ছবি। রোমান্টিক রিগা
মে মাসের মাঝামাঝি সময়টাতে লাটভিয়াতে দীর্ঘ শীত বিদায় নিয়ে বসন্তের সবে আগমনের সময়। এ সেই সময়, যে সময়ে লাটভিয়ার মানুষের গা থেকে খুলে পরতে শুরু করে গরম ওভারকোট, গমগমে আওয়াজ ছাড়া পুরনো আমলের তাপ-নিয়ন্ত্রক যন্ত্রগুলো আবার দেখা হবে আগামী শীতে বলে দীর্ঘনিদ্রার প্রস্তুতি নেয়, হাতে বোনা উলের মোজা আর দস্তানাগুলো নিজেদের স্থান খুঁজে নেয় কুলুঙ্গির এক কোণে, রঙ্গিন প্রজাপতি আর কাঠবিড়ালির খেলা শুরু হয় সদ্য গজান ঝকঝকে সবুজ পল্লবে ঢাকা উদ্যানগুলোতে, সারা দিনমান এক স্নিগ্ধ বাতাস খেলা করে শহরময়, যে বাতাস কখনো কখনো অপেক্ষায় থাকা কোন এক লাটভিয়ান তরুণীর হাতে থাকা সেলোফেন কাগজে মোড়া টিউলিপের গোছায় চুমু খেয়ে যায়। এমনি এক বসন্তের পড়ন্ত বিকেলে এসে পৌঁছুলাম লাটভিয়ার রাজধানী রিগার প্রধান বাস স্টেশনে। আগে থেকে ভেবেছিলাম হয়তো এ শহর থেকে এখনও শীত বিদায় নেয়নি, তাই গায়ে চাপিয়ে এসেছিলাম গরম কাপড়, বাস থেকে নামার পরই যা সাত তাড়াতাড়ি খুলে ফেলতে হল। রিগার এই বাস-স্ট্যান্ডটি আকারে বড় নয় তেমন। ভবনটি যে বেশ পুরনো তা বেশ বোঝা যায়, অন্তত গত বিশ-ত্রিশ বছরে মনে হয়না যে তেমন কোন পরিবর্তন হয়েছে। তবে আর যা কিছুই নতুন না হোক, অন্তত তথ্য-কেন্দ্রটি যে বেশ নতুন করে সাজানো হয়েছে সেটা এক নজর দেখলেই আন্দাজ করা যায়। একটু শঙ্কা ছিল সেই তথ্য-কেন্দ্রে ইংরেজিতে কোন সাহায্য পাব কিনা, পরে দেখলাম ইংরেজি তো বটেই আরও দু-তিনটে ভাষায় ওদের এই তথ্য-কেন্দ্রের মেয়ে দুটি সাহায্য করতে সক্ষম। যদিও বললাম আরও দু-তিনটে ভাষা, আরও খোলাসা করে বলতে গেলে বলতে হয় জার্মান ভাষারই বেশ প্রাধান্য দেখলাম সেই তথ্য-কেন্দ্রে। ওদের প্রায় সব কটি বই আর নির্দেশিকাই জার্মান ভাষায় অনূদিত। তো সেই তথ্য কেন্দ্রেরেই একজন আমাকে বেশ ভালো ভাবে বুঝিয়ে দিল আমার হোটেলটি ঠিক কোথায় এবং আমাকে কি ভাবে হেঁটে যেতে হবে।
বাস-স্ট্যান্ড থেকে বের হবার পর মনে হল অনেকটা যেন এসে পড়লাম ঢাকার গুলিস্তানে। নাহ উপমাটি হয়তো ততটা সঠিক হলনা, গুলিস্তানের মতো ততটা ভিড়-ভাটটার জায়গা নয়, তবে পূর্ব ইউরোপের অন্য যেকোনো শহরের চেয়ে একটু যেন বেশিই কোলাহল পূর্ণ মনে হল। রাস্তার ঠিক ওপারেই সস্তা কাপড়ের দোকান, অন্তর্বাস থেকে শুরু করে শিশুদের খেলনা সবই বিক্রি হচ্ছে সেসব ছোটো ছোটো খুপরি দোকানে।এই দোকানগুলো পেরুলে রিগার সেন্ট্রাল রেল-স্টেশন। পশ্চিম ইউরোপের কথা জানিনা, কিন্তু পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশ ঘুরে যা দেখলাম তা হল প্রধান রেল-স্টেশনের খুব কাছেই ওদের প্রধান বাস-স্টেশন, যাতে করে কেউ ট্রেন থেকে নেমেই বাসে করে পৌছুতে পারে পরের গন্তব্যে। আমারা কি কখনো ভেবে দেখেছি এভাবে আমাদের বাংলাদেশে? সে ভাবে ভাবলে হয়তো কমলাপুর রেল- স্টেশন ঢাকার এক মাথায় আর গাবতলি বাস- স্টেশন ঢাকার অন্য মাথায় হতনা।
কি যেন সেই মেয়েটি বুঝিয়ে বলেছিল? ডানে গিয়ে আবার ডানে যেও, তারপর রাস্তা যেখানে বাঁক নেবে সেখানে রাস্তা পেরিয়ে ওপারে গিয়ে সোজা নাক বরাবরের রাস্তা ধরবে, ঠিক ঠিকি তো মনে করে এনেছিলাম সব, কিন্তু রাস্তায় নেমে রিগার সেই জনারণ্যে আমি যেন অনেকটা হারিয়েই গেলাম। পথে এক পৌঢ় ভদ্রমহিলাকে আমার হাতে থাকা ম্যাপ দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম সেটা কোন দিকে হতে পারে। ভদ্রমহিলা লাটভিয়ান ছাড়া এক বর্ণ ইংরেজিও পারেন না, তবুও আমার ম্যাপ দেখে আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন কোন পথ ধরে যেতে হবে। রিগার এই অঞ্চলটি তেমন বনেদি নয়, কিংবা হয়তো ছিল কোন কালে, আশে পাশের বাড়ির কালচে দেয়াল আর ক্ষয়ে যাওয়া ফুটপাথ বলে দেয় এ পাড়াগুলো আর তাদের যৌবন কালে নেই।
প্রতিবারই ভ্রমণে বেরুবোর সময় আমি কোন না কোন ভুল করি, কোন বার হয়তো দাঁত মাজার ব্রাশ নিতে ভুলে যাই, কোন বার হয়তো শেভিংয়ের সরঞ্জাম। একবার তো ভুলে ক্যামেরার ব্যাগই ফেলে চলে গিয়েছিলাম। এবারও তাই এয়ারপোর্টের লাউঞ্জ পেরিয়ে ড্রিম লাইনারের পেটে ঢোকার পর মনে হয়েছিল ভুল করলাম নাতো কিছু? নাহ তেমন কোন কিছু মনে পড়ছেনা, মনে মনে বেশ খুশি হয়ে গেলাম। ওদিকে বিধাতা মুচকি মুচকি হেসে ভাবছিলেন রোসো বাছা। আসার সময় পায়ে গলিয়ে এসেছি সদ্য কেনা বাটার এক জোড়া চকচকে জুতো। একে তো নতুন জুতো তার উপর লাটভিয়ায় আসার আগে লিথুয়ানিয়ায় ব্যাপক ঘোরাঘুরির ফলে দু’পায়ে পরে গেলো বেশ বড়সড় ফোসকা। কেন যে নতুন জুতো জোড়া আনতে গেলাম! এতোটা দূর বেড়াতে এসে এখন এই পায়ের ব্যথা নিয়ে হোটেলে পরে থাকবো? ধুস...
