মহা ত্রিকোণমিতিক জরিপঃবিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম অবিশ্বাস্য সাফল্যের গল্প

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২২/০৮/২০১৪ - ২:১৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে চলাকালে ১৮৭০ সালে করা ভারতবর্ষের একটি মানচিত্র

ভারতের মহা ত্রিকোণমিতিক জরিপ বা গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এখানে ভারত বলতে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের কথা বুঝাচ্ছি। এর ভিতর বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা রয়েছে। ব্রিটিশ শাসকরা বুঝতে পেরেছিল ভারতবর্ষের একটি মানচিত্র তৈরি করা অতীব জরুরী। এর কারণ অনাবিষ্কৃত জায়গাগুলো দখল করে সেখানে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা জরুরী। তাছাড়া এই বিশাল দেশকে পরিচালনা করতে হলেও এর ভৌগলিক অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা দরকার। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জরিপ বিভাগ তিনধরণের জরিপ চালায়।

প্রথম ধরণের জরিপ ছিল রেভেনিও সার্ভে। এতে সেই অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থা নিয়ে কাজ করা হয়। দ্বিতীয় ধরণের জরিপ ছিল টোপোগ্রাফিক্যাল সার্ভে। এতে সেই অঞ্চলের ভুঅবস্থা নিয়ে কাজ করা হয়। তৃতীয় ধরণের জরিপ ছিল ত্রিকোণমিতিক জরিপ।

এই ধরণের জরিপের চিন্তা মাথায় প্রথম আসে উইলিয়াম লাম্বটনের ১৭৯৯ সালে। তখনও ভারতের স্বাধীন জায়গাগুলো ব্রিটিশরা দখল করে নিচ্ছে। এই নতুন অধিকৃত জায়গাগুলোর ভৌগলিক অবস্থা জানতে এই জরিপের প্রস্তাবনা আসে। কেন্দ্রের কাছে লাম্বটন এই প্রস্তাব পেশ করেন এবং ১৮০২ সাল থেকে কাজ করা শুরু করেন। প্রথম দিকে নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। মেজর লাম্বটন প্রথমে মাদ্রাজের উত্তরে সেইন্ট থমাস পাহাড় থেকে দক্ষিণে পেরুমবাউক পাহাড় পর্যন্ত একটি ভূমিকে জরিপ চালাতে নির্ধারণ করেন। এই বেসলাইন ছিল সাড়ে সাত মাইল লম্বা। এই জরিপ শেষ হয় ১৮০৬ সালে। ১৮১৮ সালে তার এই জরিপের নাম হয় মহা ত্রিকোণমিতিক জরিপ বা গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে।

১৮০২ থেকে ১৮১৫ সাল পর্যন্ত লাম্বটন ভারতবর্ষের ১৮ ডিগ্রি অক্ষাংশ পর্যন্ত পরিমাপ করেন। গোয়া থেকে মাসুলিপত্তম, কেপ কমোরিন থেকে মহীশুর ছিল এর ভিতর। ১,৬৫,৩৪২ বর্গমাইল জায়গা ছিল এর ভিতর।

১৮২৩ সালে উইলিয়াম লাম্বটনের মৃত্যুর পর জর্জ এভারেস্ট এই জরিপের দায়িত্বে আসেন। তিনি বেদার বেস লাইন পরিমাপ করে বম্বে এবং কেপ কমোরিনের গ্রেট আর্ককে হিমালয়ের পাদদেশ অঞ্চলের সাথে যুক্ত করেন। এভারেস্ট এক্ষেত্রে নিজের আবিষ্কৃত কিছু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। এর ভিতর একটি ছিল সনাতন পদ্ধতিতে দিনের বেলা ফ্ল্যাগ টু ফ্ল্যাগ পরিমাপ করার বদলে রাতের বেলা ফ্লেয়ার ছুঁড়ে পরিমাপ করা।

