১
আচ্ছা, বাস্তবতার সাথে- রূঢ়, কঠিন বাস্তবতার সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমি কি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি? আজ সন্ধ্যা ছয়টায়, নয়টা-পাঁচটা ক্লান্তিকর একঘেঁয়ে অফিস শেষে রাস্তার ভয়াবহ, দম আটকে আসা জ্যাম পেরিয়ে, শীতের শুষ্ক রাস্তার পরাগরেণুর মত উড়তে থাকা ধূলো গায়ে মেখে অবশেষে আমি যখন আমার একরুমের জীর্ণ আস্তানার সামনে এসে দাঁড়ালাম, তখন রীতিমত ঘেন্না হচ্ছিল এই জন্মটার উপর। কী কুৎসিত এই বেঁচে থাকাটা! অথচ কত জরুরী এই বেঁচে থাকাটাই।
এই বাসার কোন কলিং বেল নাই। সেই সনাতনী কড়া নেড়েই নিজের আগমন জানান দিতে হয়। কড়ায় হাত রাখতে না রাখতেই দরজা খুলে গেল। মাঝে মাঝে অবাক হই। টগর কি শুধু আমার জন্যই অপেক্ষা করে? কোনদিন একমুহূর্তেরও দেরী হয়না। কড়া নাড়লাম কি নাড়লাম না- দরজা খোলা।
“এত দেরী যে?”
নিত্যকার প্রশ্ন। এসময়েই আসবো, জানা কথা। তবুও...। উত্তর দিলাম না। পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়লাম ঘরে। টগর দরজা বন্ধ করে।
“আজকের পেপারটা এনেছ?”
রোজ অফিসের পেপারটা নিয়ে আসি। আজও ব্যাগ থেকে বের করলাম। তারপর ছুঁড়ে ফেললাম বিছানায়। এখন বাথরুমে ঢোকার জন্য লাইনে দাঁড়াতে হবে। বাড়িওয়ালাটা যে কী! তিন তিনটে ভাড়াটিয়ার জন্য মাত্র একটা বাথরুম! কথাটা মনে করেই হেসে ফেললাম। এই ভাড়ায় আর কত!
আচ্ছা টগরের সাথে আমার বিয়েটা কি একটা নিছক দুর্ঘটনা নয়? মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে নিজের মনকেই জিজ্ঞেস করলাম। কে এই টগর? অন্তর দিয়ে তো একে কখনোই আমি চিনি নি, ভালোবাসিনি। কী ভয়াবহ ঘটনা! বিয়েতে কনে বদলের কথা শোনা যায়, কিন্তু বর বদল! হা ঈশ্বর! তাও ঘটলো আমার জীবনে! আর আমার অতি ধর্মপ্রাণ বাবা- ‘সুখ কপালের লিখন, এটাকেই ভাগ্যবলে মেনে নে’ বলে কর্তব্য সারলেন। কী-ই বা করতে পারতেন? যে মানুষটা সামান্য মাইনের চাকুরী করে বিরাট একটা পরিবারের বোঝা টেনে বেড়াচ্ছেন, তাঁর পক্ষে আর কতটুকুই বা করা সম্ভব?
আর এসএসসি পাশ এই আমি, আজ পঙ্গু স্বামীর ভার বয়ে বেড়াচ্ছি। আশ্চর্য! যেদিন এক অচেনা লোক এসে বললো-
“আপনার স্বামী হাসপাতালে, উনি একসিডেন্ট করেছেন।”- সেদিন এই আমি যতটা না প্রাণের টানে, তারও চেয়ে বেশি ভবিষ্যতের জন্য উৎকন্ঠিত হয়ে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলাম।
তারপর একটি হাত ও একটি পা হারানো টগরকে নিয়ে যেদিন আমি বাড়ি ফিরলাম, সেদিন আমি চোখে অন্ধকারও দেখলাম না। ভবিষ্যৎ বলে যে কিছু আছে তাই ভাবতে ভয় হচ্ছিলো। সেই দুর্দিনে পরিবার থেকেও সাহায্য পেলাম না। নিজের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হলো এবং করলাম। একটা অফিসের পরিচারিকা। এসএসসি পাশ একটা মেয়ে আর কী-বা করতে পারে! অফিসের সবার মুখে মুখে আমার নাম-
“রণিতা, এককাপ চা দিয়ে যাও তো।”
“কী ব্যাপার একটা পানের কথা কখন বললাম, এখনো আনতে পারলেনা!”
