১।
সেদিনের সোনা রোদে চমৎকার ড্রাইভ শেষে অফিসে পৌঁছে যার যাথে পরিচয়, তার নামটি পড়তেই আমার মন ভালো হয়ে গিয়েছিল।
এদেশে প্যানসি নামে একটা ফুল ফোটে, স্প্রিং থেকে ফোটা শুরু করে এরা নানা বর্ণে। সামার, ফল শেষ করে শীত এলেও এরা ফুটতেই থাকে। এদের ঠাণ্ডা সহ্য করার অসীম ক্ষমতার জন্য এখানে রোড আইল্যান্ডে গুলোতে বা অফিস এবং বাগান গুলোর সৌন্দর্য বাড়াতে এরা ব্যবহৃত হয় ব্যাপক ভাবে। এদের শুধু মাত্র নিয়মিত জল দেয়া ছাড়া আর তেমন কোন যত্নআত্তিও লাগে না।
আমি নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি মিষ্টি হেসে বললেন, প্যানসি ওয়াটার্স। জানো তো ওয়াটার ছাড়া প্যানসির আর কিছুই লাগে না।
নাম পড়ে-ই তো মুগ্ধ হয়েছিলাম, নামের উপস্থাপনা শুনে আমি পুরোই বিমোহিত।
(জলেই জীবন থাকুক তোমার প্যানসি, আর সব হোক অপ্রয়োজনীয়..।।)
২।
দুপুরটা ছিল রোদের-মেঘের মিশেলে। আমি অফিস শেষ করে হাসপাতালে এলাম, এবারে আরেকজনর জনের পরিচয়। এর নামটা বেশ অদ্ভুত!
রুগী দেখা সবে শুরু করেছি, ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিট(আই সি ইউ) থেকে কল। নার্স জানায়,
-তোমাকে দেখবার জন্য এইমাত্র একজন লাফিয়ে উপরে এসেছেন, ইমারজেন্সী থেকে।
আমি অবাক হইনি, বুঝলাম নতুন কোন রুগী। আই সি ইউ নার্স এভেলীন অনেক দিন ধরে আমাকে চেনে বলে দুষ্টুমি করছে। জিজ্ঞেস করলাম,
-তো লাফিয়ে কেন, বিছানায় করে নয় কেন? ও বলল,
-কারণ উনি মিস্টার ফড়িং (মিস্টার হপার)।
নাম শুনেই ডিজনি পিক্সার এর কার্টুন মুভি 'আ বাগস লাইফ' এর অত্যাচারী, মতলববাজ এবং ইতর ভিলেন ঘাস ফড়িং, 'হপার' এর কথা মনে পড়ে গেল। বড় মেয়ে দেবীর খুব প্রিয় ছবি হওয়াতে অসংখ্য বার দেখা হয়েছে এই ছবিটি। প্রিয় অভিনেতা কেভিন স্পেসি'র অনবদ্য গলায় জীবন্ত হয়ে ওঠা এই ভিলেন চরিত্রটির কথা এখনো বেশ মনে আছে, বদমেজাজি একটা চরিত্র। ভাবনায় পড়ে গেলাম, এই মিস্টার হপারের মেজাজ মর্জি কেমন কে জানে!
একটু পরেই মিস্টার হপার-এর সাথে পরিচয়। তিনি তখনো লাফিয়ে বেড়াচ্ছেন, তবে সেটা ঘুম আর জেগে থাকার মাঝে। ব্যথার ঔষধ বেশী খেয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে ছিলেন কয়েকদিন, প্রতিবেশী খুঁজে পেয়ে এ্যাম্বুল্যান্স কল করে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। এখনও মাথা বেশ এলোমেলো, সাথে সিভিয়ার ডিহাইড্রেশন সহ আরো অনেক সমস্যা। তবে জেগেই ছিলেন। আমি পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলাম,
-তুমি মিস্টার হপার?
