একটু অনুসন্ধান নিয়ে জানলাম এই গল্পটার সূচনা হয়েছিল ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে। ইউরোপের অভিজাত শ্রেণী টমাটোকে খুব ভয় পেত । তারা টমাটোর নাম দিয়েছিল "বিষাক্ত আপেল"। মনে করা হত অভিজাত বংশের মানুষদের জন্য টমাটো অভিশপ্ত। টমাটো খেয়ে সমাজের উপরতলার মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও বিরল ছিল না। কিন্তু দিব্বি ছিলেন শ্রমজীবী সাধারণ মানুষেরা। টমাটো তাদের কোন ক্ষতি করত না।
হেঁয়ালির সহজ সমাধান মেলে রসায়নে। সেযুগে কাঁসার তৈরি চামচ-বাটি-খুন্তি-হাতা তখন আভিজাত্য ও বংশ গৌরবের পরিচয় দিত। ইউরোপীয় অভিজাত শ্রেণীর হেঁশেলে তাই শুধু কাঁসার থালা-বাটি শোভা পেত। কিন্তু কাঁসা তৈরি শিশা এবং টিন দিয়ে। অম্লের (অ্যাসিড) আধিক্য বেশি এমন ফল - শাক সবজি তাই অভিজাতদের কাছে ছিল এক্কেবারে চক্ষুশূল ... বিষ। টমাটো অম্ল গোত্রভুক্ত (অ্যাসিডিক) --- টমাটোর তাই প্রবেশাধিকার ছিল না অভিজাতদের রান্না ঘরে। কিন্তু সাধারণ গরিব ইউরোপবাসীর সে সমস্যা ছিল না। কাঁসার বাসন পত্র ব্যবহার ছিল তাদের সামর্থ্যের বাইরে। দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য তারা কাঠের চামচ-হাতা ব্যবহার করত। টমাটোকেও তাই তারা আপন করে নিতে পেরেছিল নির্ভাবনায়।
টমাটো ছিল গরিব ও মধ্যবিত্ত --- শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের খাবার। ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধ থেকে সুরু করে পরবর্তী প্রায় চারশো বছর টমাটো গরিবের বন্ধু --- মধ্যবিত্তের সুখ-দুখের সাথী।
ফরাসি বিপ্লব, নেপলিয়ানের নির্বাসন ইত্যাদি পেরিয়ে অবশেষে গোল বাঁধল উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে। দিনটা ছিল ১১ জুন ১৮৮৯। ইতালির রানি, মারগারিতা অব সাভি --- নেপলস শহরে আসবেন। রানির রাজকীয় সফরের সম্মানার্থে শহরের এক নামি রেস্তরার শেফ, রাফায়েল ইস্পসিতো, বানালেন দারুণ উপাদেয়, জিভে জল আনা এক খাবার। ইতালির জাতীয় পতাকার তিন রঙ --- সাদা, সবুজ আর লালের কথা মাথায় রেখে চ্যাপ্টা মোটা রুটির মত দেখতে নতুন খাবারটি হোল ত্রিবর্ণ রঞ্জিত। সাদা রঙ এলো চিজ থেকে, পুদিনার পেস্ট দিল সবুজ --- কিন্তু লাল রঙটা মিলবে কেমন করে?
শেফের নজর পড়ল টমাটোয়! --- তৈরি হোল পিজা মারগারিতা!
গরিবের পাত থেকে টমাটোকে ছিনিয়ে নেওয়ার সেই শুরু।
এরপর গঙ্গা-পদ্মা-টেমস-ভল্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। বরাবর দূরে সরিয়ে রাখা টমাটোকে নাকউঁচু ব্রিটিশ নিয়ে এসেছে ভারত উপমহাদেশে। ব্রিটিশ চলে যাওয়ার ৬৭ বছর পর দিল্লির মসনদে একদিন আসীন হলেন নবয়ুগের এক গৈরিক অবতার। বাজারে তবু আগুন, শাকসবজি-পেয়াজ-পটল-বেগুণ --- দামে রাশ টানা তো দূরের কথা --- তা যেন আরও ঊর্ধ্বমুখী।
আর টমাটো? ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
এহেন এক তপ্ত দিনে এক নির্বোধ সাংবাদিক দিল্লির শাসক দলের এই নেতা তথা আইনপ্রনেতাকে প্রশ্ন করলেন, --- টমাটোর দাম মধ্যবিত্তের নাগালে রাখতে তার সরকার কি ভাবছে?
জবাব এলো, "টমাটো বড়লোকের খাবার, --- গাল যাদের গোলাপি --- লাল টমাটো তাদের জন্য!"
