ভয়ংকর মেজাজ খারাপ নিয়ে ঘুম ভাংগল শাওনের। না, লাইনটা ভুল হলো,আবার বলি। ঘুম ভাংগার পর ভয়ংকর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো শাওনের। মাথার সামনে দারোয়ান চাচা দাঁড়িয়ে ডাকাডাকি করছেন। অফিসে যাবার তাগাদা।
-বাবাজি অফিসে যাবেন না? কত বেলা হয়ে গেছে দেখছেন?৯টা বাজে বাবাজি।
-হুম।
-গোসলের পানি আছে বাথরুমে। পুতুল আইছিলো। বাজারের টাকা নিয়ে গেছে। বলছে ১টার দিকে আইসা পাক বসাইবো। লোটাস ভাই বলে গেছেন, আজকে দুপুরে কারো খানা হবেনা।
-হুম।
দায়িত্ব শেষ করে হাঁটা ধরলেন দারওয়ান চাচা।প্রতিদিন সকালে সবাইকে ডাকেন আর বাসার টুকিটাকি কাজ করেন তিনি। নতুন মেস মেম্বার লাগলে দেয়ালে চিকা মারার কাজও করে দেন। বসে বসে “দারোয়ানগিরি” করার সাথে সাথে এই কাজের জন্য কিছু উপরি মাসোহারা পান তিনি। চা-পান-সিগারেটের বদ নেশার টাকা জুটে যায় তাতে।বয়স ষাট কিম্বা সত্তরও হতে পারে।একটা সময় পর বয়সের সংখ্যাটা অর্থহীন হয়ে যায়। চাচার এখন সেই বয়স । মিলাদ পড়াতে আসা হুজুরদের মতো নূরানি চেহারা,মেহেদি দেওয়া লাল চুল আর মুসলমানি দাড়ি। লম্বাতে আর দশজন বাঙ্গালির চাইতে কিছুটা বেশিই হবে। একলাইনে বললে “দেখলেই সালাম দিতে হয়” এই ধরনের বহিরাবরণ।পেশায় দারোয়ান হয়ে ফেঁসে গেছেন,সবাই সালাম দেয়না।সিগারেট খান লুকিয়ে। ধরা খেলেই বলেন, সিগারেট বদ নেশা, ছাইড়া দিমু কাল ।দুই বছর ধরে এমনি চলছে । এমন সরল লোকের উপর রাগ করাটা কঠিন,ভুল বললাম আবার, ‘ভীষন কঠিন’। কিন্তু এই মুহুর্তে রাগে গা কামড়াচ্ছে শাওনের। আহা, কী মজার স্বপ্নটাই না দেখছিলো সে। ক্ষনে ক্ষনে রঙ বদলানো স্বপ্ন না এটা, একেবারে নীল আকাশের মতো বাস্তব স্বপ্ন। কতদিন পর এমন স্বপ্ন দেখছিলো। চুমুটা মাত্র শেষ হলো। এই সেই চুমু না , যাকে বলে একেবারে ‘ফ্রেঞ্চ কিস’।দীর্ঘ চুম্বনের পর মাত্রই নিজেদের বিছানাতে আবিষ্কার করেছিলো শাওন। কলেজের মাঠে চুমু শুরু করে বিছানাতে চলে যাওয়াটা একটু অবাস্তব হলেও স্বপ্নের খাতিরে সেটিকে ‘স্পেশাল ইফেক্ট’ বলা যেতে পারে। বিছানাটাও অনেক পরিচিত, সেই ছোটবেলার গ্রামের বাড়ির দুই তলা বিছানা। সিড়ি বেয়ে উঠতে হতো বলে একে “দুইতলা বিছানা” বলা হতো।কতদিন পর সেই বাড়ি দেখলো সে। কতদিন। সেই বাড়িতে বিল্ডিং উঠেছে অনেক আগেই। চাচারা মিলে খাট-পালঙ্ক,ধানের গোলা , এমনকি দাদুর পান খাওয়ার “বাটা” পর্যন্ত ভাগাভাগি করে ফেলেছেন সেই কবে। এতদিন পরে সেই বাড়ি,সেই বিছানা আর সাথে সেই মেয়েটা। পুরো বাড়ি ফাঁকা ছিলো, মাত্রই বিছানাতে উঠে বসেছিলো দুইজন।গরম ছিলোনা কোনো, বাতাস বইছিলো। চুমু বিনিময়ের পর যেই না সবে মুখ থেকে বুকের দিকে রওনা করলো সেই সময়ই ব্যাটা ডেকে দিলো। মুখে এখনও ঠোটের স্বাদ লেগে আছে তার।কী স্বপ্নটা ভাঙ্গলো তার! কতদিন অপেক্ষা করেছে সে এমন একটা স্বপ্ন দেখবে বলে। রাগ না, এখন যেটা হচ্ছে সেটা “রাম-রাগ”। ব্যাটাকে ধরে কানের নিচে একটা দিতে পারলে কিছুটা আরাম লাগত শাওনের। সেটা সম্ভব না। চোখ বন্ধ করে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলো শাওন। মনে মনে রিভাইজ করে স্বপ্নটা যেখানে শেষ হয়েছিলো সেখান থেকে আবার শুরু করার চেষ্টা করতে থাকলো। বেশি আগে চলে গেলো মনে হয়। না আরেকটু পিছন থেকে শুরু করতে হবে। কিন্তু এইবার স্বপ্নের সাথে “কল্পনা” মিশে যাচ্ছে যে! লজিক ঢুকে যাচ্ছে সেখানে। না, লজিক থাকলে ত স্বপ্ন হলোনা,স্বপ্নে যুক্তি থাকতে নাই। স্বপ্ন হবে যুক্তিহীন,ছন্দহীন কিন্তু অনুভব করা যাবে শতভাগ। মনে হবে সত্যিই ঘটছে।একটু পার্থক্য আছে অবশ্য।সেখানে হাসি,কান্না,রাগ,উত্তেজনা,ভয় থাকবে স্বাদ,তৃষ্ণা,ভোগ,আরাম সব থাকবে কিন্তু “ব্যাথা” থাকবেনা। দশতলা বিল্ডিং থেকে লাফিয়ে পরলেও দিব্যি হেঁটে যাওয়া যাবে,আগুনে পুড়লেও ক্ষতি হবেনা তেমন,আস্ত সাপ গিলে ফেলেও ঢেকুর তোলা যেতে পারে স্বপ্নে। স্বপ্ন আর কল্পনা এক না। শাওন স্বপ্ন দেখতে চাচ্ছে, কল্পনা করতে চাচ্ছেনা কিছু।চুমুর পর যেনো কি করছিলো তারা? ঠোঁটের স্বাদটা যেনো ক্যামন ছিলো,এখনই ভুলে গেলো? সে কি উপরে ছিলো না নিচে?তার চেহারাটা ঝাপসা লাগছে কেনো? তার শরীরটা যেনো কেমন?
