অরগ্যানিক ইলেক্ট্রনিক্সঃ ভবিষ্যতের পরশ পাথর (পর্ব-৬, শেষ পর্ব)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২০/০৭/২০১৪ - ৯:১৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শেষ পর্ব নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হতে অনেক দেরী করে ফেললাম; নিত্যদিনের যান্ত্রিকতা তো আছেই, তার উপর গেল বিশ্বকাপ। কি করি বলুন! আশাকরছি এই লেখাটা পড়ে অপেক্ষা করে থাকার ক্ষোভটা বেমালুম ভুলে যাবেন।

পিছনের পর্বগুলো এখানে সাজানো পাবেন চমৎকার ভাবে, ধন্যবাদ সচলায়তনকে।

শেষের শুরুটা তাহলে শেষ করে ফেলা গেল, আসুন তাহলে শেষের শেষটা নিয়ে লেগে পরি।

এই সিরিজের পর্বগুলো পড়ে মনে হয় সবার মনে এমন ধারণা গেঁথেই গেল যে, এই অরগ্যানিক ইলেকট্রনিক্স সিলিকন ইলেকট্রনিক্সের বিকল্প, আর তাই এরা পরষ্পরের জাত-শত্রু ধরনের কিছু; সিলিকনকে সরিয়েই এই অরগ্যানিক ইলেকট্রনিক্স/পলিমার ইলেকট্রনিক্সের রাজত্ব কায়েম করতে হবে। কথাটা অবশ্যই আংশিক সত্য, তবে পুরোপুরি সত্য নয়। এটা বুঝতে হলে আমাদের সিলিকন রাজত্ব আর তার ব্যবহারিক দিকগুলোর দিকে তাকাতে হবে, আর সেই সাথে দেখতে হবে অরগ্যানিক ইলেকট্রনিক্স কতটা ঐসব ক্ষেত্রগুলোতে ব্যবহার্য, সিলিকনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হলে তার উপযোগিতা কতটুকু। কিংবা নতুন কোন কোন ক্ষেত্রে একে কাজে লাগানো যায় যেখানে সিলিকন ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

ধরুন ডিসপ্লে প্রযুক্তি, টিভির কথাই চিন্তা করুন। একটা সময়ের ঐ পেটমোটা পিকচার টিউব আপনি এখন আর কোন যাদুঘরেও খুঁজে পাবেন না। সিলিকন দিয়ে তৈরী ব্যাকপ্যানেল আর সমান্তরালে এগিয়ে যাওয়া মাইক্রোচিপ প্রযুক্তি ও এলইডি/এলইসি এর মত পিক্সেল-বেজড প্রযুক্তি ঐ পিকচার টিউবকে যাদুঘরে পাঠিয়েছে। আর তার কারণেই টিভি ছাড়াও অন্যসব ডিসপ্লে, যেমন কম্পিউটারের মনিটর, ডাক্তারদের অপারেশন বা প্যাথলজীর জন্য বিশেষ রকম মনিটর, গাড়ির ড্যাশবোর্ড, এডভারটাইজমেন্ট প্যানেল ইত্যাদি যত ধরনের ডিসপ্লের কথাই আপনি মনে করতে পারছেন, তার সবগুলোরই 'বিষ্ফোরন' হয়েছে গত দু/তিন দশকে। পাল্লা দিয়ে কমেছে এসব ডিসপ্লের আকার, পাতলা হতে হতে আমরা এখন দেখতে পাই মাত্র ৪/৫ সেন্টিমিটার পুরু টিভি বা মোবাইল। আবার, মোবাইলের কিপ্যাড থেকে দেখুন এই টাচস্ক্রিনে উন্নতিকরণ হলো এই সেদিন; আপনি যদি এখন নিম্নমাধ্যমিকের ছাত্রও হন, তারপরও আপনার ভালই মনে থাকার কথা ঐ সেদিনকার কিপ্যাডওয়ালা শুরুর দিককার মোবাইল সেটগুলোর কথা। বাজার চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে মাত্র কয়েক বছরে টাচস্ক্রিন প্রযুক্তি এখন ঈর্ষণীয় উচ্চতায়। আর এসব কারণেই বিভিন্ন মাপের ডিসপ্লে ডিভাই্স, যেমন ধরুন, মোবাইল, প্যাড, ল্যাপটপ (আরও কত কি!) বাজারে হুমড়ি খেয়ে পরলো গত বছর দশেকে।

যাক, একটিবার ভাবুন তো! এসব নতুন নতুন হাজার রকমের আকর্ষণীয় ডিসপ্লে ডিভাইসগুলোর উপযোগিতা কতটুকু হত যদি না এগুলো ইন্টারনেট সংযুক্ত না হত? বলতে চাচ্ছি এই যে, কম্পিউটার প্রযুক্তি যেমন রম, র‍্যাম, মেমোরী ক্যাপাবিলিটি ইত্যাদির উন্নতির সাথে সাথে ইন্টারনেট প্রযুক্তি যেমন ফাইবার অপটিকস, তারহীন প্রযুক্তি, ওয়াইফাই, নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন ইত্যাদির অভাবনীয় উন্নতি এই ডিসপ্লে প্রযুক্তিকে আজকের এ অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে। এই সিলিকনকে ঘিরে গড়ে ওঠা প্রযুক্তি গত মাত্র ২০ বছরে পৃথিবীর চেহারাটাই আমূল পাল্টে দিয়েছে এবং প্রতিনিয়তই দিচ্ছে। ৮৫/৯০ থেকে ২০১৪, মাত্র বছর পঁচিশ/ত্রিশের মধ্যে সিলিকনকে ঘিরে অন্যসব জ্ঞানের শাখাগুলো, যেমন কম্পিউটার, টেলিকমিউনিকেশন, টাচস্ক্রিন, এলইডি/এলইসি ইত্যাদি কেমন তরতর করে উন্নতি করে ফেললো! বেঁচে থাকার জন্যে সত্যিই খুব দারুন একটা সময়, তাই না?

