প্রথম পর্ব
- শি জিনপিং এর সাম্প্রতিক ভারত সফর স্পষ্টত মোদির জাপান সফরের কাউন্টার ব্যালেন্সিং। এটা ভাল সাইন যে এশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানরা লুক ইস্ট পলিসিতে গুরুত্ব দিচ্ছেন। এখানে যে বিষয় গুলান খেয়াল করা বাংলাদেশীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেইগুলা চিহ্নিত করা আবশ্যক।
- সফরে লাইন অব একচ্যুয়াল কন্ট্রোল সহ লাদাখ, অরুণাচল বা অন্যান্য সীমান্ত ও রাজনৈতিক সমস্যাবলী গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয় নি। এখানে অর্থনৈতিক বিষয়গুলাই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাইছে। বাংলাদেশ হলে এখানে অর্ধেক বিষয়ই থাকত ইতিহাস ও উন্নয়নের জোয়ার সংবলিত নানান ফিরিস্তি। অর্থনৈতিক কূটনীতিতে বাংলাদেশ এখনও পেশাদারিত্ব দেখাতে পারছে না।
- বিশাল জনসংখ্যার দুই বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ইন্ডিয়া ও চায়না। মোদি ইস্ট এশিয়া, প্যাসিফিক রিজিওনের বাজার, জাপানের সাথে ঘনিষ্টতা ইত্যাদি সব মিলিয়ে যুতসই দর কষাকষি করতে সক্ষম হয়েছেন। জিনপিং মোদির মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলেছে এই ঘোষনা দিয়ে যে আগামী ৫ বছরে চীন ইন্ডিয়াতে ১০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে। এটা মোদির জন্য এক চরম সফলতা। এটা গত মাসে ইন্ডিয়ার জন্য জাপান সরকারের ঘোষিত ৩৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের কাউন্টার ব্যালেন্স।
- স্বরণ করা যেতে পারে হাসিনার চীন-ভারত সম্পর্কিত কাউন্টার ব্যালেন্সের উদাহরণটি। হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মানের জন্য চীনের সমপরিমাণ অর্থ 'অনুদান' প্রত্যাখ্যান করে ভারতের বেসরকারী ব্যাংক থেকে চড়া সুদে ১০০ কোটি ডলার 'ঋণ' নিয়ে আসেন। অনুদানের বিপরীতে ঋণ দিয়ে দিল্লী বাংলাদেশের সাথে চীন প্রশ্নে কাউন্টার ব্যালেন্স করে। প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ফটোসেশন ও কিছু চড়া সুদের ঋণের বোঝা ছাড়া আমরা সেদিন আর কিছুই পেয়েছিলাম না। সেই ঋণ আবার ব্যয় হবার কথা ইন্ডিয়াকে করিডোর দেবার জন্যই।
- মোদি ও শি জিনপিং গত সপ্তাহে ২০ টির মত চুক্তি ও সমজোতা স্মারক সাইন করেছে। উল্লেখ্য এসবের বেশীরভাগই ছিল অর্থনৈতিক। এদের মধ্যে একটি হল গুজরাটে চীনা বিনিয়োগে শিল্পপার্ক স্থাপন। আরও জানানো হয় মহারাষ্ট্রেও এরকম পার্ক শীঘ্রই স্থাপন করা হবে। জিনপিং জানান চীন ইতিমধ্যে ইন্ডিয়াতে ২০০৪ থেকে ২০১২ নাগাদ ৪১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। অথচ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মনমোহন সিং ঢাকায় আসার পর আমরা দেখি ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বন্দী বিনিময়, সংস্কৃতি বিনিময় ইত্যাদি কিছু মাইনর চুক্তি সম্পাদিত হল। এবং যে তিস্তার চুক্তির জন্য বাংলাদেশীরা প্রতিক্ষা করছিল মনমোহন সেই চুক্তি উপহার না দিয়ে গোমড়া মুখে ঢাকা ত্যাগ করলেন।
