|| ঈশ্বরের অস্তিত্ব ||
একদা বসন্তের এক কাক ডাকা ভোর। বুদ্ধ তার শিষ্য আনন্দকে নিয়ে এক গ্রামে প্রবেশ করলেন। এক ব্যক্তি এসে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঈশ্বর কি আছেন?’ । বুদ্ধ তৎক্ষণাৎ উত্তর করলেন, ‘নেই, অবশ্যই নেই’। অতঃপর স্তম্ভিত জিজ্ঞাসুকে রেখে বুদ্ধ হাঁটতে থাকলেন। সকাল গড়িয়ে অপরাহ্ন। আরও এক ব্যক্তি এসে বুদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইশ্বরের অস্ত্বিত্ব কি আছে?’, বুদ্ধ উত্তর দিলেন, ‘আছে, অবশ্যই আছে’ । তারপর আগের মতই বুদ্ধ এ ব্যক্তিটিকেও পাশ কাটিয়ে আবার হাঁটতে থাকলেন। তারপর পড়ন্ত বিকেল। অপর এক ব্যক্তি এসে বুদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঈশ্বর কি আছেন?’। বুদ্ধ সেই জিজ্ঞাসুর দিকে তাকালেন। তিনি বসে পরলেন ভূমিতে, প্রশ্নকর্তাও বসে পড়লেন। বুদ্ধ তাঁর চোখ দুটো বন্ধ করলেন, প্রশ্নকর্তাও তাঁর চোখ দুটো বন্ধ করলেন। সে ছিল এক নিস্তব্ধ, নিঃশব্দ নীরবতা। সমুদ্র গভীর সেই নীরবতাই যেন উত্তর দিল জিজ্ঞাসুকে। তৃষ্ণার্ত জিজ্ঞাসু যেন মন্থন শুরু করলেন সেই সুগভীর নীরবতার সমুদ্র। প্রশ্নকর্তা এবার তার চোখ মেলে চাইলেন, ‘হে জ্ঞানী, আপনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন। আপনার প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা’।
এদিকে শিষ্য আনন্দে’র বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটছেই না। বুদ্ধ সকালে বললেন ঈশ্বর নেই, দুপুরে বললেন ঈশ্বর আছে, আর সন্ধ্যায়... সন্ধ্যায় কোন উত্তরই দিলেন না! তাহলে প্রকৃত সত্য? সত্যের কি হবে?
রাত্রিবেলা, বুদ্ধ তখন ঘুমাতে যাচ্ছিলেন। আনন্দ তাকে গিয়ে বললেন, ‘হে জ্ঞানী, ঘুমানোর আগে যদি আমাকে আমার প্রশ্নের উত্তর না দেন তাহলে আমিই ঘুমাতে পারব না। আমি সারাদিন আপনার সাথেই ছিলাম। ওই তিন ব্যক্তি প্রত্যেকেই ইশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে একটি করে উত্তর জানে কেবল আমিই জানি তিনটি উত্তর। দয়া করে আমাকে বলুন আসল সত্য কোনটা?’
