বাংলাদেশের ঔষুধ শিল্পের মান ও উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ে গতপর্বে কিছুটা অালোচনা করেছিলাম। সেই ধারাবাহিকতায় এই পর্বে সরকারী ঔষুধ উৎপাদন, ঔষুধ সেবন, বাংলাদেশের ঔষুধ শিল্পের ভবিষ্যত, ঔষুধ সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা আর উদাসীনতা সহ প্রাসঙ্গিক নানান বিষয় নিয়ে আলোকপাত করবো।
সরকারী ঔষুধ উৎপাদন ও বিতরণ: বাংলাদেশ সরকার তার সরকারী হাসপাতালগুলো তে গরীব জনসাধরণকে চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্যে বিনামূলে কিংবা নাম মাত্র মূলে ঔষুধ দিয়ে থাকে। সেই ঔষুধের সংখ্যা নেহাত কম নয়, বছরে প্রায় কয়েক কোটি টাকার ঔষুধ উৎপাদনের দায়িত্ব সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে থাকে। এই দায়িত্ব পালন করার কথা দেশের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর কিন্তু তারা সেটি করে না যার ফলে সেইসব ঔষুধ উৎপাদিত হয় মাঝারি কিংবা নিম্ন মানের ঔষুধ উৎপাদন প্রতিষ্ঠানে। বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সরকারের সাথে গভীর সম্পর্কের কারণে সাধারণত সরকারী ঔষুধ উৎপাদনে যায় না। এর প্রধান কারণ সরকারী ঔষুধে সরকার লাভ দেয় তুলনামূলক লাভের চেয়ে অনেক কম। ফলে অল্প লাভে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো সেই ঔষুধ উৎপাদনে আগ্রহী হয় না। এমনিতে বাংলাদেশের ঔষুধ উৎপানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের আর বিদেশের মানুষের জন্যে মোটামুটি দুই মানের ঔষুধ উৎপাদন করে সেখানে আরো সস্তায় যদি ঔষুধ উৎপাদন করতে হয় তাহলে তার মান কেমন হতে পারে সেটি সহজে অনুমেয়। সরকারী ঔষুধের ক্ষেত্রে কোন প্রকার মান নিয়ন্ত্রনের ধার না ধেরে সেগুলো বাজারজাত করা হয়। আমার এক পরিচিত বন্ধুর নিম্ন মাঝারি মানের প্রতিষ্ঠান, সরকারী ঔষুধ উৎপাদনের একটা বড় দায়িত্ব পেয়েছে শুনলাম। তার সাথে ঈদে এটা নিয়ে কথা হলো, সেই প্রতিষ্ঠানে মান নিয়ন্ত্রনের অন্যতম বিভাগ Microbiology আর QA (Quality Assurance)-ই নেই। ঔষুধ উৎপাদনের মান নিয়ন্ত্রনের প্রথম ধাপ হলো কাঁচামাল পরীক্ষায় পাসের পর সেটি ব্যবহারের অনুমোদন অথচ সেই প্রতিষ্ঠান কাঁচামাল আগে পাশ দিয়ে তারপর সেটি পরীক্ষা করে! এরচেয়ে হাস্যকর আর কি হতে পারে। পরিপূর্ণ ঔষুধেও তারা একই পন্থা অবলম্বন করে। এই যদি সরকারের আস্থা আর ঔষুধ উৎপাদনের জায়গা হয় তাহলে সেটির মান নিয়ে আলোচনা না করাই উত্তম। আমাদের সরকারের ভাব টা এমন যে গরীব মানুষ মরলে কি, কে তার খোঁজ রাখবে? বিনে পয়সায় ঔষুধ দিচ্ছি এটাই বা কম কিসের!