আর উনি- “এত দেরী কেন?”, “পেপার এনেছ?” হেন তেন বত্রিশটা প্রশ্ন। আমি ক্রমশ তেঁতে উঠি। ঠান্ডা পানিও আর আমাকে ঠান্ডা করতে পারেনা। ঐ অসহায় মুখ আর দেখতে ইচ্ছা করেনা।
আচ্ছা, ইদানীং আমি এত অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি কেন? সেদিন অফিসের নতুন কেরানীটা বলছিল আমি নাকি খুব সুন্দর! ছেঁড়া গামছায় চুল মুছতে মুছতে আমি হেসে ফেলি। সুন্দর...! নাহ্, এটা কারণ নয়। আমি আমার সিদ্ধান্তের কথাটি টগরকে বলতে চাইছি। আচ্ছা আজ বললে কেমন হয়?
“টগর এইভাবে আর সম্ভব নয়। আমি মুক্তি চাই।”
একটা প্রতিজ্ঞা নিয়ে বের হলাম। টগর শান্ত মুখে পেপারটা গিলছে। ভূমিকা না করেই বলে ফেললাম-
“তোমাকে একটা কথা বলা প্রয়োজন।”
টগর অবাক হয়।
“বল।”
আমি দম নিলাম।
“আমি মুক্তি চাই। তুমি...”
কথা আটকে গেল টগরের বোবা দৃষ্টি দেখে। অনেকক্ষণ পর তার মুখে কথা ফিরলো-
“আমিও বুঝতে পারছি তুমি ক্লান্ত। ব্যাপারটা কি জান, আমিও অনেকদিনই ভেবেছি যে চলে যাই যেদিকে দু’চোখ যায়, কিন্তু...” বলে একটু দম নিলো। নিজের কাটা হাত পায়ের দিকে তাকালো। তারপর আবার বলতে শুরু করলো- “কিন্তু সাহস পাইনা, সেটা তোমার জন্যই হোক আর নিজের অসহায়ত্বের কথা ভেবে হোক।” বলতে বলতে একটু বোকার মত হাসলোও।
“কী কান্ড বল তো! নিজের স্বার্থেই আমি তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি।” টগর চুপ করে গেল আমাকে সরে যেতে দেখে।
২
আজ সারাদিন খুব ধকল গেছে। কী একটা মিটীং ছিল। অনেক দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে। অথচ মনে কোন স্বস্তি ছিল না। আজ যদি গিয়ে দেখি আমার কড়া নাড়া শুনে কেউ দরজা খুলছেনা, যদি এই ক্লান্ত আমাকে কেউ জিজ্ঞাসা না করে- “এত দেরী হল যে?”, যদি অসহায় নত মুখটি থেকে না শুনি “পেপার এনেছ?”- তাহলে, তাহলে কী হবে?
