাঙলা দুটোকেই প্রায় একই গুরুত্ব দিয়েই বড় হয়েছি। বাঙলা সিনেমা কখনো দেখিনি, বাঙলা ব্যান্ডের গানও শুনিনি। সবাই যখন আইয়ুব বাচ্চু-মাইলস শোনে, আমি মামা-চাচার থেকে নিয়ে শুনতাম, লেড জেপলিন, ব্ল্যাক সাবাথ, ডিও। সবাই যখন 'কেয়ামত থেকে কেয়ামত' দেখে; আমি আমার মা-বাবার সাথে বসে দেখি 'বেনহুর'! আর হিন্দি সব কিছু ছিলো নিষিদ্ধ (আমার বাবা-মার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ)
কিন্তু, বাঙলা কখনো অবহেলিত হয়নি বাসায়। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, আবার উত্তম-সুচিত্রা, মান্না দে-হেমন্ত, কেউ বাদ যায়নি। আমি মনে করি, ব্যাপারটা গুরুত্ব দেয়ার এবং অনুধাবণের। তারপরে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ তো থাকবেই। আমার যেমন, ব্যান্ডের গানের থেকে ভাল লেগেছে, পুরনো দিনের গান; নতুন রংচটক সিনেমা থেকে উত্তম-সুচিত্রা!
আমি ব্যান্ডের গানের জায়গাটা পুরে নিয়েছি, ইংরেজি গান দিয়ে, রংচটক সিনেমাটা হলিউড দিয়ে।
কিন্তু জাতে উঠার জন্যে আপনি সত্যজিতকে ফেলে দিতে পারেন না, জীবনানন্দকেও না। আপনার 'হীরক রাজার দেশে' বা 'সাড়ে চুয়াত্তর' ভালো লাগে না, 'বনলতা সেন' কে বিচ্ছিরি মনে হয়, আমি বলবো, দুঃখিত, আপনার বাঙ্গালিয়ানায় সমস্যা রয়েছে।
কেউ জন্মেই দৌড়ায় না, আমরা বাংলাকে সেভাবে গড়ে নেইনি। এটা আমাদের দোষ, বাংলায় আসলেই সব ভাব প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু ইংরেজির সাথে তুলনা দিলে কি চলবে? তারা সারা দুনিয়া শাষণ করেছে, আমরা ৪০ বছর নিজেদের যাচ্ছেতাইভাবে চালিয়েছি! বাস্তবতাটুকু মেনে নিতে হবে, বাঙলা হয়তো অতদূর যাবে না। কিন্তু যতটুকু যাবে, তার দুই আনাও আমরা তাকে ব্যবহার করিনি, বিকশিত করিনি।
ধ্রুব
খুবই আগ্রহোদ্দীপক লেখা হইয়াছে। বাংলায় অন্য ভাষার শব্দ ব্যবহারের হেতু সলুকসন্ধানে ইহাকে মুখবন্ধ হিসাবেই মনে করিতে ভালো লাগিতেছে। আশা করিতেছি আসন্ন দিনগুলিতে বাংলা ভাষায় বৈদেশী শব্দের ব্যবহার আধিক্যের কারণ অনুসন্ধান করতঃ বিশদ লিখিতে সক্ষম হইবেন। অতীব আগ্রহের সহিত পড়িবার আশা ব্যক্ত করিয়া রাখিলাম।
তবে, এইযাত্রা বলিয়া রাখি। স্বীয় অনুমান বলিতে পারেন, কোনোরূপ গবেষণালব্ধ উপলব্ধি নহে। অদ্যকার বালক-বালিকারা, যাহারা রাত্রি জাগিয়া প্রেম-প্রীতির কথা বলিয়া অভ্যস্ত, তাহাদের হাতে আর যাহাই থাকুক, সময় বলিয়া কোনো বস্তু নাই। দৈনিক বাংলা মোড়ের টাইপরাইটার দিগের হাতের গতির ন্যায় উহারা হড়বড় করিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে এক নাগারে কথা বলিয়া যাইতে পারঙ্গম। ইহাতে যে সমস্যা রহিয়াছে এমন নহে। কিন্তু ইহা করিতে গিয়া যাহা হইতেছে তাহা হইলো, বাক্য গঠনের প্রক্রিয়ায় কিঞ্চিৎ দুষ্কর দেশীয় শব্দ পরিহার করিয়া বিনা ক্লেশে সেই স্থলে সুলভ চর্চিত আংরেজী শব্দ চোথা মারিয়া দিতেছে।
পরিনামখানা আপনি আপনার নিবন্ধে উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করিয়াছেন।
কেবল নিশিজাগা প্রেমোন্মুখ বালক-বালিকাদের কথাই বা কহি কেনো, আমাদিগের মধ্যে যাহারাই কথা বলিবার সময়ে 'সময়' নামক বস্তুটির অভাব অনুধাবন করিয়া, আন্তঃনগর রেলগাড়ির সহিত পাল্লা মারিয়া বাক্য গঠন করিয়া যাই, সকলের মধ্যেই এই কুফলখানা বর্তমান রহিয়াছে বলিয়া ধারণা করি।
কথা বলিতে পারা একখানা শিল্প! নিন্দুকেরা হয়তো বলিবেন, রেলগাড়িরও তো শিল্প! শিল্পে শিল্পে মিলাইয়া মহাশিল্প বানাইলে উহাতে ক্ষতি কী!