লিথুয়ানিয়া থেকে লাটভিয়ায় আসার জন্যে আমার বাস ছিল ঠিক দুপুর বেলায়, তাড়াহুড়োয় ঠিক পেট পুরে আর খাওয়া হয়ে ওঠেনি দুপুরে। বিকেলে হোটেলে ঢোকার পর তাই যেন রাজ্যের খিদে এসে ভর করলো। হোটেলের ম্যানেজার ছোকরাটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, “বিশুদ্ধ লাটভিয়ান খাবার কোথায় পাই বল তো?”। হোটেলে আসবার পথেই দেখে এসেছি এ পাড়ায় খাবার দোকানের অভাব নেই, কিন্তু সেসব দোকানের অধিকাংশই হল কাবাব শপ। টার্কিশরা চুটিয়ে ব্যবসা করছে এই কাবাব শপ দিয়ে, কিছু পাকিস্তানি কাবাব শপও চোখে পড়লো। আসলে শুধু লাটভিয়া নয়, গোটা পূর্ব ইউরোপেই কাবাব-শপ এক রমরমা ব্যবসা, এই দেশগুলোতে এখন ফাস্ট ফুড মানেই ‘কেবাব’ শপের কাবাব র্যাপ বা শর্মা। কিন্তু সেসব খাবনা বলেই আমার লাটভিয়ান খাবারের দোকান খোঁজা। “লাডতে চলে যাও, র্যাডিসনের পাশেই এই রেস্তোরাঁ। আমি তো প্রায়ই যাই সেখানে, তোমাকে কথা দিতে পারি তুমি নিরাশ হবেনা“। “কিন্তু বললে যে র্যাডিসনের পাশে, অনেক দামি রেস্তোরাঁ বুঝি?”। “শোন বন্ধু আমি লাটভিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি আর কয়েক ঘণ্টার জন্যে এই হোটেলে কাজ করি, বলতে পারো আমি এখনও পুরো মাত্রায় ছাত্র, তেমন দামি রেস্তোরাঁ হলে আমিও সেখানে যাবার সাহস করতাম না”। নাহ ছেলেটি ভুল বলেনি, লাড রেস্তোরাঁটি কিছুটা পুরনো ঢঙ্গে সজ্জিত, পরিবেশনকারী মেয়েদের পরনেও লাটভিয়ার ঐতিহ্যবাহী পোষাক, আর সবকটি পদের দামই কিন্তু নাগালের মধ্যে। যা যা খেতে চাও, প্লেটে উঠিয়ে নাও, আর সব শেষে গিয়ে দাম দাও। আমি নিলাম এক ধরনের লাটভিয়ান চিকেন রাইস, মাশরুমের একটা পদ আর মাছের চপ। গোট-চীজ দিয়ে বানানো মাছের চপটি যেন অমৃত। বালটিক সাগর বেশ কাছেই হওয়ায় এ দেশে সামুদ্রিক মাছের বেশ কদর। তাই যে কোন রেস্তরাঁতেই মাছের বেশ কটি পদ থাকবেই থাকবে। ভেবে রাখলাম পরেরবার এ রেস্তোরাঁয় এলে আরও কিছু মাছের পদ চেখে দেখব। হোটেলে ফিরবার তেমন কোন তাড়া নেই আমার, লাডর বিশাল কাঁচের দেয়ালের ওপাশটা দেখতে দেখতে ভাবলাম আজকের এই বিকেলের কিছুটা সময় বরং কাটুক রিগার নানা রঙের মানুষ দেখে।
তখনো রাতের আঁধার ভোরের গায়ে লেপটে আছে, এমন সময় ঘুম ভাঙলে অনেকেরই যা মনে হয় আমারও তেমনটিই মনে হল, ‘কোথায় আমি?’। চোখ কচলে জানালার ভারী পর্দা সরিয়ে দেখলাম রাস্তায় তখনো কোন জন-প্রাণী নেই। এখন আবার ঘুমোবার চেষ্টাই বৃথা, অগত্যা একটা বই নিয়ে বসলাম।
প্রাতঃরাশ সেরে একটু যেন বেশ সকাল সকালই বেরিয়ে পড়লাম, ততোক্ষণে অবশ্য রিগার মেহনতি মানুষদের কেউ কেউ হনহনিয়ে ছুটে চলেছে ট্রাম স্টেশনে, কেউবা অপেক্ষমাণ অফিসগামী বাসের জন্যে। আমার গন্তব্য অবশ্য বেশি দূরের কোন স্থান নয়। আপাতত যাব রিগার পুরনো শহরে। দেড় কি দু’মাইলের হাঁটা পথ।
লাটভিয়ান ভাষায় এয়ালা মানে সড়ক। আমার হোটেল থেকে বেরুলেই ‘জানাভেরা এয়ালা’, হাতের ম্যাপটি নির্দেশ করছে এই ‘জানাভেরা এয়ালা’ধরে দুগাভা নদীর দিকে এগোলেই হাতের ডানে পেয়ে যাব সেই পুরনো শহর।
হটাত যেন মনে হল দাঁড়িয়ে আছি পুরনো কোন এক সিনেমার সেটে। বা’পাশ দিয়ে ঠং ঠং শব্দে বহুকালের পুরনো ইট বেছান পথকে কোন ভাবে আঁকড়ে ধরা লোহার পাত ধরে ধীর গতিতে এগিয়ে চলা নীল আর সাদায় রাঙানো সেই সোভিয়েত আমলের ট্রাম আর আমার ডান দিকে দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধের সাথে লড়াই করে টিকে থাকা শতবর্ষী সব দালান। রিগা শহরে আজকাল হাল আমলের ট্রামও যে চোখে পড়েনা তা নয়, পড়ে, তবে ঠিক এ জায়গাটিতে যদি সেই হাল আমলের ট্রামগুলো চালানো হত তবে হয়তো পুরনো পুরনো গন্ধের এই পুরো দৃশ্যপটটাই যেত পালটে। ভাগ্যিস এখনও ওরা টিকে আছে।
ছবি। সেই পুরনো সোভিয়েত আমলের ট্রাম, ডানেই সেই পুরনো শহর
রিগার এই পুরনো শহরের গোড়াপত্তন সেই বারশ’ শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে। দুগাভা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই শহরের চারপাশেই সে সময় ছিল সুউচ্চ প্রাচীর, বাইরের শত্রুর হাত থেকে শহরের অধিবাসীদের রক্ষা করার জন্যে। আজ অবশ্য সেই প্রাচীরের কোন চিহ্নই অবশিষ্ট নেই। প্রায় দেড়শ’ বছর আগেই সেই প্রাচীর অপসারণ করে সেখানে বানানো হয়েছে এক খাল, পুরো পুরনো শহরটিকে নিজের পেটের কাছে চেপে ধরে যে খালটি দুগাভা নদীতেই বেছে নিয়েছে নিজের সঙ্গমস্থল।
পুরনো সে শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে সাধু পিটারের চার্চ। এই চার্চের চুড়ো থেকে এক সময় পুরো রিগা শহরটিকেই দেখা যেত। ভেবেছিলাম চুড়োয় উঠবো, কিন্তু সেদিন আবার চার্চে কি এক কনসার্টের ব্যবস্থা ছিল বিকেল বেলায়, তাই ওরা আর সেদিন ওপরে উঠতে দিলনা। চার্চের বাইরের দেয়াল আর ডোম দেখে মনে হল খুব একটা বড় কোন সংস্কার করা হয়নি এই চার্চের, সেটা কি লুথেরান চার্চ বলে?। লাটভিয়ার অন্যতম প্রাচীন এই চার্চের উপর দিয়ে কিন্তু কম ঝড়-ঝাঁপটা বয়ে যায়নি। বিগত কয়েক শতাব্দীতে ক্যাথলিক চার্চ আর সোভিয়েত সময়ে রাশান অর্থোডক্স চার্চের দোর্দণ্ড প্রতাপের কাছে এই চার্চটি অনেকটাই তার প্রভাব হারায়। আজকের লাটভিয়ায় অবশ্য অধিকাংশ মানুষ ধর্ম পরিচয়ের আগে নিজেদের মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে, আর সেজন্যেই হয়তোবা সাধু পিটারের চার্চের পাশের টিউলিপ বাগানের পরিচর্যা দিন দিন বাড়লেও বাড়েনি চার্চের দেয়ালের পরিচর্যা। সেই টিউলিপ বাগানের পাশে সারা বছরই যেন এক ছোটোখাটো মেলা, টুকি-টাকি অনেক চিত্রশিল্পীই এসেছেন নিজেদের আঁকা ছবি নিয়ে, আর বসেছে হরেক রকম অ্যাম্বারের তৈরি অলংকারের পসরা।