মানহীন নিম্নমানের ঔষুধগুলো যখন হাসপাতালে আসে সেটিও গরীব মানুষজন ঠিকমতো পায়না নানান দুর্নীতি আর অনিয়মের কারনে। নানান সিন্ডিকেটের হাত ধরে সেটি চলে যায় মফস্বলের ফার্মাসীগুলোতে। অনুমতিহীন ফার্মাসীগুলো অধিক লাভের লোভে সেগুলো ক্রয় করে। এভাবেই দুর্নীতি আর অনিয়মের কারণে মানহীন সরকারী ঔষুধও চলে যাচ্ছে বাজারে। সরকারের উচিত বড় প্রতিষ্ঠান থেকে গরীব জনসাধারণের জন্যে আদর্শ মানের ঔষুধ উৎপাদন করা, বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই কাজে বাধ্য করা। যতদিন সেটি করা সম্ভব হবে না ততদিন সরকারী ঔষুধের মানের কোন উন্নতি ঘটবে না।
ঔষুধের গঠন ও নাম: ঔষুধ যে কাঁচামাল দিয়ে গঠিত হয় তাকে দুভাগে ভাগ করা হয়, যার একটির নাম অ্যাকটিভ অন্যটির নাম এক্সিপিয়েন্ট। প্রতিটি ঔষুধে অ্যাকটিভ (সক্রিয়/কর্মিষ্ঠ উপাদান) থাকে কমপক্ষে একটি, কোন কোন ঔষুধে একের অধিক ও একটিভ থাকতে পারে। অপরদিকে যে কোন ঔষুধে এক বা ততোধিক এক্সিপিয়েন্ট (সহায়ক উপাদান) থাকে। মূল কাজটি হলো ঐ অ্যাকটিভের। যাকে ফার্মাসিউটিক্যালসের ভাষায় জেনেরিক বলে। বাজারে প্রচলিত ঔষুধের নাম সেই অ্যাকটিভ অনুসারে হয় না, কারণ একি অ্যাকটিভ দিয়ে প্রায় সব কোম্পানি ঔষুধ উৎপাদন করে। ফলে প্রতিটি কোম্পানিকে ভিন্ন ভিন্ন নাম ব্যবহার করতে হয়। আর আমরা সেই ভিন্ন নামেই ঔষুধ কে চিনে থাকি। প্রতিটি ঔষুধের গায়ে তার অ্যাকটিভের নাম লেখা থাকে। যেমন ধরুন সবার অ্যাকটিভ প্যারাসিটামল হলেও ঔষুধের নাম হচ্ছে কারো নাপা, কারো এইচ, কারো রিসেট, কারো ফ্যাপ প্রভৃতি। যেহেতু সাধারণ জনসাধারণ প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ঔষুধের নামটাই শুধু জানে তাই খুব কম মানুষ তার জেনেরিকের নাম জানে, বিশেষ করে অতি প্রচলিত ঔষুধগুলো ছাড়া। আমারদের সবারি উচিত অ্যাকটিভটার নাম জানা। যেমন প্যাটে গ্যাসের সমস্যার জন্যে নানান মাত্রার ঔষুধ আছে, ওমিপ্রাজল-প্যান্টোপ্রাজল-ইসিমোপ্রাজল-রাবিপ্রাজিল প্রভৃতি। ধরা যাক কারো পেটে গ্যাসের সমস্যা, সে পেটের গ্যাসের সমস্যার জন্যে এইসকেপের লোসাকটিল খায়, কিন্তু সে লোসাকটিলের অ্যাকটিভ(ওমিপ্রাজল-২০) কি তা জানে না। কোথাও গিয়ে যদি সে লোসাকটিল না পায় আর দোকনিকে যদি বলে গ্যাসের ট্যাবলেট দিন তখন দোকানদার তাকে দেখা গেল ইসিমোপ্রাজল অ্যাকটিভের ইবনে সিনার ইসোলক কিংবা প্যাসিফিকের ইসপ্রাজো দিয়ে বললো এটি গ্যাসের জন্যে ভালো। যার দুটোর কোনটাই ওই ব্যাক্তির জন্যে সহায়ক নয়। আমরা যদি ওমিপ্রাজল-২০ কে এগুলোর মাঝে সর্বনিম্নমাত্রার সহায়ক ঔষুধ ধরি তাহলে ক্রমানুসারে রাবিপ্রাজল হবে সর্বোচ্চমাত্রার সহায়ক ঔষুধ। এখন যার প্রয়োজন মধ্যম মাত্রার ঔষুধ সে যদি সর্বোচ্চ মাত্রার ঔষুধে অভ্যস্থ হয়ে যায় তাহলে পরবর্তীতে তার আর মধ্যম মাত্রার ঔষুধ কাজ করবে না। তাই শুধু প্রতিষ্ঠানের নামে নয় ঔষুধ চিনতে হবে অ্যাকটিভের নাম অনুসারে। ফলে অধিক লাভের জন্যে ফার্মাসিগুলো আপনাকে যেকোন ঔষুধ গুছিয়ে দিতে পারবে না।