বটে! কথাশিল্প আর রেলগাড়িশিল্পকে একীভূত করিলে ক্ষতি হইবে না লাভ হইবে উহা আমার বিবেচ্য নহে বিধায় তাহা রেল মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত বিষয় বলিয়া উহ্য রাখিলাম। আমি যাহা বলিতে চাহিতেছি, তাহা হইলো, কথা বলিবার কালে সূক্ষ্ণ পরিমান সময় হাতে লইয়া বাক্য গঠন করিলে এবং তদানূযায়ী বর্ষণ করিলে (হড়বড় করিয়া নহে) শ্রবণকারীর কর্ণকূহরের লাগিয়া যেমন মঙ্গলসম তেমনি ভাষার জন্যেও উহা স্বাস্থ্যকর।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
আপনার কমেন্টটা সবচেয়ে পরে পড়েছি, কারণ? আপনি সাধুতে লিখেছেন! কিন্তু পড়ে সবচেয়ে বেশি আনন্দলাভ করেছি, যদিও হিমুদার কমেন্ট কিন্তু আরো চিন্তা-ভাবনা করে লেখা।
কেন ভাল লাগলো, মজা পেলাম? শব্দচয়ন। কিন্তু সাধু ভাষায় না লিখে আপনি যদি, এই একই শব্দগুলো প্রায় অবিকৃতভাবে ব্যবহার করে চলিততে লিখতেন, শিল্পগুণ ক্ষুণ হতো কি? মনে হয়না।
আসলে কথ্য ভাষা বদলে যাচ্ছে। যারা লিখছি, তারা ভেবেচিন্তেই লিখছি। এখনো, লেখায় শব্দের বাহার প্রশংসিত হয়, অপ্রয়োজনীয় ইংরেজির ব্যবহার হয় সমালোচিত। তবে, বলতে গিয়ে বানের জলের মত ইংরেজি আসছে ঠোটে।
আমাদের করনীয় কি? বাংলাকে সহজে বলার মতও করে তৈরি করে নিতে হবে। কথ্য (বা গ্রাম্য) ভাষাকে টেনে আনলে চলবে না, আরো গভীরভাবে ভাবতে হবে। হুমায়ুন আজাদ যেমন দেখিয়েছিলেন, 'জিম্মি'র কি সুন্দর একটি বাঙলা করা হয়েছে 'পণবন্দী'।
তবুও আমরা কিন্তু বলি, 'জিম্মি করে', 'ব্ল্যাকমেল করে'। এর কারন মনে হয়, এই দুটি শব্দ ক্রিয়ারূপেও কাজ করতে পারে। 'পণবন্দী' তা পারছে না। জিম্মি প্রায় বাঙলা হিসেবেই দাঁড়িয়ে গেছে, আর ব্ল্যাকমেলের বাঙলা কি?
আমি আসলে সমাধাণ ঠিক জানিনা, শুধু চিন্তাভাবনার খোরাক দিলাম। আর বিজ্ঞানে কেন বাঙলা ব্যবহার করা উচিত ও কিভাবে, তা নিয়ে আরেকটি লেখা দেব।
ধন্যবাদ কমেন্টের জন্য, আমি সংস্কৃত শব্দের ভক্ত। এবং শব্দ আমার কাছে খেলার বিষয়, মজার বিষয়, তাই মন্তব্যে
ধ্রুব
সাধু! সাধু!!
____________________________
সাধু!! সাধু!!
ব্যাতিক্রমই বোধ হয়, স্কুলের পাঠাগারে বঙ্কিম আর বিদ্যাসাগরের বই বেশি থাকাতে কিনা আমার বলার ধরণেও কঠিন শব্দ ঢুকে পড়েছিল একসময়।(ব্যাপারটা আঁচ করেছি, আমাদের ক্লাসের একমাত্র বিদেশি ছেলে সবার কথা বুঝত কিন্তু আমার কথা বুঝতে তার কষ্ট হত! )
স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানো যায় যদি, টেলিভিশনে ও সংবাদ মাধ্যমে শ্রুতি মধুর তবু আপাত অচলিত বাংলা ব্যাবহার হয়, বই পড়ার অভ্যাস করানো হয়,সাবলীল বাংলায় বিজ্ঞান লেখা হয়, সহজবোধ্যতার স্বার্থে দরকারি বিদেশি শব্দ বিজ্ঞানে আত্তীকৃত হয়! সর্বোপরি চর্চা আর স্বভাষার প্রতি মমত্ববোধ।
রাজর্ষি
ইত্তেফাক সম্ভবত সম্প্রতি পড়েননি। আমার যতদূর মনে পড়ে, তারা বেশ কিছু বছর আগেই সাধুভাষাকে বিসর্জন দিয়েছে। শুধু সম্পাদকীয়টা সাধুভাষায় থাকে। ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় সাধু/চলিত -যে ভাষাতেই হোক, সেটা ক'জনই বা পড়ে? তাই পুরো পত্রিকার খবর চলিত, সম্পাদকীয় সাধু ভাষায় হলে "এখনো ধরে আছে" -এটা মানতে পারছি না। (আমি ইত্তেফাক পড়ি না, এর ভক্তও নই)
