চলার পথের সঙ্গী : কামোসশো আল্পিনো (the chamois)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১২/০৮/২০১৪ - ৩:০০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


“কত দিন কত রাত গেছে, সেই মায়া হরিণের পিছে
আমি যত ছুটে যাই কাছে, সে রয় বহুদূর”
কৈশোরে শোনা প্রিয় একটি গানের এই দুটি লাইন প্রায় দুই দশক পর নতুন করে আবার গুনগুন করে গাওয়ার ইচ্ছে জেগে উঠার রহস্যটা অবশেষে ধরতে পারলাম সেদিন। মায়া হরিণ আবার পাবো কোথায় এই দূর পরদেশে? উইকিপিডিয়া যতই বলুক না কেন এ হল ছাগল সদৃশ হরিণ, কিন্তু চতুষ্পদী এই প্রাণীর মায়া মাখা ওই দুচোখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে আমি তাকে হরিণ সদৃশ ছাগল মানতেই রাজি।

প্রাক-আল্পস পর্বতমালার অপরূপ সৌন্দর্যের আকর্ষণে ভোর রাতেই ছুটে চলে যাই ট্র্যাকিং পথের অন্বেষণে। বউকে বলি ‘ঘুম কাতুরে’ বাঙালির অপবাদ ঘোচাতে আমাকেই সবার আগেই হাঁটা শুরু করতে হবে। আসল কারণটা কিন্তু সেই মায়া হরিণের প্রেম।


ভোরের আলোয়


তুমি সেই তুলনাহীনা


কৌতূহলী

সূর্যোদয়ের ঠিক আগের প্রহরেই যেন হাজার মিটার উঁচু পাহাড়ি উপত্যকায় বসে আল্পিয় কামোসশোর(Camoscio Alpino; rupicapra rupicapra) মেলা। তাও আবার সমতল তৃণভূমি তাঁদের ঠিক পছন্দ না, খাড়া পাথুরে ঢালেই দলবেঁধে ছুটোছুটি করতেই যেন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বেশি। একে তো সূর্যমামা তখনও ঠিক মত উদিত হয়নি আর সেই স্বল্প আলোয় পিচ্ছিল পাহাড়ি ঢালে ক্যামেরা নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটাও বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা বিধায় ছবির মান নিয়ে মাথা ঘামাই না। ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে হরিণ পালের হুটোপুটি দেখি। মে-জুন মাসে জন্ম নেয়া হরিণ শাবকের নিষ্পাপ সম্মোহনী চাহুনি বারবার মনে করিয়ে দেয় ওয়াল্ট ডিসনির অমর চরিত্র বাম্বির কথা।


মা আর শাবক


বাম্বি


ছুটোছুটি

আমি ১২০০-২২০০ মিটার উঁচু পাহাড়ে কামোসশো(camoscio alpino) বিচরণ করতে দেখেছি গ্রীষ্মের শুষ্ক দিনগুলিতে। প্রত্যূষের শিশির ভেজা ঢালু উঁচুনিচু তৃণভূমিতে ভেড়ার পালের সাথে মিলেমিশে ভূরিভোজনে ব্যাতিব্যাস্ত থাকতেই যেন পছন্দ তাঁদের। আমার মত একা একা নিজের মত হেঁটে চলা পথিক পানে হয়ত তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে থাকবে কিছুক্ষণ, দ্বিপদী অভিযাত্রীর হাবভাবেই বুঝে নিবে বিপদের আশঙ্কা কতটুকু। ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলার ক্ষমতার সাথে উল্লম্বভাবে ২ মিটার উচ্চতায় লাফিয়ে ৬ মিটার পর্যন্ত লংজাম্প মারার দক্ষতাও আছে এদের। সময় গড়িয়ে সূর্যমামা চলে আসবে মাথার উপর, ট্র্যাকিংপ্রেমী অভিযাত্রীর আনাগোনাও যাবে অনেক বেড়ে। কামোসশোর দল সূর্যতাপ আর মানুষের কৌতূহলী দৃষ্টি এড়াতে চলে যায় পাইনের জঙ্গলে।