এ ফাঁকে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। একটু ভাবুন তো, এই অভূতপূর্ব উন্নতির কারণটা কি? অনেককিছুর কথাই বলা যায় কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে গবেষণার জন্যে প্রয়োজনীয় টাকা এবং গবেষণার স্বাধীনতা। টাকাওয়ালাদের কাছে এই প্রযুক্তির ভবিষ্যত চাহিদা আর সে হিসেবে মিলিয়ন/বিলিয়ন অঙ্কের লাভটা সফলভাবে তুলে ধরা হয়েছিল এর শুরুতে; তাই তারা টাকা ঢেলেছে এর গবেষণায়; পাল্লা দিয়েছে এবং দিচ্ছে একে অপরের সাথে। বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলতে গেলে পুরোটাই নির্ভর করে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে গবেষণাবাবদ টাকাপ্রাপ্তির উপর। গবেষণাতে অনেক অনেক টাকা লাগে। বলতে চাচ্ছি, এই ডিসপ্লে প্রযুক্তির উন্নতির দিকে তাকিয়ে সহজভাবে একটা উপসংহার টানাই যায়ঃ এমন টাকা পেলে অন্য অনেক গবেষণাই ২৫/৩০ বছরে এমন তাক লাগিয়ে দিতে পারে, তা শরীরবিদ্যা-মেডিসিনের গবেষণাতেই হোক কিংবা মহাকাশ-মহাবিশ্বের গবেষণা, যাই হোক না কেন!

যাক গে, আসল কথায় ফিরে যাই। এ পর্যায়ে কল্পনাশক্তির পরীক্ষা দিয়ে ফেলুন না হয় একটু! আপনি আজ এই ২০১৪ তে দাঁড়িয়ে ডিসপ্লে প্রযুক্তিকে ২০২৫-এ কোথায় দেখতে পান? কেমন হবে আপনার কপ্লনার ২০২৫? পৃথিবী এরইমধ্যে আক্ষরিকভাবেই হাতের মুঠোয়। আপনি থ্রিজি/ফোরজি প্রযুক্তিতে বাসে বসে থেকেই দেখে ফেলছেন মালয়েশিয়ান বিমানটার দুঃখজনক পরিণতি (আর পাশের অতিউৎসাহী ভদ্রলোকের 'ব্যাবাকঅই আম্রিকার ষরযনতর' ধরনের মন্তব্যও শুনে ফেলছেন প্রযুক্তির উপরিপাওনা হিসেবে)। আরও দ্রুতগতি হবে ইন্টারনেটের? মোবাইলটার আকার আরও ছোট করতে চান? কিংবা ভয়েস কমান্ড, যেটা এখনই আছে, যেমন গুগোলের ভয়েজ সার্চ বা মোবাইলের ভয়েজ ন্যাভিগেশন, সেটাকে শক্তিশালী করতে চান আরও? কিংবা রেটিনা নেভিগেশন? চোখের চশমাটাতে জিপিএস এর ম্যাপটা দেখতে চান? বা ছবি তুলতে চান চশমা থেকেই আর ততক্ষণাৎ তা শেয়ার করতে চান সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে? মোবাইলের বিভিন্ন এ্যপ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চান বাসার লাইট, চুলা বা ফ্রিজ? এগুলো সবই পরবর্তী সম্ভবনাময় প্রযুক্তি। আশা করা যায়, এগুলো হবে ২০২৫ নাগাদ, হবে হয়ত আরও অনেক কিছুই। ডিসপ্লের কথা মাথায় রেখে বলা যায়, যেগুলো হওয়ার সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি সেগুলো হচ্ছেঃ

১/ বড় আকারের বাকাঁনো সম্ভব এমন স্ক্রিন/টিভি, যেমন ৮০ বা ১০০ ইন্চির। পাওয়া যাবে খুবই উন্নত রেজ্যুলেশন, যাকে বানিজ্যিকভাবে বলা হচ্ছে আল্ট্রা-হাই-ডেফিনিশন; থাকবে চার হাজারেরও বেশি রঙ ও অত্যাধুনিক কালার কন্ট্রাস্ট এবং বাকাঁনো স্ক্রিনের জন্য পাওয়া যাবে অনেক ভাল ভিউইং আঙ্গেল।
২/ স্বচ্ছ ও বাকাঁনো সম্ভব এমন আরও হালকা মোবাইল সেট। যেটাতে যাবতীয় সুবিধাদি তো থাকবেই আর তার সাথে সংযুক্ত হতে পারে সৌরকোষ।
৩/ ফ্রিজ, গাড়ির কাঁচ, আয়নার কাঁচ ইত্যাদি স্ক্রিনের মত হতে পারে। তার সাথে সংযুক্ত থাকতে পারে ইন্টারনেট আর তাই সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে মোবাইল/নোটপ্যাড থেকেই।
৪/ হতে পারে ই-পেপার; এটি কাগজ বা প্লাস্টিকের মত দেখতে এ-ফোর আকারের স্বচ্ছ, বাকাঁনো সম্ভব একটি ডিসপ্লে ডিভাইস। এর সাথে সংযুক্ত থাকবে ইন্টারনেট আর সেই সংযুক্তির কারণে প্রতিদিনকার খবরের কাগজ পড়ে ফেলা বা খবরের ভিডিওটা দেখে ফেলা যাবে খুব সহজেই।

তালিকা আর বাড়াচ্ছি না; এখানেই থামি। তবে যখনই এই বাঁকানো, বা স্বচ্ছ বা কাঁচ, ফ্রিজের মত কোন কিছুকে স্ক্রিনে রুপান্তরের কথা আসছে, তখনই আর সিলিকন দিয়ে হচ্ছে না। আর সেখানেই এই পলিমার ইলেকট্রনিক্সের ভবিষ্যত। এরই মধ্যে বেশ কিছু নমুনা বাজারে চলে এসেছে; আরও আরও নতুন নতুন চমক আসার অপেক্ষায়। আগ্রহীরা এলজি এর খবরের এই লিঙ্কটা আর স্যামসাং এর সিইএস-২০১৪ এর এই রিপোর্টটাতে ঢু মেরে দেখতে পারেন। (খেয়াল করে দেখবেন, এরা ওএলইডি এর কথা বলছে। এই ওএলইডি হচ্ছে অরগ্যানিক এলইডি।)