বিদেশি শব্দের ব্যবহার বৃদ্ধির আরেকটা কারণ হল, আমরা অনেক পরিমাণে ইংরেজি মুভি দেখি, ফ্রেঞ্চরা দেখে ফ্রেঞ্চ এ ডাব (Dub এর বাংলা কি?) করাটা।
আমাদের পাশের দেশেও এই রোগ বিপুল বিক্রমে বিরাজমান। দর্শক না হলেও জানি, হিন্দি চ্যানেলের অনেক শো'তে বিপুল পরিমাণে ইংরেজি ব্যবহৃত হয়, অনেক বিচারকরা ইংরেজিই বলেন বেশিরভাগ সময়।
শুভেচ্ছা
হুম, ওই সম্পাদকীয়টা ধরে রেখেছে, ওটাই আমার গাত্রদাহ। ধরে রাখবার কারণ কি? সম্পাদক কি এক বিশেষ ব্যক্তি? নাকি ঐতিহ্য? সাধু ভাষায় ঐতিহ্যের কি আছে? বরং আমি এলিটিস্ট মনোভাবের বহিপ্রকাশ দেখতে পাই।
'ডাব'-এর বাঙলা মনে হয় অনুবাদ/ অনুবাদকৃত। বিটিভিতে ইরানি ছবির আগে ঘোষণা দিত নাঃ এখন দেখবেন বাংলায় অনুবাদকৃত ইরানি ছায়াছবি "কিছু একটা!"।
আর ভারতের সাথে আমাদের তুলনা মনে হয় চলে না। ওদের অসংখ্য ভাষা, ইংরেজি হিন্দির চেয়েও বেশি বুঝে সবাই। আবার, হিন্দি অত্যন্ত দুর্বল একটি ভাষা, জোর করে বানানো। শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞানে এর প্রয়োগ ও ব্যবহার খুবই কম। বরং এর তুলনায় আঞ্চলিক ভাষাগুলো অনেক বেশি সমৃদ্ধ।
ধ্রুব
ইত্তেফাকের সম্পাদকীয়টাকে নাহয় এইবেলা ছেড়েই দিন, ওটা ঐতিহ্য মনে করে ধরে থাকলে থাকুক ওরা - কি আসে যায়?
-সেটা আমিও জানি। একজন ভারতীয় আরেকজন ভারতীয়র সাথেই ইংরেজি বলতে বাধ্য হয়, যখন একজনের বাড়ি হয় পশ্চিমব্ঙ্গ আরেকজনের কেরালা।
আমি ওদের উদাহরণটা দিয়ে যেটা বোঝাতে চেয়েছি, সেটা হল আমাদের (বুঝে বা না বুঝে) অনুকরণপ্রিয়তা। ওরা করছে বলেই আমরা করব -এটা আমার বক্তব্য ছিল না। আমার ছিটেফোঁটা অভিজ্ঞতায় পুরোপুরি হিন্দিভাষায় প্রচারিত চ্যানেলেও প্রচুর ইংরেজি বলা হয় বলে মনে হয়েছে।
শুভেচ্ছা
বড় দুঃখের কথা বলি, আগে কলকাতার একটা ম্যাগাজিন পড়তাম, খুবই প্রিয় ছিলো, 'আনন্দমেলা'। চিনবেন কিনা জানি না। এখন যে তার কি অবস্থা হয়েছে! ভারতীয়দের হাতে বাঙলা কেন, কোন ভাষাই নিরাপদ বলে এখন আর মনে হয়না।
ধ্রুব
ডিউড, খুল ফ্যাক্টরের কথা বললেন না যে?
ভাই, 'ক্ষুল' যে হইতে পারি নাই! আর ওইসব পরগাছাদের আমি গোনাতেই আনিনি। তাদের নিয়ে কথা বলতে বিবমিষা জাগে।
"আজকে প্লে করতে গিয়ে ফেল ডাউন, আই হার্ট মাই লেগ"। এই প্রজন্মকে বাঙলা সুন্দর সুন্দর গালিগুলো দিতে ইচ্ছা করে। (বাংলার গালি-সম্ভার সুবৃহৎ, আমি তা নিয়ে গর্বিত )
ধ্রুব
"ফ্রেঞ্চরা সোজা বাংলায় উন্নাসিক। একটা বাইরের শব্দও নেয় না।"
একটা শব্দও নেয়না, এটা বোধহয় ঠিক না। ফারসী শমশির থেকে তুরকী চমচির থেকে ফরাসি সিমেতেখ (বাঁকা তলোয়ার), ওলন্দাজ আপার্তহাইদ (apartheid), পুরাতন আংরেজী থেকে চারদিকের নাম (নখ, এস্ত, সুদ, উয়েস্ত)। আর কোন ফরাসির ই কিন্তু ডিস্কো, ট্য়াক্সি, পিৎসা, সাগা - এগুলো বলতে অসুবিধা হয়না।
"বলা যেতে পারে, একটা ভাষা যত বেশি মৃত ভাষার (সংস্কৃত, ল্যাটিন ইত্যাদি) কাছাকাছি, সেটি দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করা তত কঠিন।"
রোমান্স ভাষা (ফরাসি, ইতালিয়, স্প্য়ানিশ) গুলির ক্ষেত্রে এই কথাটি কতটুকু খাটে?
