বাস থেকে নেমেই ক্যাফেটেরিয়ার সামনে চলে এলো রাব্বি। প্রতিদিনের মতোই বসে পড়লো অডিটোরিয়ামের সামনের ঢালুমতো জায়গাটায়। একটা, দু’টো করে অন্য বাসগুলোও চলে আসছে … সকালের ক্লাস শুরু হতে এখনো মিনিট বিশেক বাকি। ব্যাগ কাঁধে ছাত্র-ছাত্রীরা হেঁটে যাচ্ছে – কেউ ক্লাসের দিকে, কেউ ক্যাফের দিকে, আবার ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে চলছে হালকা গল্প-গুজব।
মিরপুরের বাস থেকে নেমে ড্যাং ড্যাং করে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো প্রতনু।
“আমার লগে কইছে কথা! … কইছে কথা আমার লগে!” … খুশি খুশি মুখে বলে উঠলো প্রতনু।
“বাহ, ভালোই তো আগাইসোস তাইলে।” - বললো রাব্বি। … “তা কি কইলো?”
সে তো বিরাট কাহিনী দোস্ত! ... আমি বাস থিকা নামতে গেছিলাম, মিরপুরের বাসে কেমন ভীড় তা তো জানোস ... ধাম কইরা একটা গুঁতা লাইগা গেল!
তাই নাকি? তারপর?
তারপর ও আমারে কইলো – “এক্সকিউজ মী!”
তুই কি কইলি?
“সরি।”
এই? আর কোন কথা হয়নাই?
নাহ, আরে বুঝোসনা? তাইলে কি আর এত ভদ্রবেশে নাচি?
ও! ... তা খোঁজখবর লাগাইসোস?
হ, শাওনরে জিগাইসিলাম ... আমাদের জলজ্যান্ত নিউজ নেটওয়ার্ক!
কি কয় হালায়?
সিরাম কেসরে মামা! মেয়ে তো বেশিদিক হয়নাই আইসে ‘নতুন বাংলাদেশে’!
খাইছে! কোত্থেকে আসছে ও? কইসনা পৃথিবী থিকা! তোর চাপাবাজি তো দিনদিন বাড়তেই আছে!
প্রতনু হালকা কেশে নিয়ে বললো –
ইয়ে মানে পৃথিবীরই। তাও আবার ডাইরেক্ট ঢাকা থিকা আসছে। ওর ফ্যামিলি নাকি সেটল করসে এখানে। বাবা বিরাট ব্যবসায়ী – টাইটেনিয়াম মাইনিং এর ব্যবসা। এখানের বেশ কয়েকটা পাহাড় কিনে নিসে মাইনিং করার জন্য। আর মা নাকি আমাদের ও.আই.টি.রই প্রফেসর – এনভায়রনমেন্টাল এ।
বাহ ভালোই তো। পুরাই নাড়ির খবর বাইর কইরা আনসে দেখি শাওনে! তা ওর নাম কিরে?
মিরিন্ডা!
খাইছে!
হ, একটু আনকমন নাম। যাই হোক, চল ক্লাসের দিকে যাই। টাইম হয়ে আসছে প্রায়। পোলাপাইন তো তেমন দেখতেসিনা আজকে – মনে হয় সব ডাইরেক্ট ওইদিকেই গেসে।
হ, চল।
ক্লাস, সেশনাল সব আজকের মতো শেষ। সেশনালে একটু দেরি হয়ে যাওয়ায় বাস মিস করে ফেললো প্রতনু। কর্মচারি বাসও নাকি আজকে ছাড়বেনা ... মামা বললো, বাসের সোলার প্যানেলে কি নাকি সমস্যা। এদিকে দেখতে দেখতেই সন্ধ্যা নেমে এলো, আকাশের রঙ হালকা গোলাপি থেকে গাঢ় হতে হতে এখন প্রায় অন্ধকার। সেই কালচে পটভূমিতে একটা দু’টো করে ফুটতে শুরু করলো তারার দল ... হয়তোবা পৃথিবীও ... আর অর্ধেকটা ফোবোস।
এমন সময় ও ছায়ার মাঝে দেখতে পেল একটা নারীমূর্তি এগিয়ে যাচ্ছে লাইব্রেরির দিকে।
মিরিন্ডা!