- যাবার আগে শি জিনপিং বলেন চীন হচ্ছে ওয়ার্ল্ডস ফ্যাক্টরি আর ইন্ডিয়া হচ্ছে ওয়ার্ল্ডস ব্যাক অফিস। তিনি ভারতকে চীনা মালিকানায় প্রতিষ্ঠা হতে যাওয়া AIIB ব্যাংকে যোগ দিতে বলেন। এখানে উল্লেখ করতে চাই ভারত-চীন দর কষাকষির মাধ্যমে শ্রীলংকা ভারতের নাকের ডগায় বসে কিভাবে চীনের কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা আদায় করে নিয়েছে তা শিক্ষণীয় বটে। মোদির গত মাসের শ্রীলংকা সফর ছিল একটি বিশেষ ঘটনা। ইদানিং শ্রীলংকা দিল্লীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যারা জানেন না তাদের বলতে চাই দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আধুনিক সমুদ্রবন্দর শ্রীলংকার হামবানতোতা চীনেরই অবদান। শ্রীলংকা সরকার যে ইস্যুকে বিষফোড়া হিসেবে গণ্য করত সেই স্বরাজ প্রত্যাশী সুসংগঠিত মিলিশিয়া তামিল টাইগারদের পতনও মূলত চীনের সহায়তারই ফসল।
আশা রাখলাম বাংলাদেশ সরকার পররাষ্ট্রনীতিতে পরবর্তীতে প্রজ্ঞার ছাপ রাখবে এবং অর্থনৈতিক কূটনীতিক মডেল গ্রহণ করবে।
__________________________________________________________________________________________
দ্বিতীয় পর্ব
শি জিনপিং ভারত সফরে এসে ১০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পতিশ্রুতি দিয়ে গেলেন। এই বিপুলা বিনিয়োগ ভারত ইউনিয়নের পুঁজির বিকাশে বিশাল অবদান রাখবে। তিনি গুজরাটে একটি শিল্প পার্ক উদ্বোধন করে গেলেন গত সপ্তাহে। সরকারের নানাবিধ হটকারী নীতির জন্য চীন বাংলাদেশের সম্ভবনাময় অর্থনৈতিক কোলাবোরেশন বাধার সম্মুখীন হয়েছে।
- যাই হোক আবারও চীন 'ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন' প্রতিষ্ঠা করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে চট্টগ্রামে এক হাজার একর জমি চেয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ কোরিয়ার ইয়ংওয়ান করপোরেশনকে ইপিজেড নির্মানের জন্য আড়াই হাজার একর দিয়েছে। অন্যদিকে আনোয়ারায় কর্নফুলির দক্ষিণ দিকে জাপান ৫০০ একর জমি চাচ্ছে। প্রবৃদ্ধিতে এ যাবত কালের সকল অবদানই কার্যত মধ্যপ্রাচ্যে এবং দেশের শিল্প কারখানাসমূহে কর্মরত শ্রমিকদের। আশা করি লুটেরা সরকার কিছুটা হলেও এখন প্রবৃদ্ধি ও পুঁজির বিকাশে সরাসরি অবদান রাখবে।
- এর আগে সনি, নাইকি, স্যামসাং এর মত জায়ান্ট বিনিয়োগ কারীরা ফিরে গেছে। সরকার এদের জায়গা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ টাটার মত নন্দিগ্রাম দখল করতে হত না। বিসিক অঞ্চল গুলোতেই জমি পতিত পরে আছে অনেক। চীন থেকে কারখানা গুটিয়ে বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিল নাইকি, রিবক ও অ্যাডিডাস। চট্টগ্রাম বন্দরের আশেপাশে কেবল ৬৫ একর জমি চেয়েছিল, সরকার দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। অথচ বসুন্ধারা, যমুনা গ্রুপের ভূমি দস্যুতার সহযাত্রী হতে সরকার সমূহের অনাগ্রহ দেখা যায় নাই কখনো। এদিকে ৩৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানায় ১৭০০ একর খালি জমি পড়ে আছে এখনও।