এই সময় ব্রিটিশ মেজর জেনারেল থমাস ফ্রেডরিখ কোলবি পরিমাপের জন্য কোলবি কম্পেন্সেটিং বার নামক একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন। ১৮৩০ সালে এভারেস্ট দেরাদুনের কাছে একটি বেসলাইন পরিমাপ করার জন্য এই বার ব্যবহার করেন। ৩৯,১৮৩.৭৮৩ ফুট বেসলাইন তিনি নিখুঁতভাবে পরিমাপ করেন। এরপর তিনি দেরাদুন বেসলাইনকে ৪০০ মাইল দূরে মধ্যপ্রদেশের সিরঞ্জ বেসলাইনকে যুক্ত করেন।

বিস্তীর্ণ ভূমিতে ৫০ ফুট উঁচু টাওয়ার নির্মাণ করা হত। তার মাথায় থেওডোলাইট স্থাপন করে জরিপ চালানো হত। দিনের বেলা হেলিওট্রপ স্থাপন করে সূর্যালোককে পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের দিকে পাঠানো হত। যেদিন সূর্যালোক ছিল না সেদিন রাতের বেলা ফ্লেয়ার ছুঁড়ে বা এক বিশেষ ধরণের নীল আলো ব্যবহার করা হত। এই আলো ৫০ মাইল দূরে থেকেও দেখা যেত।

১৮৩০ এর দিকের দুর্গম ভারতে মালামাল পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হত হাতি এবং ঘোড়া। এমনকি রাজস্থানের দিকে উট ব্যবহার করা হত। ১৮৩৬ এর মের ভিতরে দেরাদুন এবং সিরঞ্জের মধ্যবর্তী অর্ধেক দূরত্ব পরিমাপ করা গেল। পরের ৭ মাসেই বাকি অর্ধেক কাজ শেষ হল।

১৮৪৩ সাল। ২৫ বছর ধরে এভারেস্ট গ্রেট আর্ক নিয়ে কাজ করছেন। সে বছরই তিনি গ্রেট আর্ক এর পরিমাপ শেষ করলেন।

এই প্রসঙ্গে রাজকীয় মহাকাশবিজ্ঞান সমিতির Sir John Herschel বলেন, 'The Great Meridianal Arc of India is a trophy of which any nation, or any government of the world would have reason to be proud, and will be one of the most enduring monuments of their power and enlightened regard for the progress of human knowledge."

এছাড়াও গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভের আরেকটি কাজ ছিল হিমালয়ের উচ্চতম
শৃঙ্গগুলোর উচ্চতা নির্ণয়। মাউন্ট এভারেস্ট, কে ২, কাঞ্চনজঙ্ঘা এইসব পর্বতের উচ্চতা নির্ণয় করা হয়। এইগুলো জরিপের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ।

গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভের সূত্রপাত হয়েছিল ১৮০২ সালের ১০ এপ্রিল মাদ্রাসের নিকটে একটি বেসলাইন পরিমাপের মধ্য দিয়ে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ধারণা ছিল এই জরিপের মেয়াদ থাকবে ৫ বছর। কিন্তু ব্রিটিশ ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাবসান ঘটে ১৮৫৭ সালে সিপাই বিদ্রোহের মাধ্যমে। তারপরও এই জরিপ অব্যাহত থাকে। এর কারণ ভারতের বিশালতা এবং ব্যাপকতা। জরিপকারীরা পুরো ভারতকে উত্তর থেকে দক্ষিণ এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিভিন্ন ত্রিভুজে বিভক্ত করে এগিয়ে যেতে থাকেন। একসময় তারা এই আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষের মানচিত্র তৈরি করতে সক্ষম হন। অবশেষে ১৯২১ সালে এই জরিপের অবসান ঘটে।

এই জরিপ চলার সময় জরিপের উপর কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। ঢাকা, রাঁচি আর দেহরিতে তিনটি সরকারী স্কুলে প্রতি বছর মোট ১১৬ জন শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়া হত জরিপের উপর।

আজকে জিপিএস আর আকাশ থেকে ছবি তুলে মানচিত্র বানানো হয়। এই কাজগুলোর বেশিরভাগই হয় ডেস্কে কম্পিউটারের সাহায্যে। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর এই জরিপকারীদের কাজ ছিল অনেক কঠিন। ভয়াল শ্বাপদসংকুল অঞ্চলেও তাদের কাজ করতে হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মহা ত্রিকোণমিতিক জরিপ বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি অবিশ্বাস্য অর্জন।

সূত্রঃ
১। History: The Great Trigonometrical Survey by Tim Middleton

২। SIR GEORGE EVEREST AND SURVEY OF INDIA by Mary M. Root

৩। Bluesci: Cambridge university science magazine, 29 January 2011,"History: The Great Trigonometrical Survey", Cambridge

৪। THE GREAT TRIGONOMETRICAL SURVEY OF INDIA. IN A HISTORICAL PERSPECTIVE. RAMA DEB ROY

৫। উইকিপিডিয়া

একাকী মানব

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

মরুদ্যান এর ছবি

চলুক বাপরে!