আকাশ-পাতাল চিন্তা শুরু হয়ে গেল প্রতনুর। হাঁটতে হাঁটতে ক্যাফেতে ঢুকে কোণার দিকের একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। হাঁক ছাড়লো – “মামা! এক কাপ চা দিয়েন। চিনি বেশি।”
প্রতনুর দাদা পড়াশোনা করেছিলেন আমেরিকায় – পৃথিবীর আমেরিকায়। পি.এইচ.ডি. শেষ করে চাকরির জন্য হেন জায়গা নেই যেখানে আবেদন করেননি। থিসিস ডিফেন্সের মাস তিনেক পরেও যখন কোন গতি হচ্ছিলোনা, তখনই এলো একটা লোভনীয় প্রস্তাব। মঙ্গল গ্রহের মার্স ইউ. এস. এ. সেটলমেন্টের (পরবর্তীতে শুধু ‘মার্স ইউ. এস. এ.’ - সংক্ষেপে ‘মিউসা’) রিসার্চ সাইন্টিস্ট পদে একটা ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন মাসখানেক আগে – সেখান থেকে এসেছে চাকরির প্রস্তাব। বেতন খুবই ভালো, সমস্যা একটাই – থাকতে হবে সেই সুদূর মঙ্গল গ্রহে! যেখানে মানুষের যাতায়াত শুরু হয়েছে মাত্র বছর ত্রিশেক হবে। প্রথম দশকটা মূলত বিজ্ঞানী আর মহাকাশবিদদের দখলেই ছিলো মঙ্গল গ্রহ – কিন্তু মূল্যবান খনিজ সম্পদ আবিষ্কার হওয়ার সাথে সাথেই দলে দলে আগমণ ঘটতে লাগলো খনি ব্যবসায়ী আর খনি শ্রমিকদের। আর তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য বিভিন্ন পেশাজীবি মানুষের দল। ক্রমে গড়ে উঠলো স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বিপনিকেন্দ্র ... নাগরিক কোলাহলে মুখর হয়ে উঠলো একদা নিঃসঙ্গ, মরুসদৃশ মঙ্গল গ্রহ।
পৃথিবীর সাথে এখানের জনবসতির পার্থক্য হলো, মঙ্গলের আকাশ পৃথিবীর মতো খোলা নয়। এখানকার চরমভাবাপন্ন তাপমাত্রা আর রেডিয়েশান থেকে বাঁচার জন্য প্রতিটা বসতিগুচ্ছ আধখানা বুদবুদ আকৃতির কাচের আবরণে বাইরে থেকে আলাদা করা। আর এক গুচ্ছ থেকে অন্য গুচ্ছে যাওয়ার জন্য রয়েছে কাচে মোড়া টানেলের সারি, পাতালপথ আর পাতাল রেল। এখানে পৃথিবীর মতো উপর দিকে না বেড়ে বাড়িঘরের বৃদ্ধি মাটির তলার দিকেই বেশি। মঙ্গলে মানব বসতির মোটামুটি শুরু থেকেই পৃথিবীর দেশগুলো তাদের আলাদা আলাদা বসতি স্থাপন আরম্ভ করে। তারই ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে প্রথম দিকে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, জাপান, ভারত, ইউরোপের মার্স সেটেলমেন্ট আর কলোনি – পরবর্তীতে পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের।
‘নতুন বাংলাদেশ’ মঙ্গলের জনবসতির ইতিহাসের তুলনায় নতুন আবাসভূমি। তবে গত দুই দশকেই এর আয়তন ছাড়িয়ে গেছে শুরুর দিকের বেশিরভাগ কলোনিকে। মহাকাশ ভ্রমণের খরচ কমে আসা আর পৃথিবীতে বাংলাদেশের জনসংখ্যার বিষ্ফোরণকেই এর মূল কারণ হিসেবে দেখা হয়। সেই সাথে রয়েছে মোটা বেতনে চাকরির নিশ্চয়তা। আজকাল অবশ্য শিক্ষার মানও প্রধান একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে কারণেই নতুন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় অলিম্পাস ইনস্টিটিউট অভ টেকনোলজি (ও. আই. টি.) তে দেশি-বিদেশি এমনকি গ্রহান্তরেরও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বিচরণ।
“স্যার, আপনার চা!”