-এই মাছ। কই,শিং,পাবদা ... আছে বড় পাংগাস।
- রাখবেন সবজি।কাকরুল,বেগুন,ভেন্ডি...কচি লাও,মূলা
- মুরগীইই...দেশী মুরগীইইই...
আর সম্ভব না। ধুর বাল, বলে বিছানা থেকে উঠে বসলো শাওন।দারওয়ান ব্যাটাকে আরো কয়েকটা গালি দিয়ে মনের জ্বালা মিটানোর চেষ্টা করলো। কাজ হলো কি না সেটা সেই জানে। তবে গালাগালি করলে রাগ কমে,পরীক্ষিত সত্য। বিছানার বালিশের নিচে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করলো সে। প্যাকেটটা খুলে এইবার রীতিমত চেঁচিয়ে “ধুর বাল” বললো শাওন। রাতে তিনটা সিগারেট ছিলো এখন মাত্র একটা। মিজান ভাই আর রুবাই এর কাজ হবে। হারামিগুলা নিজেরা সিগারেট কিনবে রতি-আনা হারে স্বর্ন যেভাবে কিনে সেভাবে। খাওয়ার সময় ৮০ ভাগ খেয়ে তারপর হাতছাড়া করবে। কিন্তু শাওনের সিগারেট তাদের কাছে রুপাও না, স্টেইনলেস স্টিলের থালা-বাসন হতে পারে। দোকানে দাম কম না হলেও ঘরের ভিতর এর মূল্য অনেক কম। না বলেই নিয়ে নেয়া যাওয়া তাই। কী আর করা,যেটা আছে সেই সিগারেটটা ধরিয়ে টয়লেটের দিকে রওনা হলো শাওন। ভাগ্যিস দয়া করে এই সিগারেটখানা রেখেছিলো তারা , না হলে এখন সে পেট খালি করতো কিভাবে?
টয়লেট শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে রুমে এসে দেখে বুয়েট কোচিং করতে আসা নতুন ছেলেটি তার রুমে বসে আছে। এই বাসায় দু’টি রুম। এক রুমে শাওনসহ তিনজন থাকে। রুমটা পাশের রুমের চাইতে সাইজে বড়। পাশেই রান্নাঘর।আরেকটা রুমে থাকে লোটাস।কোচিং করতে আসা ছেলেটি গতকাল উঠেছে তার সাথে। এই বাড়ি ভাড়া পাওয়ার পিছনে লোটাসের অবদান সবচাইতে বেশি, না আবার ভুল বলা হলো। এই বাসা ভাড়া পাওয়ার পিছনে একমাত্র অবদান লোটাসের। বাড়িওয়ালা তার অনেক লতায় পাতায় আত্মীয় হন। সেই সূত্রে কলাবাগানের মতো জায়গায় এই বাসা জুটেছে তাদের কপালে। বাসা তেমন আহামরি কিছু না।নিচতলা, আশেপাশের বিল্ডিং এর সৌজন্যে দিনের বেলাতেও সূর্যের আলোর প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত ।খোদার দান হিসেবে তাই স্যাঁতস্যাঁতে ভাব বাসায়। দেয়ালের চুনরং উঠে গিয়ে প্লাস্টার দেখা যাচ্ছে, রাস্তার ভিক্ষুকদের কাপড় ছিড়ে শরীর বের হয়ে আছে যেনো।তিনটি বিছানার উপর আলুথালু মশারি,ছড়ানো কাথা-বালিশ, দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা নোংরা শার্ট-গ্যাঞ্জি-প্যান্ট, আঁশটে গন্ধ,বই ছড়ানো পড়ার টেবিল, মেঝেতে ছ্যাড়া পত্রিকা,ঠোঙ্গা আর পতাকার মতো খাটের মাথায় ঝুলে থাকা আন্ডারওয়াগুলো বাসাটিকে একটি আদর্শ “ব্যাচেলার হাউজ” এ পরিনত করেছে।
- কি হে বালক । ক্লাস রেখে ঘরে বসে থাকলে কি বুয়েটে পড়া হবে?নতুন ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বললো শাওন। মাত্র সাড়ে নয়টা বাজে। এখনই ত তাদের ক্লাস শেষ হয়ে যাবার কথা না।
- পড়া লাগবেনা ভাই বুয়েটে। মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছি ভাই ঢাকাতে কোচিং করতে এসে। শুধু শুধু সময় নষ্ট করছি,চান্স টান্স আমাদের কপালে নাই ভাই।
- ও মা! যুদ্ধের আগেই দেখি সারেন্ডার করে ফেলছে সে। এইভাবে যুদ্ধ করতে নামলে হবে নাকি? ক্যানো চান্স পাবানা? যারা চান্স পাচ্ছে তাদের কি পিছনে ল্যাজ আছে, নাকি হাত-পা দুই একটা বেশি নিয়ে জন্ম নিছে?