ঔষুধ সেবনে সচেতনতা: অসুখ হলে ওষুধ খেতে হয় এটা সবাই জানি, কিন্তু সেই ঔষুধ খাওয়ার নিয়ম আমরা মানি না। আর এই নিয়ম না মানার জন্যেই আমাদের অসুখগুলো পরবর্তীতে ভয়ংকর রূপে ফিরে আসে। নিয়ম বলতে দুটো বিষয়কে বুঝায়, প্রথমত ডাক্তারের পরামর্শে ঔষুধ খাওয়া দ্বিতীয়ত সম্পূর্ণ ডোজ শেষ করা এবং সময় মেনে সেই ঔষুধ খাওয়া। আমাদের দেশে কোন নিয়ম-ই আমরা যথাযথ ভাবে পালন করি না। প্রথমত আমরা কমবেশি সবাই ডাক্তার! তাই বেশিভাগ রোগের চিকিৎসার অামরা নিজেরাই করে ফেলি। যেমন এই ঈদে আমার নিজের পেটের সমস্যা দেখা দিলো, কিছুই খেতে পারছি না। ফলাফল হিসেবে কেউ বলছেে এন্টাসিড খেতে, কেউ বলছে ইসো খাও ভালো হয়ে যাবে, কেউবা ডমপিরিডিন খেতে বলছে। অর্থাৎ সবাই বিশেষজ্ঞ পরামর্শদাতা। আমার এ ওষুধে ভালো হয়েছে তাই তোমারও ভালো হবে এ যুক্তি সবার। আর আমাদের দেশে বন্ধু, আত্নীয় স্বজনের চেয়েও বড় ডাক্তার হলো ঔষুধের দোকানদার, যাদের ঔষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কোন ধারণাই থাকে না তারাই সবচেয়ে বড় ডাক্তার সেজে প্রতিটি পাড়া, মহল্লা, গ্রাম দখল করে আছে।
এরচেয়েও ভয়াবহ হলো ঔষুধ সেবন বন্ধ করে দেওয়া। অসুখ ভালো হয়ে যাওয়ার কারনে ডোজের মাঝপথে ঔষুধ সেবন বন্ধ করে দেওয়া হলো সবচেয়ে বড় ক্ষতিকারক। বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে এর সদূর প্রসারী প্রভাব পড়ে। ধরা যাক আপনার পেটে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমন হয়েছে মারাত্নক আকারে। ডাক্তার আপনাকে সাত দিনের অ্যান্টিবায়োটিক দিলো। পাঁচ দিনের দিন আপনি সুস্থ হয়ে ঔষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু পাকস্থলীতে থাকা সকল ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া কিন্তু মারা গেলো না, একটা ব্যাকটেরিয়াও যদি বেঁচে থাকে আর তা মল কিংবা হাঁচি-কাশীর মাধ্যমে আবার পরিবেশে ফিরে আসবে। সেই ব্যাকটেরিয়া জেনে গেছে ওই অ্যান্টিবায়োটিক কিভাবে তাদের ক্ষতি করে, ফলে পরেরবার এরা যখন অন্য মানুষের পাকস্থলীতে যাচ্ছে তখন তারা ঠিকি সেই অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। একে 'অ্যান্টিবায়োটি রেজিসটেন্স' বলে। ফলাফল সেই অ্যান্টিবায়োটিক আর ঐ সমস্ত ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে শতভাগ কাজ করতে পারছে না। এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা বংশানুক্রমে পরবর্তী প্রজেন্মর ব্যকটেরিয়ার মাঝে স্থানান্তরিত হচ্ছে। এই কারনেই অনেক এন্টিবায়োটিক এখন আর কাজ করেনা, এগুলোর ক্ষমতাও কমে আসছে দিনে দিনে। কিছুদিন আগে সরকারী এক গবেষনায় দেখা গেছে বাংলাদেশে বেশি ভাগ অ্যান্টিবায়োটিক ৫০ ভাগও কাজ করে না। বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে প্রধান দুটি অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে দেখা গেছে এগুলো আর কাজ করছে না। এদের একটি হলো কার্বপেনম। নিউমেনিয়া, রক্তে প্রদাহ এবং নবজাতকের দেহে প্রদাহের মতো রোগ নির্নয়ে এটি ব্যবহার হয়ে থাকে। চিকিৎসকরা এ অ্যান্টিবায়োটিক বেশি ব্যবহার করায় এবং রোগীরা ঠিক মতো ওষুধ না খাওয়ায় জীবাণু ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। যৌন রোগে গনোরিয়ার অ্যান্টিবায়োটিক ঔষুধ যুক্তরাজ্যেই এখন কাজ করে না। গনোরিয়ার কারণে বন্ধ্যত্ব দেখা দিতে পারে। বিশ্বে প্রতিদিন সাড়ে ১০ লক্ষ মানুষ গনোরিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে!