চিন্তার ঘোর কেটে গেলো প্রতনুর। সার্ভার রোবটের হাত থেকে চা নিতেই হঠাৎ মনে পড়লো – আগামীকাল ক্লাসটেস্ট! ভাবতে লাগলো ও – গেলোবারের মতো এবারও কি কল্লোলের খাতা দেখেই চালিয়ে দিবে? নাহ, সেটা করা মনে হয় ঠিক হবেনা ... আসলে পারাই যাবেনা। এই প্রফেসর ক্লাসে সিসিটিভি ব্যবহার করেন। গতবার মনিটরে সমস্যা থাকাতে দুই নম্বরী করার সুযোগটা পেয়েছিলো। এতদিনে সারিয়ে ফেলার কথা।
তবে এই কল্লোল ছেলেটা একটা জিনিয়াস। ও পড়াশোনা নিজে কতটুকু করে সেটা একটা রহস্য, তবে সবাইকে পড়া বুঝিয়ে দেয়ার বেলায় ওর জুড়ি মেলা ভার।
আচ্ছা! ... কিছুক্ষণ আগে কল্লোলও গেলোনা লাইব্রেরির দিকেই? মনে মনে হিসাব কষতে লাগলো প্রতনু ... ক্লাসটেস্ট ... মিরিন্ডা ... কল্লোল ... লাইব্রেরি।
সর্বনাশ!
চায়ের কাপে লম্বা করে একটা চুমুক দিয়ে উঠে পড়লো ও – লাইব্রেরির দিকে যাবে। এক্ষুনি!
মাস দুয়েক পর। বোটানিক্যাল গার্ডেনের আলোছায়া মাখা পথ ধরে পাশাপাশি হেঁটে চলেছে তরুণ-তরুণী। বাংলাদেশের রাজধানীর আদলে এখানকার বাগানটিও ‘মিরপুর’ বসতিগুচ্ছের পাশেই। দেশ থেকে যোজন যোজন দূরে এসেও শেকড়ের টান ভুলতে পারেনি মানুষ – বসতিগুচ্ছের নামকরণ করেছে পৃথিবীতে তাদের প্রিয় আবাসভূমির নামে। বাগানে যেমন রয়েছে লতা মোড়ানো প্রাচীন বট, তেমনি আছে পান্থপাদপের সারি। নাম না জানা কী এক ফুলের গন্ধে ভরে আছে বাগানের এপাশটা। পাশেই ছোট্ট সরোবরে সাদা শাপলা, ফুল আর পাতার ভীড়ে আনমনে সাঁতরে চলেছে গুটিকয়েক পাতিহাঁস।
“বুদবুদের বাইরেও যে এমন গাছপালা হতে পারে সেটা আমার বিশ্বাসই হতে চায়না!” – বলে উঠলো তরুণ।
তরুণী জবাব দিলো – “আর তো মাত্র দু’টো মাস, তোমার ফ্লাইট ল্যান্ড করার সময়ই দেখতে পাবে। … উমম, যদি দিনের বেলায় ল্যান্ড করো। আর এরপর তো আছেই।”
ভাবতেই পারছিনা যে কালকেই আমার ফ্লাইট! তা ফ্লাইটে থাকা অবস্থায় কিভাবে সময় কাটানো যায় বলতো? দুই মাস বেকুবের মতো বসে থাকবো?
আরে ব্যাপার না! আমি আসার সময় অনেক বইপত্র আর মুভি লোড করে নিয়ে এসেছি। সময় যে কিভাবে কেটে যায়!
তা নাহয় কাটলো, কিন্তু …
কিন্তু কী?
মিরিন্ডা, তোমাকেও যদি নিয়ে যেতে পারতাম!
আনমনে আকাশপানে তাকালো মিরিন্ডা। - “আমি তো যাওয়ার জন্য একপায়ে খাড়া! কতদিন গোলগাল থালার মতো চাঁদ দেখিনা! এখানকারগুলো তো আলুর মতো!”
হা হা হা হা! … শব্দ করে হেসে উঠলো তরুণ। চমকে উঠে ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে গেলো কাছেই বসে থাকা একটা দাঁড়কাক। ডেকে উঠলো কর্কশ স্বরে, যেন তরুণের হাসিকে বিদ্রুপ করলো – কা! কা!
