দেখিয়াও হইল না দেখা!

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১৭/০৮/২০১৪ - ৫:২০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


আমি কুষ্টিয়া কাটিয়েছি প্রায় তিন বছর। বাংলাদেশে এই শহর আমার সবচেয়ে প্রিয় শহর, নিজের জন্মস্থান ঝিনাইদহের থেকেও বেশী। তখনকার কুষ্টিয়ায় বহুতল বাড়ি এখনকার মত এত বাড়েনি। কুষ্টিয়ার আমাদের চারতলা বাড়ির সিড়িঘরের ছাদে একলা আমি গুনগুণ করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতাম আর চেয়ে থাকতাম বেশ দূরের একটা দশতলা কমপ্লেক্সের দিকে। জানতাম এর আশেপাশেই কোথাও একসময় রবীন্দ্রনাথের পায়ের চিহ্ন পড়েছে। আকাশটা তখন অনেক বড় মনে হত, আর মাটি থেকে অনেক উপরে প্রবল হাওয়ার মাঝে আমার মনে হত আকাশে ভাসছি। সেই ১১-১২ বছর বয়সে প্রথম আমার রবীন্দ্রনাথকে অনুভব করা। কিন্তু তারপর এতগুলো বছরেও আমার কোনদিন দেখা হয়ে ওঠেনি রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত ট্যাগোর লজ আর শিলাইদহের কুঠিবাড়ি। এক সন্ধ্যায় শ্মশান মন্দির থেকে ফেরার সময় বড়ভাই রিকশা থেকে ট্যাগোর লজ দেখিয়েছিল একবার, সেই আধো অন্ধকারে বাড়িটির অবয়ব দেখে আর মনে মনে অনেককিছু কল্পনা করে সেবার শিহরিত হয়েছিলাম। এই জায়গাগুলো হয়তো আরও কয়েকবছর আমার না দেখা থেকে যেত। কিন্তু আমার এক আমেরিকান বন্ধুর অছিলায় এবার সে সুযোগ ঘটে গেল। এই আমেরিকান বন্ধুর পরিচয় দেওয়া যাক। ঢাকার ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে বাংলা ল্যাংগুয়েজ ইন্সটিটিউট নামে এক অঙ্গ প্রতিষ্ঠান আছে। এই প্রতিষ্ঠানে সামারে প্রতিবছর আমেরিকা সরকারের বৃত্তি নিয়ে ১৬ থেকে ২০ জন আমেরিকান Critical Language Scholarship নিয়ে বাংলা শিখতে আসে। এছাড়া বছরের অন্যান্য সময়েও ফুলব্রাইট স্কলারসহ আরও অনেকেই বাংলা শিখতে এই ইন্সটিটিউটে আসে। তো এই অধমের কাজ হল তাদেরকে বাংলা শিখতে সাহায্য করা এবং বাংলা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা দেওয়া (আমি কিন্তু শিক্ষক নই!)। তো এভাবেই এবছর আমার ভাগে পড়েছে ইয়ান রিড নামের এই আমেরিকান। পড়াশোনা ধর্মতত্ত্ব নিয়ে। আগ্রহ প্রাচীন হিন্দুইজম নিয়ে। তাই ঢাকায় এই কবছরে যতগুলো মন্দিরে না গিয়েছি, এক ইয়ানের সাথেই ঘুরে দেখা হয়ে গেছে অনেকগুলো। আরও গিয়েছি ৫০০ বছরেরও পুরনো এক খ্রিস্টান সিমেট্রিতে, কয়েকটা মাজারে এবং ঢাকার বাহাই উপাসনালয়ে। তো ঈদের ছুটিতে ইয়ানকে দাওয়াত দিলাম আমার বাড়ি ঝিনাইদহে যাওয়ার জন্য সাথে টোপ হিসেবে দিলাম কুষ্টিয়া কুঠিবাড়ি ও লালনের মাজার দেখার সুযোগ। গীতাঞ্জলী পড়ুয়া লালনভক্ত ইয়ান এক পায়ে খাড়া। ঈদের ভীড়ে ইয়ানকে নিয়ে বাড়ি যাওয়ার গল্প অন্য সময়ের জন্য না হয় তোলা থাক।
****
২৬ জুলাই আমি, ইয়ান আর আমার এক ছোটভাই জয় ঝিনাইদহ থেকে কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। অবশ্যই লোকাল বাসে। বেচারা ইয়ান! পড়বি তো পড় একেবারে যেদিকে রোদ বেশী সিট পড়ল ঠিক সেই দিকে। যাইহোক জয় আর ইয়ান উচ্চাঙ্গের(!) অনেক বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনা করতে করতে বাসের সময়টুকু পার করে ফেলল। কুষ্টিয়া বাস টার্মিনালে নেমে আমরা একটু দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেলাম কারণ সেখান থেকে আমাদের যেতে হবে আলাউদ্দিন নগর আর সেখানে যাওয়ার বাসের যে অবস্থা দেখা গেল তাতে আর যাই হোক ইয়ানকে নিয়ে যাওয়া চলে না। ভাগ্য ভাল আমার মা’র এক কলিগকে পাওয়া গেল বাসের অপেক্ষায়। তিনি নিজেই এসে আমাদের বুদ্ধি দিলেন সিএনজিতে করে একেবারে কুঠিবাড়িতে চলে যেতে। অগত্যা তাই নিলাম। কুষ্টিয়ার সিনজিতে ঢাকার মত খাঁচা বসানো নেই। বেশ আরামেই চারিদিকে দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। রাস্তার দুপাশে চিরায়ত বাংলার রূপ দেখে আমারই চোখ জুড়িয়ে গেল, ইয়ানের কথা তো বলাই বাহুল্য। পাশে পাশে বেশ খানিকটা উঁচু দিয়ে চলছে ট্রেন লাইন আর তার সাথে বড় বড় গাছের ঝোপ। পথে আরও পড়ল গড়াই নদীর এক অংশ। নদী দেখে আমি ছেলেমানুষের মত খুশী হয়ে উঠি অনেক আগে থেকেই। এখানেও তার ব্যতিক্রম হল না। একসময় পৌছলাম কুঠিবাড়িতে। আমাদের টিকেট ২০ টাকা, ইয়ানের জন্য ১০০। আমাদের দিতে কোন আপত্তি ছিল না, কিন্তু জানা গেল কুঠি বন্ধ! ঈদের জন্য নাকি বন্ধ হয়ে গেছে! একপ্রস্থ তর্ক হয়ে গেল, বন্ধ কুঠি দেখার জন্য টিকেট কেন কাটতে হবে। অবশেষে রফা হল সবারই ২০ টাকা দিলে চলবে। মূল কুঠিবাড়িতে ঢোকার কোন উপায় নেই। বাধ্য হয়ে চারপাশে ঘুরেই দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে হল।
কুঠিবাড়ি

কুঠিবাড়ি

পদ্মা বোট

এক পাশে দেখা গেল পুকুরে “পদ্মা” নামের একটা বজরা রাখা। রবীন্দ্রনাথের “পদ্মা” বোটের নাম শুনেছি কিন্তু এটা সেটাই কিনা কেমন জানি একটু সন্দেহ হল। সেদিন ছিল প্রচণ্ড রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। ছায়া ছাড়া দাড়ানোই যাচ্ছিল না। তার মধ্যেই জয় আমার ক্যামেরা নিয়ে প্রজাপতির ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এর মাঝে এক কুলফিওয়ালা এসে হাজির। সাথে সাথে নিয়ে নিলাম দুটো। আমার আর জয়ের জন্য। ইয়ানকে দিলাম না, কারণ দূতাবাস থেকে ওদের উপর নির্দেশনা আছে যেখানে সেখানে খাবার না খাওয়ার জন্য। আমাদের খাওয়ার দিকে লোভাতুরভাবে ইয়ান তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। বেচারা!
****
জীবনের এই বাইশ বছরে এসে কুঠিবাড়ির সামনে গিয়ে দাড়ালাম কিন্তু আশ্চর্য্য হয়ে দেখলাম কুঠিবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমার বিশেষ কোন অনুভূতি হল না। নির্লিপ্তভাবে দেখলাম যেন আর দশটা সাধারণ বাড়ির মত। কোন কল্পনা বা চিত্রায়ন আমার মনে ভেসে উঠল না। যেন রবীন্দ্রনাথের সাথে এর কোন সম্পর্কই নেই। নিজের নির্লিপ্ততায় নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। কুঠিবাড়ি থেকে বের হয়ে বিলের জলের উপর কারেন্টের তারে এক বন্ধুর দেখা পেয়ে গেলাম! সাদা-কালো মাছরাঙা। নানা ভঙ্গিমায় তার ছবি তোলা হল কিন্তু আমাদের দিকে ভ্রুক্ষেপ করার সময় কই তার!