অনেক অ্যান্টিবায়োটিকের কয়েকটি প্রজন্ম চলে গেছে, প্রজন্ম বলতে সহজ ভাষায় ববুঝায় সংস্কার। ঠিক কি ধরনের প্রতিরোধ ব্যাকটেরিয়া গড়ে তুলে সেটি আবিষ্কার করে সেই প্রতিরোধ ভেঙ্গে দেওয়ার জন্যে নতুন গঠন কিংবা বৈশিষ্ট্য ঔষুধে নিয়ে আসা। বিষয়টি আসলে যত সহজ কাজটি আসলে তত কঠিন। অনেক অনেক গবেষনা আর দীর্ঘ সময়ের সাথে প্রয়োজন হয় বিপুল পরিমান অর্থের। আবার দেখা যাচ্ছে প্রতিটি অ্যান্টিবায়োটিক এর কার্যক্ষমতা সব দেশে সমান নয়, যেখানে ভুল ব্যবহার হয় বেশি সেখানে এর কার্যক্ষমতা কমে আসে, যেমন বাংলাদেশে। বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতার কমে যাওয়ার মূল কারণ কারনে অকারনে এটি সেবন এবং ডোজ শেষ হওয়ার আগে সেটি বন্ধ করে দেওয়া। অ্যান্টিবায়োটিকের পরিমান ব্যাকটেরিয়ার তুলনায় অতি নগন্য ।এভাবে চলতে থাকলে ব্যাকটেরিয়ার কাছে ঔষুধের তথা মানুষের শোচনীয় পরাজয় সন্নিকটে। এখন শুনতে হাস্যকর কিংবা অবিশ্বাস্য শুনালেও এভাবে চলতে থাকলে খুব সাধারণ সংক্রমণ আর সামান্য কাঁটাছেড়াতেও মানুষ মারা যাবে! তাই অ্যান্টিবায়োটিক তাকেই খেতে হবে যার প্রয়োজন, একদিনের জ্বর, একদিনের পেটের ব্যাথায় নিজেই ডাক্তার হয়ে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে। আমাদের দেশে ডাক্তাররাও কথায় কথায় অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকে। এর দুটো উপকারিতা আছে, প্রথমত এতে অল্পতেই রোগ ভালো হয়ে যায় ফলে ডাক্তারের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত ঔষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর লব্দিকরা এমআরদেরকেও খুশি করে নানান সুযোগসুবিধা পাওয়া যায়। এ কথায় হয়তো অনেক ডাক্তার আহত হবেন, কিন্তু বিষয়টা চরম সত্য। আমার নিজের ভাই-ভাবী ডাক্তার। ওরা একমাসে যে পরিমান ঔষুধ ফ্রি পায় তাতে ছোটখাট একটা ফার্মাসি দেওয়া কোন বিষয়-ই না। এটি ছাড়াও নানান উপহারতো আছেই। বিষয়টি শুধু অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে নয়, সব প্রেসক্রিপশানের ক্ষেত্রে ঘটে। অধিক কমিশনের লোভে পড়ে ডাক্তাররা অজ্ঞাত, অখ্যাত কোম্পানির ঔষুধও লিখে দিচ্ছে। সেই কারনে সাধারণ জনসাধারণকে সচেতন হতে হবে, ডাক্তার যে ঔষুধটি লিখে দিবেন সেটি যদি অজ্ঞাত আর অখ্যাত কোম্পানির হয় তাহলে সেই অ্যাক্টিভের-ই ঔষুধ আপনি বড় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নেওয়ার চেষ্টা করবেন।