"কিন্তু প্রাগ, প্যারিস, বার্লিন, ভিয়েনা, বুদাপেস্টে ও পুরো পোল্যান্ডে তা বিন্দুমাত্র কাজে আসে নি।"
এটাও মনে হল অতিশয়োক্তি। বুদাপেস্ট ছাড়আ অন্য় শহরগুলোকে কিছুটা দেখার সুযোগ হয়েছিল। ওগুলো বড় কজমোপলিটান শহর ও বিবিধ পরিস্থিতিতে ইংরেজী জানা স্থানীয় লোকের সাথে আমার দেখা হয়েছে।
ফরাসি ফুলবাবুরা এক্কেবারে ঠেকায় না পড়লে বিদেশি শব্দ নিতে চায়না। এটা সর্বজনবিদিত, আমিও তারই পুনরাবৃত্তি করেছি। এটা কিন্তু খারাপ কিছু না, যদি তারা এভাবেই চালিয়ে নিতে পারে, ক্ষতি কি?
রোমান্স ভাষা সম্পর্কে আমার জ্ঞান ভাসা ভাসা, দুঃখিত। এক সময় ফরাসি শেখার চেষ্টা করেছি, কিছু শব্দ ধরতে পারি। কিন্ত তাতে আমার রাস্তা-ঘাটে ল্যাটিন পড়ায়/ বোঝায় (মূলত এপিটাফ বা কোন মেমোরিয়ালে) মোটেও লাভ হয় না। যেমন আমরা সংস্কৃত পড়তে পারি না, তেমনি আমার ইতালিয়ান বন্ধুরা পারেনা ল্যাটিন পড়তে। যদিও ইতালিয়ান ল্যাটিনের সবচেয়ে কাছের ভাষা।
আর সবচেয়ে আন্তর্জাতিক হলো ভিয়েনা, প্রাগ। ইংরেজি বলে কাজে এসেছে, তবে ইংরেজি লেভেল "ইয়েস, নো, ভেরি গুড"। পোল্যান্ড আর বুদাপেস্টে আমি একজনও পাই নি, ইংরেজি বুঝেছে। বার্লিনেও মোটামুটি কাজ চলেছে। এখন আপনি অফিস-আদালতে গেলে ইংরেজি বলতে পারবেন, কিন্তু আমি তো ছিলাম ব্যাক-প্যাকার!
ট্রেনে-বাসে-ট্রামে এমনকি ম্যাকডোনাল্ডসে (পোল্যান্ডে ম্যাকে সাইনবোর্ড থাকে, এখানে ইংরেজি বলা হয়!) আপনি ইংরেজি বলে বোঝাতে পারছেন না। (আমি এয়ারপোর্টেও পারিনি) এরপর তো মনে হতেই পারে, ইংরেজি শিখে কি লাভ হলো?
আর প্যারিসের কথাটা বাকি রেখেছি, তারা সবচেয়ে খারাপ (!)। যে কজন ইংরেজি বুঝে, বলে না। আমি ইংরেজিতে প্রশ্ন করি, জবাব দেয় ফরাসিতে। ফাজিলের ফাজিল!
আমার এক বন্ধু (পর্তুগিজ বলা ব্রাজিলিয়ান) লিও-তে ছিল বেশ কয় মাস। সে যথেষ্ট ভালো ফরাসি পারে, পর্তুগিজের সাথে মিল আছে তো একটু হলেও। তো একদিন তার বাড়িওয়ালী এসে তাকে বললো, "দেখো, নো অফেন্স, তুমি আর ফ্রেঞ্চ বলো না। ইংরেজিতে কথা বলো, আমি ফ্রেঞ্চে জবাব দেবো। তোমার জঘন্য ফ্রেঞ্চ আমার কানে লাগে এবং মনে হয় কেউ আমার ভাষার ১২টা বাজিয়ে দিচ্ছে! আমরা ফরাসিকে বড় ভালবাসি"
হা হা হা! এই গল্প শুনে আমি ব্যাপক মজা পেয়েছিলাম।
ধ্রুব
বাঙ্গালী জাতি এবং বাংলা ভাষা, কোনটিই তো মৌলিক কিছু নয়। প্রোটো বাঙ্গালী জাতিগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছিল অস্ট্রোলয়েড সাঁওতালী নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের সাথে আরেক অস্ট্রোলয়েড দ্রাবিড় এবং মঙ্গলয়েড বোরো নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের সংমিশ্রনে। তাদের উপর সংস্কৃত ভাষাভাষী আর্য্য জনগোষ্ঠীর প্রভাবের কারনে কালের প্রবাহে ধীরে ধীরে গঠিত হয় বাঙ্গালী জাতিগোষ্ঠী এবং বাংলা ভাষা। একেবারে শুরু থেকেই সংস্কৃত কিংবা সংস্কৃতমূলক শব্দ ব্যবহার করে জাতে ওঠার একটা প্রবণতা হয়তো ছিল, নিদেনপক্ষে বস্তুগত কারনে সে সব শেখার প্রয়োজন হয়েছিল। পরবর্তীতে একই কারনে আরবি, ফার্সি, তুর্কী, আরও পরে পর্তুগীজ এবং সবশেষে ইংরেজী। এই যে জাতে ওঠার প্রবণতা, তা বোধ হয় এখনো পুরোমাত্রায় বর্তমান, কথাবার্তায় একটু ঠাস ঠুস ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করলে বক্তা সম্পর্কে সাধারন্যে কমবেশি একটা সমীহের ভাব ফুটে ওঠে। কিন্তু যে কারনেই হোক, যে প্রক্রিয়াতেই হোক, তদ্ভব তো বটেই, তৎসম, এমনকি বিদেশী তথা আরবি, ফার্সি, তুর্কী, পর্তুগীজ এবং ইংরেজী শব্দাবলীও এখন বাংলা শব্দ হিসেবেই গৃহীত। সুতরাং জাতে ওঠার আকাঙ্খায় অকারনে ঠাস ঠুস ইংরেজী শব্দ ব্যবহার আমাদের চিত্ত ও শিক্ষার দৈন্যতা প্রকাশ করলেও প্রয়োজন বোধে দেশী ও তদ্ভব শব্দ ছাড়াও বাংলা ভাষায় গৃহীত তৎসম ও বিদেশী ভাষার ব্যবহারে দোষের কিছু নেই।