একটা ভ্যান নেওয়া হল। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য এক পুরনো মন্দির। ভ্যানে আরও একজন যাত্রী। তিনি যাবেন পদ্মার ঘাটে। জানা গেল তার বাড়ি পাবনা। নদী পার হলেই নাকি পাবনা। আমি একটু বিরক্ত হচ্ছিলাম কারণ আমাদের পথ পদ্মার দিকে নয়। কিন্তু গ্রামের রাস্তা দিয়ে গ্রাম ভেদ করে হঠাৎ যখন নদীর সামনে গিয়ে পড়লাম তখন আমার কন্ঠরোধ হয়ে গেল! হঠাৎ যেন কোন অপূর্ব মায়াজালে আমি যেতে থাকলাম রবীন্দ্রনাথের সময় পেরিয়েও আরও অতীত থেকে অতীতে। যেন প্রাচীনকালের এক আমি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে এই শোভা দেখছি, আধুনিক সভ্যতা থেকে অনেক অনেক পিছনে। এই নদী যেন আমার কাছে মহাকালের প্রতীক হয়ে উঠে আমাকে মনে করিয়ে দিল, কতকাল কেটে গেছে.... আমার মতই কতজন হয়তো একই বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকেছে তার দিকে কিন্তু অবিচল নদী বয়ে চলেছে তো চলেছেই। এই প্রথম যেন আমি একটু অনুভব করতে পারলাম রবীন্দ্রনাথের আবেগ। আমি যেন বুঝলাম কীভাবে নদীর ঢেউ রক্তে কবিতার সঞ্চার করে।

আহ নদী!

ওহ নদী!

সেখানের সেই বিহ্বলতা কাটিয়ে ভ্যানে করে আরেকটি পুরনো স্থাপনার সামনে পৌছলাম। আমি ঐ অঞ্চলের ইতিহাস ঘেঁটে যাই নি তাই সেটা কী ছিল আন্দাজ করতে পারলাম না। যেই বানিয়ে থাকুক তার রুচি ছিল বলতে হবে। বাড়ির সামনে খোলা প্রাঙ্গন ছাড়িয়ে গাছতলায় সুন্দর গোলাকৃতি সিমেন্টের বেঞ্চ পাতা। বিকালে বসার জন্য একেবারে পারফেক্ট।

সম্ভবত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দাতব্য চিকিৎসালয়

সেখান থেকে গেলাম প্রাচীন এক মন্দিরে। মন্দির ধ্বসে পড়েছে অনেকটা। কিছু অংশ কোনমতে প্লাস্টার আর রঙ করা হয়েছে পুরনো টেরাকোটার কাজ মুছে দিয়ে। পুরনো মন্দিরের গা ঘেঁষে অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে বানানো হয়েছে সংকীর্তনের জায়গা। কিছুই করার নেই।