আশ্চর্য! শুধু কি তার আমাকে প্রয়োজন? আমার কি তাকে একটুও প্রয়োজন নেই? তার জন্যই তো আজ আমার একটা সামাজিক নিরাপত্তা আছে। সেই তো ঐ একটা হাত আর একটা পা নিয়ে ধুকে ধুকে আমার জন্য বাজার করে নিয়ে আসে। রান্না করে দুপুরের খাবার সাজিয়ে রাখে। তাকে দেখেই কি অফিস ফেরত ক্লান্ত এই আমি একটা সুখ নিঃশ্বাস ফেলি না? তাহলে? একটা স্বার্থের সম্পর্কে তো বটেই; সাথে সাথে সূক্ষ্ণ একটা মানসিক সম্পর্কেও তো তার সাথে আমি জড়িয়ে গেছি। একে উপেক্ষা করে হুট করে আমি মুক্তি চাই বলাটা কি এতই সহজ! অথচ কাল... না না। একটা প্রবল অপরাধবোধে আমি আক্রান্ত হই।
দুর্ভাবনায়, দুশ্চিন্তায় নিঃশেষ হয়ে, সন্ধ্যায় যখন ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম, তখন কিন্তু অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশী সময় গড়িয়ে গেছে। এই শীতের সন্ধ্যায়ও এত কেন ঘামছি? কাল রাতে ওকে ঘুমাতে দেখি নি। আজ সকালেও দেখলাম চোরের মত চুপচুপ করে চলাফেরা করতে। যখন বের হচ্ছি, তখন কি যেন বলতে গিয়েও বলেনি।
হাত কড়ার উপর রাখার সাথে সাথেই যখন দরজাটা খুলে গেল, তখন একটা অদ্ভুত স্বস্তির অনুভূতি হল আমার। বোধহয় তারই আবেশে এক টুকরো হাসি আমার চোখেমুখে খেলে গেল; যা অনেকদিন ধরেই আমার মুখে ছিলনা। আমি হাসতে হাসতেই বললাম-
“আজ একটু দেরী হয়ে গেল।”
বিস্ময় মেশানো ভয়ার্ত দৃষ্টিতে টগর আমাকে দেখতে লাগলো। আমি ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে একটা নির্ধারিত প্রশ্ন আশা করছিলাম। প্রশ্নটা না পেয়ে শেষে নিজেকেই বলতে হল-
“এই নাও তোমার পেপার।”
Nahid Nipa
মন্তব্য
বাহ!
-- ঘুমকুমার
বাহ! বেশ ভালো লেখেন তো আপনি!
পাঠকের আন্দাজ ছিল, টগর বাসা থেকে চলে যাবে; গতানুগতিভাবে শেষ হয়নি গল্পটা।
আপনি কি এখন হিলসবরোতে থাকেন?
তিন চতুর্থাংশ পেরোবার পর গল্প ক্লাইম্যাক্সে উঠতে হবে কে বলেছে? কী সুন্দর সাইন কারভের মতন উচ্চতায় উঠে আবার হালকা ভাবে নেমে গেল। পড়ে আরাম পেয়েছি।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
শিশিরকনার এই মতটুকু আমারও, হয়ত তার মত করে বলতে পারতাম না, তাই ধার নিতে হল!
অদ্ভুত মুন্সিয়ানা রয়েছে আপনার গল্পে, শুধু পরিচারিকা না বানালেই হত! সেক্ষেত্রে সামান্য যেটুকু ঘাটতি চোখে পড়েছে, তাও হয়ত থাকত না।
পরের গল্পটি পড়ার জন্য প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি।
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
অসাধারণ আপনার লেখা। সত্যি, গল্পের শেষটা মন ছুঁয়ে যায়। সচলায়তনে পড়া আমার ভাল কিছু গল্পের একটা। আমি সাধারণত critical কমেন্ট করি; কিন্তু এই লেখা পড়ে শুধু বলব, ধন্যবাদ। নিশাচর জীব।
গল্প লেখা চলুক।
চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহার নিয়ে একটু নজর দেয়া যাবে কি? যেমন,
একঘেঁয়ে --> একঘেয়ে
তেঁতে --> তেতে
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
দারুণ! ভাল লাগল।
এ এস এম আশিকুর রহমান অমিত
গল্প ভাল লেগেছে।
লেখকের নিরবতা ভাল লাগেনি।
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
টগরকে যে গল্পের স্বার্থে জগত ছাড়তে হয় নাই সেই বা কম কী?
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
হ আমরাই তাড়াতাড়ি কাটি চলেন
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
নতুন মন্তব্য করুন