সাধু ভাষার উপর এতটা বিরুপ হওয়ার কোন কারন খুঁজে পেলাম না। মনে রাখতে হবে আমাদের সাহিত্যে গদ্য রীতির প্রচলন না থাকলেও দলিল-দস্তাবেজ এবং স্মারকলিপিতে কিন্তু বাংলা প্রাচীন কাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছিল, তথাকথিত সাধু ভাষা বা সাধু রীতি সেই গদ্যেরই ধারাবাহিকতা মাত্র। নদীয়া/শান্তিপুরের ভাষা প্রমিত বাংলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের আগে পর্যন্ত সাধু ভাষার অবদান অস্বীকার করার কোন উপায় নাই।
সহমত। তৎসম তো আমাদের মোটামুটি প্রায় সব শব্দেরই মূল (রুট-এর বাঙলা কি হবে?)।
আমি হয়তো বোঝাতে পারিনি, আমার ক্ষোভ অফিস-আদালতে সাধুর ব্যবহার। সাধু ভাষা না থাকলে আমি যেভাবে লিখছি, সেটাই তো দাড়াতো না!
কিন্তু আপনি ১০০ বছরের পুরনো ভাষায় আগামীকালের মিটিং-এর কার্য-বিবরনী লিখবেন, এটি সম্পূর্ন অদ্ভুত একটি ব্যাপার। সাহিত্যে আমি সাধু কেন, কথ্য/ আঞ্চলিক -ও ব্যবহার করতে পারি। ওটা আমার স্বাধীনতা, কিন্তু একটি প্রমিত চলিত রূপ থাকার পরেও, আমরা কেন ঘাড় থেকে সাধুভাষার ভূতকে নামাচ্ছি না?
ধ্রুব
এটুকু হলে ঠিকই আছে। এর বেশি কিছু বলার দরকার ছিল না। আবেগাতিশয্যে সাধু-চলিত প্রসঙ্গে বাকি যা বলেছেন তার প্রায় সবটাই বাহুল্য। "ঘৃণা", ইত্তেফাক, ইত্যাদি - এগুলি নেহাতই আপনার ব্যক্তিগত অনুভূতি, সবাই তা শেয়ার নাও করতে পারে, আর মৃত-সিম্পলি জাস্ট ডেড ইত্যাদি - সিম্পলি জাস্ট ভুল!
তবে লেখাটা ও মন্তব্যঘরে আলোচনাটা ইন্টারেস্টিং হয়েছে।
****************************************
হুমায়ুন আজাদের একটি বই আছে 'আধার ও আধেয়'। আপনি দেখবেন সেখানের প্রবন্ধগুলোতে তিনি সংবাদপত্রগুলোকে একহাত নিয়েছেন, অকারণে কিন্তু নেননি। আমি সেই লেখার মনে হয় ৩০/ ৪০ বছর পর দেখি, ইত্তেফাক ঠিক যা ছিল, তাইই আছে, তাদের কিছু গালি সেজন্য প্রাপ্য নিশ্চয়ই!
আর আমি মৃত বলতে বুঝিয়েছি, যে ভাষা আর মুখে বলা সম্ভব নয়। ভাষাকে মনে হয় তখনই মৃত বলা হয়। মিশরিয় হিয়েরোগ্লিফিক কিন্তু শিখে নিয়ে আমি-আপনি যে কেউ কিছু লিখতে পারি। তবে তা দিয়ে "মা, ভাত দাও, ক্ষুধা পেয়েছে" বলতে পারবো? না, মনে হয়। লিখতে বললে লিখে ফেললেও ফেলতে পারি।
এবং সাধু ভাষায় সাহিত্য চলতে পারে, কিন্তু সেটি সংবাদ পরিবেশন বা নথি তৈরিতে এখন আর উপযুক্ত নয়, একান্তই ব্যক্তিগত মতামত।
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্যে
ধ্রুব আলম
"মৃত ভাষা" স্বীকৃত একটা বিশেষ টার্ম, আপনি সেটা আপনার মনোমত যত্রতত্র বা যেখানে প্রযোজ্য নয় সেখানে প্রয়োগ করলেই তো আর সেটা গ্রহণযোগ্য হয়ে যায় না! উপরে হিমু আপনাকে অত্যন্ত সহজ ও চমৎকারভাবে সাধুভাষা কেন "মৃত ভাষা" নয় সেটা দেখিয়েছেন, তারপরও আপনি বিষয়টা এর প্রতি আপনার অন্ধ "ঘৃণা"-র কারনেই মনে হয় গুলিয়ে ফেলছেন বারবার। হিমু কি বলেছেন আরেকবার দেখি তাই --
কি বুঝা গেল?