অপসৃয়মান ইতিহাস

আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য লালনের মাজার। যা শুনেছিলাম তাই। জায়গাটা পচে গেছে। মূল ফকির বা বাউল সংস্কৃতির কিছুই তেমন অবশিষ্ট নেই। গিয়ে মনে হল কোন ধর্মীয় পীরের মাজারে এসেছি। গেট থেকে আমরা ঢোকার সাথে সাথে আমাদের দেখেই কয়েকজন গান গাওয়া শুরু করে দিল। আমরা স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে গেলাম সেদিকে। জায়গায় জায়গায় গ্রামীণফোনের নীল রঙের কুৎসিত সাইনবোর্ড, “মাজারের পবিত্রতা রক্ষা করুন”। একজন এসে আমাদের জন্য চেয়ার পেতে দিল। তারপর শুরু হল গান। স্বীকার করছি অসাধারণ গলা আর সুর, কিন্তু তাঁদের চোখের দিকে তাকিয়ে কেন জানি মনে হল সেখানে শিল্পীস্বত্তার বড় অভাব। তিনটি গান শেষ হলে আমরা উঠলাম। তখন একজন এসে গলা নামিয়ে বলল, “শিল্পীদের কিছু বখশিশ দিয়ে যান।” তার দিকে তাকিয়ে আমার বেশ দুঃখ হল। এই প্রতিভা নিয়ে এদের সার্বক্ষনিক যে অর্থচিন্তায় ভুগতে হচ্ছে তাতে এরা একেকজন শিল্পী নয় যেন গান গাওয়া কল হয়ে উঠেছে। যাওয়ার সময় তাদেরকে দেওয়া হবে জানিয়ে আমরা গেলাম পাশের লালন জাদুঘর(!)এ। একটাই মাত্র রুম। তার একপাশে স্তুপ করে রাখা আছে নারকেলের খোল (!)। একজন মহিলা তখনও ডাব পেড়ে এনে ভর্তি করছে রুমে। দেখার মধ্যে একটা বিশাল হুক্কা ছাড়া আর কিছু দেখেছি বলে মনে পড়ে না। হাছন রাজাসহ অনেকের ছবিই টানানো আছে দেখা গেল। সেখান থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে আমরা গেলাম লালনের মূল সমাধির দিকে। সেখানে ফকির আলী শাহ আমাদের স্বাগত জানালেন। ইয়ান মূল মাজারের মধ্যে ঢুকে গেল। তার একটা ছবি তুলতে ইচ্ছা হল ভেতরের। সে আলী শাহকে ভাঙা বাংলায় জিজ্ঞেস করল, “ছবি? ছবি?” উনি কী বুঝলেন তিনিই জানেন। ইয়ানকে একপাশে নিয়ে পাশাপাশি রেখে ছবি তোলার পোজ দিলেন। অর্থাৎ উনি ভেবেছেন উনার সাথে ইয়ান ছবি তুলতে চেয়েছে! অগত্যা সেই ছবিই তোলা হল। আলী শাহ্‌র সাথে একজন সাগরেদ ছিল। সে আমার উপর বড়ই খুশী বলে মনে হল কারণ আমি একজন বিদেশীকে নিয়ে এসেছি। তারপর সে আমাকে আরও মনে করিয়ে দিল যে বাংলাদেশে “ইসলামের” আরও যেসব নিদর্শন আছে সেগুলো সম্পর্কেও যেন বিদেশীকে জানাই। উদাহরনস্বরূপ সে বার বার করে অন্যান্য বিভিন্ন পীরের মাজারের নাম নেওয়া শুরু করল। তার সাথে আরেকটু কথা বলতেই সে জানাল, লালনের গানে আসলে কোরান-হাদিসের ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। মনে মনে প্রমাদ গুনে সেখান থেকে কেটে পড়লাম। ফেরার আগে ইয়ান শিল্পীদের কিছু টাকা দিল।

লালনের মাজার

লালনের উত্তরসূরী?(!)