মুভির ভিলেন হপার এর মতো একটুও বদমেজাজি নয় এই হপার। বরং মনে হোল বেশ রসিক। বললেন,
-হ্যাঁ, আমি-ই সেই হপার, সারাজীবন লাফিয়ে বেড়িয়েছি। এখনো লাফাচ্ছি ঘুম আর জেগে থাকার মাঝে, জীবন আর মরণের মাঝে। আমি বললাম,
-তুমি বরং মৃত্যুর পাশটা ফেলে জীবনের দিকে লাফিয়ে চলে এসো। আমরা সবাই অপেক্ষায় রইলাম। বুড়ো ফড়িং হালকা হেসে আবার ঘুমে তলিয়ে গেলেন।
হাসপাতাল থেকে বাইরে এসে সবুজ ঘাস আর নানা রঙের ফোটা ফুল দেখে রূপকথার এক গঙ্গা ফড়িং হবার খুব একটা ইচ্ছে জাগলো। সে ফড়িংটার সময় আর দূরত্বের মাঝে লাফিয়ে বেড়ানোর অপার্থিব ক্ষমতা থাকবে। বেশ লাফিয়ে লাফিয়ে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত আর দেশ-বিদেশ করে বেড়াবে সে যখন তখন...। ভাবতেই ভাল লাগছিল। সত্যি, বেশ হোত....... , বেশ হোত তবে...।
(বুড়ো ফড়িং নিশ্চয় লাফ দিতে জীবনের দিকটাই বেঁছে নেবেন।)
৩।
সেই শুক্রবার বিকেলে শেষ রুগীর দোরে যখন পা দিয়েছি, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে। পশ্চিমের জানলা দিয়ে ঢলে নামা স্নিগ্ধ রোদে যাকে দেখতে এলাম তার নাম, উজাল। ৯৩ বছরের উজাল এর নাম বলে সহকর্মী আগের রাতে যখন কন্সাল্টেশনের রিকোয়েস্ট করলেন, তখন তার রোগের বর্ণনা নয়, নামের পিছনের কাহিনী টাই খুব বেশি করে ভাবনাটুকু দখল করে নিয়েছিল। প্রতিটি নামের পিছনে থাকে একটি গল্প, খুব মনে লেগে যাওয়া নাম হলে সেইটি জানবার ইচ্ছেটা চেপে রাখা খুব কঠিন।
উজাল তার গল্পটা ঠিক ঠিক বলতে পারবে কিনা জানতাম না, ৯৩ এ এসে জীবনের অনেক কিছুই বিস্মৃতির ঘন কুয়াশার দখলে চলে যায় জানা আছে। তবে একে বলা যায়, ৯৩ বছরের কিশোরী, সব বোধ এখনো টনটনে। উঁচু কার্ডিয়াক চেয়ারে বসে গায়ে নির্মল আলো লাগিয়ে স্নান করছেন, জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম তুমি কি করে বলো?
ও বলল, মড । আমার লাস্ট নেম উজাল।
বললাম, উজাল এর অর্থ কি? মড ই বা কি বোঝায়।
সে জানাল, মড এসেছে 'মাটিল্ডা' থেকে, আর উজাল তার স্বামীর নাম। অর্থ জানা নেই কিছু।
গল্পটা তবে ছিল না কোনকালেই। একটু আহত মনেই তার সাথে এবার রোগ শোক নিয়ে কথা শুরু করলাম। মড এবারে হতাশ করেনি, চমৎকার করে সব প্রশ্নের উত্তর দিল, কিষাণী মড নিজেদের খামারেই কাটিয়েছে প্রায় সারা জীবন। চাষ বাস আর পশুপালন করেই ছিল তাদের আয় উপার্জন। তিন ছেলে পাঁচ মেয়ের সংসার, এখন গাদা-গুচ্ছের নাতিনাতনি-পুতিপুতনি। খামার এখন ছেলেদের একজন দেখে, নিজে বড় মেয়ের সাথে থাকে, অনেক বছরের হাই ব্লাড প্রেশার আর ডায়াবেটিস, খামারের গাছ-পালা পশুপাখিদের সাথে নিজের শরীরের যত্ন বেশ ভালোই নিয়েছে, এখনও ওর সব কিছু অনেক যুবতী স্বাস্থ্যের ঈর্ষার কারণ হতে পারে। অনেক বছর পরে এই বসন্তে নিউমোনিয়া কে আর ঠেকাতে পারেনি ৯০ উত্তীর্ণ প্রতিরোধ। এখনো বেশ শ্বাস কষ্ট, তবু মুখে অপরূপ এক স্মিতি নিয়ে বলল ও, এখনই অনেক ভালো হয়ে গেছি, আর দুয়েক দিন সব ঠিক হোয়ে যাবে। আমার দেবার আশ্বাস আমাকেই দিয়ে দিল আগেভাগে। কথা শেষ করে বেরিয়ে আসার আগে আবার জিগ্যেস করলাম, তোমার স্বামী এখনো বেঁচে আছেন?
না, ও চলে গেছে আজ অনেক বছর। আমি ওর নাম নিয়ে আছি এখনও, তবে আর খুব বেশী দিনের অপেক্ষা নয়।
বেরিয়ে আসতে গিয়ে দুয়ারে দাঁড়িয়ে 'মড উজাল' কে আবার দেখলাম একবার, মুখের বাম পাশ ম্লান সোনালী রোদে ভেজা, মৃদু যন্ত্রনা ক্লিষ্ট মুখ তবু কি আশ্চর্য এক পরিতৃপ্তি।
(মড উজাল নামের কোন গল্প নেই, সে নিজেই যে এক অপরূপ পরিতৃপ্তির গল্প।)
মন্তব্য
বাহ!