ছবি। সাধু পিটারের চার্চ
ছবি। চার্চের সম্মুখভাগে এক প্রতিকৃতি
ছবি। সকালের মিষ্টি আলোয় চার্চের পাশের টিউলিপ বাগান
ছবি। সাধু পিটারের চার্চ
চার্চ পেরিয়ে বাঁয়ের রাস্তা ধরলেই এক খোলা চত্বর, প্রথম সকালের মিষ্টি রোদে যেখানে খেলে বেড়াচ্ছে অসংখ্য কবুতর। এই চত্বরটিকে বলা যায় রিগার প্রধান শিল্প সাহিত্য চত্বর, এখানে সারা বছরই লেগে থাকে কোন না কোন প্রদর্শনী। চত্বরের বা’দিকে চোখে পড়ে অপূর্ব কারুকার্যময় এক ভবন। লাটভিয়ায় আগত জার্মান বণিকদের একটি সংঘ, যারা পরিচিত ছিল ব্ল্যাক-হেড হিসেবে, তারাই এই ভবনের পত্তন করে তেরশ’ শতাব্দীতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় গুড়ো-গুড়ো হয়ে যাওয়া এই ভবনকে লাটভিয়ানরা আবার গড়ে তোলে পুরনো সেই রূপে সত্তরের দশকে। ইচ্ছে ছিল ভেতরটা ঘুরে দেখার। ভবনের প্রধান ফটকের সামনে পৌঁছে দেখি সেখানে এক ফলকে লেখা, “লাটভিয়ার মহামান্য রাষ্ট্রপতির বাসভবন”। বোঝো ঠ্যালা। এমন এক সদর মফঃস্বল ধরণের বাড়িতে বাস করেন লাটভিয়ার রাষ্ট্রপতি? ফটকের সামনে এক নিরাপত্তারক্ষী অলস ভঙ্গীতে বিড়ি ফুঁকছে, তাকে বললাম, “একটা ছবি তুলে দেবে আমার?” আমার অনুরোধে বেচারা যেন একটু ধন্দে পরে গেলো, পাশের এক সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করলো, কি? দেবো?। ওপাশ থেকে তার সহকর্মী যেন উত্তর দিল, “পাহারা বাদ দিয়ে এমনিতেই বিড়ি ফুঁকছ, তার উপর আবার পর্যটকদের ছবি তুলে দিতে চাও, না হে তোমার নামে একটা রিপোর্ট করতেই হয় দেখছি”। বেচারার আর কিই বা করার ছিল, তাকে ধন্যবাদ দিয়ে সে ভবনের অন্য এক কর্মচারীকে ধরলাম এবার ছবি তুলে দেবার জন্য, এ ভদ্রলোক রাজি হয়ে গেলো এক কথায়। লাটভিয়ার রাষ্ট্রপতির প্রকৃত বাসভবন কিন্তু আসলে তেরশ’শতাব্দীতে নির্মিত রিগা দুর্গে। রাষ্ট্রপতি মহাশয় ভাগ্যবান বটে, থাকেন কিনা রাজা-গজাদের জন্যে নির্মিত দুর্গে। তবে গত বছর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দুর্গের বেশ খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তিনি এসে উঠেছেন দুর্গের খুব কাছেই এই অস্থায়ী বাসভবনে। সেই দুর্গেও এখন সংস্কার কাজ চলায় সেটি পর্যটকদের জন্য তালাবন্ধ।
ছবি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ভবন
ছবি। রাষ্ট্রপতি ভবনের সম্মুখভাগ
হাতে সময় আছে বেশ খানিকটা, তাই ভাবলাম ওই কবুতরদের মতো আমিও না হয় কিছুক্ষণ সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে মাখি। সুবিধেমত একটা খালি বেঞ্চ পেয়ে বসে পড়লাম, বসে বসে ভাবছিলাম স্বাধীনতার জন্যে বুভুক্ষু দুর্ভাগা এই ছোট্ট দেশটির কথা। লাটভিয়ার যেকোনো মানুষকে যদি প্রশ্ন করা হয় তোমরা কবে স্বাধীন হয়েছিলে, তবে হয়তো সে পাল্টা প্রশ্ন করে বলবে কোন স্বাধীনতার কথা তুমি বলছ? প্রথম স্বাধীনতা? না দ্বিতীয় স্বাধীনতা? সেই মধ্যযুগ থেকেই জার্মান ব্যারনরা চেয়েছে বন্দর-কেন্দ্রিক এই এক টুকরো দেশটিকে পদাবনত করার, যে লোভ একসময় প্রসারিত হয় রাশান জারদের মাঝেও। এরপর গত শতাব্দীতে প্রথমে এলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সে যুদ্ধে জার্মানদের বিরুদ্ধে পুষে রাখা রাগ থেকে অধিকাংশ লাটভিয়ানই নাম লেখায় রাইফেল বাহিনীতে, বলশেভিকদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা যুদ্ধ করে জার্মানদের হটানর জন্য। লেনিন তাদের কথা দিয়েছিলেন লাটভিয়া জার্মান-মুক্ত হলে সেটি হবে স্বাধীন লাটভিয়া। যুদ্ধ শেষ হয় ১৮’র নভেম্বর, লাটভিয়ানদের মনের শঙ্কা তবু দূর হয়না, লেনিন কি কথা রাখবেন? লেনিন কিন্তু সেদিন কথা রেখেছিলেন, আর সেটাই ছিল গত শতাব্দীতে লাটভিয়ার প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ। ২৪’এ লেনিনের মৃত্যুর পরপরই আস্তে আস্তে পাল্টাতে থাকে দৃশ্যপট, জার আমলের সেই উগ্র জাতীয়তাবাদ আবারো এসে ভর করে বলশেভিকদের ঘাড়ে, রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্যে বালটিক তীরের দেশগুলো দখল করার ছুতো খুঁজতে থাকে তারা। খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হলনা তাদের, ৩৯’এই তাদের জন্য সেই ছুতো নিয়ে হাজির হল হিটলার। ৩৯’এ রাশিয়া আর জার্মানির মাঝে যে গোপন চুক্তি সাক্ষরিত হয়, ইতিহাসে যা মলোটভ–রিবেনট্রপ চুক্তি নামে বিখ্যাত, সে চুক্তির বলে ৪০’এর গ্রীষ্মে রাশান লাল বাহিনীর সেনারা হুড়মুড় করে ঢুকে পরে লাটভিয়ায়। পোড়াকপাল লাটভিয়ানরা বুঝল আবারো তাদের নিজ দেশের পতাকা খুলে ফেলার সময় এলো। শুধু যদি ততটুকুই হত তবু হয়তো লাটভিয়ানদের দুর্দশা ততটা হতো না, কিন্তু রাশানরা লাটভিয়ায় ঢুকেই পাইকারি হারে শুরু করলো শুদ্ধি অভিযান। শত শত লাটভিয়ানকে রাতের আঁধারে পাঠিয়ে দেয়া হল রাশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে, আর যাদের ভাগ্য ততটা ভালো নয় তাদের স্থান হল সাইবেরিয়ার শ্রম শিবির কিংবা বন্দুকের নলের অগ্রভাগে। ওদিকে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জুন মাসের এক রবিবারের সকালে রিগার মানুষরা আবিষ্কার করলো পুরো রিগা ছেয়ে গেছে জার্মান বাহিনীর কালো হেলমেটে। এ যেন ছোট্ট এক টুকরো মাংস নিয়ে দু’নেকড়ের কাড়াকাড়ি। লাল বাহিনীর নৃশংসতা দেখা মানুষেরা এবার যেন অনেকটা সাদরেই বরণ করলো জার্মান বাহিনীকে। জার্মানরাও জন মানুষের এই মনোভাবকে পুরোপুরি ব্যাবহার করতে চাইল লাল-বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের ব্যাবহার করে। ৪৫’এ যুদ্ধ শেষ হল, উত্তাল হল পুরো ইউরোপ স্বাধীনতার আনন্দে, ওদিকে লাটভিয়ানদের মুখ থেকে তত দিনে হাসি মিলিয়ে গেছে, কারণ ততদিনে তাদের ভূখণ্ডে ঢুকে গেছে নব ত্রাতা-রুপী সেই পুরনো মস্তান, লাল বাহিনী। এর পর লাটভিয়ানদের অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়েছে সুদীর্ঘ ৪৬টি বছর স্বাধীনতার লাল সূর্যের দেখা পাবার আশায়।