এতো গেলো জীবাণু সংক্রামণ এর কথা। অন্য যেকোন নিয়মিত ব্যাধি যেমন হাই ব্লাড প্রেশার, ডায়বেটিসে ঔষুধ ব্যবহারে অনিয়মিত হলে উপকারের চেয়ে অপকার-ই বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আপন হোক আর প্রিয় হোক অজ্ঞ ব্যাক্তির পরামর্শে ঔষুধ খাওয়া কোন ভাবেই ঠিক নয়। চিকিৎসক-ই ভালো বলতে পারবেন কোন ঔষুধের কি পাশ্বপ্রতিক্রিয়া আছে ফলে তিনি খুব ভালো করে জানেন কাকে কি ঔষুধ ভালো কাজ করবে। খুব সাধারণ ঔষুধ যা সহজলভ্য, প্রেসক্রিপশান ছাড়া যেগুলো আমরা মুড়ির মতো খাই সেগুলোরও মারাত্নক পাশ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। যেমন কৃমির ঔষুধ গর্ভের শিশুদের মারাত্নক ক্ষতি করে, প্যারাসিটামল লিভারের রোগীর জন্যে অন্যতম ক্ষতির কারণ। তাই ইচ্ছেমতো ঔষুধ খাওয়ার অভ্যেস আমাদেরকে পরিহার করতে হবে। এছাড়া ঔষুধ খাওয়ার সময় ও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যে ঔষুধ খালি পেটে কাজ করবে সেটি ভরা পেটে খেলে কাজ করবে না। সুতরাং ঔষুধ সেবনে সবাইকে সচেতন এবং আরো যত্নবান হতে হবে।
ঔষুধের দাম এবং মেয়াদ: অবাক করা বিষয় হলো আমাদের দেশে ঔষুধের জন্যে সুনিদিষ্ট কোন নীতিমালা নেই। আর নীতিমালা দিয়েও বাংলাদেশে ঔষুধের দাম নিয়ন্ত্রন রাখা যাবে কিনা সেটিও ভাববার বিষয়। কারণ আইন করে বসে থাকলে জনগণ কখনো সেই আইনের সুফল পায় না। তাই প্রয়োজন সেটি মনিটরিং এর। নিদিষ্ট নীতি নেই বলেই বাংলাদেশে একি ঔষুধের দাম একেকে প্রতিষ্ঠান একেক রকম রাখছে! যেমন এরিষ্টোফার্মার ক্যালসিয়ামের একপাতা ট্যাবলেটের দাম ২৫ টাকা আর স্কয়ার ফার্মার সেই একি ঔষুধের দাম ৩৫ টাকা। এভাবে কমবেশি প্রতিটি ঔষুধে প্রতিষ্ঠান ভিত্তিতে দামের উঠানামা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। এবার দেখলাম একটি নিম্ন মাঝারি মানের প্রতিষ্ঠানের মাঠ পর্যায়ের বিক্রেতা ৬০টি ক্যাপসুলের একবাক্স ওমিপ্রাজল-২০ মাত্র ৭৫ টাকায় একটি ফার্মাসিতে দিচ্ছে ঠিক সেই ঔষুধ বড় প্রতিষ্ঠান দিচ্ছে ১৮০ টাকায়! তাহলে কি দাঁড়ালো? ফার্মাসিগুলো বেশি মুনাফার লোভে নিশ্চয় কম দামের ঔষুধটি বেশি রাখবে। একটি ওমিপ্রাজল ৫টাকা করে বিক্রি করলে তাল লাভ থাকছে প্রায় চারশগুন।, ভাবা যায়! এর ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকেও উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে হচ্ছে। আর যখনি উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা হচ্ছে তখনি মানের সাথে আপোষ করতে হচ্ছে। এভাবেই সুনিদিষ্ট নীতি আর তার প্রয়োগের অভাবে দিন দিন বাংলাদেশের ঔষুধ শিল্পের মান নিচের দিকে যাচ্ছে।
ঔষু্ধের মানের সাথে সাথে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো তার মেয়াদ যাচাই। এখানেও রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি। সাধারণত ট্যাবলেট-ক্যাপসুলের ক্ষেত্রে ঔষুধের উৎপাদন সময় ও মেয়াদের সময় প্রতিটি আলাদা পাতায় উল্লেখ থাকে না, উল্লেখ থাকে বাক্স কিংবা কার্টনে। আর সাধারণ জনগণ কখনো বাক্স/কার্টন সহ ঔষুধ কিনে না। কারণ এক বাক্সে থাকে অনেক ঔষুধ। ফলে তার ক্রয়কৃত ঔষুধের মেয়াদ আছে কি নেই তার জন্যে নির্ভর থাকতে হচ্ছে ফার্মাসির দোকানদারের উপর। মেয়াদ আছে কি নেই তা জনগণের যাচাইয়ের কোন উপায় থাকছে না। এই ফাঁকিবাজি বন্ধ করতে প্রয়োজন প্রতিটি ট্যাবলেট আর ক্যাপসুলের পাতার গায়ে তার উৎপাদন এবং মেয়াদ উর্ত্তীনের তারিখ উল্লেখ। এটি করতে না পারলে মানহীনের পর মেয়াদহীন ঔষুধও মানুষকে খেয়ে যেতে হবে অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্য।
বাংলাদেশের ঔষুধ শিল্পের ভবিষ্যত: গার্মেন্টস শিল্পের পরে বাংলাদেশের ঔষুধ শিল্প সবচেয়ে সম্ভবনাময় একথা আমি-আপনি কমবেশি সবাই জানি। কিন্তু কাগজে কলমের সেই সম্ভবনা আসলে কতটুকু বাস্তবিক সেটা ক-জনে জানে? গার্মেন্টস শিল্পের মতো এখানেও সস্তায় শ্রম পাওয়া যায় বলে বিশ্বের অন্য যেকোন দেশ থেকে বাংলাদেশে ঔষুধ উৎপাদন খরচ অনেক অনেক কম। আর ঠিক এই কারনেই বাংলাদেশের ঔষুধ পৃথিবীর ৯০টি দেশে যাচ্ছে। আরো অনেক দেশে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু সব সময় কি এমন সস্তায় সব পাওয়া যাবে? বিস্ময়কর হলেও সত্য আমাদের দেশে উৎপাদিত কোন ঔষুধ-ই আমাদের নিজস্ব নয়। বেশিভাগ কাঁচামাল( অ্যাকটিভ-এক্সিপিয়েন্ট) বাহির থেকে আনতে হয়, অ্যাকটিভ-অ্যাক্সিপিয়েন্ট দিয়ে ঔষুধ তৈরী করার কোন ফর্মুলাই অমাাদরে নয়। অর্থাৎ সবকিছুতে আমারা অন্যের উপর নির্ভরশীল। আমরা শুধু অন্যদেশ থেকে ধার করা ফর্মুলা দেখে দেখে ঔষুধ বানিয়ে বাজারজাত করি। আমরা খুব কম অ্যাকটিভ উৎপাদন করতে পারি (প্যারাসিটামল এখন অল্প পরিসরে হচ্ছে, তবে তার মান যথেষ্ট নয়), এক্সিপিয়েন্টও ও খুব নগন্য পরিমানে উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে সবকিছুর জন্যে বিদেশের উপর নির্ভশীল থাকতে হচ্ছে আমাদের। এটি অনেকটা আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের প্রথম দিককার অবস্থার মতো। প্রথম দিকে আমাদেরকে বাহির থেকে কাপড়, সুঁই-সুতা নিয়ে আসতে হতো। আমরা শুধু সেলাই করে দিতাম। এখন আমাদের ঔষুধ শিল্পও তাই। যত ঔষুধ বাংলাদেশে উৎপাদিত হয় তার প্রতিটি ফর্মুলা বা পেটেন্ট রাইটস বাহির থেকে ধার করা। আর হুমকিটা এই ধার করাতেই। ২০১৬ সালের পর পেটেন্ট রাইটস আবিষ্কারক দেশগুলো থেকে কিনে আনতে হবে। অর্থাৎ নতুন ঔষুধ আবিষ্কারের ফর্মুলাগুলো এখনকার মতো বিনামূল্যে আর পাওয়া যাবে না তখন। উচ্চমূল্যে সেগুলো ক্রয় করতে হবে। সেই উচ্চমূল্য কত হতে পারে সেটা নিয়ে একটা ধারণা দেই। একটি নতুন ঔষুধ আবিষ্কার করতে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়! আপনি যখন তার উৎপাদন কৌশল ক্রয় করতে যাবেন তখন তার দামও হবে আকাশচুম্বী। তাই ঔষুধ দাম বেড়ে যাবে এখনকার চেয়ে বহুবহু গুন। ২০১৬ সালের পর সত্যি এই অবস্থা হলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আর ঔষুধ কিনে খাওয়ার সামর্থ্য থাকবে না।