- হাত,পা ঠিকি আছে ভাই, ল্যাজও নাই কারো। কিন্তু মাথায় মনে হয় ওজন বেশি তাদের। আর নাহলে আমার মাথার ওজন কিছুটা কম।কী যে পড়ায় ভাই, কোন জায়গা থাইকা পড়ায় তার কিছুই বুঝিনা। আজকে আছিলো মেরিট টেস্ট। কোন জায়গা থাইকা যে প্রশ্ন করছে সেইটাই বুঝতে পারলাম না। ‘আমার মেরিট নাই’ এই কথা মাইনা নিয়া আমি খাতা জমা দিয়া আইসা পরছি।
কোচিং সম্পর্কে কিছু জ্ঞান দিবে বলে বিছানাতে বসলো শাওন। এমন সময় বাইরে হইচই শোনা গেলো।দারোয়ান চাচাকে বকাবকি করছেন বাড়িওয়ালা আংকেল। কয়েকবার ‘সিগারেট’ শব্দটা শুনে বের হলো শাওন। নতুন ছেলেটা একটু তাড়াহুড়ো করেই যেনো নিজের রুমে ঢুকে গেলো। কাচি-গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দরোয়ানকে ঝাড়ি দিচ্ছিলেন বাড়িওয়ালা।ভদ্রলোক আর্মিতে ছিলেন।রিটায়ার করে এখন ঢাকা শহরে ভাড়া বাণিজ্য করে খাচ্ছেন। এক ছেলে আছে মনে হয়, আমেরিকা থাকে শোনা যায়।ভদ্রলোক আর্মির নিয়মের বাইরের এই পৃথিবীকে ঠিক মেনে নিতে পারছেন না। ‘নিয়ম ছাড়া পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো মানে নেই’ এই সংক্রান্ত উপদেশ নিত্যই দেন তিনি। খুঁটের সাথে বেঁধে রাখা গরুর খুঁট খুলে দিলেও সে মাঠ ছেড়ে যেতে চায় না, তেমনি নিয়মের মাঝে বসবাস করা মানুষও নিয়মের বাইরে কী আছে তাকে দেখাটা ‘অনিয়ম’ ভাবেন।ভদ্রলোক বেজায় বিপদে আছেন এই নৈরাজ্যের মাঝে। শাওনকে দেখেই উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাস করলেন বাড়িওয়ালা, গেটের সামনে এতগুলো সিগারেট কোন জায়গা থেকে আসল শাওন? সকালবেলা আমি নিজ হাতে৭টা সিগেরেট ফিল্টার পেয়েছি। বেটা আবার গুনেও রেখেছে দেখি। কারনটা শাওন নির্দিষ্ট করে না জানলেও অনুমান করতে পারছে। কোচিং করার জন্য নতুন যে ছেলেটা উঠেছে সেই করেছে হয়ত। তাকে যদিও বলে দেয়া হয়েছিলো যে রুমে সিগারেট খেলে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু লোটাসের ভয়ে হয়ত খায়নি সে।লোটাস ‘ভাব’ নিতে ভালোবাসে।বন্ধুদের মাঝেও মুখ গোমড়া করে বসে থাকে সে, যেন আড্ডাটা নেহায়েত দায়ে পরে দিতে হচ্ছে। নতুন ছেলেটা ঐ মুখ দেখেই সিগারেট ধরানোর সাহস করেনি হয়ত।
- আংকেল আমরা ত এখানে খাই না। কে করেছে কিভাবে বলব?
-তোমরা ছাড়া এই বিল্ডিং বিড়িখোর আর কে আছে? তিনতলার বরুনরা রা ত সিগারেট খায়না। অবশ্যই তোমাদের কেউ করেছো। ফালতু জিনিস খেয়ে টাকা নষ্ট,জীবন নষ্ট আর ‘মানুষের বাসা নষ্ট’ করার কি মানে আমি বুঝিনা। কলা কিনে খেতে পারোনা সিগারেটের টাকা দিয়ে?‘মানুষের বাসা নষ্ট’ শব্দটাতে জোর ছিলো।‘সময়’ আর ‘নিজের বাসা’ ছাড়া অন্যসবকিছুতেই উনার চরম অনাগ্রহ।
কলা খেয়ে কেউ যদি বাসার সামনে বাঁকল ফেলে রাখে তবে? সিগারেটের ফিল্টারে ত আর বিপদ নেই কিন্তু সাতটা কলার বাঁকল যদি এখানে পরে থাকত তাহলে ত নির্ঘাত একটা দূর্ঘটনা ঘটে যেতো। মনে মনে বলল শাওন। সে ভালো করেই জানে টাকা-শরীর নষ্ট হওয়া নিয়ে মেজর সাহেবের তেমন কোনো চিন্তা নেই,উনার যত আশংকা বাড়ি নিয়ে।
গোসল শেষ করে অনেকদিন পর পছন্দের জিন্স আর টি-শার্ট পরল শাওন। হালকা পারফিউমও দিলো। কোচিং করতে আসা ছেলেটি এতক্ষন আত্মোগোপনে ছিলো। শাওনের মুখে গান শুনে আবার কিছুটা ভরসা পেয়ে রুম থেকে বের হলো।
- কি ব্যাপার ভাইয়া, বাড়িওয়ালা আংকেল হইচই করছিলেন কেনো?
নিজের অপরাধ প্রকাশ পেলো কী না জানতে চাইলো সে । চেহারাই বলে দিচ্ছিলো সেটা। মিথ্যা বলতে পারা অনেক অভিজ্ঞতার ব্যাপার। হুট করে মিথ্যা বলা যায়না। চোখ, মুখ প্রতিবাদ করে জানিয়ে দেয় ‘মিথ্যাতে তাদের প্রবল আপত্তি আছে’। বার বার বলতে থাকলে হাল ছেড়ে দেয়া অভিভাবকের মতো তারাও হাল ছেড়ে দেয়।তখন চোখের মাঝে আতংক খেলা করেনা, মুখের চামড়া টানটান হয়ে যায়না। স্বাভাবিকভাবে মিথ্য বলতে অনেক প্র্যাক্টিস করা লাগে। বাচ্চা ছেলেটা মাত্র ইন্টার পাস দিলো আর মিথ্যার শহরে মাত্রই পা দিলো, এখনই মিথ্যা বলতে পারবে কেনো?
- তেমন কিছুনা । বাসার সামনে আবর্জনা ছিলো তাই দারোয়ান চাচাকে বকাবকি করছিলেন।
- অ। আংকেল খুব রাগি বুঝি?