লেখকঃ ডিঙ্গি নৌকার নাবিক
মন্তব্য
লেখনী ভাল হয়েছে। তবে সংবাদের লিঙ্কটা আর কিছু সূত্র থাকলে আরো ভালো হতো।
ধন্যবাদ নেবেন। সংবাদ লিঙ্ক এবং তথ্য সূত্র দেওয়া জরুরি ছিল, সেটা পোস্ট করার পর বুঝতে পেরেছি।
সংবাদ লিঙ্ক -- http://www.timesnow.tv/Tomato-only-for-rich-says-BJP-MP/videoshow/4460587.cms
-- ডিঙ্গি নৌকার নাবিক
ধন্যবাদ
মজার তথ্য তো
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
তথ্যগুলো অনুসন্ধানের পর আমিও মজা পেয়েছি। ধন্যবাদ।
-- ডিঙ্গি নৌকার নাবিক
কাঁসা মানে যদি ব্রোঞ্জ হয় তাহলে সেটা তৈরি হয় তামা আর টিন দিয়ে। এখানে সীসা লাগে না। তামা ও টিনের সাথে টমেটোর অ্যাসিডের বিক্রিয়াতে কী হয়? পিতল বা ব্রাস তৈরিতে তামা ও দস্তার সাথে সীসা (সর্বোচ্চ ২%) ব্যবহারের ইতিহাস আছে।
টমেটো যে বিষ এই অপপ্রচার চালু ছিল গ্রেট ব্রিটেন আর তার উত্তর আমেরিকান উপনিবেশগুলোতে, সম্ভবত গোটা ইউরোপে নয়। কারণ, স্পেন আর ইতালিতে শুরু থেকে (মানে ষোড়শ শতাব্দী থেকে) টমেটো খাবার প্রচলন ছিল।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
লেখার আগে ''pewter'' এর বাংলা নিয়ে সংশয় ছিল আমার। গুগল ট্রান্সলেটর বলল ''কংস'' তাই কাঁসা লিখেছি। এটা কি তবে ''পেতল'' ?
লেখার তথ্য স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন থেকে নিয়েছি।
http://www.smithsonianmag.com/arts-culture/why-the-tomato-was-feared-in-europe-for-more-than-200-years-863735/?no-ist
দেরিতে রেসপন্স দেওয়ার জন্য আন্তরিক দুঃখিত। ধন্যবাদ নেবেন।
-- ডিঙ্গি নৌকার নাবিক
পিউটার কাঁসা নয়, তবে বাংলাটা জানি না।
এবং এতে সীসা ছিলো, তবে সীসামুক্তটিই সাধারণত ব্যবহৃত হত টেবিলওয়্যারের ক্ষেত্রে। (উইকি বলছে)
দেরিতে রেসপন্স দেওয়ার জন্য আন্তরিক দুঃখিত।
টমেটোর বিষের ব্যাপারটা উইকিতে পেলাম না। এজন্যেই একটু সূত্রগুলো (রেফারেন্স) দিতে অনুরোধ করেছিলাম।
আর টমেটোকে 'বিষাক্ত আপেলে'র তুলনায় 'স্বর্ণালি আপেল' (গোল্ডেন অ্যাপেল-ইংরেজি, পমিদোরো-ইতালিয়ান) বলা হয়েছে বেশি। পোলিশ একটু আধটু জানি, তাই বলছি, স্লাভিক ভাষাগুলোয় এখনো টমেটো হচ্ছে 'পমিদরে'।
ব্রিটেনে জন জেরার্ড, টমেটো নিয়ে আসেন, বাগানে লাগান। ভদ্রলোক বিশেষ সুবিধার না (উনার নামে অন্যের লেখা মেরে দেয়ার অভিযোগ আছে), উনি 'টমেটো বিষাক্ত' বলে দাবি করেন, ভিত্তি ছাড়া। তিনি আরেক উদ্ভিদবিদ রেম্বার্ট ডোডোয়েন্সের ভুল মতটি অন্ধভাবে মেনে নেন।
তবে টমেটো খুব অল্প পরিমানে বিষাক্ত ছিল, সেটি টমাটিনের উপস্থিতির জন্যে। টমেটো গাছ বিষাক্ত হলেও, ফল নয়, এ ধারণা সে সময়েই প্রচলিত ছিল।
উইকিতে বলা হয়েছে, জনাব জেরার্ডের এই প্রচার বা লেখনী, বেশ প্রভাব ফেলেছিলো এবং প্রায় দুইশ বছর টমেটো ব্রিটেন ও তার উত্তর আমেরিকান কলোনিতে খাওয়া হতো না।
উইকি রেফারেন্স হিসেবে নির্ভরযোগ্য না, তাই আপনি/ আপনারা আরো খুঁজে অনেক তথ্য পেতে পারেন। আমি গুগল বুকে গেরার্ডের বক্তব্যের বিবরণওয়ালা মূল বইটির অংশবিশেষ পেলাম।
দেরিতে রেসপন্স দেওয়ার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত ও লজ্জিত।
লেখার তথ্য স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন থেকে নিয়েছি।
http://www.smithsonianmag.com/arts-culture/why-the-tomato-was-feared-in-europe-for-more-than-200-years-863735/?no-ist
ইতিহাস বিষয়ে স্মিথসোনিয়ান খুব নির্ভরযোগ্য, ওরা কিন্তু ''বিষাক্ত আপেল'' (বা বিষ আপেল) ই বলছে। অন্যান্য কথাগুলির সাথে সহমত।
আলোকপাত করার জন্য ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।
ইন্টারেস্টিং টপিক। লেখা আর কমেন্টগুলো আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। আরো কমেন্টের অপেক্ষাতে থাকলাম।
টমেটো বুঝি আপনার প্রিয় খাবার? এত কিছু থাকতে এরে নিয়া পরলেন কেনো?