তো লাখ টাকা দামের প্রশ্নটা এখন আপনি করতেই পারেন? 'এত এত কিছু তো এর মধ্যেই আছে, আরও রেজ্যুলেশন, হাই, আল্ট্রা-হাই, আল্ট্রা-আল্ট্রা-হাই ইত্যাদি আমরা কোন চুলায় দেব? এসবের আর দরকারটা কি?' খুবই সত্যি কথা। উপযোগিতা কখন বিলাষিতা হয়ে যায়, টের পাওয়া মুশকিলই বটে। বিশেষ করে এত এত নতুন নতুন 'কুল' সব জনিসপত্রের ছড়াছড়িতে প্রয়োজনটাকে স্ট্যাটাস, বিলাষিতা থেকে আলাদা করাটা বেশ কষ্টসাধ্যই বোধকরি। সে যাই হোক, আপনাকে শান্ত করার জন্যে বলতে পারি, এই নতুন প্রযুক্তির উৎপাদন ব্যয় এখনকার সিলিকন প্রযুক্তির অর্ধেকেরও কম। তাই, এখন কিংবা শুরুতে এসব ডিসপ্লে/টিভির দাম আকাশছোঁয়া হলেও অরগ্যানিক ইলেকট্রনিক্স প্রযুক্তি এমন যে তা যদি বড় আকারে কারখানাতে উৎপাদন করা সম্ভব হয়, তাহলে এগুলোর দাম বর্তমানের দামের চেয়ে অর্ধেকে বা তারও কমে নেমে আসবে। তবে জানিয়ে রাখি, কারখানাতে তৈরী করার মত অবস্থা এখনও এই প্রযুক্তির হয় নি; এখনও এটা পরীক্ষাগারেই সীমাবদ্ধ বলা যায়। তবে এর সম্ভবনার কথা বুঝতে পেরেই ছোট্ট আকারে হয়ত বড় বড় কম্পানী যেমন এই স্যামসাং বা এলজি শুরু করেছে বা করতে যাচ্ছে এর বানিজ্যিকিকরণ। তাই এদিকটার ভবিষ্যত সে অর্থে ভালই বলা যায়।

এতো গেল, 'কুল' সব বাজার মাতানো সামগ্রীর কথা। আগের পর্বে বলেছিলাম, সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে আমাদের এই অরগ্যানিক ইলেকট্রনিক্সের গবেষণাটা খুবই জরুরী। অবাক হয়ে নিশ্চয় ভাবছেন, এ বেকুব বলে কি! বাকাঁনো টিভি বা স্বচ্ছ মোবাইল না হলে সভ্যতা টিকবে না!!! সভ্যতা টিকিয়ে রাখার জন্য এই 'কুল' ডিভাইস লাগবে!! না, ঠিকই ধরেছেন। তা অবশ্যই লাগবে না। টিভি না হলে কিচ্ছুটি হবে না, গাড়ি না হলেও চালিয়ে নেয়া যাবে কিন্তু সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে লাগবে দুটো জিনিসঃ প্রথমত লাগবে শক্তি আর দ্বিতীয়ত লাগবে মানুষের বসবাসযোগ্য এই আদরের ধরণীটিকে টিকিয়ে রাখা। আসল কথায় আসি তাহলে।

আজকের এই মূহুর্তে আমাদের এই ধরণীতে যত সংখ্যক মানুষ আছে তা এই ধরণীর ৫ মিলিয়ন বছরের ইতিহাসের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি। আজকের এই মূহুর্তে সেসব মানুষগুলো যে পরিমান শক্তি খরচ করছে, তা তেল বা কয়লা পুড়িয়েই হোক বা পানির ধারাকে বাঁধ দিয়েই হোক, তা এর ইতিহাসের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি। এমনকি সঠিকভাবে বললে, তা গতকালকের চেয়ে বেশি। এবং এটা বেড়েই চলেছে। এর মানে হচ্ছে দুটো। সেটা বুঝতে হলে আপনাকে আইনস্টাইন হতে হবে না, শুধু রাজনীতিবিদ না হলেই চলবে। প্রথমত এর মানে হচ্ছে, গতকাল যেটুকু শক্তি ছিল, আজ আছে তার থেকে কম। কাল থাকবে আরও কম। শক্তি ক্রমে ক্রমে কমেই যাচ্ছে। আর দ্বিতীয়ত এর মানে হচ্ছে, এই শক্তি খরচের ফলে ভয়ংকরভাবে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে পরিবেশে। কাল যতটুকু বেড়েছিল, আজ বাড়লো আরও বেশি। ক্রমে ক্রমে তা বেড়েই যাচ্ছে। আর এই দুটো 'মানবিক বোকামি'র চড়া মূল্য দিয়ে যাচ্ছে আমাদের এই সাধের পৃথিবী; যা কিনা আমাদের জানামতে, অন্তত ৭০ আলোকবর্ষ পরিধির মধ্যে এক ও একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহ। এই ধরণীমাতা কিন্তু আর পেরে উঠছে না! আমাদের সময়ের মাপকাঠিটা খুবই আজব! ব্যক্তি অভিজ্ঞতায় বড়জোড় ১০০ বছর গুণতে পারি আমরা। মাত্র ১০০ বছর! তাই আমাদের কাছে ঐ কবেকার ডাইনোসর বিলুপ্তির ঘটনা যেমন রূপকথার মত মনে হয় তেমনই পাগলা বিজ্ঞানীদের আগামী ১৫০ বছর পরের ভবিষ্যত্বাণীগুলোকে একইরকম ফালতু মনে হয়; মনে হয় এইসব গ্লোবাল ওয়ার্মিং ইত্যাদি ঐ পাগলদের পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই না।

