দুবাইয়ের পথে পথে - পর্ব ২

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ৩০/০৮/২০১৪ - ৩:৩৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দুবাইয়ের দুবাই হয়ে উঠার পিছনে যেটির সবচেয়ে বড় অবদান তা হলো দুবাই ক্রিক (খোর দুবাই)। আমাদের দেশের ছোট খাটো একটা খালের মতই হবে এর বিস্তৃতি - কিন্তু এই খাল বা খাড়ি তিল তিল করে গড়ে তুলেছে এই শহরকে। আরব সাগর থেকে বাঁক খেয়ে দুবাইতে ঢুকে প্রায় ১৫-২০ মাইলের মত এই ক্রিক বা খাড়িকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল দুবাইয়ের সব ব্যবসা - এখনো চলছে।

১৯ শতকের শেষের দিকে মাকতুম বংশ (দুবাইয়ের বর্তমান শাসক বংশ) দুবাই ক্রীকের পাশে স্থায়ী বসত গড়ে তোলে। এর আগে বাহরাইন থেকে ওমান উপকূল পর্যন্ত মাছ ধরা, মুক্তা আহরণ আর জলদস্যুতা করেই এদের দিন চলত। ২০ শতকের গোড়ার দিকে এরা ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সাথে একটি চুক্তি করে যার মাধ্যমে দুবাই একটি ব্রিটিশ আশ্রিত বন্দরে পরিনত হয় আর সেই থেকে এর বানিজ্যিক যাত্রা শুরু।


১. ১৯৫০ এর দশকে দুবাই ক্রিক - ডান দিকের অংশটি দেইরা দুবাই, আর বাম দিকে বুর দুবাই। (Building of a nation - বই থেকে নেয়া)


[i]২. এটা এখনকার দৃশ্য - ছোট ছোট এই ট্রলারগুলো মাল বোঝাই করে মধ্যপ্রাচ্যের ছোট ছোট বন্দরে যায়।


৩. মালবাহী ট্রলার চলছে দুবাই ক্রীকের বুকে। দুরে দেখা যাচ্ছে HSBC ব্যাঙ্ক যা ৭০ দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত দুবাইয়ের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক হিসাবে কাজ করত।

দুবাই ক্রীকের এক পাশে দেইরা দুবাই গড়ে উঠে প্রধান বানিজ্য কেন্দ্র হিসাবে। এখানে গড়ে উঠা সূক (Souk) বা বাজার এখনো দুবাইয়ের অন্যতম প্রধান বানিজ্য কেন্দ্র। কি-ই না পাওয়া যাই এখানে - শুকনা মসলা থেকে শুরু করে এরোপ্লেনের যন্ত্রাংশ পর্যন্ত পাবেন এখানে। এর পাশেই গড়ে উঠেছে বিশ্ব বিখ্যাত দুবাই গোল্ড সুক বা সোনার বাজার। প্রথম যেবার বোনকে নিয়ে গোল্ড সুকে গেলাম চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। প্রায় দুই কিলোমিটার ব্যাপী রাস্তাটা বড়ই বিপদজনক জায়গা - যদি আপনার সাথে নারী জাতির কোনো প্রতিনিধি থাকে আপনার পকেট একদম খালি হয়েই এই রাস্তা থেকে বের হবেন।

সোনার বাজার ছাড়াও এই এলাকার প্রধান ব্যবসা মসলা, খাদ্য সামগ্রী আর কার্পেটের ব্যবসা। চাকরিসুত্রে এখানকার দুএকজন ব্যবসায়ীর সাথে একটু আলাপ পরিচয় আছে। তাদেরই একজন মি. ভাটিয়া (পুরো নাম নাই বা বললাম) – দুবাইতে চার পুরুষ ধরে এখানে ব্যবসা করছেন চাল ডাল তেলের । মি. ভাটিয়ার দাদা এসেছিলেন ১৯৩০ এর দশকে।তখন ভারতের মুম্বাই বা করাচি থেকে মাল বোঝাই বড় বড় জাহাজগুলো দুবাই ক্রিকে এসে থামত - তারপর এখান থেকেই ছোট আবরা বা ধাউ বোঝাই করে আবু ধাবি, কাতার, বাহরাইন, ইরাক চলে যেত। ১৯৭০ দশকে যখন আল রশিদ বন্দর চালু হলে তখন থেকে বড় জাহাজগুলো আর এখানে ভিড়ে না - কিন্তু ছোট ছোট ধাউ করে জিনিসপত্র এখনো ছোট ছোট বন্দরগুলোতে চালান হয়। যদিও প্রধান ব্যবসা চলে ইরান এর সাথে।