আজ থেকে ঠিক ত্রিশ বছর আগে এই মে মাসেই সুনীল এসেছিলেন রিগায়, তার সেই অভিজ্ঞতাগুলো তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন তার ভ্রমণ-পঞ্জীতে। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, “রাস্তায় অনেককেই আমি এরকম ফুল হাতে নিয়ে যেতে দেখেছি। বড় বড় মোড়ে ফুলের দোকান। এদেশে কারুর বাড়িতে দেখা করতে গেলেই ফুল নিয়ে যাওয়ার প্রথা। প্রিয়জনদের সাথে প্রথম দেখা হতেই আগে তার হাতে ফুল তুলে দেয় তারা”। আশ্চর্য, গত ত্রিশ বছরে লাটভিয়ানদের অন্তত এই স্বভাবটুকু বদলে যায়নি এতোটুকু। বেঞ্চে আধ-ঘণ্টা বসে থাকবার সময়েই বেশ কিছু তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার হাতে লক্ষ করলাম টিউলিপের গোছা। আগে থেকে লাটভিয়ানদের এই ফুল প্রীতির কথা না জানা থাকলে হয়তো ভাবতাম তারা এই ফুলগুলো নিয়ে চলেছে কোন এপিটাফ বা মিনারের বেদীতে নিবেদনের উদ্দেশে। শুধু তাই নয়, এরপর স্থানীয় এক বাজারে গিয়েও চোখে পড়েছিল সেখানে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে কেবলই বিক্রি হয় রঙ বেরঙের ফুল। বিষয়টি আমাকে মুগ্ধ না করে পারেনি।
সুনীলের কথা বলছিলাম, সে সময় কিন্তু সুনীলের মতো এমন অনেক সোভিয়েতের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদদের আমন্ত্রণ করে আনা হত সোভিয়েত ইউনিয়নে। আর তাদের সফর- সূচিতে মস্কো, লেনিনগ্রাদ, স্তালিনগ্রাদের সাথে অনেক সময়ই জুড়ে দেয়া বালটিক কোন দেশের শহর। একটি বিশেষ কারণ ছিল এর পেছনে। পশ্চিমা বিশ্ব কখনই বালটিক দেশগুলোতে রাশিয়ার আগ্রাসনকে স্বীকৃতি দেয়নি। তাই এসব অতিথিদের এখানে এনে দেখান হত কতই না সুখে আছে এখানকার মানুষরা, যাতে করে তারা ফিরে গিয়ে নিজ দেশে বলেন সেই সব কথা। আগে থেকেই ঠিক করে রাখা নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি, নির্দিষ্ট কিছু স্থান, নির্দিষ্ট কিছু অনুষ্ঠানেই শুধুমাত্র নিয়ে যাওয়া হত তাদের। এর বাইরে ও দেশকে জানার তেমন কোন সুযোগ ছিলোনা সেই সব অতিথিদের। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়েই তাদের সার্বক্ষণিক গাইডটি থাকত কে-জি-বিরই কোন চর। সুনীলের সেই ভ্রমণ-পঞ্জী পড়ে আমার মনে হয়েছে তার সার্বক্ষণিক গাইড সেরগেই এর হাতে তিনি যে অনেকটা নজরবন্দী সেটি মনে হয় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কিন্তু যেহেতু পুরো ভ্রমণটাই করে গেছেন সোভিয়েত সরকারের বদান্যতায় তাই এ ব্যাপারে তার লেখায় আর বেশি আলোকপাত করে তাদের বিরাগভাজন হতে চাননি। যদিও সত্যের দায়বদ্ধতা থেকে সেই আলোকপাত জরুরী ছিল বৈকি।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকেই ইউরোপের একদল স্থপতি ভাবা শুরু করেন পুরনো আদলের নকশার বদলে এখন থেকে তারা নকশা করবেন নতুন এক ধারায় যেখানে প্রাধান্য থাকবে ফুল, পাখি, প্রকৃতি আর মানুষের। কালক্রমে নতুন এই ধারাটির নামই হয়ে ওঠে “আর্ট নুভহ”। সে সময়ে সেই নতুন ধারা অনুসুরন করে সারা পৃথিবীতে যেসব ইমারত নির্মিত হয়েছিল তার ভেতর সব চেয়ে বেশি সংখ্যক ইমারত এখনও টিকে আছে এই রিগা শহরে। এই ধারার নকশার খুব সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল ভবনের বিভিন্ন কোণে বিভিন্ন তলায় জোড়া থাকে মানুষের মুখ, সে মুখটি কখনো হয় কোন বলিষ্ঠ পুরুষের আবার কখনো বা স্বর্গের কোন রূপবতী দেবীর। রিগা শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমন অসংখ্য ইমারতের বদৌলতে রিগাকে অনেক সময় ডাকা হয় হাজার মুখের শহর বলে। পুরনো শহরে আমি শুধু হেঁটেই বেড়াই না, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করি “আর্ট নুভহ” ইমারতগুলো। যার প্রতিটি নকশা, প্রতিটি মুখাবয়ব আমাকে মুগ্ধ করে।
ছবি। পুরনো শহরের এক গলি
ছবি। আর্ট জাদুঘর
পাইতাভাস স্ট্রিট যেন এক ভূতুড়ে পাড়া, পুরনো শহরের একেবারে শেষ প্রান্তের এ পাড়ার বাড়িগুলোতে এখন আর কোন জন-প্রাণী বাস করে বলে মনে হল না। কালচে ইটের এবড়ো খেবড়ো রাস্তা মাড়িয়ে এ পাড়ায় ঢুকতেই গা যেন ছম ছম করে। তবে এ সড়কের ঠিক মাঝের ওই সাদা বাড়িটা যেন অন্য পোড়ো বাড়িগুলোর সাথে বেমানান। এই বিসদৃশের কারণ এই বাড়িটি সংস্কার করা হয়েছে এই গত কয়েক বছর আগে, রিগার নিবু নিবু সলতের মতো জ্বলতে থাকা স্বল্প সংখ্যক ইহুদিদের একমাত্র প্রার্থনা-স্থল এই সিনাগগ টি। ভেতরে ঢোকার মুখেই বা’দিকের এক নিরাপত্তা কক্ষে এক অস্ত্রধারী রক্ষী বসে আছে সি সি টিভির সামনে। মিসেস বিয়েতা আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন সিনাগগের পুরোটা। একশ বছর আগে তৈরি হলেও তখনকার সময়ের চার্চের ভেতরকার অঙ্গসজ্জার সাথে তুলনা করলে এই সিনাগগটিকে বেশ সাদামাটাই বলা যায়। ৪১’র জুন মাসে জার্মান বাহিনী রিগায় ঢোকার পর পরই রিগার সব গুলো সিনাগগ পুরিয়ে ফেলে, বেঁচে যায় শুধু এই সিনাগগটি এর অবস্থানগত কারণে, কারণ এতে আগুন ধরালে পাশের ভবনগুলোতেও আগুন ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনা ছিল। যা হোক, সিনাগগ তো দেখা হল, কিন্তু একটা প্রশ্ন যে মনের ভেতর শুধুই ঘুরপাক খাচ্ছে। রিগার রাষ্ট্রপতি ভবনেই যেখানে নিরাপত্তার এতো ঢিলেঢালা ভাব, সেখানে এই নিঝুম সিনাগগে নিরাপত্তা রক্ষী কেন? প্রশ্নটা মিসেস বিয়েতাকে না করে পারলাম না। মিসেস বিয়েতার ইংরেজিটা ততটা সড়গড় নয়, তবু ও তার ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে চেষ্টা করলেন আমার কৌতূহল নিবৃত্ত করার।