১। 'সাধুভাষা' আলাদা কোন ভাষা না। এইটা হলেই কেবল একে "মৃত" বলার প্রসঙ্গ তৈরি হত মাত্র, যদিও আমার মতে তারপরও আসলে একে মৃত বলা যেত না।
২। এটা আমাদের ভাষার আর দশটা রূপের মতই একটা বিশেষ "রূপ" (ভেরাইটি) মাত্র, যা গোড়া থেকেই বিশেষ ক্ষেত্রে বা কন্টেক্সটে ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত ছিল। অর্থাৎ প্রমিত লিখ্য রূপ হিসেবেই, কথ্য রূপ হিসেবে নয়। গোড়া থেকেই। অর্থাৎ, নতুন করে এর "আর মুখে বলা সম্ভব নয়" হয়ে উঠার বা বেসম্ভব হয়ে উঠার কোন প্রশ্নই উঠে না, কারন সে প্রশ্ন ছিলই না কখনও। এটা দৈনন্দিন কথ্য ভাষা কোনদিনই ছিল না, সুতরাং "কথ্য" ভাষা হিসেবে এর মৃত্যু হওয়ার কোন প্রশ্নই উঠে না। খুব বেশি হলে যা বলা যায় তা হল - যুগের বিবর্তনে এর জন্য প্রচলিত ক্ষেত্র বা কন্টেক্সটগুলির মধ্যে কিছু পরিমার্জন হয়েছে, কিন্তু তাই বলে তা মোটেই নিঃশেষ হয়ে যায়নি - প্রয়োজনে কিম্বা বাস্তব চর্চায়।
আপনার নিশ্চয়ই জানা থাকবে 'ডাইগ্লোসিয়া' (Diglossia) কাকে বলে। উইকিপিডিয়া 'ডাইগ্লোসিয়া' সম্পর্কে বলছে -
সমাজভাষাতত্ত্ববিদ চার্লস ফার্গুসন তাঁর 'Diglossia' গ্রন্থে এর এরকম একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন -
রোনাল্ড ওয়ার্ড্হ তাঁর 'এ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু সোশিওলিঙ্গুইস্টিক্স' গ্রন্থে ব্যাপারটা আরও সংক্ষেপে ও জেনেরিকভাবে বলেছেন এভাবে --
আমাদের সাধু-চলিতের রূপবৈচিত্র্যকে এই ডাইগ্লোসিয়ার একরকম উদাহরণ বলা যেতে পারে। এর মধ্যে আভিজাত্য-টাভিজাত্য সহ আরও নানা রকম কারন থাকতে পারে হয়তো (সবসময় বা একমাত্র নয় অবশ্যই), কিন্তু এটা অবশ্যই জীবিত / মৃতর ব্যাপার না বা তার সাথে একে গুলিয়ে ফেললে ভুল হবে বলেই মনে করি। হ্যাঁ, এরও মৃত্যু হতে পারে বৈকি, তবে সেটা "....আর মুখে বলা সম্ভব নয়" বলে নয়, বরং বাস্তব চর্চায় লিখ্যরূপ হিসেবে কোনরকম প্রয়োজন পূরণের মাধ্যম হিসেবেই যদি এর আর কোন বাস্তব ব্যবহারকারীই অবশিষ্ট না থাকে - তবেই। কিন্তু সেরকম অবস্থার তো এখনও সৃষ্টি হয়নি তাই না? আপনার লেখা থেকেই স্পষ্ট যে এটা অফিস-আদালত-আইন-কানুন-ধর্ম-সাহিত্যর নানারকম প্রয়োজন পূরণে বাস্তবে বেশ তুমুলভাবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে এটা এখনও মৃত নয়। আপনি বড় জোর বলতে পারতেন যে আপনি এটাকে - মারতে চান। কিন্তু কাউকে 'মারতে চাওয়া' আর সেটা 'মৃত' এক কথা নয় নিশ্চয়ই। আকাঙ্ক্ষার সাথে বাস্তবতার তফাৎ কোথায় জানতে হবে।
****************************************
আমার একটি প্রশ্ন আছেঃ আপনি তাহলে ব্যবহারিক ও সাহিত্যিক, উভয় ক্ষেত্রেই লেখ্য হিসেবে, সাধু ভাষাকে চাইছেন?
যদি উত্তর হয়ে থাকে না, তবে কেন 'না'? লেখ্য হিসেবে এটি তো বেশ কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলো, যাচ্ছে গত প্রায় ২০০ বছর ধরে অফিস-আদালত-সাহিত্যে।
আমি আমার অবস্থানটি পরিস্কার করি আবারো, সাহিত্য ক্ষেত্রে সাধু ভাষা অবশ্যই চলুক। বাংলা ভাষার এই রূপটিকে তো বাদ দেয়া যাবে না, তা অসম্ভব। চলিতও এসেছে সাধু থেকেই বলতে হবে। সংস্কৃত>প্রাকৃত>>বাংলা, এভাবে যদি ধরি, এই প্রাকৃত থেকে তো লাফ দিয়ে বাংলা প্রমিত কথ্য রূপ আসেনি।
বাংলাকে সহজ করার লক্ষ্যে, ভাব-প্রকাশের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যেই তো সাধু থেকে চলিতের আগমন মনে হয়, তাই না? এখন আমি যদি সাধু কেন, সংস্কৃতে কাব্য-রচনা করি, সমস্যা আছে কি?