তাহলে কি এর কোন সমাধান নেই? আছে, সহজ সমাধানই আছে। প্রথমত, যত জলদি সম্ভব বিকল্প শক্তির ব্যবস্থা করা আর দ্বিতীয়ত, সেটা এমন হওয়া যা পরিবেশে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছড়াবে না। এগুলোকে বলছে গ্রিন এনার্জি বা অল্টারনেটিভ এনার্জি বা ইনভারনমেন্ট ফ্রেন্ডলি এনার্জি ইত্যাদি।

এখন আপাত এই সহজ সমাধান হাতের মুঠোয় আছে যেহেতু, সেহেতু বিজ্ঞানীরা কেন কিছু করছে না-বলে তাদের আবার গালাগালি শুরু করে দেবেন না যেন। আসুন, একটু বোঝার চেষ্টা করি। আপাত এই সহজ সমাধান কিন্তু সহজ নয়! চিন্তা করুন তো, বিকল্প শক্তি কি হতে পারে? কিংবা, শক্তি উৎপাদনের এমন কেমন ব্যবস্থা হতে পারে যেখানে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছড়াবে না? উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এমন একটা চমৎকার বিকল্প শক্তি হচ্ছে পানির প্রাকৃতিক প্রবাহ। তাকে বাঁধ দিয়ে উপর থেকে নিচে ফেললে ঐ মাধ্যাকর্ষণ জনিত শক্তি দিয়ে একটা বড়সর চরকা ঘুরানো যায়। আর তার থেকে চুম্বককে কাজে লাগিয়ে বৈদ্যুতিক শক্তি পাওয়া যায়। এতে পরিবেশে কার্বন-নিঃসরণ হয় না, হলেও তা অনেক কম বা সহনীয়। আমাদের কর্ণফুলীতে এমনই একটা পানিবিদ্যুত কেন্দ্র আছে; যদিও সেটা প্রাকৃতিক ছিল না, বাঁধ দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল। (আর তাতে ভিটে ছাড়া হয়েছিল কয়েক লাখ পাহাড়ি মানুষ। এর ফলেই কিন্তু তৈরী হয়েছিল আজকের আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা, কাপ্তাই লেক। আগ্রহীরা তানভীর মোকাম্মেলের চলচিত্র 'কর্ণফুলীর কান্না' (বাংলাদেশে নিষিদ্ধ) দেখে নিতে পারেন)।

তো, যে বিকল্প ও সবুজ শক্তির কথা বলছি, তার একটা দারুন উৎস হচ্ছে সূর্য। প্রতিদিন যে পরিমান আলো ও তাপ নিয়ে সূর্যরশ্মি আছড়ে পরে পৃথিবীতে, তাকে কাজে লাগাতে পারলে তা হবে আমদের প্রয়োজনের তুলনায় ঢের ঢের বেশি। তাহলে, এটাকে কি করে কাজে লাগানো যায়? বেশ কয়েক ভাবেই কাজে লাগানো যায় আসলে। যেমনঃ সূর্যের আলো, মানে কিনা যাকে খটমট ভাষায় বলে, ফোটন, তাকে ফটোইলেকট্রিক প্রক্রিয়াতে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তর করা যেতে পারে (সৌরকোষ)। কিংবা, গাছের মত ঐ ফোটনকে কাজে লাগিয়ে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াতে রাসায়নিক শক্তি পাওয়া যেতে পারে (কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষণ)। আবার, সূর্যের তাপকে কাজে লাগিয়ে পানিকে বাষ্পীভূত করে সেখান থেকে বৈদ্যুতিক শক্তি পাওয়া যেতে পারে (সৌর-বাষ্প) ইত্যাদি। আবার, অন্যসব 'অসীম' উৎস, যেমন সমুদ্রের পানি বা বাতাস (উইন্ডমিল ইত্যাদি) বা কারখানাতে উৎপাদিত তাপশক্তিকে পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি সবুজ শক্তি নিয়েও গবেষণা চলছে।

যাইহোক, আমাদের প্রাণভভোমরার কথায় ফিরে আসি। এই প্রাণভভোমরা দিয়ে তৈরী করা যায় সৌরকোষ। সূর্যকে কাজে লাগিয়ে এটি তৈরী করতে পারে শক্তি; আর এই প্রযুক্তির রয়েছে অপার সম্ভবনা। গবেষণার প্রয়োজনীয় চালান পেলে এটি সারা বিশ্বের শক্তি-চাহিদার শতকরা বিশ/ত্রিশ ভাগ পূরণ করতে পারবে আসছে ভবিষ্যতে-এমনটিই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা, খুব আত্মবিশ্বাসের সাথেই তারা বলছেন সে কথা। তবে তা সহজসাধ্যও নয়। গতপর্বে যেমনটা বলেছিলাম, এদিকটার গবেষণা আসলে মাল্টি-ডিসিপ্লিনারী আর তাই সমন্বয় একটা বড় বাধাঁ। তার উপর প্রয়োজনীয় টাকা, আর সেটা আনুদানকারীর থেকে যোগাড় করা তো মহাভারত জয় করার মত। এরপর আছে ঐসব অনুদানকারীর সামনে আশানুরূপ ফলাফল তুলে ধরা, একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। সেটাও অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ।

যাই হোক, শেষ করে ফেলছি এই পর্ব, এই সিরিজ। শুরুর দিকে যেমন বলছিলাম, গবেষণার টাকা আর স্বাধীনতা পেলে এই অরগ্যানিক ইলেকট্রনিক্স তাক লাগিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে, যেটা ডিসপ্লে প্রযুক্তিতে আসছে ভবিষ্যতেই দেখা যাবে। কিন্তু খুবই দুঃখের আর আফসোসের বিষয় হচ্ছে এই যে, শক্তি উৎপাদনের গবেষণায় তেমন টাকা বা স্বাধীনতা বা আগ্রহ পাচ্ছে না এই অরগ্যানিক ইলেকট্রনিক্স। মিলিয়ন/বিলিয়ন অঙ্কের হিসেব নেই যে সেখানে! আর টাকা আর ক্ষমতাওয়ালা তেল-গ্যাসের মালিকরা তো আর চাইবে না এমন কিছু হোক যেটার কারণে তাদের লাভের অঙ্ক কমে যায়! সেদিকটা তাই অবহেলিতই থেকে যাচ্ছে, যেটা আসলে গুরুত্ব পাওয়া উচিৎ সবচেয়ে বেশি। তারপরও একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, অপার সম্ভবনার এই নতুন ইলেকট্রনিক্স, আমাদের সাধের প্রাণভোমরা, ভবিষ্যতে পাল্টে দিতে যাচ্ছে আমাদের জানা দুনিয়ার চেহারাটা, পুরোপুরি।