--------------------------
আশফাক(অধম)
আসলে বিগত কিছুদিন আমার এত কাজের চাপ বেড়েছে, ভাবলাম সহজ-সরল চাপমুক্ত কিছু একটা নিয়ে লেখার চেষ্টা করি।
-- ডিঙ্গি নৌকার নাবিক
সব বড়লুকের গাল গোলাপী হয় কে বলেছে!
আপনার নিকটা মজারু কিন্তু
আন্নে বড়লুক? নাকি আন্নের গাল গোলাপী?? কোনডা???
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
প্রশ্নটা আয়নামতির উদ্দেশে, উনিই জবাব দেবেন। প্রসঙ্গত জানাই আমার গালের রঙ কালো এবং আমি গরিব।
-- ডিঙ্গি নৌকার নাবিক
আমার কেন জানি না চোখ বন্ধ করে বড়লোকের মেয়ে কল্পনা করলে শুধু গোলাপি গালের নাদুসনুদুস একটা মেয়ের কথা মনে পড়ে।
ছোট বেলায় মাঝি হওয়ার শখ ছিল। নিকটার মাধ্যমে ইচ্ছের সামান্য পূরণ ।
-- ডিঙ্গি নৌকার নাবিক
হিম্ভায়ের একটা গপ্পো ছিল "হাতিসোনা", পড়েছেন?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
আমি সচলে একেবারে নতুন, আমার পড়া ছিল না। আপনি বলায় খুঁজে বের করলাম, পড়লাম। এবং মুগ্ধ হলাম।
-- ডিঙ্গি নৌকার নাবিক
হিমু ভায়ের গল্প বরাবরই মুগ্ধকরে, আপনার "গোলাপি গালের নাদুসনুদুস একটা মেয়ের" এই বর্ণনা পড়ে কেন জানি গপ্পটা মনে পড়ল
বলা হয়নি, আপনার লেখাও ভাল লেগেছে
আরও লিখুন, ভাল থাকুন, শুভেচ্ছা
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
হাহা।মজার টপিক। কিন্তু কাঁসা/ পেতল/ ব্রোঞ্জের সাথে টমাটোর বিক্রিয়ায় ঠিক কি ধরনের বিষ উৎপন্ন হয় জানা হলনা। এটা কি শুধু রান্নার বেলায়ই উৎপন্ন হবে?
আমি কাঁসার থালায় টমাটোর তরকারি খেয়েছি অনেক, কিছু তো হয়নাই
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
প্রশ্নটা আমারও ... উপরে দেওয়া স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিনের লিঙ্কটা দেখলে কিন্তু দেখবেন ওরা লিখছে ...
" ... t was thought that aristocrats got sick and died after eating them, but the truth of the matter was that wealthy Europeans used pewter plates, which were high in lead content. Because tomatoes are so high in acidity, when placed on this particular tableware, the fruit would leach lead from the plate, resulting in many deaths from lead poisoning. No one made this connection between plate and poison at the time; the tomato was picked as the culprit. "
এমনটাও হতে পারে সে আমলে সংকরায়ন প্রকৌশল তেমন উন্নত না থাকায় ক্রুড লেড থেকে যেত থালা বাসন বানানোর পর। (অনুমান)
-- ডিঙ্গি নৌকার নাবিক
-- ডিঙ্গি নৌকার নাবিক
লেখাটা পড়ে কিছু জানতে পারলাম আর কিছুটা মজাও পেলাম।
"ছোট বেলায় মাঝি হওয়ার শখ ছিল" - আপনি কিন্তু এখনও মাঝি। আপনার মনের আপনিই মাঝি
ফাহিমা দিলশাদ
এত মিস্তি কথাটি বলার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
-- ডিঙ্গি নৌকার নাবিক
ছেলেবেলায় একটা কথা শুনেছিলাম মায়ের কাছে - কাঁসার থালায় করে নাকি তেঁতুল খেতে হয়না। এটা নিয়ে কখনো অনুসন্ধান করা হয়নি। আপনার লেখাটা পড়ে সেই কথাটা মনে পড়লো।
____________________________
এটা আমিও শুনেছি মা, দাদি নানিদের মুখে। এবং সত্যিই দেখতাম তেঁতুলের সংস্পর্শে কাঁসার থালা বাসনে কেমন একটা কালশিটে দাগ পরত।
ধন্যবাদ নেবেন।
-- ডিঙ্গি নৌকার নাবিক
পিৎসা মার্গারিতার সবুজ আসে বাসিল থেকে, পুদিনা (মিন্ট) থেকে নয়।
নতুন মন্তব্য করুন