আরব সাগরের উষ্ণ নীল্ জলে ঝড় ঝঞ্ঝার দেখা মিলে না খুব সহজে । এই সাগরে প্রাণঘাতী বা আগ্রাসী সামুদ্রিক প্রাণীরও দেখা মিলে না তেমন (কোনো হাঙ্গর বা অক্টোপাসের আক্রমনের খবর আসেনি কোনদিন)।দুই-এ মিলে শান্ত, উষ্ণ এই সমুদ্রে তাই নিরাপদ আশ্রয় গড়ে তুলেছিল নানা জাতের মাছ, কচ্ছপ, আর কোরাল। পশ্চিমে সোমালিয়া থেকে শুরু করে ইয়েমেন, ওমান, ইরান হয়ে ভারত পর্যন্ত এই বিশাল আরব সাগরীয় অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল এসব প্রাণীর এক নিরাপদ আবাস্থল।
কিন্তু ৬০এর দশকে আরব উপদ্বীপে তেল আবিস্কারের পর এই সমুদ্রে জাহাজ চলাচলের পরিমান গেল বেড়ে, এর পর নানা যুদ্ধ বিগ্রহে আর সমুদ্রের পানি দখল করে জমি উদ্ধার (land reclaim) এর কারনে ঐসব অবলার দল দেদারসে সাফ হতে লাগলো। কেউ যখন তাদের কথা মাথায় আনছে না, কেউ রক্ষা করতে এগিয়ে আসছে না, তখনি এইসব বিপদগ্রস্থ অবলা প্রানীদের ত্রাতা হয়ে আবির্ভূত হলো E M E G!!!
ভাবছেন ক্যাপ্টেন প্লানেটের মিডল ইস্ট ভার্সনের ভুমিকা দিচ্ছি? আমারও তাই মনে হচ্ছিল যখন লেকচারটা চলছিল। তবুও কষ্ট করে হজম করে যাচ্ছিলাম আমরা ১0 জনের একটা দল, কারণ EMEG যে আমাদের ঘুরাতে নিয়ে যাবে কচ্ছপের দ্বীপে !
EMEG হলো Emirates Marine Environment Group, আমার অফিস এদেরকে বছর বছর মোটা অঙ্কের টাকা দেয় সংযুক্ত আরব আমিরাতের আশেপাশে বেশ কিছু সামুদ্রিক অভয়ারণ্য বা আশ্রয়স্থল গড়ে তোলার জন্য।এবার আমরা যাব সরেজমিনে EMEGর কার্যক্রম দেখতে। আমাদের গন্তব্য শারজাহ উপকূল থেকে ৬৫ কিমি দুরের সির বু নায়ার দ্বীপ। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় থাকা প্রাকৃতিক এই দ্বীপে EMEG গড়ে তুলেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সবচেয়ে বড় কচ্ছপের আশ্রয়স্থল। জনমানব্ বর্জিত এই দ্বীপে একটি প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় আর একটি অপ্রাকৃতিক রানওয়ে ছাড়াও আছে শারজাহ পুলিশের একটি ক্যাম্প, আর সেনাবাহিনীর একটি রেডিও স্টেশন। দ্বীপটি ইরানের জলসীমার একদম গা ঘেষে বলে সামরিকভাবে বু নায়ার দ্বীপটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ - তাই সাধারণ মানুষের এই দ্বীপে প্রবেশাধিকার নেই।
সাধারণের প্রবেশাধিকার নিষেধ যেই দ্বীপে - এখানে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে আমাদের একটু "অসাধারণ" লাগছিল বই কি, তাই যাত্রা পূরবর্তী ব্রিফিং নিরবে কানের এ পাশ ও পাশ করে দিচ্ছিলাম। কোনো প্রকৃতিপ্রেমী পাঠক যদি কচ্ছপের জীবনযাপন বা পরিবেশ প্রতিবেশ নিয়ে কোনো তথ্য আশা করে লেখাটি পড়তে শুরু করেন, তাকে আশাহত করার জন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিলাম।
