দুইজন বাবা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ০৪/১০/২০১৪ - ৪:১৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৯৮৪ ইং সালে আমি ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে সুযোগ পেয়ে ভর্তি হই।
আমার জীবনকে সম্পুর্ণ ওলট-পালট করে দিয়ে চিন্তা-ভাবনার জগৎটাকে সহ আমি এক ভিন্ন যায়গায় এসে পড়লাম যেন। সবে ছয়টি ক্লাস পার করা বলতে গেলে এক শিশুই তো ছিলাম তখনো। সারাদিন ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ানো খুলনার চিরপরিচিত সেই মুক্ত পরিবেশ থেকে আমাকে নিয়ম-শৃংখলার এক আবদ্ধ ভূবনে পাঠানো হল। যেখানে সবাধীনভাবে শ্বাস নেবার মতোও অবকাশ ছিল না। আর 'সিনিয়র' নামের কিছু দানব সদৃশ দু'পেয়েদের নিষ্ঠুরতায় সেই পরাধীন জগতটি আরো ভয়ংকর হয়ে উঠল আমার কাছে।

শারীরিক এবং মানসিক টর্চারে আমার ঠাই হয়েছিল যশোহর সিএমএইচ (সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল) এর কমিশন্ড ব্লকে। আমার 'প্লুরাল ইফিউসন' হয়েছিল। অবস্থা খুবই সিরিয়াস আঁকার ধারণ করে। আমি কেমন একটা ঘোরের ভিতর থাকতাম। আজ অনেক বছর হয়ে গেলেও আবছা আবছা সে সময়গুলোকে এখনো মনে করতে পারি।

আমার আব্বা তখন খুলনা কাস্টমস হাউসে 'প্রিভেন্টিভ অফিসার' পদে কর্মরত। প্রতিদিন খুলনা থেকে অফিস করে তিনি আমাকে দেখতে আসতেন। আমার সাথে কিছু সময় কাটিয়ে আবার বাসায় চলে যেতেন পরবর্তি দিনে অফিস করার জন্য। আমার জ্ঞান ফিরলে আমি আমার আব্বাকে আমার পাশে বসা দেখতে পেতাম। তখন খুলনা থেকে যশোর এর রাস্তা ছিল খুবই খারাপ। আর আমার আব্বা একটি মটর বাইক চালাতেন। সারাদিনের ক্লান্তিকে ঝেড়ে ফেলে বিকেল ৫টার পরে সেই বাইকটি নিয়ে প্রতিদিন আমাকে দেখতে চলে আসতেন সিএমএইচে!! এভাবে প্রায় ৪ মাস ওনাকে আসতে হয়েছিল।

আজ আমি নিজেই সুন্দরী বাবু এবং জ্ঞানী বাবু'র পাপা!
আর আমার আব্বা থেকে অনেক দূরে রয়েছি... প্রায় ১৪ বছর ধরে।
বছরে ও একবার তাঁর সাথে দেখা হয় না। মোবাইলে কথা হয়। তবে এখন আর তিনি সেইভাবে আমাকে চিনতে পারেন না। আমাদের চারভাই এর নাম্বার তাঁর মোবাইলে সেভ করা রয়েছে। তারপরও অনেকক্ষণ কথা বলার পরে হঠাত বলে উঠেন, " কে তুই?"। আসলে আব্বা আব্বার মতই রয়ে গেছেন। আমিই পালটে গেছি। না হলে আমি কেন তাকে দেখতে যেতে পারি না?

আমার দুই মেয়েকে ছেড়ে সপ্তাহের ৫ দিন ঘন্টাখানেক দূরত্তের পথ থাকতে আমার কেমন কষ্ট হয় সেটা এখন অনুভব করছি। আর আমার আব্বা আমাকে ছেড়ে এতোগুলো বছর হৃদয়ে কি যাতনা ই না অনুভব করছেন!

১৯৮৪ ইং সালে একজন বাবা তাঁর শত ব্যস্ততার মাঝেও তাঁর সন্তানকে প্রতিদিন সময় দিয়েছিলেন। এরপর আরো অনেকগুলো বছর ও দিয়েছেন... যতদিন জীবিত থাকবেন দিয়ে যাবেন।
কিন্তু সেই সন্তান আজ বাবা হয়ে তাঁর জনকের জন্য কিছুই করছে না। এতটাই যান্ত্রিক জীবনে সে অভ্যস্ত যে হৃদয়টাও তাঁর যন্ত্রে পরিণত হয়েছে।
আসলে দুইজন বাবা লেখাটাই ভুল হয়েছে।
এখানে একজন ই বাবা!
দুই সন্তান এর জন্মনিবন্ধন কার্ডে আমার নাম লেখা থাকলেও আজো আমি বাবা হতে পারলাম না!!

# লেখকঃ আল মামুন খান


মন্তব্য

সত্যপীর এর ছবি

চমৎকার চলুক

..................................................................
#Banshibir.