এর মাঝে মি. ভাটিয়ার মত ব্যবসায়ীরা গড়ে নিয়েছেন নিজেদের ভাগ্য। এদের এক রুমের ছোট অফিস দেখে বোঝার উপায় নেই যে এরা লন্ডন বা নিউ ইয়র্কের প্রাইম লোকেশনে বিশাল বিশাল অট্টালিকার মালিক। অবশ্য এদের কথা বার্তাতেও কোনো অহংকার নেই - খুব সহজেই এরা এদের কর্মচারীদের সাথে মিশে যান। হয়ত এদের সফলতার এটাই প্রধান কারণ।

বন্দর সরে গেলেও মানুষজনের ভিড় কিন্তু সরে নি। যেকোনো কর্মদিবসে শত দেশের মানুষের দেখা মেলে এই এলাকায় - বিক্রেতারা অধিকাংশই ভারতীয় বা ইরানি, মাল টানা লোকগুলো পাঠান বা আফগান, আর ক্রেতারা আফ্রিকান, আরব, চিনে, আর কত দেশের লোক !


৪. দুবাই ক্রিকে ড্রাগন বোটের রেস, পিছনে মেরামতের অপেক্ষায় থাকা পুরানো ধাঁচের একটি প্রমোদ তরী


[i]৫. দুবাই ক্রিকে একদিন সূর্যোদয়


৬. দেইরা দুবাই আর বুর দুবাইয়ের মধ্যে যাতায়াতের প্রথম মাধ্যম ছিল আবরা বা ডিঙ্গি নৌকা। সময়ের বিবর্তনে হাতে টানা নৌকা এখন ইঞ্জিনচালিত, কিন্তু কম সময়ে ও কম খরচে এপার অপার করতে এখনো আবরাই ভরসা।

দুবাই ক্রীকের অপর পাড়ে গড়ে উঠে আবাসিক এলাকা যার নাম বার দুবাই বা বুর দুবাই। আগে দুবাইয়ের আদি বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি এখানেই ছিল - পরে পুরা এলাকাটা ভরে যায় ভারতীয় অভিবাসীদের দিয়ে। কোনো ভারতীয় উত্সবের দিন (যেমন দেওয়ালি বা পুন্গাল) বুর দুবাইতে পা ফেললে মনে হবে আপনি ভারতেরই কোনো শহরে আছেন - ইউরোপ আমেরিকার ভারতীয় অধ্যুষিত এলাকাগুলোতেও কি তাই হয়?

দুবাইয়ের ব্যবসা বানিজ্যে ভারতীয় প্রভাব সুস্পষ্ট - হবেই বা না কেন? ১৯ শতকের গোড়ার দিকে থেকেই যে ভারতীয়রা এখানে ব্যবসা করে আসছেন। ৭০ দশক পর্যন্ত এখানে ভারতীয় রুপি চলত।তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই এলাকা অবরুদ্ধ ছিল - চরম খাদ্যাভাবে পড়ে যায় এই এলাকা। তখন মুম্বাইয়ের মহারাজা অনেকগুলো জাহাজ ভরে খাদ্য সামগ্রী পাঠিয়ে দেন দুবাই আর আবু ধাবিতে। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তখন থেকেই সব ব্যবসার লাইসেন্স আর ডিক্রী ভারতীয়দের জন্য খুলে দেন এই অঞ্চলের শাসকরা। ৬০ এর দশকের শেষে তেল আবিষ্কার হলে, অর্থনীতি আর বানিজ্যের চাকা জোরে ঘুরতে শুরু করে আর সেসময় ব্যবসাটাও ভাগাভাগি করে নেয় ভারতীয় আর ইরানিরা।

এরই মাঝে এক স্বপ্নহারা একজনের কথা বলি - দেবাশিষদা। দেবাশিষদার সাথে আমার প্রথম দেখা দিল্লি এয়ারপোর্ট এ - ঢাকা যাওয়ার পথে। তখন আলাপ পরিচয়, জানলাম উনি দুবাইয়ের কোনো একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিতে হিসাবপত্র দেখেন। কলকাতায় ক্যান্সার আক্রান্ত মা, ছোট বোন্ আর দুটি ছোট সন্তানদের সাচ্ছন্দ্য দেয়ার জন্য পড়ে আছেন এই মরুর বুকে। মাত্র চার হাজার দিরহাম (১০০০ ডলার) এর চাকরি - যার অর্ধেকই চলে যাই থাকা খাওয়াতে। তবু তার মনে অনেক স্বপ্ন ছিল পাকা দালান করবেন, মায়ের চিকিত্সা করবেন - কিন্তু সেই স্বপ্নগুলো চুরমার হয়ে গেল অর্থনৈতিক মন্দায়।