যেতে যেতে কার্ল স্যাগানের একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যাই। স্যাগান খুব আক্ষেপের সাথে বলেছিলেন, ''We live in a society exquisitely dependent on science and technology, in which hardly anyone knows anything about science and technology.'' ব্যক্তিগতভাবে আমারও খুব দুঃখ হয় আশপাশের এসব মানুষগুলোকে দেখে যারা সবাই পুরোপুরিভাবে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল কিন্তু তার সম্বন্ধে ছিটেফোঁটাও ধারণা রাখে না। নূন্যতম কৃতজ্ঞতাটুকু দেখায় না ঐসব মানুষ ও তাদের মেধার প্রতি যাদের জন্য এই মাত্র দশ বছর আগেও ৫/৭ জনকে জিজ্ঞাসা করে, ১০ গলি ঘুড়ে একটা ঠিকানায় পৌঁছাতে হত আর এখন হাতের জিপিএসটা দেখিয়ে দেয় চলার পথ, পৌঁছে দেয় গন্তব্যে। আশার কথা এই যে, এমন করেই চলার পথ দেখিয়ে দিয়ে যাবে পাগলা মানুষগুলো যুগ যুগান্তরে, কারো কোন কৃতজ্ঞতার তোয়াক্কা না করেই। আর আপনার মত পাঠকের এমন আগ্রহেই তৈরী হবে বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ, তৈরী হবে ভবিষ্যতের পাগলা বিজ্ঞানী।

ধন্যবাদ সবাইকে। ভাল থাকুন।
-স্বপ্নচারীর স্বপ্ন


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলার পথ দেখিয়ে দিয়ে যাবে পাগলা মানুষগুলো যুগ যুগান্তরে, কারো কোন কৃতজ্ঞতার তোয়াক্কা না করেই। আর আপনার মত পাঠকের এমন আগ্রহেই তৈরী হবে বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ, তৈরী হবে ভবিষ্যতের পাগলা বিজ্ঞানী।

হাততালি সাব্বাস, হুয়াট'স কামিং আপ নেক্সট?

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ সত্যানন্দদা হাসি
ঠিক বুঝলাম না কিন্তু! আমার লেখা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলেন এরপর কি নাকি অন্য কিছু জানতে চাইলেন?
-স্বপ্নচারীর স্বপ্ন

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হ, সিরিজ শ্যাষ কইলেন না? তাই জিগাইলাম এরপর কি? হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

দেখি, এরপর আসলে কি! চোখ টিপি
অবশ্যই চেষ্টা করবো আবার নতুন কিছু নিয়ে হাজির হতে হাসি
ভাল থাকুন।
-স্বপ্নচারীর স্বপ্ন

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ মেঘলা মানুষ হাসি আপনার মন্তব্যের অপেক্ষাতেই ছিলাম। আর এমন দারুন মন্তব্য করে আফসোস ঘুচিয়ে দিয়েছেন এক্কেবারে !

যাক, প্রথমত, দ্বিমত করার কিছুই নেই আপনার সাথে। 'টাকা ঢাললেই চমৎকার সব গবেষণার ফলাফল বেরিয়ে আসবে‌' অত পাগল হই নি এখনও হাসি তবে ফান্ডিং টা যে অনেক জরুরী সেটা বোঝানোর জন্যেই অমন করে বলা আর কি!

দ্বিতীয়ত, কন্সপেরেসি থিওরীর কথা বললেন, সেখানে একটু বলতে চাই। সোলিন্ড্রা'র কথা জানতাম না, সেটা তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ। ঠিক কন্সপেরেসি হয়ত না তবে এটা তো 'ওপেন সিক্রেট' যে কোন খাতে টাকা ঢালা হবে না হবে, কতটা হবে, কি ফলাফল চিন্তা করে টাকাটা ঢালা হবে সেটা দিন শেষে প্রায় পুরোটাই তো টাকাওয়ালাদের উপর নির্ভর করে! বিজ্ঞানীদের কান্নাকাটির তো খুব একটা দাম নেই! গ্রেস পিরিওড কেউই অনন্তকাল পাবে না, খুবই সত্যি কথা আর ফলাফল ডেলিভারী না দিতে পারলে সেটা কমতে কমতে শুন্যও হয়ে যাবে একদিন, সেটাও সত্যি। কিন্তু একটা বিষয় একটু চিন্তা করুনঃ

১/ উদাহরণ হিসেবে বলছি, তেল/গ্যাস সণাক্তকরণের জন্য যে গবেষণা বা তেল/গ্যাস উত্তোলন ও শোধনের জন্য যে গবেষণা (তা পানির নিচেই হোক বা মাটিতে), সেসবে তেল কম্পানীগুলো যে টাকা ঢালছে, তার কত ভাগ নতুন বিকল্প শক্তির জন্য তারা ঢালছে? এমন না যে এই তেল/গ্যাসের দিকটাতে প্রতিষ্ঠিত জ্ঞান নেই! যথেষ্টই আছে, খুব ভাল ইইল্ড পাওয়া যাচ্ছে এখনকার প্রযুক্তিতেই কিন্তু তা আরও সস্তায় কি করে পাওয়া যায়, আরও ইইল্ড কি করে পাওয়া যায়, আরও এফিসিয়েন্সি কি করে পাওয়া যায় ইত্যাদির জন্য গবেষণায় টাকা ঢালা কিন্তু বেশ চলছে! 'আমার কাছে কোন তথ্য নেই' (চোখ টিপি) যদিও, তবে সাধারণভাবে বলতে পারি, ঐ একই কম্পানী বিকল্প শক্তির জন্য যতটা না খরচ করবে/করছে, নিসন্দেহে তার কয়েক গুণ খরচ করবে/করছে ঐ তেল/গ্যাসের গবেষণাতে।