ছবি। ভূতুড়ে পাড়া পাইতাভাস স্ট্রিট
ছবি। পাইতাভাস স্ট্রিট
ছবি। ওই দেখা যায় সাধু পিটারের চার্চ
ছবি। ভেঙ্গে পড়া জীর্ণ বাড়ি, পুরনো শহরে
হলকাস্টের কথা উঠলেই পোল্যান্ড, জার্মানি, অষ্ট্রিয়া এই দেশগুলোর নামই মূলত সামনে চলে আসে। কিন্তু হলকাস্টের ইতিহাস বইয়ের এক কোণে যে লেখা লাটভিয়ার নাম, সেটা আমার স্বল্প জ্ঞানের পরিধিটিতে জানা ছিল না। এই না জানা থাকার পেছনে একটা কারণও অবশ্য আছে, সোভিয়েত সময়ে বলশেভিকরা চায়নি ইহুদিরা পুরনো ইতিহাস নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করুক। এর অনেক কারণের একটি ছিল তারা জানত যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে তাদের থলের বিড়াল বেড়িয়ে যেতে পারে। মলোটভ–রিবেনট্রপ চুক্তির কথা তো সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বীকার করলো এই সেই ৮৮ সালে। অন্য আরেকটি কারণ ছিল তারা চাইত না কোন ধর্ম ভিত্তিক জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাস নিয়ে বেশি মাতামাতি হোক, এতে করে হয়তো সেই জাতি গোষ্ঠী নিজেদের মাঝে সংগঠিত হবার সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। কিন্তু এর ফলে ক্ষতিটা যা হবার তা হল ইতিহাসের। ৪১’এ জার্মান বাহিনী রিগায় ঢোকার পরই তাদের প্রধান টার্গেট হয়ে দাঁড়ায় রিগা তথা লাটভিয়ার ইহুদীরা। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই যুদ্ধ-পূর্ব লাটভিয়ার জনসংখ্যার প্রায় নব্বই ভাগ অর্থাৎ প্রায় আশি হাজার ইহুদী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় চিরদিনের মতো। কিন্তু কি করে জার্মান বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হল এতো অল্প সময়ের ভেতর এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে হত্যা করা? এখানেই আছে ইতিহাসের কিছু অন্ধকার অলিগলি। জার্মান বাহিনী প্রথমেই গঠন করে নেয় স্থানীয়দের নিয়ে এক দালাল বাহিনী, যা পরিচিতি পায় ‘আজারস কমান্ডো’ বাহিনী হিসেবে। ইহুদী নিধনে এই বাহিনী কাজ করে জার্মানদের ডান হাত হিসেবে। এই বাহিনীরই এক পাণ্ডার নাম সুকুরস। যুদ্ধের সেই দশকে সুকুরসের বয়স চল্লিশের কোঠায়। সুদীর্ঘ গঠন, মাথার চুল মাঝখানে সিঁথি করা। দূরপাল্লার বিমান চালনায় বেশ কিছু রেকর্ড তৈরি করে এই সুকুরস যুদ্ধের আগেই বেশ হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল রিগায়। কিন্তু যুদ্ধ এই বীরের মধ্যে থেকে বের করে নিয়ে এলো লুকিয়ে থাকা পশুটিকে। অভিযোগ আছে এক রবিবারের দিনে রিগার এক সিনাগগে প্রার্থনা-সভা চলাকালে এই সুকুরসই বাইরে থেকে তালাবন্ধ করে ভেতরে পুড়িয়ে মাড়ে পূন্নার্থীদের। সেখানেই শেষ নয়। এরপর গঠিত হয় রিগা ঘেঁটো কয়েক মাসের মধ্যেই, ততদিনে জার্মান এস এস বাহিনীর জল্লাদের দল প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে রিগা থেকে মাইল দশেক দূরে রাম্বুলা নামক এক পাহাড়ি জায়গায় রিগা ঘেঁটোর সব ইহুদীকে হত্যা করার। এখানেও অভিযোগ আছে সুকুরসের দল সেদিন পুরো সহায়তা করেছিল জার্মান বাহিনীর হত্যাযজ্ঞে। পরিতাপের বিষয় এই সুকুরসকে আজকের লাটভিয়ায় দেখা হয় জাতীয় বীর হিসেবে, যুদ্ধ-পূর্ব সময়ে বৈমানিক হিসেবে তার কৃতিত্বের জন্য। এমনকি ২০০৩ সালে লাটভিয়া একটি ডাকটিকেটও প্রকাশ করে সুকুরসকে নিয়ে। ঘটনাটি হয়তো খুবই নগণ্য, কিন্তু এই ছোট্ট উদাহরণটিই প্রকাশ করে কেন আজও রিগার ইহুদীরা নিজেদের কেন এতটা নিরাপত্তাহীন মনে করে।
ছবি। সিনাগগের ভেতরের একাংশ
হাতে বেয়োনেট, পরনে খাকী পোশাক, হাতে কালো দস্তানা – এভাবেই দু’সৈনিক ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে দিন, রাত, বছর আগলে রাখে রিগার স্বাধীনতা স্তম্ভটি। হটাত দেখলে ভ্রম হয় তারাও বুঝি এই স্বাধীনতা স্তম্ভেরই অংশ, তারপর ভুল ভাঙে। স্বাধীনতা স্তম্ভ যেহেতু, তাই প্রথমে আমার ধারণা ছিল এটা বোধহয় গড়া হয়েছে ৯১’এর স্বাধীনতার পর। কিন্তু আমার ধারণা ভুল। অধরা স্বাধীনতাকে অমর করে রাখতে এই স্তম্ভটি তৈরি হয়েছিল সেই ১৯৩৫ সালেই, মানে লাটভিয়ার প্রথম স্বাধীনতার পর পরই। সোভিয়েত আমলে বেশ ক’বার ভাবা হয়েছিল এই স্তম্ভটি ভেঙ্গে ফেলবার, কিন্তু স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে সোভিয়েত সরকার আর সেদিকে পা বাড়ায়নি। এই স্তম্ভের চুড়োয় দণ্ডায়মান এক নারীর আকাশের দিকে প্রসারিত বাহুতে থাকা তিনটি তারাই যেন অনেকটা বাঁচিয়ে দেয় এই স্তম্ভটিকে। সোভিয়েতরা এই বলে গাল-গল্প চালানো শুরু করে যে ওই নারী প্রকৃতপক্ষে মা রাশিয়ারই প্রতীক, আর তার হাতের ওই তিনটি তারা বালটিক তিনটি দেশ লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া আর এস্তনিয়াকেই নির্দেশ করে। যতই গাল-গল্প মারুক, সাধারণ লাটভিয়ানরা ঠিকই জানত এই স্তম্ভটিই তাদের সেই হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতার প্রতীক। আর তাই তো ৮৭’র গ্রীষ্মে স্বাধীনতার দাবীতে লাটভিয়ানদের গণ-আন্দোলন যখন দানা বাঁধতে শুরু করে, তখন সে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় এই স্তম্ভটিই।