‘আনন্দ আমি তোমাকে কোন উত্তরই দেই নাই, কারন তুমি আমাকে জিজ্ঞেস কর নাই। সকালের ব্যক্তিটি ছিল একজন বিশ্বাসী আস্তিক, দুপুরের ব্যক্তিটি ছিল একজন অবিশ্বাসী নাস্তিক, আর সন্ধ্যার ব্যক্তিটি ছিল সন্ধিগ্ধ সংশয়বাদী। আমি তাদের ঈশ্বর সম্পর্কে কিছুই বলি নাই, আমি কথা বলেছি স্বয়ং প্রশ্নকর্তার বিষয়ে, ঈশ্বর বিষয়ে কোন কথাই আমি বলি নাই। যে ঈশ্বর বিশ্বাস করে আমি তাকে বলেছি যে ঈশ্বর নেই। এর কারন আমি তার চিন্তাকে মুক্ত করে দিতে চেয়েছি। তার ঈশ্বরের চিন্তা ছিল ‘ধার’ করা, এখানকার বেশীরভাগ মানুষই তার মতন। সে ঈশ্বরকে কখনো অনুভব করে নি, তা করলে আমার কাছে প্রশ্ন করতে হতো না। আর যে ইশ্বর অবিশ্বাস করে আমি তাকে বলেছি যে ঈশ্বর আছেন। এর কারন হল সে ঈশ্বর বিশ্বাস করে না, তাই সে আমার কাছে তার এই বিশ্বাসের পক্ষে স্বমর্থন প্রত্যাশা করছিলেন। তাই আমি এই দুই ব্যক্তিরই বিশ্বাসকে ভেঙে দিয়েছি। মনে রাখবে বিশ্বাস হল প্রতিবন্ধকতা। বিশ্বাস সত্য অনুসন্ধানের পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা। তাই আমি তাদের এই বাঁধাকে চুর্ন করে দিতে চেয়েছি। এবার আস তৃতীয় ব্যক্তিটির কথায়। যার প্রশ্নের উত্তরে আমি ছিলাম নিশ্চুপ, কারন সেই ছিল প্রকৃত অনুসন্ধিৎসু। সে সন্ধিগ্ধ, সে সন্দেহ করতে জানে। ‘বিশ্বাস’ বা ‘অবিশ্বাস’ ; তার কোন ধরণের পুর্ব-বিশ্বাস নেই। তাই তার প্রতি আমি ছিলাম নিশ্চুপ, সেটাই ছিল আমার দেয়া উত্তর। প্রশ্ন করোনা বরং উত্তর খোঁজ! আমি তাকে নিশ্চুপ হতে বলেছি, আমি তাকে খুঁজে নিতে বলেছি। যেমন করে 'সিদ্ধার্থ' বেড়িয়ে পড়েছিল উত্তর খোঁজার জন্য তেমনি করে এই জিজ্ঞাসু তোমাদের মধ্যে 'বুদ্ধ' হয়ে ফিরে আসবে। আমি তাই তাকে কোন ধরণের আধ্যাত্মিক উত্তর দেই নি কারন এ ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তর হয় সহজলভ্য এবং সস্তা। কিন্তু তার প্রয়োজন ভিন্ন রকম স্বাদ, ভিন্ন রকম অনুভূতি; এমন অনুভূতি যা সে স্পর্শ করতে পারে’।
২৪.০৫.২০১৪
ক্ষুদে গল্পঃ ছায়া থেকে লেখা
।। আটকে পড়া সত্য।।
অত্যন্ত প্রাচীন কালে একদিন আমাদের এক রাস্তা দিয়ে শয়তান ইবলিশ এবং তার এক সাগরেদ হেঁটে যাচ্ছিল। যেতে যেতে তারা দেখল এক সাধু পুরুষ এক বট বৃক্ষের ছায়ায় ধ্যানমগ্ন। সেই সাধুর মুখাবয়ব থেকে ঝলমল করে জ্যোতি ঠিকরে বেরুচ্ছিল। কৌতূহলী সাগরেদ ইবলিশকে প্রশ্ন করল, ‘এটা কি ব্যাপার?’। শয়তান হেঁসে উত্তর দিল, ‘ওটা হচ্ছে সত্য। সে এইমাত্র এক খণ্ড সত্যের সন্ধ্যান পেয়েছে’। ‘ওহ!’ হতাশ কণ্ঠে বলল সাগরেদ, ‘এটা আপনাকে বিরক্ত করেনা? এইসব সত্যের সন্ধান আপনাকে চিন্তিত করেন?’। ইবলিশ তাচ্ছিল্য ভরা কণ্ঠে বলল, ‘নাহ। এটা একটা সূচনা মাত্র। চিন্তার কিছু নেই, কারণ এই সত্য কিছুক্ষণ পরেই তার বিশ্বাসে পরিণত হবে।’
১৩.০৬.২০১৪
ক্ষুদে গল্পঃ ছায়া থেকে লেখা।
|| ভাল থাকাই শেষ কথা ||
উত্তর ভারত, ২০০১ সাল। গঙ্গার তীরে ৪০ হাজার মানুষ সমাবেত; হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃস্টান, শিখ, জৈন ইত্যাদি। মঞ্চে উপবিষ্ট আছেন তৎকালীন দালাইলামা এবং বিভিন্ন ধর্মের কয়েকজন বুজুর্গ। সবেমাত্র দালাই লামা তার বক্তৃতা সমাপ্ত করেছেন। একজন দাড়িয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন লাউড স্পীকারে, ‘বুঝলাম বৌদ্ধ ধর্মে ঈশ্বর নাই, তো ঈশ্বর বিষয়ে আপনার চিন্তা কি? ঈশ্বর আছেন না নাই?’