বটম লাইনঃ বিকল্প শক্তির গবেষণাতে টাকা ঢালাটা টাকা-দেনেওয়ালাদের কাছে, অন্তত এখনও অব্দি, কেবলমাত্র 'সামাজিক দায়বদ্ধতা' বা 'করপরেট সোস্যাল রেসপন্সিবিলিটি' বা কোন স্টেট/সেন্ট্রাল গভর্ন্মেন্টের প্রতিশ্রুত 'সবুজ ভবিষ্যতের' জন্য দেয়া অল্পকিছু ফান্ডিং এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। লাভের অঙ্ক না দেখালে হাজার গলা ফাটানো গ্লোবাল ওয়ার্মিং, শক্তি ফুরিয়ে গেল ব্লা ব্লা চিৎকার তাদের কানে পৌঁছবেই না। সাদা পায়রা শান্তি আনতে পারে না, খুবই দুঃখজনক কিন্তু কঠিন বাস্তবতা।

ফলোয়াপ প্রশ্নঃ তাহলে কি করণীয়?
উত্তরঃ গ্রেস পিরিওড টা যতটা সম্ভব কাজে লাগানো, কিছু দারুন আউটপুট দেয়া যাতে 'তারা' আগ্রহী হতে বাধ্য হয়।
প্রশ্নঃ অরগ্যানিক ইলেকট্রনিক্স কি পারছে?
উত্তরঃ চেষ্টা করে যাচ্ছে জানপ্রাণ দিয়ে। সম্ভবনাময় অবশ্যই। বাস্তবিকভাবে, এই দশকে বা সামনের দশকে (২০৩০ নাগাদ) কিছু না হলে, এর মৃত্যু ঘটবে বলে ধরেই নেয়া যায়। তবে, অত্যাধুনিক আর উন্নততর পরীক্ষাগার পদ্ধতি, যেগুলো গত দশকেও কল্পনার বাইরে ছিল কিন্তু এই দশকে এই সিলিকন প্রযুক্তির কারণে সম্ভব হয়েছে, সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে ধুন্দুমার কিছু ফলাফল বের হয়ে আসবে-সে আশা করাই যায়।

আর জানেনই তো, ব্যক্তিগতভাবে আমি স্বপ্নচারী হাসি স্বপ্ন নিয়েই বাঁচি হাসি

ভাল থাকুন।

(ঐ ল্যাবমেট কিছু প্রাথমিক সমস্যা বের করে ক্যামিস্টদের কাছে পাঠিয়েছে, তারা দেখছে কি করে আসলে একই কোর কিন্তু ভিন্ন সাইড চেনওয়ালা বস্তু তৈরী করা যায়! তাই ঝুলে আছে আপাতত ক্যামিস্টদের উপর। সেই সুযোগে ও অন্য একটা ম্যাটেরিয়াল নিয়ে লেগে পরেছে)

-স্বপ্নচারীর স্বপ্ন

এক লহমা এর ছবি

৫ তারা - সমস্ত পর্ব মিলিয়ে।
বিজ্ঞান নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে পূর্ণ সহমত। সমস্ত পর্ব মিলিয়ে একটি অত্যন্ত উপভোগ্য পাঠ।
অজস্র বাধা আর নীচতাকে কাটিয়ে উঠে এক দুরন্ত ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় আপনাকে জানাই অন্তরের অভিনন্দন। পারলে সচলায়তনের সমস্ত পড়ুয়াদের আমি পড়াতাম এই লেখা।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ এক লহমা হাসি
পড়ে ভাল লেগেছে আপনার, আর সাথে ছিলেন পর্বগুলোজুড়ে-দু কারণেই অনেক ভাল লাগছে। আর পারলে সবাইকে লেখাগুলো পড়াতেন জেনে তো 'বেশ একটা কিছু করে ফেললাম' ধরনের তৃপ্তি পাচ্ছি!
ভাল থাকুন।
-স্বপ্নচারীর স্বপ্ন

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অতিথি লেখক এর ছবি

সেটা বুঝতে হলে আপনাকে আইনস্টাইন হতে হবে না, শুধু রাজনীতিবিদ না হলেই চলবে।

একদম খাঁটি কথা চলুক

সবগুলো পর্বই চমৎকার লেগেছে। আপনার কাছ থেকে বিজ্ঞানের উপর আরো লেখা আশা করছি।

সোহেল লেহস

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ সোহেল লেহস হাসি
লেখাগুলো পড়েছেন, ভাল লেগেছে জেনে আসলেই অনেক ভাল লাগে। আপনাদের এমন উৎসাহ পেলাম যেহেতু, সেহেতু ভবিষ্যতেও লিখতে চেষ্টা করবো সাধ্যমত। ভাল থাকুন।
-স্বপ্নচারীর স্বপ্ন

প্রশ্ন এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

মেঘলা মানুষ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ, এত খাটাখাটুনি করে (এবং অবশ্যই শত ব্যস্ততার মাঝে) সিরিজটা শেষ করার জন্য।
শুরু থেকেই সাথে ছিলাম, পড়েছি পর্বগুলো মনোযোগ দিয়ে।

এমন টাকা পেলে অন্য অনেক গবেষণাই ২৫/৩০ বছরে এমন তাক লাগিয়ে দিতে পারে, তা শরীরবিদ্যা-মেডিসিনের গবেষণাতেই হোক কিংবা মহাকাশ-মহাবিশ্বের গবেষণা, যাই হোক না কেন!