লংজাম্প


বসন্তের কামোসশো


পাহাড়ি ঢালে দাঁড়িয়ে

পুরুষ আর মাদী কামোসশো খালি চোখে আলাদা করে চেনাটা দুষ্কর। দুজনেইর মাথায় চিরস্থায়ী শিং আছে, আকারে হয়ত সামান্য পার্থক্য থাকতে পারে। শিঙের মাথা অনেকটা হুকের মত বাঁকানো। প্রজননকাল বাদে বাকি মাসগুলিতে পুরুষ কামোসশো সাধারণত নিঃসঙ্গ একা একা দিন কাটিয়ে দেয়। মাদী হরিণগুলি দলবদ্ধ জীবনযাপনেই অভ্যস্ত। পুনরায় বাচ্চা প্রসবের আগ পর্যন্ত আগের বছরে ভূমিষ্ঠ শাবকের দেখভাল করার পুরো দায়িত্বটা মা হরিণের।
বুড়োগুলিকে তাঁদের ধুসর লোমে আবৃত চামড়া দেখে চেনা যায় সহজেই। প্রাকৃতিক পরিবেশে ২৫ বৎসর পর্যন্ত বাঁচার কথা থাকলেও বেশিরভাগই ১৫/১৬ বৎসরের বেশি টিকে না। দাঁতক্ষয় জনিত কারনে বৃদ্ধ বয়সে খাদ্য আহরণে সঙ্কট দেখা দেয় প্রবলভাবে। অক্টোবর মাসের মধ্যে চর্বির আস্তর জমাতে না পারলে এমন উচ্চতায় প্রবল শীত মৌসুম কাটিয়ে পরবর্তী বসন্ত দেখার আশাটা দুরূহ।


গ্রীষ্মের বাদামী চামড়া


শীতের শেষে কালো পশম


বার্ধক্য

আল্পিয় কামোসশো নিজের চোখে কোনদিন দেখেনি বরফে ঢাকা প্রান্তরে কিন্তু পদচিহ্ন দেখেছি প্রায়শই। এদের ক্ষুর যেমন ঢালু পাথুরে দেয়ালে হেঁটে বেড়াতে কার্যকরী তেমনি তুষারাবৃত বনে-বাদারেও সমান উপযোগী। শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচতে প্রকৃতির নিয়মেই অক্টোবর মাস থেকে কামোসশোর গ্রীষ্মকালীন বাদামী-খয়েরি চামড়ার রঙ বদলাতে শুরু করে। কালো রঙয়ের পশমে নিজেকে ঢেকে ফেলে পুরোদস্তুর বদলে দেয় অবয়ব।


পদচিহ্ন


শীতের কামোসশো (ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

ইতালিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর এক জরিপে আল্পিয় কামোসশোর সংখ্যা ২০,০০০ ছাড়াতে পারেনি। তড়িঘড়ি করে শুরু হয় এদের বাঁচানোর প্রয়াস, আইন করে কামোসশো হত্যা নিষিদ্ধ করে আর সংরক্ষিত বনাঞ্চল সৃষ্টির মাধ্যমে আজকে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫-৬ গুন। সরকারি প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছাড়াও পরোক্ষভাবে মানুষও রেখেছে তাঁর অবদান। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালীন শিল্পায়নের ধারায় পাহাড়ি মনুষ্য জনপদ হয়েছে বিরান, একে একে সবাই গিয়েছে শহরে ঘড়িবাঁধা জীবনযাপন করতে। বেঁচেছে কামোসশোর চারণভূমি, বিনাশের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে আল্পিয় অরণ্য।

(আলোর স্বল্পতা আর দূর থেকে দাঁড়িয়ে ক্যামেরা ব্যাবহারের কারনে ছবির মান নিয়ে আক্ষেপ কিছুটা মনে রয়ে গেছে। পাঠকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। অনেকদিন ধরেই ব্লগ লিখা হয়না, লেখার ধারেও নিশ্চিত জমে গেছে কিছুটা জং। তারপরও প্রিয় সচলায়তনের জন্য কিবোর্ড চাপার আনন্দটা আগের মতই অসীম।)

.........জিপসি


মন্তব্য

মাসুদ সজীব এর ছবি

চলুক

সবগুলো ছবি তেমন ভালো না আসলেও ভোরের আলোর ছবিটা মুগ্ধ করেছে। আর গ্রীষ্ম-শীত এবং বার্ধক্য এই তিন রূপে কামোসশো দেখাতে পেয়ে ভালো লাগলো। ঘুরাঘুরি চলুক হাসি

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

অতিথি লেখক এর ছবি

যতদিন না তুষার ঢাকা প্রান্তরে কামোসশোর দেখা না মিলছে ততদিন পর্যন্ত এদের পিছু ছাড়ছি না। তাই ঘোরাঘুরিটা চলছে এবং চলবে। চোখ টিপি

.........জিপসি

তিথীডোর এর ছবি

দ্বিতীয় ছবিটা দারুণ! চলুক চলুক

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার ভাল লাগা দ্বিতীয় ছবিটা ১৩০০ মিটার উঁচুতে তোলা। আমাকে দেখে লংজাম্প মেরে পালিয়ে যাওয়ার আগে কামোসশোটি মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিল ভোরের আলোয়।