দেখবে, দেখবে। আমরা দু’জনেই দেখবো – একসাথে, আর খোলা আকাশের নিচে! – বললো তরুণ।
মুচকি হাসলো মিরিন্ডা। … অত চিন্তার কিছু নেই, চলে আসছি আমিও – দুই বছরের মধ্যেই। ও. আই. টি.র ডিগ্রী নিয়ে কম লোকই পৃথিবীতে ফেরত যায়, চাকরি পাওয়া কোন ব্যাপারই হবেনা।
হুমম … আর আমার তো এই গোলাপি আকাশ আর মাটি ছেড়ে চার চারটা বছর পৃথিবীতে পড়ে থাকতে হবে – হ্যাঁ, কম করে হলেও চার বছর!
আমার নীল আকাশ দেখতে খুব ইচ্ছা হয়। … আচ্ছা, আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি কি এই জীবনে আর হবেনা? এখান থেকে পৃথিবী আর কতই বা দূর? যেতে দুই-দুইটা মাস লাগবে তাই বলে?
মিরিন্ডা, আমার তো মনে হয় ভাড়া তারচে’ বড় সমস্যা। যাওয়ার টিকেট কাটতেই ফতুর অবস্থা!
হুমম, সেটা ঠিক। ফ্লাইটের সময় নাহয় এটা সেটা করে কাটিয়ে দেয়া যায়।
আচ্ছা, পোর্ট অভ এন্ট্রিতে কেমন ঝামেলা করে?
মঙ্গলের এরা তো দেখি খুবই কড়া! আমি আসার সময়ই টের পেয়েছি। এই টেস্ট, সেই টেস্ট …
হ্যাঁ, শুনেছি এরা সন্ত্রাসী কার্যকলাপের চেয়ে রোগ-জীবাণু নিয়ে বেশি চিন্তিত। তাই অনেক ধরণের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে।
তা হবে। আমি শুনেছি পৃথিবীতে এর উলটো – ওদের চিন্তা সন্ত্রাস দমন নিয়ে।
যাব্বাবা! আমি অন্তত সন্ত্রাসী নই!
আবার মুচকি হাসলো মিরিন্ডা। … “অন্য রকমের সন্ত্রাসী!”
বাগানে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, কাছেই বাঁশঝাড়ে সভা বসিয়েছে চড়ুই পাখির দল। আলোছায়া মাখা মেঠোপথে বেড়ে চলেছে ছায়ার বিস্তার। এরই মাঝে হেঁটে চলে ওরা। সহসাই মিরিন্ডার কন্টাক্ট লেন্সের এক কোণায় সুক্ষ্ম সবুজ একটা আলো জ্বলে উঠেই নিভে যায়।
প্রতনুর টেক্সট মেসেজ!
“বিকেল পাঁচটা … ক্যাফেটেরিয়া।”
-ছায়াপথের পথচারী
[বি.দ্র. নিতান্তই একটি প্রাথমিক প্রচেষ্টা। পাঠপরবর্তী বিবমিষার জন্য সচল কর্তৃপক্ষ দায়ি নয়, সকল দায়বদ্ধতা লেখকের। উন্নতির উপায় বাতলে বাধিত করবেন আশা রাখি। - ছায়াপথের পথচারী]
মন্তব্য
বাহ, আরো লিখুন
[ ওআইসি আর আইইউটি প্যাঁচ লাইগা গ্যাছে মাথার ভিত্রে, নামও একখান দিছেন ]
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ধন্যবাদ! হাহা! আইইউটিতে বারবার কনসার্ট দেখতে যাওয়ার ফল হবে হয়তো।
অনেক ভালো লাগা।
ছবিটা অসাধারণ!
শুভকামনা জানবেন। অনিঃশেষ।
দীপংকর চন্দ
ধন্যবাদ!
সাইন্স ফিকশন পড়তে ভাল লাগে। তবে আপনার গল্পের প্লটের আগা মাথা কিছু ধরতে পারি নাই, তাই ভাল লাগেনি। লেখালেখি চলুক
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
ধন্যবাদ। নতুন লিখছি, আস্তে আস্তে লাইনে চলে আসবো আশা রাখি। ফিডব্যাক চলুক।
বুয়েটের মেকানিক্যালে ছিলেন নাকি? কোন ব্যাচ?
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
নতুন মন্তব্য করুন