ইয়ান ও আলী শাহ

সবশেষে আমরা গেলাম কুষ্টিয়া শহরের মাঝে টাগোর লজে। ছোট্ট দোতলা বাড়ি। বোঝাই যাচ্ছে বানানো হয়েছিল অল্প সময় থাকার জন্য। সেখানের কেয়ারটেকার আমাদের সাদর সম্ভাষণ জানালো। বিদেশী দেখে সে সত্যিই অভিভূত। উপরে গিয়ে আমাদেরকে নিজেদের মত করে সব দেখতে বলে দিল। আসলেই যেন তখন বাড়িটা আমাদের নিজেদের। আর কেউ নেই ছোট্ট দোতলা বাড়িটায়। পেঁচানো লোহার সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হল (পেঁচানো সিড়ি বেশ অস্বস্তিকর)। উপরে একটাই বড় রুম। সেখানে আমরাই লাইট জ্বালালাম। তখন মনে হল আমি যেন রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় আর তার বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। দেয়ালে সাড়ি সাড়ি রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন দূর্লভ ছবি। এক কোনায় বুক শেলফে বেশকিছু বই। মেঝেতে পাটি পাতা। তার উপর একটা হারমোনিয়াম আর তবলা। যেন এখনই কেউ গান গাইবে। কেয়ারটেকার আমাদের বারান্দায় যেতে সাবধান করেছিল কারণ সেখানে নাকি বোলতার বাসা। সারাজীবন পোকামাকর আর কীটপতঙ্গ নিয়ে কাটানো আমাকে কি আর বোলতার ভয় দেখানো যায়! গেলাম বারান্দায়। সুন্দর লম্বা টানা বারান্দা। বাড়ির সাথেই এক পাশে আরও একটা পুরনো স্থাপনা জঙ্গল হয়ে আছে। অন্য পাশে গা ঘেঁষে কিছু সাধারণ বাড়িঘর। জানালা দিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তা দেখা যায়। রাস্তার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মনে হল আমার মত রবীন্দ্রনাথও একদিন হয়ত চেয়ে ছিলেন এই জানালা দিয়ে। তখন পথ ছিল অন্যরকম, পথের মানুষগুলো ছিল অন্যরকম। আজ সেই বাড়ি একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কতকিছু বদলে গেছে! ফেরার সময় কেয়ারটেকার আবদার করল রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্যের সাথে আর বিদেশীর সাথে তার দুটো ছবি তুলে দিতে হবে এবং সে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে যদি আমরা ছবিদুটো তাকে পাঠাই। দিলাম তুলে, আর লিখে নিলাম তার ঠিকানা।

ট্যাগোর লজ


রবীন্দ্রনাথের কোন ছবিতে চুলের সিঁথি একপাশে দেখেছি বলে মনে হয় না!

ওঠা বেশ অস্বস্তিকর

হেঁটে ফেরার পথে পড়ল কুষ্টিয়ার পরিত্যাক্ত রেল স্টেশন। ব্রিটিশ আমলের লাল ভবন খাঁ খাঁ করছে। আর একটু এগোতেই চোখে পড়ল অপূর্ব এক দৃশ্য। একটু দূরে কুষ্টিয়া জিউর মন্দিরের চূড়া দেখা যাচ্ছে, তার পাশেই একটা মসজিদের চূড়া। দুটোই পাশাপাশি সমান মর্যাদায় মাথা উঁচু করে আছে আকাশের বুকে। আমার ক্যামেরায় চার্জ নেই। ইয়ান ছবি তোলার চেষ্টা করতে লাগল আর আমি মনে মনে ভাবলাম এমন বাংলাদেশই কি আমরা চাইনি?

স্বপ্ন

কুষ্টিয়া! রবীন্দ্রনাথ, লালন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, কাঙ্গাল হরিনাথ, গ্রামপত্র প্রকাশিকা, নীল বিদ্রোহ, নীল দর্পন, মীর মোশাররফ হোসেন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন কতকিছু চলে আসে মনে। এত কম সময়ে তাই সত্যিই মনে হয়, দেখিয়াও হইল না দেখা!

- সীমান্ত রায়


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

ভালো লাগলো আপনার তোলা ছবিগুলো।
আর, কেশবিন্যাসের পরিবর্তন করে তো রবীন্দ্রনাথের চেহারাই পাল্টে দিয়েছে! অ্যাঁ

ঈদের ভীড়ে ইয়ানকে নিয়ে বাড়ি যাওয়ার গল্প অন্য সময়ের জন্য না হয় তোলা থাক।

-এই লেখা দ্বিতীয় পাতায় গেলেই শেলফ থেকে নামিয়ে দিন না হয় আমাদের পড়ার জন্য দেঁতো হাসি

শুভেচ্ছা হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য দেঁতো হাসি

রবীন্দ্রনাথের এই ভাস্কর্য হাঙ্গেরিতে থাকা ভাস্কর্যের হুবুহু অনুরূপ। সেখানে গিয়ে রবীন্দরনাথ এই চুলের স্টাইল নিয়েছিলেন কিনা কে জানে! হাসি