যাই হোক - নির্ধারিত দিন সকালবেলা আমরা অফিস প্রাঙ্গনে জমায়েত হলাম বাসের জন্য। বাস আমাদের নিয়ে চলল জেবেল আলী গলফ রিসর্টে - আমরা একটু দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়লাম। যাব কচ্ছপের দ্বীপে, আর আমাদের নিয়ে এলো গলফ খেলতে? এই খেলাটাত মাথায়ই ঢুকে না - খেলা তো পরের কথা! কিন্তু না - EMEG আমাদের জন্য ভালো আয়োজনই করেছে দেখি। বু নায়ার দ্বীপে যাওয়ার দুটো উপায়, জাহাজে করে অথবা সী প্লেনে করে। সী প্লেন এই রিসর্ট থেকেই ছাড়ে, পাশাপাশি আমাদের জন্য প্রাতরাশের ব্যবস্থাও এখানেই। মাশাল্লাহ বলে ঢুকে গেলাম ক্লাব হাউসের ডাইনিং রুমে।
নাস্তা খাওয়ার মাঝে আমাদের সাথে পরিচয় হলো EMEG-এর লজিস্টিক ডিরেক্টর জন উইলসন এর সাথে। জন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ডাইভার ছিলেন - এখন লজিস্টিক এর কাজ করছেন, বেশ চৌকস লোক । জন আমাদের জানালেন আমরা দুটি সী প্লেনে করে দ্বীপে পৌছাব। একটু বিশ্রাম ও আরেকটু লেকচারের পর আমরা দ্বীপের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখব, সৈকত পরিস্কার করব। সন্ধ্যা থেকে আমরা পালাক্রমে সৈকত টহল দিব যদি কোনো মা কচ্ছপ সৈকতে ডিম পাড়তে উঠে আসে তার খোজে। পরদিন সকালে আবার ফিরতি ফ্লাইটে দুবাই ফেরত।
ভরপেট খাবার পর আমাদের বহুজাতিক বাহিনী দুই দলে ভাগ হয়ে ব্যাগ বাক্সসহ ছোট খেলনার মত সী প্লেনে চেপে বসলাম। আমার মত আরো অনেকেই এই প্রথম সী প্লেনে চড়ছি - দারুন মজা পাচ্ছিলাম। শ্রীলংকার তৌফিক, ভারতীয় গীতা, পাকিস্তানি আলী, ফিলিপিনের লিনা আর বাংলাদেশী আমি। ঝটপট সেলফি আর আশেপাশের ল্যান্ডস্কেপ তোলায় সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমাদের প্লেন আরব সাগরের সবুজ পানি কেটে উড়াল দিল গন্ত্যবের দিকে। ছোট প্লেন - বেশ নিচু দিয়েই উড়ে যাচ্ছিল পাইলট। মাঝে মাঝে চোখে পড়ছিল মালবাহী জাহাজ, বা মাছ ধরা ট্রলার। পাইলটকে জিজ্ঞেস করলাম আমরা দুবাইয়ের উপকূল আর বিখ্যাত স্কাই লাইন চোখে পড়ছে না কেন? জবাবে পাইলট বললেন আমরা উপকূল ধরে না গিয়ে সোজা মাঝ সমুদ্রে চলে এসছি।
সী উইংস -এর এই প্লেনে করেই যাত্রা করেছিলাম
নিচু দিয়ে উড়ে যাবার সময় নির্মান স্থগিত পাম জেবেল আলীর একাংশ
২০ -১৫ মিনিট পরে আমাদের চোখে পড়ল প্রায় পানির ফোঁটার মত দেখতে একটা দ্বীপ - পোতাশ্রয়টাও চোখে পড়ল। একটু পর গোত্তা খেয়ে আমরা নেমে এলাম ছোট একটা এয়ার ফিল্ডে। ছেলেবেলায় তিন গোয়েন্দার একটা গল্পে পড়েছিলাম টিম গোয়েন্দা একটা ছোট বিমান নিয়ে ক্যারিবিয়ান অভিযানে বেরিয়েছিল - অকূল সমুদ্রের মাঝে এই দ্বীপে ছোট প্লেনে করে এসে আমারও সেরকমই লাগছিল। যাই হোক, একটা জীপে করে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন আমিরাতি পোশাক পড়া এক ভদ্রলোক। উনি EMEG-র প্রধান মেজর আলী আল সুয়ায়দী - আমাদের জন্য সব ব্যবস্থা করার জন্য নিজের ইয়ট নিয়ে আগেই চলে এসছেন। তবে আমাদের দেখে মনে হয় সবচেয়ে খুশি হযেছিল ওই দ্বীপে থাকা পুলিশ সদস্যরা - এই পান্ডব বর্জিত জায়গায় এত গুলো অতিথি পেয়ে তারা দারুন খুশি। পরে তাদের আতিথেয়তার নমুনা দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছিলাম।