তাহলে এ শিল্পের ভবিষ্যত কতটুকু সম্ভবনাময়? একটি নুতন ঔষুধ আবিষ্কার করতে যেখানে ৫৬ হাজার কোটি টাকা খরচ হয় সেখানে বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠানতো দূরের কথা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষেও একাজে এগিয়ে আসা সম্ভব হয়নি এখন পর্যন্ত। শুধু বাংলাদেশ নয়, উন্নয়শীল কোন রাষ্ট্রের পক্ষেই নতুন ঔষুধ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ব্রিটেন, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি এবং আমেরিকায় প্রায় সব ঔষুধ আবিষ্কার হয়েছে। তাহলে কি ঘটতে যাচ্ছে ভবিষ্যতে? অন্যের হাতে ভাগ্য সোপে দিয়ে কি আমরা বসে থাকবো? উন্নত বিশ্বে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের পাশাপাশি ঔষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন ঔষুধ আবিষ্কারের জন্যে গবেষনায় অর্থ লগ্নি করে। আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর একার পক্ষে হয়তো সেটি সম্ভব না হলেও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আর সরকার মিলে সেই গবেষনায় মনোযোগী হতে পারে। এছাড়া যৌথভাবে দুই-তিনটি রাষ্ট্র গবেষনার অর্থ ব্যয় করতে পারে। এটি ইউরোপে প্রায়-ই হচ্ছে। আসল কথা নিজেরা ঔষুধ গবেষনায় যুক্ত হওয়ার সময় এসেছে, আর নিজেরা নতুন ঔষুধ আবিষ্কার করতে না পারলে সেটি কোনভাবেই এই শিল্পকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে পারবে না।
মাসুদ সজীব
মন্তব্য
ভয়ংকর অবস্হা। এই সেক্টরের অবস্হা যে এত খারাপ আপনার লেখা না পড়লে জানতেই পারতাম না!!
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
খোঁজ নিলে দেখা যাবে দেশের সব সেক্টর-ই গভীর দুর্নীতি আর অনিয়মের সাগরে নিমজ্জিত ।
মাসুদ সজীব
দু'টি লেখার জন্যই আপনেক ধন্যবাদ। অবস্থা খারাপ জানতাম কিন্তু এখন ত দেখি অবস্থাই নাই ।
অহন তাইলে আমরা কী কর্তাম?
-------------------------
আশফাক(অধম)
সচেতন হতে হবে, অসুখ হলেই নিজে ডাক্তার সেজে ওষুধ না খেয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। ওষুধ ক্রয়ের আগে প্রতিষ্ঠানের নাম এবং মেয়াদ দেখে কিনতে হবে। এবং ওষুধের ডোজ শেষ করতে হবে আর বাকীটা ছেড়ে দিন উপরওয়ালার হাতে। কথায় আছে না রাখে আল্লাহ মারে কে
মাসুদ সজীব
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
সচলে যে পরিমান ইটা রেখে গেছেন সেগুলো দিয়ে মনে হয় এতদিনে একটা বাড়ী করে ফেলতাম । গুপনে গুপনে বলেনতো খাম্বা মামুনকে টেক্কা দিতে কি এহন ইটের ব্যবসায় নামছেন নাকি?