- রাগি ত হবেই। আর্মিতে থাকার প্রথম শর্ত হলো রাগি হওয়া। যদি রাগ করতে না পারো তাহলে রাগ করার অভিনয় হলেও করতে হবে। না হলে আর্মিতেও ইজ্জত থাকবেনা আর পাবলিক বলবে ‘মাহুন্দা আর্মি অফিসার’।তাই সবসময় রাগি রাগি ভাব ধরে থাকতে থাকতে হবে। রাগের বিষয় না হলেও রাগ করতে হবে।
- ‘মাহুন্দা কি জিনিস ভাই’?
হা হা করে হেসে উঠলো ছেলেটি। ছেলেটা ত দেখতে সুন্দর ভারী । এতক্ষন খেয়াল করেনি শাওন। তেমন ফর্সা না, বিয়ের ভাষাতে যাকে বলে “উজ্জ্বল শ্যামলা”, কোঁকড়ানো চুল, মেয়েদের মতো পাতলা ঠোঁট, হাসিটা ‘মন ভালো হয়ে যায়’ টাইপ।
- মাহুন্দা কি সেটা তোমার এখন না জানলেও চলবে। আগে বলো কতজন গার্লফ্র্যান্ড তোমার?
ছেলেটা শুধু দেখতে মেয়েদের মতো না, ব্যবহারেও ‘লক্ষী মেয়ে’ ভাব আছে মনে হচ্ছে। মাথা নিচু করে ‘কী যে বলেন ভাই’ বলে বসে রইল।
-লজ্জা ত মেয়দের অলংকার জানতাম। ছেলেরা আবার কবে থেকে এগুলো পরা শুরু করলো? মেয়দের ব্রেসলেট,লকেট পরার সাথে সাথে আজকাল ছেলেরা লজ্জাও পেতে শুরু করেছে বুঝি।
নিজেকে ছেলেটার বন্ধু মনে হচ্ছে শাওনের। বন্ধুদের সাথে আগেরমতো সহজ সরল গল্পগুলো করা হয়না এখন আর। চাকরি,টাকা...আরো ভালো চাকরি,আরো টাকা এইগুলোর গল্প শেষ করে নারীর দেহ, আর নতুন কেউ বিয়ে করলে বিয়ের পর তার অধঃপতন নিয়েই আলোচনা চলে সেখানে। সহজ কথা বলা, খুনসুটি করা ভুলে গেছে সবাই। কেনো?
-সত্যি ভাই। গার্লফ্র্যান্ড নাই।
তেজিভাবে বললো এইবার ছেলেটি। মেয়েদের সাথে তুলনাটা কোনো পুরুষই মেনে নিতে পারেনা। এই বয়সের বাচ্চারা ত একদমই পারেনা। ছোটবেলার সংস্কার এই বয়সে “লিংগাভিমান” এ রুপ নেয়।
- নাই তাহলে বানাও। এই রুপ-যৌবন নিয়ে কি করবা যদি গার্লফ্র্যান্ডই না থাকে।
পুরনো ফর্মে চলে গিয়েছে শাওন। বন্ধুমহলে পচানোর কাজটা সেই সবচাইতে ভালো করতে পারতো।
- একটু শিখিয়ে দেন না ভাই কিভাবে বানাতে হয় গার্লফ্র্যান্ড। কত চেষ্টা করলাম,কাজ হচ্ছেনা ত।
কাউন্টার এ্যাটাকটা ভালোই করেছে ছেলে। হা হা করে হেসে উঠলো শাওন।
- ঠিক আছে বতস। অবশ্যই শিখাবো। গুরুদক্ষিনা দাও আগে। সিগারেট নিয়ে আসো একটা।
এই ফাঁকে ছেলেটিকে রুমে সিগারেট খাওয়াটাও অভ্যাস করিয়ে দেয়া যাবে। ছেলেটি একটি বেনসন নিয়ে আসলো। ১০টাকার সিগারেট অনেকদিন খাওয়া হয়না শাওনের। আগ্রহভরেই নিলো সে।
- ভাইয়া আজকে অফিসে যাবেন না? জানতে চাইলো নতুন ছেলেটি।
ওরে তাই ত। বলেই রুম থেকে বের হয়ে গেলো শাওন। আজ দুইদিন হলো তার চাকরি চলে গিয়েছে। ব্যাপারটা এখনও বাসায় জানায়নি সে।
২
বাস আটকে আছে শাহবাগের মোড়ে।ঘেমে মোটামোটি গোসলের মতো করে ফেলেছে শাওন। পাশের সিটে বসে থাকা ভদ্রলোক মনে হয় আতর মেখে এসেছেন গায়ে। আতরের সাথে ঘামের গন্ধে অদ্ভুত এক রসায়নের উদ্ভব হয়েছে। বমি বমি ভাব আসছে শাওনের। নেমে যাওয়ার উপায় নেই কারন কাউন্টার থেকে টিকেট করে উঠেছে সে। নামলে পুরো টাকা গচ্চা, সিটও ফাঁকা নেই গাড়িতে।অগত্যা আতরযুক্ত ঘামের গন্ধ হজম করেই যেতে হবে তাকে। চাকরি চলে গেলো ৩দিন। পকেটে একশ টাকার দু’টো নোট আর কিছু খুচরা পয়সা, এই তার সম্বল এখন। সামনে ঘোর বিপদ আসছে হয়ত। অর্থ এখন শুধু জরুরত না, অর্থ এখন জীবন।
- হালার দেশ। কিছু হইলেই পাবলিক রাস্তা দখল কইরা বইসা থাকবো। বাপ দাদার তালুক পাইছে রাস্তারে। সবডিরে পিডাইয়া ঠ্যাং ভাইংগা দেয়া উচিৎ। মালিকে বেতন না দিলে মালিকের বাড়িত গিয়া জিনিসপাতি নিয় আয়। রাস্তায় কী করস।
- মালিকের বাসায় যাইবো ভাই? গার্মেন্টসের সামনেই কথা কইলে ঠ্যাং ভাইংগা দিবো পুলিশে। সাধে কি আর মিছিল করে এই গরমের মাঝে?