দালাই লামা হাসলেন। পাশে দাঁড়ানো ধর্মগুরুদের হাত চেপে ধরলেন, অতঃপর তাদের হাতকে শুন্যে উঠিয়ে বললেন, ‘ঈশ্বর আছেন কি নেই সেটা আমাদের উপরই ছেড়ে দিন না। আপনি শুধু শিখে নিন কিভাবে শান্তিতে বসবাস করতে হয়। ভাল থাকাই শেষ কথা।
২৭ মে, ২০১৪
ক্ষুদে গল্পঃ ছায়া থেকে লেখা।
সোয়াদ আহমেদ
মেইলঃ
মন্তব্য
"ইবলিশ তাচ্ছিল্য ভরা কণ্ঠে বলল, ‘নাহ। এটা একটা সূচনা মাত্র। চিন্তার কিছু নেই, কারণ এই সত্য কিছুক্ষণ পরেই তার বিশ্বাসে পরিণত হবে।’"
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
অনেক ধন্যবাদ।
ভাল থাকুন
_________
সোয়াদ আহমেদ
চমৎকার ৷
অনেক ধন্যবাদ
ভাল থাকুন
_________
সোয়াদ আহমেদ
এই অংশটুকু জীবনের সব প্রশ্নের উত্তরের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলে মনে করি।
ভালো লেগেছে।
ভালো থাকুন সোয়াদ আহমেদ। শুভকামনা।
-------------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
অনেক ধন্যবাদ
ভাল থাকুন
_________
সোয়াদ আহমেদ
সবগুলোই ভালো লেগেছে, লেখা চলুক…
--আরাফ করিম
অশেষ ধন্যবাদ।
আরও গল্প নিয়ে আসার চেষ্টা থাকবে।
ভাল থাকুন
_________
সোয়াদ আহমেদ।
খুব ভালো লেগেছে। শুধু গল্প না, চিন্তার খোরাক যুগিয়েছে লাইনগুলো।
ভালো থাকুন, শুভেচ্ছা
অশেষ ধন্যবাদ।
ভাল থাকুন
_________
সোয়াদ আহমেদ।
চমৎকার! তিনটি গল্পই চমৎকার।
”বাঁধা” মানে গেরো বা গিট্টু আর ”বাধা” মানে প্রতিবন্ধকতা মানে অবস্টাকল। দুটি শব্দের ভুল ব্যবহার প্রায়ই চোখে পড়ে। হেসে শব্দটির উপর চন্দ্রবিন্দু নাই।
শুভেচ্ছা।
অশেষ ধন্যবাদ।
ভুলগুলো ধরিয়ে দেবার জন্য কৃতজ্ঞতা।
ভাল থাকুন
_________
সোয়াদ আহমেদ।
এটা যেহেতু একটা গল্প মাত্র, তাই আর প্রশ্নের কোন অবকাশ থাকে না। নইলে মহামতি বুদ্ধকে প্রশ্ন করা যেত- অত ঘোরপ্যাচের মধ্যে না গিয়ে সরাসরি বলেন দেখি ঈশ্বর আছেন নাকি নাই?
দুই আর তিন বেশি ভাল্লাগলো!
___________________
রাতের বাসা হয় নি বাঁধা দিনের কাজে ত্রুটি
বিনা কাজের সেবার মাঝে পাই নে আমি ছুটি
অশেষ ধন্যবাদ।
ভাল থাকুন হাসি
_________
সোয়াদ আহমেদ।
কি ভালই না হত, আমরা সবাই যদি মনে রাখতাম এই প্রতিবন্ধকতার কথা, সবার চিন্তা হত মুক্ত!
কিন্তু দিনশেষে কেউই আমরা মনে রাখি না, না আস্তিক, না নাস্তিক, না সংশয়বাদী! সবাই আমরা আটকা পড়েছি নিজেদের তৈরি ঘূর্ণাবর্তে!!!
লেখালেখি চলুক, সোয়াদ আহমেদ!
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
অশেষ ধন্যবাদ।
ভাল থাকুন
_________
সোয়াদ আহমেদ।
চিন্তার খোরাক। পড়ে ভাল লাগল। নিশাচর জীব।
নতুন মন্তব্য করুন