.........জিপসি

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

কামোসশো সম্পর্কে আরো জানার জন্য আগ্রহ বোধ করছি। ছবিগুলো খুব ভালো না হলেও আপনার লেখার সাথে মানিয়ে গিয়েছে। শুধু একটা জিনিস: ইন্টারনেট থেকে ছবি নিলে তার সূত্র উল্লেখ করা দরকার। ধরুন আপনার ছবিগুলো যদি কেউ নিয়ে কোথাও ছাপিয়ে দিয়ে বলে ইন্টারনেট থেকে পেয়েছে তাহলে কি আপনার ভালো লাগবে? হাসি

আরেকটা বিষয়: ঘটনাস্হলের একটা সংক্ষিপ্ত ভৌগলিক অবস্থান ও পরিচয় দিলে আমার মতো পাঠকও আপনার সাথে সেখানে ঘুরে আসতে পারতো। ধারণা করছি এটা ইতালির কোথাও হবে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ওই একটা ছবিই ইন্টারনেট থেকে জুড়ে দিয়েছি। গুগল সার্চ করে প্রাপ্ত এই লিঙ্কে ছবিটা মিলেছিল। আমার এখনও বরফে ঢাকা উপত্যকায় কামোসশোর বিচরণের ছবি তোলার সৌভাগ্য হয়নি।
পোস্টে জুড়ে দেয়া বাকি ছবিগুলি ৩-৪ মাস ধরে অনেক ঘোরাঘুরির সময় তোলা। ইতালির ভিচেন্সা, ভেরোনা আর ত্রেনতো জেলার সীমান্তবর্তী প্রাক আল্পস অঞ্চলের পর্বতমালার ট্র্যাকিং পথেই বেশি হেঁটেছি। জায়গাটা অনেকটা নো-ম্যানস ল্যান্ডের মত, পুরোটাই সংরক্ষিত অভয়ারণ্য।
কামোসশো সম্পর্কে আরও কিছু হয়ত লিখব ভবিষ্যতে, চলার পথের সঙ্গী সিরিজে পরবর্তী পর্বে লিখব কামোসশোর এক প্রতিবেশী আল্পিয় মারমটের কথা।

সাথে থাকুন, ভাল থাকুন।

.........জিপসি

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

পাহাড়ি ঢালের ছবিটা দারুণ এসেছে। শেষের ছবিটাও খুবই চমৎকার হয়েছে।

দীনহিন এর ছবি

কতদিন পরে এলেন, জিপসি!
যে কজনের লেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি, আপনি তাদের একজন।
শীত-গ্রীষ্মের কামোসশো রোমাঞ্চিত করল। পুলকিত করল!

নিয়মিত লেখার অনুরোধ থাকল।

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

অতিথি লেখক এর ছবি

বিশেষ কোন কারণ ছাড়াই অনেকদিন ব্লগ পড়া আর লিখা থেকে দূরে ছিলাম। হাতে এক সপ্তাহ ছুটি আছে, দেখা যাক ঝটপট আরও কিছু লিখতে পারি কিনা। এতদিন হেঁটেছি তো অনেক, হার্ডডিস্কে যেমন জমে গেছে অনেক ছবি তেমনি হৃদয়েও আছে অনেক সুখস্মৃতি।
আপনার সুন্দর মন্তব্যও আমাকে পুলকিত করেছে, ধন্যবাদ দীনহীন।

.........জিপসি

অতিথি লেখক এর ছবি

"ভোরের আলোয়" ছবিটা চমৎকার হয়েছে।

"পাহাড়ি ঢালে দাঁড়িয়ে" দেখে আমার উচ্চতা ভীতি দেখা দিচ্ছে। লইজ্জা লাগে

--------------------
আশফাক(অধম)

অতিথি লেখক এর ছবি

ভোরের আলো ছবিটা অনেকটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই তোলার সুযোগ পেয়েছিলাম। গাড়ি পার্ক করে মাত্র মিনিট বিশেক পথ হেঁটে গিয়েই দেখা মিলে যায় এক জোড়া কামোসশোর। সাধারণত লোকালয়ের এতটা কাছে এরা আসে না।
পাহাড়ি ঢালের কামোসশোটা দাঁড়িয়ে ছিল ১৬০০ মিটার উঁচুতে। যেখানে সে দাঁড়িয়ে আছে সেখান দিয়েই কিন্তু নেমে গেছে একটি ট্র্যাকিং পথ। পাথুরে সেই খাড়া পথ বেয়ে উঠানামা করতে আপনাকে অবশ্যই ভাল ট্র্যাকিং-সু ব্যবহার করতে হবে নাহয় কামোসশোর মত ক্ষুর থাকতে হবে। চোখ টিপি

.........জিপসি

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

'কৌতূহলী' দারুণ হয়েছে। চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- কৌতূহলী ছবিটা মে মাসের শুরুর দিকে তোলা, কামোসশোর চামড়া তখনও শীতের ঘন কালো পশমি লোমে ঢাকা।

………জিপসি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ সাক্ষী হাসি

………জিপসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।