- তাইলে স্টেডিয়াম খুইলা দেওক। সবাই গিয়া সেইখানে খুব মিছিল-মিটিং করুক গা। আমরা কি হেগো বেতন আটকায়ে রাখছি? তাইলে আমাগো কষ্ট দিওনের মানে কি?
কথোপকথনে সচকিত হলো শাওন।মিছিলটা সে মাত্রই দেখল।গাড়ির হর্ণ,মানুষের চিতকারের শহরে মিছিলের শব্দ আলাদা কোনো আমেজ নিয়ে আসেনা, হ্যা ভয়ের উদ্রেগ করে মাঝেমধ্যে।
তবে এই মুহুর্তে ভয় না, টেনশন কাজ করছে। অফিসে যেতে হবে সময়মত। চাকরি চলে যাওয়াটা অনেকটা জেনটেলমেন এগ্রিমেন্টের মতোই হয়েছে। মার্কেটিং এর কিছু লোক ছাটাই করবে মালিকপক্ষ অনেকদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিলো। মালিক ঔষধের ফ্যাক্টরি দিচ্ছেন । ঐখানে ইনভেস্ট করাতে এই ব্যবসা থেকে লোক ছাঁটাই করতে হবে এমন গুজব অফিসে শোনা যাচ্ছিলো।কয়েকজন আন্দোলন করার হুমকিও দিলো। এইচ আর থেকে যখন ডাক এলো তখনই বুঝে গিয়েছিলো শাওন যে তার ঘন্টা বেজেছে। ডিপার্টম্যান্ট হ্যাড বেশ ভালোভাবেই বুঝালেন তাকে, ম্যানেজম্যান্ট না চাইলে কারো পক্ষে কাজ করা সম্ভব না।অবশ্যই স্যার, বলে সায় দেয়া ছাড়া আরে কিছু বলতে পারছিলোনা শাওন। এইচ আরের হ্যাড তখন প্রস্তাবটা দিলেন, শাওন মনযোগ দিয়ে আমার কথা শোনো।অফিসে কয়েকজন কর্মকর্তা এ্যামপ্লয়িদের 'তুমি' করে বলে। এই স্যার তাদের একজন। সবাইকে আমি এভাবে বলিনা। অনেকেই চাকরি চলে যাওয়া নিয়ে ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করছে। আন্দোলন করবে,মিডিয়াতে বলবে অনেক কিছু শোনা যাচ্ছে। করতে পারে। সবারই অধিকার আছে এগুলো করার। কিন্তু করে লাভটা কি হবে ভেবে জানো? উপরের কয়েকজনের ফায়দা হবে,মিডিয়ার ব্যবসা হবে আর বাকিদের কপালে কিছুই জুটবেনা।তোমাকে আমি অনুরোধ করবো এই ধরনের কিছু করবেনা । তোমাকে আমরা এই মাসের বেতন সম্পূর্ণ দেবো। তিন মাসের টাকা পাবে চাকরি চলে যাওয়ার ক্ষতিপূরন হিসেবে। এছাড়া কোথাও এ্যাপ্লাই করলে অবশ্যই আমাদের রেফারেন্স দিবে,আমরা যথাসাধ্য সহযোগিতা করবো তোমার চাকরির জন্য। একদমে কথাগুলো বলে রিজাইন লেটার দিয়ে দেবার আবেদন জানালেন তিনি। হিসেব করে নিলো শাওন, তিন মাসের বেতন মানে ৩৬ হাজার টাকা। সাথে এই মাসের বেতন ১২ হাজার টাকা। অন্তত ঢাকা শহরে ৪/৫ মাস থাকার মতো টাকা থাকলে সেটি অনেক বড় ব্যাপার। এই কয়মাসে কী একটা চাকরি জুটবেনা?
- আমি রাজি স্যার। এই কথা বলা ছাড়া আর কোনো রাস্তা খোলা ছিলোনা শাওনের হাতে।
এই মাসের বেতন ত ঢুকে যাবার কথা কিন্তু এখনও ঢুকেনি।মাসের বেতনের সাথে বাকি পে-মেন্টগুলো কবে নাগাদ হাতে আসবে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে আজকে। এইচ আর ডিপার্টম্যান্ট হ্যাড আবার ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছেন। আজকেই সবকিছু ফাইনাল না করলে পরে আবার কোন ঝামেলা হয় কে জানে? মিছিলের জন্য দেরী হয়ে যাচ্ছে। লাঞ্চের টাইম হয়ে গেলে পরে যদি কেউ না থাকে তাহলে বিপদে পরতে হবে। সকাল সকাল কাজ করিয়ে নেয়াটাই উত্তম। মিছিলটা বড্ড জ্বালাচ্ছে দেখি।
শেষ
- শাওন সাহেব কেমন আছেন?
- এইত ভাই,আছি আর কী। বেতন কি ঢুকেছে রিয়াদ ভাই?
- বেতন ত গতকালই ঢুকে গিয়েছে। কেনো আপনার এ্যাকাউন্টে যায়নি টাকা?