ছবি। ফ্রিডম মনুমেন্ট
ছবি। ফ্রিডম মনুমেন্ট
“দুগাভা নদীতে ঘুরে আসবেন? মাত্র আঠেরো ইউরোতে পুরো খাল ঘুরিয়ে, নদী দর্শন করিয়ে আবারো এখানে নিয়ে আসবো, যাবেন?”। পুরনো শহরটিকে ঘিরে থাকা খালে ভাসতে থাকা এক নৌকার মাঝির ডাকা ডাকি। আঠেরো ইউরো যেন একটু বেশিই ঠেকল, কিন্তু রিগায় তো আর বছর বছর আসা হবেনা, বরং একটু দুগাভা নদীর সাথে সাক্ষাৎ হয়ে যাক। ছাউনি দেয়া এ নৌকার ভেতরটা দেখতে অনেকটা এক ঘড়ের মতো, চামড়ার গদি মোড়া আরামদায়ক বসবার ব্যবস্থা পুরো নৌকা জুড়ে। মৃদু শব্দে, হাল্কা ঢেউ তুলে, খালের নিস্তরঙ্গ জল কাটিয়ে আমাদের নৌকা প্রথমে যাত্রা শুরু করলো পুরনো শহরের পূর্ব প্রান্তের পানে। এখন যেন পুরনো শহরটিকে আরও ভালো করে দেখতে পাচ্ছি- ওই তো ন্যাশনাল অপেরা, অপেরা হাউসের সামনের অপূর্ব সুন্দর গোলাপের বাগান, শতাব্দী-প্রাচীন উদ্যানের লোহার বেঞ্চ, রডডেনড্রনের গুচ্ছ, বেলারুশ থেকে আসা একদল বুড়বুড়ির দল- যাদের একজন আরেকজনের ছবি তুলছে আর হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে, এক দম্পতি বেড়িয়েছে তাদের পোষা কুকুরটিকে নিয়ে-কাছে যাবার পর দেখালাম ব্রোঞ্জের মূর্তি তারা, ওই তো দেখা যায় ডোম ক্যাথেড্রালের চুড়ো, নদীর পাড়ের বাঁধানো ঘাটে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা কিশোরী, দুগাভা নদীর ওপরের ঝুলন্ত সেতু। নাহ শুধু পয়সার কথা ভেবে এই নৌকা ভ্রমণে না এলে অনেক কিছুই যে অদেখা থেকে যেত।
ছবি। পুরনো শহরকে ঘিরে বয়ে চলা খাল
ছবি। দুগাভা নদী
ছবি। দুগাভা নদী থেকে দেখা ডোম ক্যাথেড্রালের চুড়ো
‘রাইমেরসা এয়ালা’ সড়কের এক কোনের দেয়ালে ঝুলছে হলদে রঙের এক ডাক বাক্স। এই বাক্স দেখেই হটাত মনে পড়লো আরে আমি না নতুন কোন দেশে গেলেই সে দেশের ডাকঘরে ঢু মাড়ি সে দেশের ডাকটিকিটের জন্যে। দু’ ব্লক হাঁটার পরই পেয়ে গেলাম এক ডাকঘর। ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশ লাটভিয়া, তাই ভেবেছিলাম ডাকঘরটি হয়তো হবে এলেবেলে, আর যেহেতু প্রাক্তন সমাজতান্ত্রিক দেশ তাই হয়তো কর্মচারীরাও হয়তো নেহাতই ‘কাজ করতে হয় তাই করছি’ ধরণের। আমার জন্য কিন্তু চমক অপেক্ষা করছিলো। আমেরিকার কোন ডাকঘরের সেবার সাথে লাটভিয়ার এই ডাকঘরের কোন পার্থক্যই আমি খুঁজে পেলামনা, এমনকি ভেতরের সাজসজ্জাও অনেকটা একই। আমেরিকায় যেমন টিকে থাকার জন্যে ডাকঘরগুলো আজকাল বিক্রি করে নানা ধরণের ষ্টেশনারী সামগ্রী, এরাও তেমনি বিক্রি করছে সুভেনির, কার্ড, এমনকি কোমল পানীয়ও। এরাও বুঝে গেছে সেবা-খাত হলেও সরকারের ভর্তুকির দিন শেষ, এখন নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরই বুঝে নিতে হবে। “কোথায় চিঠি পাঠাতে চাও?” কাউন্টারের ওপাশের ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন। “চিঠি না, তোমার দেশের কিছু ডাকটিকিট সাথে করে নিয়ে যেতে চাই স্মৃতি হিসেবে”। ভদ্রমহিলা বেশ আগ্রহের সাথে বের করে দেখালেন তার কাছে থাকা রঙ বেরঙের সব ডাকটিকিট। আমি যেটি চাইছিলাম, সেটি ছিলোনা তার কাছে, উঠে গিয়ে এক সহকর্মীর ডেস্ক থেকে নিয়ে এলেন সেই কাঙ্ক্ষিত ডাকটিকিটটি। সেটি তো বটেই, আরও কিছু ঝলমলে ডাকটিকিট খামে ভরে সুন্দর করে মুড়ে দিলেন। একবার মার কাছে চিঠি পাঠাবো, আমেরিকার এক ডাকঘরে গিয়ে বলেছিলাম চিঠিতে মিটার না বসিয়ে কতগুলো ডাকটিকেট লাগিয়ে দাও না। চরম বিরক্ত হয়ে সেই ডাকঘর কর্মী আমাকে বলেছিল, “মিটার থাকতে আবার ডাকটিকেট কেন হে বাপু? এখন এতো সময় নেই খুঁজে খুঁজে ডাকটিকেট বের করার”। কিন্তু লাটভিয়ানরা মনে হয় এখনও ডাকটিকেটের ব্যাবহার সেভাবে ছাড়তে পারেনি, আরও যেন বহুকাল না পারে সে কামনাই করি। এই ডাকঘরে এসে কিন্তু লাটভিয়ার সরকারী দপ্তরগুলো কেমন চলছে সে বিষয়য়েও একটা ছোটো-খাটো ধারণা পেলাম। সমাজতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসার পর প্রথম দশ-পনের বছর এই সরকারী খাতগুলোকে রীতিমতো কঠিন সময় পাড়ি দিতে হয়। তখনো মানুষের মাঝে জ্বলজ্বলে সমাজতন্ত্রের স্মৃতি, তখনো সবার ধারণা-সেবা, নাগরিক সুবিধা এ সব কিছুর দায়িত্ব কেবলই সরকারের ঘাড়ে। দিনে দিনে সে ধারণা পাল্টাতে থাকে, মানুষ বুঝতে শুরু করে সরকার কোন আলাদা সত্ত্বা নয়, জনগণই সরকার। তাই সত্যিকারের কোন উন্নয়ন পেতে হলে আগে বদলাতে হবে নিজেদের। আরেকটি সমস্যাও ছিল, আর সেটি হল- দুর্নীতি। সোভিয়েত সময়ের শেষ ভাগে এসে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিলো যে কোথাও কোন ভালো আবাসন পেতে হলেও পার্টির ওপরের লেভেলের কারও সুপারিশ প্রয়োজন হতো। এই সুপারিশ, প্রভাব খাটানো, দুর্নীতি এ যেন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো নিত্ত-নৈমিত্তিক ব্যাপার। সেই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য লাটভিয়ানরা প্রাণপণে যুজছে গত বিশটি বছর ধরেই।