- আপনাকে ধন্যবাদ দিতে হবে এখানে 'অনেক‌ ' শব্দটা ব্যব‌হার করার জন্য, এখানে সব‌ ব্যব‌হার করলে আপনার সাথে তর্কে বসতাম। অনেক কিছুতে মিলিয়ন ডলার ঢেলে অনেক কিছু বের হয়েছে, সেগুলোতে বিলিয়ন ঢেলে সোনার ডিম পাড়া হাঁস (পড়ুন চমৎকার চমৎকার কাজের জিনিস) পাওয়া গিয়েছে। অন্যদিকে, অনেক কিছুতে বিলিয়ন বিলিয়ন ঢেলেও তেমন কিছু হয় নি। টাকা অবশ্যই দরকার, তবে "টাকা ঢাললেই চমৎকার সব গবেষণার ফলাফল বেরিয়ে আসবে‌ " এরকম জনপ্রিয় ধারণাতে উৎসাহ দেননি দেখে ভালো লাগল। (আপনি বিজ্ঞানের লোক বলে আপনার কাছে এরকম সচেতনতা আসলে প্রত্যাশিতই ছিল এবং আপনি প্রত্যাশা পূরণ করেছেন।)

কিন্তু খুবই দুঃখের আর আফসোসের বিষয় হচ্ছে এই যে, শক্তি উৎপাদনের গবেষণায় তেমন টাকা বা স্বাধীনতা বা আগ্রহ পাচ্ছে না এই অরগ্যানিক ইলেকট্রনিক্স। ... ... ...আর টাকা আর ক্ষমতাওয়ালা তেল-গ্যাসের মালিকরা তো আর চাইবে না এমন কিছু হোক যেটার কারণে তাদের লাভের অঙ্ক কমে যায়!

-এটা একটু কন্সপিরেসি থিওরির মত শোনাল। তেল গ্যাস ওয়ালাদের শক্তিশালি লবিং আছে মানছি, তবে পুরোটাই তাদের একার কৃতিত্ব(!) না। ফান্ডিং এজেন্সির টাকা যাঁরা( কমিটি) ছাড় করেন, তাদেরও দায়বদ্ধতা আছে। অর্গানিকের পেছনে টাকা খরচ হয়নি এটাই কিন্তু না! যে পরিমাণ (এবং যে মানের) ভালো ভালো ফলাফলের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, সেটা সবসময় 'ডেলিভারি' না করলে কিন্তু ধীরে ধীরে ফান্ডিং শুকিয়ে আসবে। অনেক প্রোপোজালেই হয়ত বলা হয়েছে, এটা হলেই আমরা অর্গানিক সোলার সেলের বাণিজ্যিক উৎপাদনের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে যাব। কেউ কেউ কথা রাখতে পেরেছেন, কেউ পারেন নি (সেটাই স্বাভাবিক)। কিন্তু, বাস্তবের বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসার জন্য যে বাঁধাগুলো (Hurdles) সেগুলো দ্রুত পার হওয়া দরকার, কোন টেকনোলজিই চিরকাল 'গ্রেস পিরিয়ড' পায়না। অনেকেই কিন্তু ভেঞ্চার ক্যাপিটাল তুলে অনেকরকম কম্পানি খুলে ফেলেছেন - কারোটা টিকেছে, কারোটা টেকেনি। 'সোলিন্ড্রা' বলে একটা কম্পানির ইতিহাস দেখতে পারেন। এরা বিশাল পরিমাণ ফেডারেল সরকারের মানি গ্যারান্টির উপর বসে ছিল। copper indium gallium selenide দিয়ে এরা বাজারে টিকতে পারেনি, কারণ এদের কাঁচামাল খুব একটা সস্তা না।

আবারও, গ্রাফিন, ন্যানোটিউব -টেকনোলোজির কথা মনে করি। এরা কিন্তু অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছিল এই শতকের শুরুতে। যার কিছু বাস্তবায়িত হয়েছে, কিছু টুকিটাকি প্রয়োগ খুঁজে পাওয়া গেছে, কিন্তু গ্রাফিন, ন্যানোটিউব দিয়ে ট্রাঞ্জিস্টর বানিয়ে (এবং বাণিজ্যিক ভাবে বাজারজাত করে) পুরো পৃথিবীর টেকনোলজিতে যে বড় ধরণের আলোড়ন ফেলার কথা ছিল সেটা কিন্তু হয় নি। আর, শুরুর দিকের গ্রাফিন, ন‌্যানো টিউব দিয়ে সব কিছুর (উন্নততর) বিকল্প বানিয়ে ফেলব‌ -এই প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। কাজেই, ফান্ডিং দেনেওয়ালারা আগের মত অত হাতখোলা নেই, সাথে রিসেশন পরবর্তী বাজেট সংকোচনও এরজন্য দায়ী।

সিলিকন শিল্পের আজকের অবস্থায় আসতে পারার পেছনে বড় একটা কারণ হল এটার বাণিজ্যিক উৎপাদন সুনিয়ন্ত্রিত, ভুলের হার কম। বড় আকারের প্রেসিশন উৎপাদনের এই মডেল অনুসরণ করে অন্যান্য শিল্পেও ভালো ফল পাওয়া সম্ভব হয়েছে।

পলিমার এখানে সস্তা দামে জিনিস দিতে পারে কিন্তু স্থায়িত্বের (Stability) দিকটায় অগ্রগতি না হলে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়া কঠিন হবে। আবার বাণিজ্যিক উৎপাদেন গেলেও Yeild, Variation -এসব সমস্যার মোকাবেলাও কঠিন হবে। দেখা যাক, ভবিষ্যতে কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য!

যাই হোক, আপনার গবেষণা সফল হোক, এই শুভকামনা করছি।
(আপনার এক ল্যাবমেটের একটা জায়গায় আটকে গিয়ে সমস্যা হচ্ছিল বলেছিলেন, তার কি অবস্থা?)

ভালো থাকুন, শুভেচ্ছা হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

(খুবই দুঃখিত মেঘলা মানুষ। আপনার মন্তব্যের প্রতি মন্তব্যটা ৫ নং এ লিখে ফেলেছি; খেয়াল করিনি। মনে হচ্ছে, সচলে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারি নি এখনও হাসি তাই, আবার কপি/পেস্ট করে নিচে তুলে দিলাম। )

অনেক ধন্যবাদ মেঘলা মানুষ হাসি আপনার মন্তব্যের অপেক্ষাতেই ছিলাম। আর এমন দারুন মন্তব্য করে আফসোস ঘুচিয়ে দিয়েছেন এক্কেবারে !