- না। আমার মোবাইলে ত কোনো মেসেজ আসলোনা। আর সকালে আমি এটিএম এ চ্যাক করে এসেছি। কোনো টাকা ঢুকেনি।
- অ। আচ্ছা দাঁড়ান। আমি একটু দেখে দিচ্ছি। সবার টাকাই ত গতকাল ঢুকে গিয়েছে। আপনারটা না ঢুকার ত কারন নেই কোনো।
- একটু দেখেন না রিয়াদ ভাই। আর আমার তিনমাসের যে টাকাটা পাওয়ার কথা সেটি কবে নাগাদ ঢুকবে তাও একটু বলে দেন আজকে।
- হুম । দেখছি দাঁড়ান।
কম্পিউটারে ব্যাস্ত হয়ে গেলেন রিয়াদ। বেতনটা হয়ে গেলে একটু দম পেতো শাওন। হাতে টাকা না থাকলে অসহায় লাগে।আর সামনে টাকা আসার কোনো উপায় না থাকলে হাত-পা অবশ হয়ে যায়। ঢাকা শহরে অক্সিজেন ছাড়া বেঁচে থাকা যেতে পারে কিন্তু টাকা ছাড়া এক দন্ডও বেঁচে থাকা যাবেনা। ঢাকার বাতাসে টাকা উড়ে কথাটা ভুল,ঢাকা শহরের বাতাসকেও টাকা দিতে হয়।
মুখটা গম্ভীর করে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলেন রিয়াদ সাহেব।উনার মুখে সর্বদাই হাসি লেগে থাকে। এইচ আর এ কাজ করার প্রধান শর্তই বুঝি হাসতে পারা, আর আশার কথা শোনানো। অফিসে আসার পর থেকে রিয়াদ সাহেব তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা শুনিয়েছেন বেশ কয়েকবার। তবে এই মুহুর্তে তার ভবিষ্যতের ঔজ্জ্বল্যের চাইতে ভবিষ্যতের অস্তিত্বটা জরুরী। আর সেই জন্য তার টাকাটা দরকার।
- আপনার টাকাটা বোধহয় ঢুকতে একটু দেরী হতে পারে শাওন সাহেব। ভদ্রলোক চেষ্টা করেও মুখের তরলতা ধর রাখতে পারছেন না।
- মানে কি? এই মাসের বেতন ত ঢুকবে নাকি? স্যার ত বলেছিলেন যে এই মাসের বেতন আমি সময়মতো পাবো আর বাকি টাকা একমাসের মাঝেই ঢুকে যাবে।
- জ্বি,তা ঠিক। স্যার হয়ত বলেছেন। কিন্তু এ্যাকাউন্টস থেকে অন্য নির্দেশনা এসেছে। আমরা আর কী করতে পারি বলেন। উপর থেকে যাই বলবে আমরা ত তাই করবো। আপনি না হয় এ্যাকাউন্টসের রফিক স্যারের সাথে একবার কথা বলে দেখেন।
রফিক স্যার অফিসের সবচাইতে খবিশদের একজন। ডিরেক্টর স্যারের খুব প্রিয় মানুষ তিনি। মাঝে মাঝে টি এ বিল আনতে গেলে এমনভাবে কথা বলবেন যেনো নিজের পকেট থেকে টি এ দিচ্ছেন তিনি। এখানে এত টাকা ক্যান লাগলো, সিএনজিতে কেনো উঠেছেন আপনি, এই জায়গা থেকে সেই জায়গা যেতে আপনার সিএনজি লাগে... অভিযোগের শেষ নেই উনার। পারতপক্ষে উনাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে শাওন। আর নতুন ফ্যাক্টরির কাজে তিনি এখন অনেক ব্যাস্ত। এই অফিসে বসেনই না খুব একটা।
- রফিক সাহেবের সাথে আমি কি কথা বলবো? উনার সাথে কথা বললেই ত হাজারটা যুক্তি দেখান তিনি। আর আমার কথা বলার দরকারই বা কি? আমাকে স্যার যেভাবে যা করতে বলেছেন আমি সেভাবেই সব করেছি। এখন তাহলে আমার টাকা দিতে দেরী হবে কেনো ভাই। আমি স্যারের সাথে কথা বলবো।
- আমি বুঝতে পারছি শাওন সাহেব। কিন্তু আমাদের ত হাতপা বাঁধা। এ্যাকাউন্টসের কাজ ত আর আমরা করিনা। আমরা এ্যাকাউন্টসে বলতে পারি কিন্তু তারা কখন এ্যাপ্রুভ করবে তা ত আমাদের হাতে নাই। আপনি ত দেখেছেন অফিসের আইন। এখানে আমাদের ত কিছু করার নাই। আপনি এ্যাকাউন্টসে কথা বললেই মনে হয় ভালো হবে।
- আমি স্যারের সাথে কথা বলব। এ্যাকাউন্টসে গিয়ে শুধু শুধু ঘুরাঘুরি করতে পারবোনা আমি।
- আচ্ছা। বসুন। আমি স্যারকে বলছি আপনার কথা।
নিচের লবিতে বসে আছে শাওন। আসন্ন বিপদটা আঁচ করতে পারছে কিন্তু সেটিকে মেনে নেয়ার প্রশ্নই আসেনা।টাকা না নিয়ে যাবেনা সে কোনো অবস্থাতেই। বাড়ি ভাড়া দিতে হবে,বাজার খরচ দিতে হবে, দোকানের বাকি পরে আছে, আজকে দিবে বলে সে আরো দশটা সিগারেটও কিনে এনেছে। টাকা না নিয়ে সে বাসায় যেতে পারবেনা আজকে। নিচের ডেস্ক থেকে একবার ফোন করলো আবার সে রিয়াদ সাহেবকে। স্যার ফ্যাক্টরিতে যাবেন। আপনি নিচেই থাকুন,স্যার আপনার সাথে সেখানেই দেখা করবেন বলেছন। আমি স্যারকে বলেছি, আপনি চিন্তা করবেন না, বলে রেখে দিলেন রিয়াদ সাহেব। আশা দেয়া যাদের কাজ তাদের আশাতে চিন্তামুক্ত হওয়া সম্ভব না। ঘন্টাখানেক বোধহয় হয়ে গেলো বসে থাকতে থাকতে শাওনের। উত্তেজনাতে এর মাঝে তিনবার সিগারেট খেতে বের হয়েছিলো সে। অফিসের আরো দুইজনের সাথে দেখা হলো। শাওনের কথা শুনে স্বান্তনা দিলো তারা। স্বান্তনা ব্যাপারটা পাওয়া কতটা আনন্দের সেটা বুঝতে পারলো শাওন। এদের সাথে ভবিষ্যতে আর যোগাযোগ রাখবেনা নিশ্চিত করলো সে।
ম্যানেজম্যান্টের কয়েকজ কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে বলতে নিচে নামলেন এইচ আর ডিপার্টম্যান্টের পরিচালক। কাচুমুচু হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকলো শাওন। চাকরি চলে গেলেও এই মানুষগুলোর সামনে সোজা হয়ে দাঁড়ানো সম্ভব না। এরা সোজা হয়ে দাঁড়ানোটা পছন্দ করেন না এবং তাদের পছন্দের গুরুত্ব দেয়াটা শাওনদের জীবিকা। শাওনকে দেখেও কথা বলে চললেন পরিচালক স্যার যেনো শাওনের উপস্থিতির আলাদা কোনো বৈশিষ্ট নেই। শাওন এমনিতেই দাঁড়িয়ে আছে এখানে,রোজকার মতোই। অফিসের গেটের সামনে গিয়েও যখন শাওনকে ডাকলেন না তিনি তখন আর শাওনের পক্ষে অপেক্ষা করা সম্ভব হলোনা। তার জীবিকা গেটের ঐপারে চলে যাচ্ছে।
-স্যার আপনার সাথে একটু কথা ছিলো। যথাসম্ভব গলাটা নিচু করে কথা বলার চেষ্টা করলো শাওন।
- ও শাওন সাহেব। বলুন কি বলবেন। সাথের কর্মকর্তাদের সামনে দাঁড়িয়েই কথা বলে গেলেন তিনি। এর অর্থ তোমার হাতে সময় কম,জলদি বলো।
-স্যার আমার বেতন ঢুকেনি। আর আপনি যে বলেছিলেন তিনমাসের স্যালারি ঢুকবে সেটা নিয়েও রিয়াদ স্যার কিছু বলতে পারেন নি। আপনি কি একটু বলে দিবেন স্যার?