এইবার বলি, সংস্কৃতে কিন্তু আমি অফিসের সব কাজ-কর্মও করতে পারবো মনে হয়। যখন শব্দ পাবোনা, বিদেশি থেকে ধার করবো। এখন আপনি 'সংস্কৃত'-র বদলে বসান 'বাংলা ভাষার সাধু রূপ'।
আপনি যদি একে প্রাত্যহিক জীবন থেকে বিদায় না দেন (আপনি যাকে বলেছেন মেরে ফেলা!), তবে কি করতে চান? আমি তো বলছি না, সাহিত্য থেকে ফেলে দিন। কিন্তু প্রায় ১০০ বছর আগে প্রমথ চৌধুরি আর রবীন্দ্রনাথ যা শুরু করেছিলেন, আমরা কি ৭১'র পরে তার উলটো দিকে হাটছি না?
আমি উইকি থেকে ডেড ল্যাঙ্গুয়েজের ব্যাপারটা তুলে দিচ্ছিঃ
(সোর্সঃ http://en.wikipedia.org/wiki/Dead_language#Dead_languages_and_normal_language_change)
হু, সাধু ভাষা মৃত বলা যাবে না, বলতে হবে 'সুডো-এক্সটিংসন' পর্যায় চলছে তার (বাংলাঃ ছদ্মবিলুপ্তি?)।
যা হোক, সাধুভাষা যে কি চমৎকার ও আনন্দদায়ক হতে পারে, তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণঃ উপেন্দ্রকিশোরের "ছোটদের রামায়ণ" আর "ছোটদের মহাভারত" বই দুইটি (ছোটদের না ছেলেদের আমি ঠিক মনে করতে পারছি না, দুঃখিত)। আমি এখনো পড়ি, এত প্রাঞ্জলতা চলিততেও অর্জন করা কঠিন।
সাধু ভাষার প্রতি আমার কোন বিদ্বেষ নেই, আছে তার ব্যবহারের উপর।
ধন্যবাদ আপনার এত কষ্ট করে, মুল্যবান একটি মন্তব্যের জন্যে। (বুঝিবার তরে সম্পূর্ণটা ৩ বার পড়িতে হইয়াছে!)
ধ্রুব
তাহার পরেও আপনি বোধ করি বুঝিতে পারেন নাই। অতএব আমি শেষ বারের তরে আরেকটি প্রয়াস গ্রহণ করিতেছি। তবে আপনি যদি মনস্থির করিয়া রাখেন যে আপনি বুঝিবেন না, তাহা হইলে তিনবার কেন তিন শত বারেও বুঝিতে পারিবেন না।
প্রথমেই বলি, আপনি যে উদ্ধৃতিটা দিয়েছেন তা এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক, প্রযোজ্য না। কেন অপ্রাসঙ্গিক বা অপ্রযোজ্য তা আমার উপরের মন্তব্যে বারবার বলেছি। আপনি না বুঝলে বা মানতে না চাইলে আমার কিছু করার নেই। তবু আবারও বলছি - এটা আলাদা কোন ভাষা নয়, আমাদের ভাষারই একটা সুস্পষ্ট ব্যবহার বা প্রয়োগক্ষেত্র-বিশেষায়িত রূপ মাত্র। ভিন্ন বা স্বতন্ত্র ভাষা নয়। এরকম একটা "রূপের" বিস্তৃত বা অত্যন্ত সীমিত বা পরিবর্তনশীল ব্যবহার বা প্রয়োগক্ষেত্র থাকতেই পারে, থাকতে পারে সীমিত সংখ্যক ব্যবহারকারী, এবং থাকেও পৃথিবীর অনেক ভাষায়। স্রেফ কোরান শরীফের কারনে ক্লাসিকাল আরবি বর্তমানে ডাইগ্লোসিক 'H'-variety-র অন্যতম 'রেজিস্টার' হিসেবে এভাবে অন্তত ১৪০০ বছর ধরে বেঁচে আছে, মরে নাই! সুতরাং ২০০ বছর তো কোন ছার! কিন্তু এই সীমিত ব্যবহারক্ষেত্র 'ভাষামৃত্যু'-র লক্ষণ বা প্রমান না। এটা 'ডাইগ্লোসিয়া'-র লক্ষণ। সাধুভাষাও এইরকম ভাবে কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে এখনও দিব্যি বেঁচে আছে। এটা আপনার উদ্ধৃতির ওল্ড ইংলিশও না, ল্যাটিনের মতও না। বিবর্তিত হতে হতে সম্পূর্ণ নতুন রূপ পরিগ্রহ করেনি বা সন্তানোৎপদন করে নিজে মরে যায় নি। এর কখনই "native speakers" ছিল না - এখনও নাই, ফলে dead language" -এর "no native speakers" এই সংজ্ঞা খাটে না এখানে। তবে "native writers" ছিল, এখনও আছে। সুতরাং এটা 'ডেড' নয়। ফলে 'ল্যাংগুয়েজ ডেথ' টার্মটাও এখানে প্রযোজ্য হয় না। এমনকি ভাষা বলতে যদি এর সব রূপ বা 'ভেরাইটি'-র সমষ্টিকে বুঝি, তাহলে সাধুভাষা আসলে 'ভাষা' বা 'ল্যাঙ্গুয়েজ'-ও না।