আর দ্বিতীয় পাতার ব্যাপারটা ঠিক কী? এটাই আমার সচলে প্রথম পোস্ট। এতদিন শুধু পড়েই এসেছি, তাই সব খুঁটিনাটি এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি মন খারাপ
- সীমান্ত রায়

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

সচলায়তনের নীড়পাতা অর্থাৎ যে পাতাটি দৃশ্যমান থাকে সেখানে আপনার কোন লেখা থাকলে আপনারই আরেকটি লেখা প্রকাশিত হবেনা। তাই আপনার লেখাটি নীড়পাতা থেকে অপসৃত হলে দ্বিতীয় লেখাটি দিলে সেটা প্রকাশিত হতে পারে যদি লেখাটা মডারেটরের দৃষ্টিতে সচলায়তনে প্রকাশের মানসম্মত হয়।
ছবিগুলো খুব সুন্দর হয়েছে, লেখাও ভাল লেগগেছে।
যাহোক, আমিও কিন্তু প্রাচীন হিন্দুইজম এ বড্ড আগ্রহী। আপনি নিশ্চয় এত দিনে মন্দির, আশ্রম ঘুরে অনেক কিছুই জেনেছেন। তাই আপনাকে আমার বিশেষ প্রয়োজন।
লেখা চলুক। চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

হ্যাঁ এখন বুঝেছি হাসি আসলে পাশ্চাত্যের একদম পিএইচডি করা বা হিন্দুইজম নিয়ে সত্যিকার অর্থে রিসার্চ করা মানুষ ছাড়া প্রাচীন হিন্দুইজম সম্পর্কে এদের ধারণাটা কিছুটা ফেব্রিকেটেড। যে ব্যাপারটা আমরা এই অঞ্চলে থেকে বা প্রাচীন সংস্কৃতির কিছুটা বাহক হয়ে বুঝতে পারি, সেটা ওদের কাছে ঐ ভাবে ধরা পড়ে না। এর আগে এক জাপানি প্রফেসরের সাথে কাজ করেছি (ঐ একই কাজ, বাংলা শেখানো), তিনি আগ্রহী ছিলেন বাংলা শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন নিয়ে। তিনি এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাচীন কিছু পাণ্ডুলিপি স্ক্যান করে নিয়ে যেতে (আমিও তার কাছ থেকে রেখে দিয়েছি খাইছে)। তো তার রিসার্চের বিষয় দেখা গেল বিভিন্ন গোস্বামীদের জীবনী, যা অবশ্যই ইতিবাচক দিক দিয়ে। সেই একই বিষয় আমরা যদি আমাদের চোখে দেখি তাহলে হয়ত প্রাথমিক সম্মান কেটে গিয়ে তাদের জীবনের অনেক খুঁটিনাটি দিক ধরা পড়বে। তাই এদের মাধ্যমে আমি যে প্রাচীন হিন্দুইজম সম্পর্কে অনেক নতুন কিছু জেনেছি সেটা দাবী করব না। শুধু কয়েকটি জায়গায় ভ্রমণই যা সম্বল বলতে পারেন।

- সীমান্ত রায়

দীনহিন এর ছবি

আমার স্বপ্নের জায়গাটিতে এখনো যেতে পারিনি! জানি না, না দেখেই চলে যেতে হবে কিনা! নইলে কেন যাওয়া হবে না দেশের মধ্যেই ঢাকা থেকে মাত্র কয়েক ঘন্টার দূরত্বের এই তীর্থস্থানে?

হ্যা, বুঝেই তীর্থস্থান শব্দটি প্রয়োগ করেছি, রবীন্দ্রনাথ ও লালনকে যেখানে এক সাথে পাওয়া যায়, তা বাঙ্গালির তীর্থস্থান নয়?