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনার অনুভূতি রেখে যাবার জন্য।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার লেখাটা পড়ে মনটা খুব খারাপ হলো।
আমি যখন খুলনা থেকে ঢাকা আসলাম জীবিকার তাগিদে, আব্বা বলতো সন্তানদের না দেখে থাকা খুব কষ্টকর। যখন দেশের বাইরে এলাম, আব্বা বলতো আর কতদিন না দেখে থাকবো। আমি বলতাম, আমিতো দুনিয়াতেই আছি, এত চিন্তা কেন। আব্বা বলতো, আগে বাপ হও, তারপর বুঝবা। আব্বার সাথে দেখা হয়নাই ৬ বছর। আমি বাপ হলাম, বাচ্চা নিয়ে দেশে যাবো ডিসেম্বরে, কিন্তু অক্টোবরের শেষ দিনেই আব্বা হুট করেই মারা গেলেন। মেয়ের পাসপোর্টে ভিসা লাগবে নভেম্বরে, সুতরাং হুট করে যাওয়াও সম্ভব হলো না। ৬ বছর দেখতে না পারা, আর মারা যাওয়ার পরেও দেখতে না পারা- এই যে কষ্ট সেটা সারা জীবন থাকবে। বাপ হওয়ার পরে বুঝি, সারা দিন মেয়েকে না দেখলে মন ছটফট করে, আর বছরের পর বছর বাবা মা কি আমাকে না দেখে কেমন কষ্টে ছিল সেটা অনুভব করতে পারি, যদিও অনুভুতি কেমন যেন ভোঁতা হয়ে গিয়েছে। যে কষ্ট আমি দিয়েছি, আমার বাচ্চা হয়তো সেই কষ্ট আমাকে দিবে।

দেশ বন্ধু

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। আপনার জীবনে বাবাকে নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি জেনে আমার মর্মকে স্পর্শ করল। আমি কিছুটা সময় বেদনায় নীল হয়ে স্থানুর মত বসে রইলাম! আমরা সন্তানেরা নিজেদের জনককে চিনতে পারি বড্ড অবেলায়, তখন অনেকেরই চাইলেও কিছু করার থাকে না। তবে যখন ভোঁতা অনুভূতির ভিতরেও নিজেদের 'না পারার' ব্যর্থতা বুঝে আসে- অনুতাপের আগুনে কঠিন হৃদয় কোমল হয়, তখনই নিজ জনকের জন্য প্রানখোলা দোয়া করা উচিত। পৃথিবীর সব বাবারা যেন দু'পাড়েই ভালো থাকে, সবসময়।
ভালো থাকবেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

দুই সন্তান এর জন্মনিবন্ধন কার্ডে আমার নাম লেখা থাকলেও আজো আমি বাবা হতে পারলাম না!!

কঠিন উপলব্ধি!

শুভকামনা জানবেন। অনিঃশেষ। সবসময়।

দীপংকর চন্দ

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার মন্তব্যের জন্যও অনেক অনেক শুভকামনা রইলো।

অতিথি লেখক এর ছবি

লাইনটা গেথে গেল মাথায় ভাইয়া!
"দুই সন্তান এর জন্মনিবন্ধন কার্ডে আমার নাম লেখা থাকলেও আজো আমি বাবা হতে পারলাম না!! "

-অপদার্থ

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার লেখা পড়ে আমার ক্যাডেট কলেজের আটমাসের স্মৃতি মনে পড়ে গেল।

-অপদার্থ

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

মাসুদ সজীব এর ছবি

চলুক

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

নজমুল আলবাব এর ছবি

বাবাগুলো এমনই

অতিথি লেখক এর ছবি

সহমত আপনার সাথে। অনুভূতি রেখে যাবার জন্য ধন্যবাদ।

রংতুলি এর ছবি

মন খারাপ

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার অনুভূতি রেখে যাবার জন্য ধন্যবাদ।

হিমু এর ছবি

প্রিয় আল মামুন খান, আপনি অনুগ্রহ করে সচলায়তনের নীতিমালাটি একটু পড়ে দেখুন। নীড়পাতায় এক লেখকের একাধিক লেখা সচলায়তনে প্রকাশ করা হয় না। আপনার এই লেখাটি যখন নীড়পাতা থেকে সরে যাবে, তখন আবার আপনার দ্বিতীয় লেখাটি পোস্ট করুন। কোনো লেখা যদি পোস্ট করার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রকাশিত না হয়, ধরে নেবেন ওটি আর প্রকাশিত হবে না। সব লেখা একদিনে পোস্ট করবেন না, প্লিজ।

আপনার লেখার হাত ভালো, সচলায়তনে নিয়মিত লিখুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। আমি আসলে সব কিছু গুলিয়ে ফেলেছি। ব্লগে একে নতুন, তারপরে কিভাবে কি করব নীতিমালা পড়েও বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আপনার মন্তব্য আমাকে সঠিক পথের দিশা দিয়েছে, এজনয আরো একবার ধন্যবাদ আপনাকে।

রাজিব মোস্তাফিজ এর ছবি

মন খারাপ

----------------------------------------------------------------------------
একশজন খাঁটি মানুষ দিয়ে একটা দেশ পাল্টে দেয়া যায়।তাই কখনো বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা করতে হয় না--চেষ্টা করতে হয় খাঁটি হওয়ার!!

মরুদ্যান এর ছবি

১৪ বছরে একবারও যান নাই? অ্যাঁ

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।