- ও, তোমাদের বেতন ত একটু দেরী হবে। অপেক্ষা করো পেয়ে যাবে। আর তিনমাসের স্যালারি অবশ্যই পাবে। অফিসিয়াল ব্যপার ত বোঝই। একটু সময় লাগবে।
- আমার এই মাসের বেতনটা ত স্যার পাওয়ার কথা ছিলো সময়েই। গতকাল অফিসের সবার বেতন হয়েছে। আমারটা কেনো হলোনা স্যার?
- সেটা ত আমার ডিসিশন না । আমি তোমার ফাইল ফরোয়ার্ড করে দিয়েছি। এখন এ্যাকাউন্টস যখন এ্যাপ্রুভ করবে তখনই পাবে। বলেই হাঁটা ধরলেন তিনি। হঠাত লোডশেডিং হলে যেমন অন্ধকার থাকে সেই অন্ধকার ঘিরে ধরলো শাওনকে। দৌড়ে গিয়ে স্যারের সামনে দাঁড়ালো আবার সে।
-স্যার, আমার এই মাসের স্যালারিটি বের করতে বলে দেন প্লিজ। না হলে আমি ভীষন বিপদে পরে যাবো।
- সেটা ত আমার কথাতে হবেনা শাওন। বোঝার চেষ্টা করো। এ্যাকাউন্টস কাজ করে ম্যানেজম্যান্টের ডিসিশন অনুযায়ী। আমি শুধু প্রপোজাল দিতে পারি। তুমি অপেক্ষা করো, হয়ে যাবে।
- স্যার প্লিজ,আমার এই মাসের স্যালারিট প্লিজ।
আই এম সরি। আই কান্ট ডু এ্যানিথিরং রাইট নাউ। লেটস গো জ্যান্টেলম্যান, বলে হাঁটা ধরলেন তিনি।মুখের চামড়া কিছুটা শক্ত হয়ে গিয়েছে তাঁর। এই মুখ শাওন চিনে। এর অর্থ এরপর কথা বলতে আসলে গার্ড ডাকবো।
স্যার তাঁর দলবল নিয়ে চলে গেলেন। লবির গেটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে শাওন। কতক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলো ঠিক বলতে পারবেনা সে। হয়ত ১০ মিনিট, হয়ত একঘন্টা। ঝড়ের পরে শান্ত কোনো ধ্বংসস্তুপের সামনে যেভাবে দাঁড়িয়ে থাকে মানুষ সেভাবে। ডেস্কের ছেলেটি এসে ভিতরে যেতে বললো শাওনকে। হয়ত কিছু স্বান্তনার কথা সেও শুনিয়ে গেলো, কথা কানে যাচ্ছেনা শাওনের। প্রতারিত হলে মানুষ ভাষা হারিয়ে ফেলে। বিশ্বাস করে ঠকা অনেক কষ্টের। শাওন বুঝতে পারছে তার সাথে চমৎকার প্রতারনা হয়েছে। কথাতে ভুলিয়ে তার কাছ থেকে রিজাইন লেটার নিয়ে নেয়া হয়েছে।টাকা না দিলেও কিছু করার নেই তার এখন। রিজাইন লেটার দেয়ার পর চাকরির এ্যাগ্রিমেন্ট মানতে মালিক বাধ্য না। তার পক্ষে বাকিদের দলে ভিড়াও সম্ভব না এখন। চমৎকারভাবে খেলেছেন স্যার তার সাথে। এখন কিছুই করার নেই তার। বাড়িভাড়া,বাজার খরচ,দোকানের বাকি,বেচে থাকা কিভাবে হবে এখন? ঢাকা শহরে একদিন থাকার মতো টাকাও নেই তার কাছে। ধার করবে? কিভাবে শোধাবে? চাকরি নেই শুনে কে দিবে ধার? বাড়ি যাবে? কিভাবে যাবে? কি বলবে? সেই কবেই ত সেই সব ছিন্ন করে চলে এসেছে এই শহরে। না,বাড়ি যেতে পারবেনা সে। বাপ নামের সেই ভদ্রলোকের চেহারা দেখার ইচ্ছা নেই তার। মায়ের কবর দেখারও ইচ্ছে নাই। পিঠে হাত পরলো মনে হয় কারো। রিয়াদ সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। আপনি রিজাইন করে ঠিক করেন নি শাওন সাহেব। যাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হচ্ছে তারা কেস করছেন, মিডিয়াতে খবর হচ্ছে। আপনি বোকার মতো কাজ করেছেন। আপনি যত জলদি পারুন চাকরি খুঁজে নিন।
বললেই হলো? চাকরি কি বসে আছে খুঁজে নেবার জন্য?চাকরি খুঁজতেও যে টাকা লাগে। বেঁচে থাকতে যে টাকা লাগে। সেটি কই পাবে সে এখন? অফিস থেকে পা টেনে টেনে হেঁটে বাইরে আসলো শাওন। বুকের মাঝে কান্না দলা পেকে উঠছে কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার কান্না আসছেনা। আসন্ন ভবিষ্যতের উৎকণ্ঠা কান্নার চাইতে প্রবল। কান্না করে সেই ভয় থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব না। হাঁটতে হাঁটতে পল্টন মোড়ে চলে এসেছে শাওন। মোড়ে অনেক ভিড়। মানুষের ভিড়। ভিড়ের মাঝে চিৎকারও শোনা যাচ্ছে। অনেকটা স্লোগানের মতো মনে হচ্ছে হইচইটা। ধাক্কাধাক্কির মাঝে বোধ ফিরে পেলো শাওন। শাহবাগের সেই মিছিলটি এখন পল্টনে চলে এসেছে।মিছিলের স্রোত শাওনকেও টেনে নিলো তাদের মাঝে।