আপনার এই প্রশ্নে অনেকগুলি সাংঘাতিক সমস্যা!! প্রথম কথা হলো, আমি কি চাই না চাই তাতে কি আসল গেল? আমরা তো আমার ব্যক্তিগত পছন-অপছন্দ প্রসঙ্গে আলোচনা করছি না। সাধুভাষা মৃত কি জীবন্ত সে প্রসঙ্গে ব্যক্তির ব্যক্তিগত চাওয়া-না চাওয়া, পছন্দ-অপছন্দের কি প্রাসঙ্গিকতা? ভাষা তো একটা গোষ্ঠিগত বা সামষ্টিক সম্পদ, কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি না। যেখানে একটা ভাষাগোষ্ঠির একটা বিশাল অংশ একটা নির্দিষ্ট ভাষারূপ ব্যবহার করছেই, সেখানে আমি সেটাকে অপছন্দ বা ঘৃণা করলেই কি তা মিথ্যা বা নাই হয়ে যাবে? মৃত বললেই মৃত হয়ে যাবে? একটা বাস্তবে চলেফিরে বেড়ানো বেঁচে-বর্তে থাকা মানুষকে আপনি যতই [i]ঘাটের মড়া[/i] , জিন্দালাশ, মামদো ভূত ইত্যাদি বলে গালি দেন না কেন, সে কি ফ্যাকচুয়ালি আসলেই মৃত প্রতিপন্ন বা প্রমাণিত হয় তাতে? বাংলাদেশের অফিস-আদালতে-সংসদে সাধুভাষায় কি পরিমান আইন-কানুন-দরখাস্ত-পিটিশন-কার্যনিবরণী-দলিল-দস্তাবেজ-নথিপত্র উৎপন্ন হয় আপনার জানা আছে? আমার নাই, তবে আমি কোথাও পড়েছিলাম বাংলাদেশে প্রায় ১৩ লক্ষ সরকারী কর্মচারী আছেন (সেইসাথে তাঁদের সরাসরি সেবাপ্রার্থী বা গ্রহীতাদের যোগ করুন এর সাথে!)। পৃথিবীর অনেক 'জাতি' বা 'স্পিচ-কমিউনিটির' মোট জনসংখ্যাও এর থেকে অনেক অনেক অনেক কম! অর্থাৎ সাধুভাষা 'মৃত' না, বরং একটা সাক্ষাৎ, জলজ্যান্ত বাস্তবে চর্চিত বিষয় - ভাল বা মন্দ হোক, কারও পছন্দ হোক বা নাই হোক। এটা বাস্তবতা। আর কোন বাস্তবে অস্তিত্ত্বশীল বা জীবন্ত বিষয়কে আপনি কাল্পনিক ভাবে নাই বা 'মৃত' বলতে পারেন না।
এখানেই আপনার প্রশ্নের ও বক্তব্যের সবচেয়ে বড় সমস্যা আমার মতে। আপনি ব্যক্তিগত মানসিক আশা-আকাঙ্খা-প্রত্যাশ্যা আর বিদ্যমান বাস্তবতার মধ্যে, ফ্যাক্ট ও ফিকশনের মধ্যে - পার্থক্য উপলব্ধি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হচ্ছেন। এই ব্যর্থতা অন্যথায় ইন্টারেস্টিং একটা আলোচনার বড় একটা অংশকে বিপথু ও বিভ্রান্ত করেছে বলেই মনে করি।
শেষ একটি উত্তর -
প্রথমত, 'যাচ্ছিলো' না, এখনও যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। ২য়তঃ না, ব্যবহারিক বা সাহিত্য কোন ক্ষেত্রেই আমি সাধুর ব্যবহার আগের মত করে চাচ্ছি না। কিন্তু এটা সাধুর মৃত্যু কামনাও না, বিদ্যমান বাস্তবতাও না। আর আমি-আপনি না-চাইলেও অনেকেই আছেন যারা কিন্তু কোন কোন ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এর ব্যবহার চান এখনও। তাছাড়া পরিবর্তনশীল ভাষার মত ভাষার সুনির্দিষ্ট কোন রূপের প্রয়োগক্ষেত্রেও পরিবর্তন, পরিমার্জন, সঙ্কোচন-প্রসারণ আসতে পারে - কিন্তু তা এর অবধারিত বা নিকটবর্তী মৃত্যু-সম্ভাবণা বা তার ঔচিত্য প্রমাণ করে না।
যাজ্ঞে, সব দ্বিমত সত্বেও চমৎকার ইন্টারেস্টিং একটা লেখা ও আলোচনার জন্য আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ। ভাল থাকুন।
****************************************
আমার যা যা বলতে ইচ্ছে ছিল, হিমু আর মন-মাঝির মন্তব্যগুলিতে সেগুলি চমৎকারভাবে বলা হয়ে গেছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
সাধু ভাষার একটা সৌন্দর্য্য আছে। সাধু ভাষায় আরো বেশী গল্প লেখা হোক।
বাংলায় স্যাটায়ারের ভাষা হিসেবে সাধু ভাষার শক্তিটা টের পেয়েছি মহামতি মুখফোঁড়ের লেখাগুলো থেকেই
নতুন মন্তব্য করুন