মন্দায় দেবাশিষদার কোম্পানির লাল বাতি জ্বললো - সেই সাথে চাকরিটাও গেল। দুবাই তথা মধ্যপ্রাচ্যের ভিসার নিয়ম চাকরি ভিত্তিক, চাকরি আছে তো ভিসা আছে, চাকরি গেলে ৬০ দিনের মধ্যে ফিরে যেতে হবে। ইউরোপ বা আমেরিকার মত ভিসা ছাড়া থাকার বা চাকরি খোঁজার সুযোগ এখানে নেই। ফিরে গেলেন দেবাশিষ বর্মন - আরো অনেকের মত যারা অনেক কিছু বাজি রেখে এই কঠিন কঠোর প্রান্তরে এসেছিলেন স্বপ্নপূরণে। অর্থনৈতিক মন্দায় তাদের ফেলে দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তার দিকে। অনেক চেষ্টা করেছিলাম দেবাশিষদার জন্য একটা নতুন চাকরির - কিন্তু মন্দার বাজারে তা সম্ভব ছিল না।

দেবাশিষদার গুমরে উঠা কান্না, আর চাপা আর্তনাদ আজও আমার কানে বাজে - হয়ত সারাজীবনই বেজে যাবে এই ব্যর্থতার সুর।

মরুচারী


মন্তব্য

মরুদ্যান এর ছবি

শাসকদের উপাধিটা মনে হয় 'মাখতুম', মাকতুম নয়।

লেখা বেশ উপাদেয় হয়েছে। জায়গা গুলো যদিও আমার দেখা, কিন্তু মুম্বাইয়ের মহারাজার সাহায্য করার ব্যপারটা জানা ছিলনা।

লেখা চলুক চলুক

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনার উত্সাহের জন্য।

আর শাসকদের উপাধিটা "মাকতুম"-ই, আরবিতে কাফ দিয়ে লিখে مكتوم ।

মরুচারী

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

ভালো হচ্ছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ

মরুচারী

Sohel Lehos এর ছবি

গতবারের থেকে এবার আরো ভাল হয়েছে। ভাল লাগল। পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

পপ কর্ন নিয়া বসলেন? হাহাহা
ধন্যবাদ

মরুচারী

এক লহমা এর ছবি

লেখা স্বচ্ছন্দ। নানা অজানা কথা জানছি। ভাল লাগছে।
আদার ব্যাপারী আমরা জাহাজের খোঁজ নিতে ভালই ভালবাসি। অতএব লেখা চলুক হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

হেহেহে - আপনি দেখছি দাদা জাহাজের খবর বের করেই ছাড়বেন। আমি ছোট খাটো মানুষ (সাইজে না), বেশি খবর দেয়ার সামর্থ্য কিন্তু নাই, পরে আশাহত হবেন না কিন্তু হাসি

মরুচারী

ইনভার.ব্রাস এর ছবি

আগের পর্বের তূলনায় এবারকার পর্বটি বেশ ভালো হয়েছে। বেশ কিছু ঐতিহাসিক তথ্য জানলাম।

সিরিজ চালু থাকুক। চলুক

ইনভার.ব্রাস

অতিথি লেখক এর ছবি

চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে - ইনশাল্লাহ

মরুচারী

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

ছবিগুলো চোখ কেড়ে নিল! বিশেষ করে ৪,৫,৬।

লেখার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। পরের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ - লেখা ও ছবি ভালো লেগেছে জেনে উত্সাহিত হচ্ছি হাসি

মরুচারী

ধ্রুব আলম এর ছবি

প্রথম লেখাটা আপনিই লিখেছিলেন তো? খাইছে

অতিথি লেখক এর ছবি

গড়াগড়ি দিয়া হাসি ঐটা বেশ ভয়ে ভয়ে লিখেছিলাম, সংকোচ আর দ্বিধা নিয়ে

মরুচারী

ধ্রুব আলম এর ছবি

নতুন লেখা দেন, আর পারলে গাড়ী নিয়ে লিখুন, গাড়ির ইতিহাসসহ। খারাপ হবে না। ভিন্টেজ গাড়ি দেখার সৌভাগ্য তো আর সবার হয়ে ওঠে না।

অতিথি লেখক এর ছবি

অফিসের কাজের চাপে স্যান্ডুইচ অবস্থা
কত আইডিয়া মাথায় আসে - লিখা হয় না ..

মরুচারী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।