দূর থেকে দেখা যাচ্ছে মিছিলের মাঝখানে টি-শার্ট আর জিন্স পরা এক যুবক চিৎকার করে যাচ্ছে,
“ভাত চাই,কাপড় চাই
সময়মতো বেতন চাই।।”
-------------------------------------------
আশফাক (অধম)
মন্তব্য
প্রতারিত মানুষ নিয়ে লেখা গল্প ভালোলেগেছে।
এই পরিচয়টা ভালো লাগেনি, বিশেষ করে মুসলমানি দাড়ি বাক্যটা। নিদিষ্ট সম্প্রদায়কে হেয় মূলক মনে হলো অনেকটা। হাচল হলে বাক্যটি সম্পাদনা করার দাবি রেখে গেলাম।
আপনি কমা ব্যবহারের পর অনেক জায়গায় স্পেস দেননি, ফলে পড়তে কিছুটা সমস্যা হয়। এছাড়া আমার মতো আপনিও দেখি বেশ বানান ভুল করেছেন , আশা করি সেগুলো পরবর্তী লেখায় শুধরে নিবেন। লেখালেখি চলুক
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
হেয় করার ইচ্ছে থেকে ত লিখিনি। ভদ্রলোকের চেহারাটা আঁকতে গিয়ে ঐ বিবরনটাই মাথায় এসেছিলো। তবে সেটা হেয়মূলক মনে হলে তা অবশ্যই লেখকের চিত্র আঁকার ব্যার্থতা ।
বানানের সমস্যাটা অনেকদিনের। চেষ্টা করতেছি বলাটাও অন্যায় হবে কারন আমি বিরাটা আইলসা মানুষ। কি-বোর্ডে এফ-১২ চাপতেই যদি আইলসামি লাগে তাইলে আবার 'স্পেল চ্যাক' ইউজ করতে ক্যামন লাগে কন দেহি। । চেষ্টা করবো যথাসাধ্য ভুল কমিয়ে আনার।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
----------------------------
আশফাক(অধম)
গল্প ভাল লেগেছে। আপনি সুন্দর লেখেন। খুব সহজ সরল ভাবে এগোয় আপনার লেখা। পড়ে আরাম পাওয়া যায়।
সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
--------------------------
আশফাক(অধম)
গল্প ভালো লেগেছে। তবে গল্প বলেই হয়তো মেসের সকালের বিস্তারিত বর্ণনা অযথা বড় মনে হয়েছে। মূল কাহিনির সাথে তেমন যোগাযোগ তো নেই - তাই এখন মনে হচ্ছে ঐ অংশটা ছোট হলেই ভালো হতো। এটা যদি উপন্যাস আকারে লেখা হতো, তাহলে হয়তো চরিত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য ওটা ঠিক ছিল।
কয়েকটা বানান খুব চোখে লাগছে - ডিপার্টম্যান্ট হ্যাড , চ্যাক , ম্যানেজম্যান্ট ইত্যাদি। আর মাঝে মাঝে বিরাম চিহ্নের পরের স্পেসটা পড়েনি, তাই পড়তে কষ্ট হয়েছে।
লেখা চলুক তরতরিয়ে।
____________________________
ধন্যবাদ ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য। অবশ্যই চেষ্টা করবো ঠিক করে নেবার। লেখা একবার পোস্ট করার পর এডিটের অপশনটা না থাকাতে বিরাট সমস্যা। অনেক ভুল পোস্ট করার পরে চোখে পড়ে।
--------------------
আশফাক(অধম)
এ ক্ষেত্রে অধমের একটা পরামর্শ ছিল - লেখা পড়ার পরে ওটাকে ফেলে রেখে দেন কয়েকদিন ( ),
না হলে অন্তত কয়েক ঘন্টা। তারপর একবার পড়ে ফেলুন আগাগোড়া। দেখবেন অনেক কিছু বদলে গিয়ে পুরো লেখাটাই অন্য মাত্রা পেয়ে গেছে!
____________________________
----------------
আশফাক(অধম)
বাস্তবের কাছকাছি লেগেছে গল্পটা
শুভেচ্ছা
ধন্যবাদ মেঘলা মানুষ
-----------------
আশফাক(অধম)
গল্পের বক্তব্য ভাল লেগেছে। বাকি যা বলার ছিল তা উপরে প্রফেসর সাহেব বলে দিয়েছেন। আপনার উত্তরও পরেছি এখানে আর তাই সেগুলির পুনরাবৃত্তি করলাম না। শুভেচ্ছা নেবেন। পরের গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
-----------------
আশফাক(অধম)
ভাল লেগেছে, আর এক লহমা ও হিজিবিজির সাথে একমত।
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
ধন্যবাদ
-------------------
আশফাক(অধম)
লেখার হাত ভালু আপনার
ব্যাথা/ব্যথা, ভীষন/ভীষণ, পরিনত/পরিণত(হ্যাড/চ্যাক /ম্যাক এরাম ভান্মা ভালু না)
টাইপো চোখে পড়লো। এডিটের ক্ষমতা পাইলে ঠিক করে নেবেন।
লেখালেখি চলুক
------------------
আশফাক(অধম)
আজব বেপার তো! ভালুই তো কইছি তাতে তো খুশি হইবার কথা। আপ্নে কান্দেন ক্যান?
এত্ত এত্ত ভুল আর কান্দুম না??
-------------------
আশফাক(অধম)
নতুন মন্তব্য করুন