- ত্রিশ বছর আগে ভিয়েতনাম বাংলাদেশের চেয়ে অনেক দুর্বল অর্থনীতির দেশ ছিল। ৭০ এর দশকে দু দেশীই একসাথে পোশাক শিল্পে প্রবেশ করে। ভিয়েতনাম ইতিমধ্যে ভারী শিল্পে প্রবেশ করে ফেলেছে অথচ বাংলাদেশের প্রধান শিল্প এখনও পোষাক শিল্প যা কার্যত উৎপাদন মুখী নয় বরং পরনির্ভরশীল। এদিকে ভিয়েতনামে অবস্থিত স্যামসাং এর যে সুবিশাল কারখানা রয়েছে সেখান থেকে তাদের দেশের বিরাট অংশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। পৃথিবীর এমন কোন দেশ নেই যেখানে সেই কারখানার মোবাইল রপ্তানি না হয়।
- পুঁজি নির্দিষ্ট সীমা নাগাদ বাড়ে। উদ্বৃত্ত হবার আর জায়গা না থাকলে তখন পুঁজি রপ্তানি হয়। পুঁজি মাঝে মাঝে শ্রমিক আমদানি করে আবার মাঝে মাঝে নিজেই রপ্তানি হয়ে সস্তা শ্রমিকদের দেশে যায়। যদি চীন ও ভারতের পুঁজির তুলনা করা যায় তবে বলতে হবে চীনের পুঁজি মাঝ বয়সী অর্থাৎ পরিপক্ক বা ম্যচিউর। আর যদি ভারতের পুঁজির কথা আসে তবে বলতে হবে ভারতের পুঁজি যৌবনে অর্থাৎ অপরিপক্ক, ভেরি আনপ্রফেশনাল। এই ধরণের ইমম্যাচিউর পুঁজির চরিত্র হয় আগ্রাসী। এরা উৎপাদন, বাজার, প্রতিযোগিতা ইত্যাদি হিসেব নিকেশ করে পরিশ্রম করার বদলে লুটপাট করে সহজে অর্থ বানাতে বেশি আগ্রহ দেখায়। তাই পৃথিবীর সস্তাতম শ্রমিকদের দেশ, ক্ষুধার্ত মানুষের দেশ বাংলাদেশে যখন এই দুই দেশের বিনিয়োগ আসবে তখন অনেক হিসেব নিকেশ করার বিষয় থাকে। কিন্তু লুটেরা দেশী এজেন্ট বা তথাকথিত সরকার বাহাদুর সবসময় জনগণের স্বার্থ বিকিয়ে নিজের সুখ ভোগের কথা চিন্তা করে।
সোয়াদ আহমেদ।
ভবঘুরে কথকথা । ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৪
মন্তব্য
কোনো তথ্যসূত্র নাই কেন?
তথ্যসুত্রঃ
দ্যা ডিপ্লোম্যাটঃ http://goo.gl/6EwkDZ
কালের কণ্ঠঃ http://goo.gl/RjBhNT
কালের কণ্ঠঃ http://goo.gl/wps5mB
সোয়াদ আহমেদ
তথ্যসূত্র এভাবে দেওয়া না দেওয়া সমান কথা। তথ্যের পাশে একটা ক্রমিক দিন, তারপর নিচে সে ক্রমিকের পাশে সূত্র দিন, তাহলে পাঠকের বুঝতে সুবিধা হবে।
আপনি একদিকে সরকারকে লুটেরা বলছেন, অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের জমিজমা বিদেশী বিনিয়োক্তার হাতে তুলে দিতে বলছেন। ঐটার সাথে লুটের পার্থক্যটা কোন কোন জায়গায়?
"আন্তর্জাতিক মানে" বোধহয়
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
আসলে আমি প্রফেশনাল লেখালেখিতে অভিজ্ঞ নই। পরবর্তি লেখাসমূহে রেফারেন্সিং এর ব্যাপারটা খেয়াল রাখব।
বিদেশী বিনিয়োগ একান্ত কাম্য বিষয়, পুঁজির বিকাশের স্বার্থে। তবে এক্ষেত্রে স্বদেশী পুঁজির বিকাশ প্রাধান্য পাবে, উৎপাদন মুখী সেক্টর প্রাধান্য পাবে, রপ্তানিমুখী সেক্টর প্রাধান্য পাবে। পাবলিক এন্টারপ্রেনারশিপ এখানে লস প্রজেক্ট হিসেবে পরে থাকে অন্যদিকে বেসরকারিকরণও কাম্য নয়। সরকারী কারখানা সমূহের আশেপাশে যেহেতু জায়গা পরে আছে সেহেতু এগুলোর সঠিক ব্যবহার করা উচিৎ। তাই বলে সরকারী কারখানা উঠিয়ে বিদেশী বিনিয়োগ কাম্যনয়। বলেছি যে, জায়গাটা আসলে প্রধান সমস্যা নয়, চাই সরকারের সদিচ্ছা।
ধন্যবাদ, হিমু ভাই।
সোয়াদ আহমেদ।
নতুন মন্তব্য করুন