চমৎকার একটা পোস্ট, সীমান্ত! চলুক

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ পোস্ট পড়ার জন্য হাসি একদিন সময় করে চলে আসুন না। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন বা মৃত্যুদিন এ বা তার আগে পরে যাওয়া উচিৎ হবে না কারণ তখন বড্ড লোকজন আর মিডিয়ার ভীড় থাকে। অন্য সময় গেলে নিজের মত করে ঘুরে দেখতে পারবেন। কুষ্টিয়াকে অনেকেই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে থাকে। সেই অর্থে তীর্থ তো বটেই। কিন্তু সংস্কৃতির কতটুকু চর্চা যে ঐ শহরে টিকে রয়েছে সেটা ভাবলে খারাপ লাগে।

-সীমান্ত রায়

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লাগা জানিয়ে গেলাম।

রাজর্ষি

বন্দনা এর ছবি

খুবি যাবার ইচ্ছা ছিল, আপনি ইচ্ছেটাকে আর ও একটু উস্কে দিলেন।

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি

নদীর ছবি গুলো খুব সুন্দর হয়েছে।

এক লহমা এর ছবি

লেখা, ছবি সব-ই ভাল লাগল।
নদীর ছবি তিনটি খুব ভাল লেগেছে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

মাসুদ সজীব এর ছবি

ছবি এবং লেখা সবকিছুই দুর্দান্ত হয়েছে চলুক

আমিও যাবো যাবো করে এখনো যেতে পারিনি এই তীর্থ স্থানে। আশা করছি খুব শীঘ্রই যাচ্ছি কুষ্টিয়াতে। ভালোথাকুন হাসি

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক
নদীর পাড়েই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা তাই নদী দেখলেই বুকটা কেমন হুহু করে উঠে।

অভিমন্যু .
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার জন্ম নদীর পাড়ে নয়, কিন্তু তবুও নদী দেখলে মন কেমন করে ওঠে।

-সীমান্ত রায়

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

সেই ২০০০ সালে গড়াই পেরিয়ে যখন প্রথম কুঠিবাড়ি গেলাম তখন অন্যরকম এক অনুভূতি ঢেউ তুলেছিল শরীরে। সেই প্রথম এবং সেই শেষ। অনেক বার যাব যাব করেও আর যাওয়া হয়নি। সেই বকুলগাছটা কি আছে, রবীন্দ্রানাথের লাগানো বকুল গাছ, পুকুর পাড়ে? ওখানে ওই পুকুর ঘাটে বসে মনে হয়েছিল “গগণে গরজে মেঘ, ঘন বরষা”। আর সেই বিশাল শিশুগাছটা। এতবড় শিশুগাছ আমি আর কখনও দেখিনি।
আপনার বাড়ি ঝিনাইদহের কোথায়? আমার মহেশপুর উপজেলায়, একেবারে সীমান্তে।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

অতিথি লেখক এর ছবি

হ্যাঁ সেই বকুল গাছ এখনও আছে। ঐ পুকুরেই "পদ্মা" বোটটা রাখা আছে। শিশুগাছটার ব্যাপারে ঠিক নিশ্চিত নই। আর আমার বাড়ি মূল ঝিনাইদহ শহরেই।

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুণ। এই বছরেরই কোন এক সময় যাওয়ার পরিকল্পনা করেছি।

গোঁসাইবাবু

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

তিথীডোর এর ছবি

কুঠিবাড়িতে যাওয়ার শখ ছিল, হয়নি।

কয়েকটা ছবি চমৎকার লাগল। হাসি চলুক

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

চলে যান। এখনও কুঠিবাড়ি ও এর আশপাশের এলাকা বেশ মনোরম আছে। কতদিন থাকবে জানা নেই, তাই আগেভাগে দেখে আসাই ভাল।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক
এক দশক আগে গিয়েছিলাম, আবার মনে করিয়ে দিলেন ইয়ে, মানে...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

এই পোষ্টের মাধ্যমে সচলায়তনের সকল লেখক যাদের মাধ্যমে এতদূরে থেকেও নিজের দেশকে দেখার সুযোগ হচ্ছে তাদের সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাতে চাই।
আপনার লেখাটা অনেক ভালো লেগেছে চলুক

ফাহিমা দিলশাদ

অতিথি লেখক এর ছবি

ছবি, সে তো শুধু ছবি নয়, সে যে ইতিহাস! আপনার লেখা যেমন চিত্ররুপময়, ছবিগুলোও দুর্দান্ত। পড়ে খুব ভাল লাগল। এর পরে একবার সময় করে ওদিকে যাওয়ার ইচ্ছাটা চাঙা হয়ে উঠলো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।