বেশ কিছুকাল ঘুমোবার পর মা রাশিয়ার সন্তান প্রেম আবার যেন উথলে উঠেছে। এইতো কদিন আগেই ক্রিমিয়াকে তাই টেনে নিলেন নিজের কোলে। এখন সেই মা আবার তার হারিয়ে যাওয়া অবাধ্য অন্য সন্তানদের কাছে পাবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন কিনা সে নিয়েই চাপা কানা-ঘুষো শুনি চারপাশে। নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে অনেকেরই স্বগোক্তি, “পুরনো সেই দিন আর ফিরে আসবে না বুঝলে, এখন ন্যাটোর প্লেন আছে না আমাদের এখানে?”। তবে এই স্বগোক্তির পরও সত্যিকারের সংশয়টা কিন্তু অনেকেই লুকোতে পারেনা। কিছুটা সংশয় থাকাটা অবশ্য অমূলকও নয়। লাটভিয়া থেকে ফেরার পথে এসব নানান কিছু নিয়েই কথা হচ্ছিলো আন্নার সাথে, আন্না লাটভিয়ার প্রধান গ্যাস কোম্পানির পোর্টফলিও ম্যানেজার।“আচ্ছা আন্না তোমাদের দেশে তো আজ জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশই রাশান, তোমার কি মনে হয়না এই বিপুল সংখ্যক রাশানদের উপস্থিতি তোমাদেরকে একদিন ঠেলে দিতে পারে ইউক্রেনের পরিণতির দিকে? আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি তোমাদের স্বাধীনতা এই রাশানরা সেদিন কি ভাবে মেনে নিয়েছিল”। স্তালিন-পরবর্তী সময়ে ততটা নির্মম ভাবে না হলেও জাতিগত-ভাবে লাটভিয়ানদের স্থানান্তর কিন্তু চলছিলোই, যদিও কিছুটা অন্য ভাবে। সে সময় একটু লেখাপড়া জানা লাটভিয়ানদেরই বদলি-সূত্রে পাঠিয়ে দেয়া হতো সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্য কোন রাজ্যে, অন্তত কয়েক বছরের জন্য। আর তাদের সেই শূন্যস্থান ভরাট করা হতো রাশান বা বেলারুশিয়ানদের এখানে পুনর্বাসন করে। সামরিক কৌশলগত দিক থেকেও লাটভিয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এখানে ছিল বেশ বড়সড় সামরিক উপস্থিতি। অবসর গ্রহণের পর এই সৈন্যদেরও অনেকেই থেকে যায় লাটভিয়ায়, আর এভাবেই আজ লাটভিয়ার জনসংখ্যার এক উল্লেখযোগ্য অংশই রাশান। থেকে যাওয়া এই রাশানদের অনেকের মাঝেই এখনও নাক-উঁচু ভাবটি প্রবল, রাশান ছাড়া ভুলেও তারা লাটভিয়ান ভাষায় কথা বলেন না। স্থানীয়রা ব্যাপারটিকে ভালো চোখে দেখেনা মোটেও। চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্রী এনা তাই রাগ ঝেড়ে আমাকে একবার বলেছিল, “আর বোলনা, এই রাশান বুড়বুড়িগুলো এই দেশকে এখনও ওদের বাপের দেশ ভাবে, হাসপাতালে এলে ওদের মুখ থেকে এক বর্ণ লাটভিয়ানও বের করা যায়না”। আজকের লাটভিয়ায় জাতিগত সংহতি নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে আমার হোটেলের সেই ম্যানেজার ছেলেটি, নিকলাই, বলছিল, “আমার মা বেলারুশিয়ান, বাব লাটভিয়ান।বাবা গিয়েছিলেন বেলারুশে বেড়াতে, সেখানেই মার সাথে পরিচয়। সেই যে বাবার হাত ধরে এলেন, তার পর জীবনের ত্রিশটি বছর কাটিয়ে দিলেন এই লাটভিয়াতেই। কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানো? আমার মা কিন্তু আজও লাটভিয়ার নাগরিক নন।কারণ মা আজও ভাষাটি ঠিক রপ্ত করতে পারেননি, যা কিনা নাগরিক হবার পূর্বশর্ত।নাগরিকত্ব থেকে এভাবে বঞ্চিতরা এই ভাষা জানার ব্যাপারটিকে ভালো ভাবে নেয়নি, তাদের কথা হল এত বছর এ দেশে থাকার পরও যদি এদেশ আমাদের ভাষার দোহাই দিয়ে আপন না ভাবে তবে প্রয়োজন নেই সেই নাগরিকত্বের। প্রতিবেশী লিথুয়ানিয়া কিন্তু এ ভুল করেনি, স্বাধীন হবার পরই ওরা বলে দিয়েছিল সংবিধান এবং সার্বভৌমত্তের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে যারা যারা থেকে যেতে চাইবে তারা সবাই সেদিন থেকে লিথুয়ানিয়ার নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে”।তবে আন্নার মুখ থেকে শুনলাম কিছুটা ভিন্ন ছন্দের কথা-“হ্যাঁ, রাশান প্রবীণরা এখনও কিছুটা জাত্যভিমান ধরে রেখেছে ঠিকই, কিন্তু নতুন প্রজন্মের মাঝে কিন্তু কে রাশান আর কে আসল লাটভিয়ান এ নিয়ে ভেদাভেদ ক্রমশই কমছে। আমাদের পরের প্রজন্ম হয়তো ভুলেই যাবে কার মূল কি, তখন হয়তো সবাই নিজেদের শুধুমাত্র লাটভিয়ান হিসেবে পরিচয় দিতেই গর্ব বোধ করবে। তুমি স্বাধীনতার সময়ের কথা বলছিলে, একটা বিষয় কি জানো, আজকের রাশিয়ায় মত প্রকাশের যে স্বাধীনতা, গর্বাচেভের শেষ সময়ের রাশিয়াতে তার চেয়ে অনেক বেশিই মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল, আর তখনকার সময়ে রাশানরা নিজেরাই ছিল সমাজতন্ত্রের প্রতি ত্যক্ত-বিরক্ত, তারা নিজেরাও মুক্তি চাচ্ছিল এই নাগপাশ থেকে, সেটাই তাদেরকে আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রতি সমব্যথী করে তোলে”। “বুঝলাম, কিন্তু তোমরা যেভাবে পশ্চিমের দিকে ঝুঁকছ সেটা কি রাশিয়াকে চটিয়ে তুলতে পারেনা? আমিতো যত দূর জানি তোমরা এখনও গ্যাসের জন্য অনেকটাই রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল”।“ঠিক বলেছ, আমরা নির্ভরশীল, কিন্তু সামনের দিনগুলোতে আমরা কিন্তু ততটা নির্ভরশীল থাকবনা। লিথুয়ানিয়া, সুইডেন আর নরওয়েকে সাথে নিয়ে আমরা যে সমন্বিত-গ্রিড ব্যবস্থা গড়ে তুলছি, তাতে করে বর্ষার সময় আমাদের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ আমরা পাঠাতে পারব লিথুয়ানিয়ায়, অন্য দিকে শীতের সময় আমরা আনতে পারব সুইডেনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ। আরেকটা ব্যাপার তুমি জানো কিনা জানিনা, গ্যাসের ব্যাপারে আমরা কিন্তু রাশিয়ার ওপর একপাক্ষিকভাবে নির্ভরশীল নই, রাশিয়াও আমাদের উপর নির্ভরশীল অন্য এক দিক দিয়ে”। কি ভাবে??