মাসুদ সজীব
____________________________
সুস্থ থাকুন, সচেতন থাকুন
মাসুদ সজীব
ধন্যবাদ মাসুদ
ভালোথাকুন সবসময়
মাসুদ সজীব
আপনার দু'টো লেখাতেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই লেখাটা আরও প্রচার মাধ্যমে আসা উচিত যাতে করে আপনার পরামর্শগুলো সবাই জানতে পারে (আমিও মাথায় টুকে রাখলাম):
- পুরো ডোজ শেষ করা
-ভালো-মন্দ ওষুধের পার্থক্য করা
-জেনেরিক নাম জেনে রাখা
-টুক করে নিজে নিজে ওষুধ কিনে না খাওয়া
-ফার্মেসিওয়ালার কথায় ওষুধ না খাওয়া
-মেয়াদ দেখে ওষুধ কেনা
-অখ্যাত কম্পানির ওষুধ এড়িয়ে চলা
খুব বেশি কঠিন মনে হচ্ছে না কাজগুলো। আশা করি সবাই এগুলো মেনে চলবে -যত তাড়াতাড়ি হয় ততই ভালো।
শুভেচ্ছা
আপনিতো সংক্ষেপে সঠিক সারমর্মটাই দাঁড় করিয়ে দিলেন ! তাই মন্তব্যে ৫ তারা।
আপনাকেও শুভেচ্ছা এবং
মাসুদ সজীব
জার্মানিতে আমার বন্ধুকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিল। একটা বিশেষ ঔষধ দেয়ার আগে তাকে তিন ঘন্টার সেমিনারে যাবতীয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ব্যাবহার বিধি বলে দিয়েছিল। (সে বেশি কিছু বুঝে নি অবশ্য )। এখানে এসব ব্যাপারে এত কড়াকড়ি কেন এখন বুঝতে পারছি।
কে লিখবে এসব ব্যাপার বলুন। কে জানে গরিব দেশের দুখী মানুষের আর কত কষ্ট দেখার বাকি ! কবে সত্যিকারের রাজনীতিবিদ-ব্যাবসায়ী-আমলা আমরা পাব !!
রাজর্ষি
ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
মাসুদ সজীব
আপনার পোস্ট আর মেঘলা মানুষ-এর মন্তব্য -
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ
লেখার বিষয় ছিলো দুটো। এক মানুষের সচেতনতা সৃষ্টি, দুই এই শিল্পের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং সরকার সকলকে মনে করিয়ে দেওয়া পেটেন্ট রাইটস সম্পর্কে। কারণ এই চুক্তি মোতাবেক ২০১৬ সালের পরে বিনামূল্যে কোন ওষুধ তৈরির কৌশল পাবে না বাংলাদেশ। তাই সময় এসেছে নিজেরা গবেষনা করার, সেই গবেষনায় অর্থ লগ্নি করার। সরকার কয়েকশ কোটি টাকা দিয়ে যুদ্ধ বিমান ক্রয় করতে পারলে কয়েকশ কোটি টাকা এই খাতে ও লগ্নি করতে পারে। যুদ্ধ জাহাজ কিংবা যুদ্ধ বিমানের চেয়ে এটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আজকের একপাতা প্যারাসিটামল যদি আট টাকা দিয়ে কিনতে হয় তো এই চুক্তির পরে সেই প্যারাসিটামলের দাম ৫০-১০০ টাকার উপরে পড়বে। সেটি হবে বাংলাদেশের জন্যে ভয়াবহ বিপর্যয়। তাই সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সময় থাকতে সরকার সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হতে হবে।
মাসুদ সজীব
"সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সময় থাকতে সরকার সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হতে হবে।" -
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
লেখক বাংলাদেশের ঔষুধ শিল্পের বর্তমান অবস্থা নিয়ে একটি ইনফরমেটিভ লেখা লিখেছেন। পড়ে ভাল লাগল ।
আল রশিদ
নতুন মন্তব্য করুন