[মড উজাল নামের কোনও গপ্প নেই, কিন্তু মাটিলদা নামে তো ছিল]
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
সাক্ষী সত্যানন্দ,
মাটিল্ডা নামের গল্প আছে, কিন্তু ওর নাম যে 'মড', 'মাটিল্ডা' নয়। তাই আর সে গল্পটা শোনা হয়নি আমার।
পড়বার জন্য ধন্যবাদ।
রীতু
'সেই যেখানে সারাজীবন বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে...
সেই যেখানে কেউ যায়না, কেউ যায় নি কোনদিনই...'
চমৎকার লাগলো টুকরো টুকরো জীবনকথা। সবার জীবনটাই আসলে গল্প!!
____________________________
রীতু
'সেই যেখানে সারাজীবন বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে...
সেই যেখানে কেউ যায়না, কেউ যায় নি কোনদিনই...'
আপনার লেখা পড়তে ভাল লাগছে। চলুক।
সোহেল লেহস
চালিয়ে যাবার ইচ্ছে আছে, শুধু সমস্যা হয় সময়ের। সাথে থাকার জন্য ধ্ন্যবাদ।
রীতু
'সেই যেখানে সারাজীবন বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে...
সেই যেখানে কেউ যায়না, কেউ যায় নি কোনদিনই...'
ভালো লাগলো পড়ে।
এমনকরে লিখতে থাকুন।
শুভকামনা জানবেন রীতু।
ভালো থাকুন।
------------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
আপনি ফিরে এসেছেন লেখা পড়তে দেখে অনেক ভালো লাগল। ভালো থাকুন, শুভকামনা।
রীতু
'সেই যেখানে সারাজীবন বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে...
সেই যেখানে কেউ যায়না, কেউ যায় নি কোনদিনই...'
অনেক ভালো লাগলো।
চলুক আপনার লেখা।
শুভকামনা জানবেন রীতু।
ভালো থাকবেন।
---------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
'নাম'-এর এই গল্পগুলো ভালো লেগেছে। বিশেষত এই লাইনটা ছুঁয়ে গেছে,
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
যাক, পাণ্ডবদের একজনকে অন্তত আমার লেখা ছুঁয়েছে
শুভেচ্ছা।
রীতু
'সেই যেখানে সারাজীবন বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে...
সেই যেখানে কেউ যায়না, কেউ যায় নি কোনদিনই...'
বেশ ভাল লাগছে আপনার গল্পকথাগুলো। পড়ে কেমন যেন একটা 'বেশ তো!' রকমের ভাল লাগা ছুঁয়ে যায়!
চলুক এভাবেই।
-স্বপ্নচারীর স্বপ্ন
ভালোলাগা ছুঁয়ে থাকুক যদিন লিখি ততোদিন।
ধন্যবাদ।
রীতু
'সেই যেখানে সারাজীবন বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে...
সেই যেখানে কেউ যায়না, কেউ যায় নি কোনদিনই...'
এই পর্ব বেশ ভাল্লেগেছে।
বিশেষত এই অংশটা।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
রীতু
'সেই যেখানে সারাজীবন বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে...
সেই যেখানে কেউ যায়না, কেউ যায় নি কোনদিনই...'
মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা। লিখতে থাকুন, মন খুলে।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
মন খোলাই থাকে, হাত খুলতে পারিনা। সময় নিতান্তই সল্প।
অনেক ধন্যবাদ। সাথেই থাকুন।
রীতু
'সেই যেখানে সারাজীবন বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে...
সেই যেখানে কেউ যায়না, কেউ যায় নি কোনদিনই...'
ভাল লাগলো জীবনের কথকতা। আমিও জীবনের দিকেই লাফিয়ে চলে যাব।
লেখা চলুক।
এইতো শুনতে চেয়েছিলাম।
শুভকামনা।
রীতু
'সেই যেখানে সারাজীবন বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে...
সেই যেখানে কেউ যায়না, কেউ যায় নি কোনদিনই...'
স্কুল মাস্টার বিভূতি ভূষণ পশ্চিমে যান নি , কিন্তু তাঁর দেশের, তাঁর মতো অনেকেই গেছেন !
বিহঙ্গ-চোখ,গল্পকাজল জেগে থাক অনিবার।
রাজর্ষি
বিভূতি ভূষণ .............!! বাক্যহীন।
"বিহঙ্গ-চোখ,গল্পকাজল" ; অসীম ভালোলাগা।
রীতু
'সেই যেখানে সারাজীবন বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে...
সেই যেখানে কেউ যায়না, কেউ যায় নি কোনদিনই...'
ভাল।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
রীতু
'সেই যেখানে সারাজীবন বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে...
সেই যেখানে কেউ যায়না, কেউ যায় নি কোনদিনই...'
ভালো
ধন্যবাদ।
রীতু
'সেই যেখানে সারাজীবন বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে...
সেই যেখানে কেউ যায়না, কেউ যায় নি কোনদিনই...'
লেখা দামী
কবি111
নতুন মন্তব্য করুন