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

এক লহমা এর ছবি

চলুক
কত লোক যে কত ধৈর্য্য নিয়ে কত বড় বড় কাজ করে গেছেন, সে সবের সুফল আমরা আজ উপভোগ করি।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

শেহাব এর ছবি

এটাই কি আর এস খতিয়ান?

ধ্রুব আলম এর ছবি

মনে হয় না। এটা মনে হয় সি এস খতিয়ান। C.S.=cadastral survey

বন্দনা এর ছবি

১৮০২ থেক ১৯২১, মানে ১১৯ বছর ধরে এই জরিপ করা হয়েছে!!

দীনহিন এর ছবি

জরিপকর্ম এত সহজ নয়। অনেক গোলমেলে সব ব্যাপার-স্যাপার রয়েছে। তাছাড়া সময়টাও দেখতে হবে।

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

স্যালুট ঐ সব দু:সাহসী লোকদের।

____________________________

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

এই জরিপ চলার সময় জরিপের উপর কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। ঢাকা, রাঁচি আর দেহরিতে তিনটি সরকারী স্কুলে প্রতি বছর মোট ১১৬ জন শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়া হত জরিপের উপর।

এতগুলা লোক পরে কি করত? চিন্তিত

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

It was the year 1876 that the nucleus of the Buet was first formed with the establishment of a survey school named Dacca Survey School at a rented building at Nolgola [west of Salimullah Medical College] in the old part of Dhaka. The school, established by the then Government of Bengal of British India, initiated a survey course of two years duration with a view to producing men qualified to work as land surveyors.
The Survey School became Ahsanullah School of Engineering offering three-year diploma courses in Civil, Electrical and Mechanical Engineering. In recognition of the generous financial contributions from the then Nawab Khwaja Salimullah, it was named after his father Khawja Ahsanullah.
It moved to its present premises in 1912. In 1947, the School was upgraded to Ahsanullah Engineering College as a Faculty of Engineering under the Dhaka University, offering four-year bachelor's courses in Civil, Electrical, Mechanical, Chemical and Metallurgical Engineering. In 1948 the Government of East Pakistan gave recognition to the engineering college.
Hakim Ali was appointed the first Principal of the college. The then Vice-Chancellor of Dhaka University Mahmood Hasan was the first Vice-Chancellor.
In 1951 TH Mathewman was appointed principal and was succeeded in 1954 by MA Rashid. In 1956 a new course-curricula and the semester system were introduced at the Ahsanullah Engineering College. In 1957 the enrolment capacity for the bachelor's degree was increased from 120 to 240 and the diploma course was withdrawn from 1958.
In order to create facilities for postgraduate studies and research, the Ahsanullah Engineering College was upgraded and the East Pakistan University of Engineering and Technology established on 1st June 1962.
MA Rashid was appointed the first Vice Chancellor. After the independence of Bangladesh in 1971, it was renamed as the Bangladesh University of Engineering and Technology.
In the sessions 1962-1963, there enrolled 1022 students; three of them were female in two faculties and 10 departments. There were 89 teachers. At present the campus occupies 76.85 acres of land. The academic area is confined in and around the old campus occupying 30.24 acres of land.

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

ছায়াপথের পথচারী এর ছবি

কী বিরাট ব্যাপারস্যাপার! ত্রিভুজগুলো দেখে মনে হচ্ছিলো ব্রিটিশ ব্যাটারা ভারতবর্ষের উপর ফাইনাইট এলিমেন্ট স্ট্রেস এনালাইসিসের তালে ছিলোনা তো? ইয়ে, মানে... চিন্তিত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।