১৪ ডিসেম্বর:
মিত্রবাহিনীর তুমুল আক্রমনে সারা পূর্ব বাঙলায় পাকিস্তানী সৈন্যরা কোনঠাসা হয়ে গেছে।
ভারতীয় বিমানবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর গোলন্দাজরা পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে বিরতিহীনভাবে বোম্বিং করছে।
পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে সকালে গর্ভনর হাউজে পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর ডা: মালিক তার ১১ মন্ত্রী সহ পদত্যাগ করে।
সামরিকভাবে মিত্রবাহিনীর সামনে টিকতে না পেরে ও সকল আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় দুপুরের কিছুটা আগে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তারবার্তা পাঠিয়ে ডা: মালিক ও জেনারেল নিয়াজীকে আত্মসমর্পনের প্রস্তুতি গ্রহণ করার কথা জানায়।
পাকিস্তানীরা নিজেদের পায়ের নিচে মাটি সরে গেছে বুঝে যায়। ডা: মালিক বিকেলে স্বপরিবারের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমানে রূপসী বাঙলা হোটেল) আশ্রয় নেয়।
এদিকে নিয়াজী ও রাও ফরমান আলী নিজেদের পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে মানব ইতিহাসের অন্যতম এক গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়; বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা শুরু করে।
১৫ ডিসেম্বর:
ডা: মালিক আত্মসমর্পনের বিষয়ে আলোচনা করার জন্য নিয়াজীকে হোটেলে ডাকেন কিন্তু নিয়াজী না এসে ঠান্ডা মাথার খুনি রাও ফরমান আলীকে পাঠায়।
ডা: মালিক, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর লিয়াজোঁ অফিসার কর্নেল গফুর, জেনারেল রাও ফরমান আলী, জাতিসংঘের (UNROD) জন কেলী এক আলোচনায় বসে।
আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়-
০১. অবিলম্বে অস্ত্রবিরতি কার্যকর করা ও পূর্ব-পাকিস্তানে সকল বিরুদ্ধতার অবসান ঘটানো।
০২. চারটি মার্কিন গ্যারান্টির ভিত্তিতে পূর্ব-পাকিস্তানের প্রশাসন স্থানান্তরিত হবে; সেগুলো হলো-
ক. পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাবার আগ পর্যন্ত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তা প্রদান।
খ. পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা প্রদান।
গ. পূর্ব-পাকিস্তানে অবস্থানরত অবাঙালি জনগণের নিরাপত্তা প্রদান।
ঘ. সংঘর্ষ চলাকালীন সময়ে পূর্ব-পাকিস্তানে যারা পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থেকেছে, তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ হতে বিরত থাকা।
জন কেলী পূর্ব-পাকিস্তানে নিযুক্ত জাতিসংঘের প্রধান প্রতিনিধি পল মার্ক হেনরীকে জানিয়েছিলেন, আজ পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির কথা বলছে অথচ সপ্তাহখানেক আগে জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগাশাহী যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নাকোচ করে দিয়েছিল।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!
নিয়াজীর সম্মতি সহ সিদ্ধান্তগুলো ইসলামাবাদকে জানানো হয় কিন্তু ইসলামাবাদ প্রস্তাবটি নাকোচ করে দেয়।
বাংলাদেশের কাছে প্রশাসন হস্তান্তর ও আত্মসমর্পন কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না বলে জানায় ইসলামাবাদ।
মিত্রবাহিনীও জানায়- নি:শর্ত আত্মসমর্পন না করলে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হবে না।
এদিকে সারা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা শেষ আঘাত হিসেবে নারকীয়ভাবে বুদ্ধিজীবি ও সাধারণ বাঙালি জনতাকে হত্যা করে।
১৬ ডিসেম্বর:
ইসলামাবাদের গোয়ার্তুমি শেষ পর্যন্ত ধোপে টিকলো না।
অবশেষে বাঘের পোষাকের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিড়াল বেরিযে এলো; মিত্রবাহিনীর কাছে নি:শর্ত আত্মসমর্পন করলো পাকিস্তান।
১৪ ডিসেম্বর মাত্র একদিন আগে জাতিসংঘের (UNROD) জন কেলী আত্মসমর্পনের বিষয়ে পাকিস্তানী জেনারেল রাও ফরমান আলীর সাথে আলোচনা করেছিলেন।
কিন্তু মাত্র একদিন পরে জন কেলী রেডক্রসের মি. ল্যাম্পেল সহ সকাল নয়টার দিকে জেনারেল রাও ফরমান আলীকে আত্মসমর্পন করাতে গেলে তাকে ঠিক চিনতে পারলেন না।
জনকেলীর ভাষায়- জেনারেলের চেহারা ছিল ভীত, ভগ্ন, উদ্ভ্রান্ত।
জনকেলী লেখায় আরো জানা যায়- ভীত পাকিস্তানী জেনারেল রাও ফরমান আলী কাতরভাবে অনুরোধ করছিল যেন আত্মসমর্পনের সময় আরো ছয় ঘন্টা বাড়িয়ে দেয়া হয়।
সকাল সাড়ে দশটার দিকে মিত্রবাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করে। বিকেল সাড়ে চারটায় মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী।
আর এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় বাঙালি জাতির ২৪ বছরের সংগ্রাম, ০৯ মাসের রক্তক্ষয়ী ভয়াবহ যুদ্ধ আর জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাঙালির একমাত্র জাতিরাষ্ট্র "বাংলাদেশের"।
জাতিসংঘের পিটার হুইলার তাঁর বিবরণীতে লিখেছেন- ঢাকায় বাঙালিদের উচ্ছ্বাস এতটাই তীব্র, যেন মনে হচ্ছিল তারা মায়ের বুকে ফিরেছে, ঘরে ফিরেছে।
[ ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭২-এ বিজয়ের এক বছর পূর্তিতে 'বাংলাদেশ অবজার্ভারে' প্রকাশিত সাংবাদিক আবদুর রহীমের কলাম অবলম্বনে ]
________________________________________
সাব্বির হোসাইন।
sabbir.egdnc এট gmail.com
পুরাতন লেখাসমূহ:
একাত্তরে বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড
ফিরে দেখা- বাংলাদেশ (২০০১-২০০৬)- সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতালম্বী নির্যাতন
রানা প্লাজা ও কিছু খেদোক্তি
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দুর্লভ ভিডিও ফুটেজ ও অডিও
মন্তব্য
"এদিকে সারা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা শেষ আঘাত হিসেবে নারকীয়ভাবে বুদ্ধিজীবি ও সাধারণ বাঙালি জনতাকে হত্যা করে।" আর এই কাজে যারা তাদের সহায়তা করল তাদের কতটুকু যে শাস্তি হল!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
এই লেখাটা কি আগের কোন লেখার ধারাবাহিকতার অংশ?
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
না।
বাংলাদেশ অবজার্ভারের ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭২ সংখ্যায় প্রথম বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে সাংবাদিক আবদুর রহীম পাকিস্তানীদের শেষ তিন দিনের কিছু ঘটনার উপর একটি কলাম লিখেন।
সেই কলামে উল্লেখিত ঘটনাগুলো পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে মূলত: এই লেখাটি লেখা হয়েছে।
অনুবাদ বা ভাবানুবাদ ট্যাগ দিইনি, কারন এই লেখাকে অনুবাদ বলা যায় না বরং মূল কলামটিকে তথ্যসূত্র হিসেবে ধরে নিয়ে নিজের মত করে লেখা হয়েছে।
[ সাব্বির হোসাইন ]
দারুণ! চলুক!
-এ এস এম আশিকুর রহমান অমিত
নতুন মন্তব্য করুন