যাক, প্রথমত, দ্বিমত করার কিছুই নেই আপনার সাথে। 'টাকা ঢাললেই চমৎকার সব গবেষণার ফলাফল বেরিয়ে আসবে‌' অত পাগল হই নি এখনও হাসি তবে ফান্ডিং টা যে অনেক জরুরী সেটা বোঝানোর জন্যেই অমন করে বলা আর কি!

দ্বিতীয়ত, কন্সপেরেসি থিওরীর কথা বললেন, সেখানে একটু বলতে চাই। সোলিন্ড্রা'র কথা জানতাম না, সেটা তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ। ঠিক কন্সপেরেসি হয়ত না তবে এটা তো 'ওপেন সিক্রেট' যে কোন খাতে টাকা ঢালা হবে না হবে, কতটা হবে, কি ফলাফল চিন্তা করে টাকাটা ঢালা হবে সেটা দিন শেষে প্রায় পুরোটাই তো টাকাওয়ালাদের উপর নির্ভর করে! বিজ্ঞানীদের কান্নাকাটির তো খুব একটা দাম নেই! গ্রেস পিরিওড কেউই অনন্তকাল পাবে না, খুবই সত্যি কথা আর ফলাফল ডেলিভারী না দিতে পারলে সেটা কমতে কমতে শুন্যও হয়ে যাবে একদিন, সেটাও সত্যি। কিন্তু একটা বিষয় একটু চিন্তা করুনঃ

১/ উদাহরণ হিসেবে বলছি, তেল/গ্যাস সণাক্তকরণের জন্য যে গবেষণা বা তেল/গ্যাস উত্তোলন ও শোধনের জন্য যে গবেষণা (তা পানির নিচেই হোক বা মাটিতে), সেসবে তেল কম্পানীগুলো যে টাকা ঢালছে, তার কত ভাগ নতুন বিকল্প শক্তির জন্য তারা ঢালছে? এমন না যে এই তেল/গ্যাসের দিকটাতে প্রতিষ্ঠিত জ্ঞান নেই! যথেষ্টই আছে, খুব ভাল ইইল্ড পাওয়া যাচ্ছে এখনকার প্রযুক্তিতেই কিন্তু তা আরও সস্তায় কি করে পাওয়া যায়, আরও ইইল্ড কি করে পাওয়া যায়, আরও এফিসিয়েন্সি কি করে পাওয়া যায় ইত্যাদির জন্য গবেষণায় টাকা ঢালা কিন্তু বেশ চলছে! 'আমার কাছে কোন তথ্য নেই' (চোখ টিপি) যদিও, তবে সাধারণভাবে বলতে পারি, ঐ একই কম্পানী বিকল্প শক্তির জন্য যতটা না খরচ করবে/করছে, নিসন্দেহে তার কয়েক গুণ খরচ করবে/করছে ঐ তেল/গ্যাসের গবেষণাতে।

বটম লাইনঃ বিকল্প শক্তির গবেষণাতে টাকা ঢালাটা টাকা-দেনেওয়ালাদের কাছে, অন্তত এখনও অব্দি, কেবলমাত্র 'সামাজিক দায়বদ্ধতা' বা 'করপরেট সোস্যাল রেসপন্সিবিলিটি' বা কোন স্টেট/সেন্ট্রাল গভর্ন্মেন্টের প্রতিশ্রুত 'সবুজ ভবিষ্যতের' জন্য দেয়া অল্পকিছু ফান্ডিং এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। লাভের অঙ্ক না দেখালে হাজার গলা ফাটানো গ্লোবাল ওয়ার্মিং, শক্তি ফুরিয়ে গেল ব্লা ব্লা চিৎকার তাদের কানে পৌঁছবেই না। সাদা পায়রা শান্তি আনতে পারে না, খুবই দুঃখজনক কিন্তু কঠিন বাস্তবতা।

ফলোয়াপ প্রশ্নঃ তাহলে কি করণীয়?
উত্তরঃ গ্রেস পিরিওড টা যতটা সম্ভব কাজে লাগানো, কিছু দারুন আউটপুট দেয়া যাতে 'তারা' আগ্রহী হতে বাধ্য হয়।
প্রশ্নঃ অরগ্যানিক ইলেকট্রনিক্স কি পারছে?
উত্তরঃ চেষ্টা করে যাচ্ছে জানপ্রাণ দিয়ে। সম্ভবনাময় অবশ্যই। বাস্তবিকভাবে, এই দশকে বা সামনের দশকে (২০৩০ নাগাদ) কিছু না হলে, এর মৃত্যু ঘটবে বলে ধরেই নেয়া যায়। তবে, অত্যাধুনিক আর উন্নততর পরীক্ষাগার পদ্ধতি, যেগুলো গত দশকেও কল্পনার বাইরে ছিল কিন্তু এই দশকে এই সিলিকন প্রযুক্তির কারণে সম্ভব হয়েছে, সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে ধুন্দুমার কিছু ফলাফল বের হয়ে আসবে-সে আশা করাই যায়।

আর জানেনই তো, ব্যক্তিগতভাবে আমি স্বপ্নচারী হাসি স্বপ্ন নিয়েই বাঁচি হাসি

ভাল থাকুন।

(ঐ ল্যাবমেট কিছু প্রাথমিক সমস্যা বের করে ক্যামিস্টদের কাছে পাঠিয়েছে, তারা দেখছে কি করে আসলে একই কোর কিন্তু ভিন্ন সাইড চেনওয়ালা বস্তু তৈরী করা যায়! তাই ঝুলে আছে আপাতত ক্যামিস্টদের উপর। সেই সুযোগে ও অন্য একটা ম্যাটেরিয়াল নিয়ে লেগে পরেছে)

-স্বপ্নচারীর স্বপ্ন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।