ক্রুশ্চেভের আমলে ষাটের দশকের শেষ দিকে সিদ্ধান্ত নেয়া হল একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভু-তাত্ত্বিক সমীক্ষা চালানো হবে রাশিয়ার পশ্চিম উপকূলে, মূল উদ্দেশ্য তেল গ্যাসের নতুন আঁধার খুঁজে পাওয়া। বেশ কয়েক বছর ধরে চলল সেই সমীক্ষা। কিন্তু তেমন কোন আশানুরূপ ফল পাওয়া গেলনা। তবে জরিপ শেষ হবার পর ভূতাত্ত্বিকরা আবিষ্কার করলেন একটি চমকপ্রদ ব্যাপার, আর তা হল লাটভিয়ার উপকূলবর্তী অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ বেলে পাথরের স্তরটি এমন যে খুব সহজেই একে ব্যাবহার করা যায় প্রাকৃতিক গ্যাস সংরক্ষণের কাজে। অনেকটা একই সময়ে মস্কোর নীতি-নির্ধারকেরা ভাবছিল কিভাবে উত্তর-পূর্বের গুরুত্বপূর্ণ শহর লেনিনগ্রাদের জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। এই জরিপ তাদের সামনে নিয়ে এলো তার সমাধান। ঠিক হল লাটভিয়ায় নির্মাণ করা হবে বিশাল ভূগর্ভস্থ গ্যাস সংরক্ষণাগার। গ্রীষ্মে এখানে গ্যাস মজুদ করা হবে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে এনে, আর শীতকালে তা সরবরাহ করা হবে লেনিনগ্রাদে। তখন কি আর তারা জানত যে লাটভিয়া একদিন চলে যাবে রাশিয়ার সীমানার বাইরে! মূলত এ কারণেই লাটভিয়া গ্যাসের দিক দিয়ে অনেকটাই নিশ্চিত। রাশিয়ার খুব ভালো ভাবেই জানা আছে লাটভিয়ার সাথে গ্যাস-কূটনীতির পথ ধরলে তাদের সেন্ট-পিটার্সবার্গের উনুনেই হয়তো আগুন জ্বলবেনা।
বাইরে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা এসে লাগছে আমাদের বাসের কাঁচে। ঝুম বৃষ্টিতে বাসের ড্রাইভার বাধ্য হল গাড়ির গতি কমাতে। বৃষ্টিভেজা সবুজ মাঠগুলো যেন আরও বেশি সবুজ মনে হচ্ছে এখন। ফিরে চলেছি লাটভিয়া থেকে। ফেরার পথে ভাবছিলাম আন্নার বলা শেষ কিছু কথা, ”আমাদের এই জাতিগত বিভাজনগুলো কখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে জানো? ঠিক নির্বাচনের সময়। রাজনীতিবিদরা মানুষের মাঝে এই বিভাজনগুলো আরও বেশি করে ছড়িয়ে দিয়ে শুধুই তাদের ফায়দা লুটতে চায়”। হুম, রাজনীতিবিদদের এই বিভাজন তৈরির খেলা কি তবে দেশে দেশে? কে তাদের বোঝাবে এই খেলাগুলো না থাকলেই বরং আমরা হাত ধরাধরি করে চলতে পারি সংহতি আর সৌহাদ্রের পথে, পৃথিবী হয়ে উঠতে পারে আরও শান্তিময়।
ছবি। রিগা সুপার মার্কেটের একাংশ
ছবি। সবজি বাজার
ছবি। সবজি বাজার, পেছনের অংশটি ফুলের দোকানদের দখলে
ছবি। নানা রঙের ফুলের বাজার
ছবি। রিগার প্রধান মার্কেট
ছবি। এই দিদিমার কাছ থেকে কিনেছিলাম এক অপূর্ব এম্বারের মালা
জীবনযুদ্ধ
মন্তব্য
বিস্তারিত লিখেছেন দেখে ভাল লাগলো।
অনেক পুরনো স্মৃতি মনে করিয়ে দিলেন ম্যান, আমরা যখন রিগা গেছিলাম সেখানের ৬০% অধিবাসী ছিল রাশান, দেখা যাক ভবিষ্যতে কী হয়। রিগার অনেক বড় বড় সুদৃশ্য ভবনের স্থপতি কিন্তু বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আইজেনস্টাইনের বাবা।
আচ্ছা, নদীর নামের উচ্চারণটা কী স্থানীয়দের কাছেই শুনেছেন?
facebook
ধন্যবাদ অনুদা , রিগা নিয়ে কিন্তু আপনার কোনো লেখা পাইনি, আপনিও লিখে ফেলুন না কিছু, আপনার প্রতিটি লেখাই তো গোগ্রাসে গিলি।
"রিগার অনেক বড় বড় সুদৃশ্য ভবনের স্থপতি কিন্তু বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আইজেনস্টাইনের বাবা। " - এ তথ্যটি জানা ছিল না, ধন্যবাদ
নাহ, স্থানীয়রা মনে হয় একে উচ্চারণ করে দৌগাভা বা দুওগাভা বলে (আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে)
জীবনযুদ্ধ
কী সুন্দর ছবি!! লেখাও ভালো লেগেছে।
আপনার নিক কি জীবনযুদ্ধ?
____________________________
ধন্যবাদ প্রফেসর , হা আমিই জীবনযুদ্ধ, ধন্যবাদ লেখা এবং ছবি ভালো লাগায়
আসলে নিকটা শেষ ছবির নিচে থাকায় হয়ত ঠিক দৃস্যমান নয়
জীবনযুদ্ধ
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
চমৎকার
"পুরনো শহরের এক গলি" ছবিটা মারাত্মক, মনে হচ্ছে এখনি বাম দিকে পানশালার দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসবে তলোয়ার কোমরে গোঁজা এক আধা মাতাল পাইরেট...আর পিপার উপর হাতের বীয়ারের মগ নামিয়ে রেখে সশব্দে ঢেকুর তুলে বলবে, আররররররর!!
..................................................................
#Banshibir.
জটিল বলেছেন পীরদা , ধন্যবাদ
জীবনযুদ্ধ
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
আপনার এর আগের পর্বটির মতই এই পর্বেও ভ্রমণের সাথে ইতিহাস আর ঐতিহ্য জানানোর চেষ্টা ভালোলাগলো। এই সুবিশাল পোষ্ট লেখতে কি পরিমান কষ্ট করতে হয়েছে আপনাকে? আচ্ছা আপনি কি একা একাই ঘুরতে যান? শুভেচ্ছা, আপনার আরো ভ্রমণ অভিজ্ঞতার জন্যে অপেক্ষায় থাকবো।
মাসুদ সজীব
ধন্যবাদ সজীব আপনার মন্তব্যের জন্যে।
তা প্রায় সপ্তাহ খানেক তো লেগেছেই লেখাটি শেষ করতে।
এবারের ভ্রমণে একাই ছিলাম। আপনার আগ্রহের জন্যে আবারও ধন্যবাদ
জীবনযুদ্ধ
খুব ভালো, খুব ভালো।
অ-নেক ভালো লেগেছে আপনার ছবি, তারচেয়ে বেশী লেখা।
ভালো থাকবেন জীবনযুদ্ধ।
আপনার জন্য শুভকামনা।
---------------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
ওহ্, দারুণ! দারুণ হয়েছে আপনার লেখা ও ছবিগুলো। আর কী সুন্দর টিউলিপ ফুল!
সময়ের অভাবে পুরোটা পড়ে উঠতে অনেক দেরী হয়ে গেল। পড়া শেষ করে খুব ভালো লাগল। লেখা, ছবি - সমস্তই চমৎকার।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ভালো লেগেছে
ধন্যবাদ রুদ্রদা
জীবনযুদ্ধ
নতুন মন্তব্য করুন