সির বু নায়ার দ্বীপ - প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় গোল পুকুরের মত দেখতে
দ্বীপের সামনে দিয়ে চলে যাওয়া জাহাজের সারি
গোটা দ্বীপটাই চাঁদের পাহাড়ের মত একদম ন্যাড়া
এই নীল সমুদ্রের হাতছানি মনে হয় মানুষের উপেক্ষার অসাধ্য
পরের প্লেনে বাকি সবাই এসে পৌছালে আমরা বসলাম পুলিশ কম্পাউন্ডের মজলিস হলে। এটা একাধারে মিটিং রুম, ডাইনিং হল, টিভি রুম ও গেমস রুম হিসাবেও ব্যবহার হয়। মূল ভুখন্ড থেকে বিছিন্ন হলেও ২৪ ঘন্টা জেনারেটার চলে - মোবাইলের নেটওয়ার্ক আছে, প্রতি ঘরেই এসি, গরম জলের ব্যবস্থা, টিভি আর ডিশের কানেকশনও আছে। গেমস রুমে টেবিল টেনিস, পুল আর ফুসবলের ব্যবস্থা - বেশ একটা রিসোর্টএর মত ভাব আছে - কেবল সবুজের অভাব।
চা নাস্তার পাশাপাশি আমরা পরিচিত হতে লাগলাম মেজর আলী ও তার দলবলের সাথে। মেজর আলীর পরিবার বংশানুক্রমে ডুবুরি - মুক্তো তোলাই ছিল তাদের প্রধান ব্যবসা। মেজর আলী ও তার পরিবারের ছেলেরা এখনো শখের বশে মুক্তো তুলতে ডুব দেন। এমনিতে মেজর সাহেব ৩০ বছর নৌবাহিনীতে সেল্ভেজ ডাইভার ছিলেন - ব্যাপক তার অভিজ্ঞতা যার কিছু গল্প আমরা পরে শুনেছি। মেজর আলী জানালেন এই দ্বীপে সবসময় অন্তত EMEGর দুই জন লোক থাকে। এক সপ্তাহ অন্তর একজন করে ওশেনোগ্রাফার বা সমুদ্রবিজ্ঞানী ঘুরে যান। বড় কিছু ঘটলে প্লেন ভাড়া করে চলে আসেন বিজ্ঞানীর দল।
নাস্তা খাওয়ার পর আমরা জীপে করে বেড়িয়ে পড়লাম দ্বীপটা ঘুরে দেখতে। একদমই রুখা শুখা লাল মাটি, পাথরের ফাঁকে ফাঁকে কিছু ক্যাকটাস আর জংলি গাছ ছাড়া কিছু গজায় না। জন গাড়ি চালাতে চালাতে বলল এই লাল মাটিতে প্রচুর পরিমানে লোহাজাতীয় আকরিক আছে - কিন্তু শুদ্ধিকরনের খরচ অনেক বেশি হওয়াতে কেউ আর এগিয়ে আসে নি। এরি মাঝে পৌছে গেলাম সৈকতে - যেখানে বেশ কিছু কচ্ছপ ডিম পেড়ে গেছে। সমুদ্রের পানি এখানে অদ্ভুত রকমের নীল - অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলাম সুনীল দিগন্তের দিকে যেখানে নীল আকাশ আর নীল সাগর মিশেছে। নীলের এমন খেলা ক্যামেরার চোখে ধরা আমার কর্ম নয়।
সৈকতের ওই বাক্সের নিচে কচ্ছপের ডিম রাখা থাকে
নীল সমুদ্র আর আকাশের রঙের খেলা
ওই সুনীল সাগরের তীর ধরে তখন হেটে আসছেন স্বর্ণকেশী এক তরুণী - পাঠক আবার জেমস বন্ডের ড. নো সিনেমার উরসুলা আন্দ্রেসের সেই বিখ্যাত দৃশ্যের কথা মনে করবেন না। সেরকম কিছুই না - কালো ওয়েটসুটে মোড়া এই সুন্দরী EMEG-এর ওশেনোগ্রাফার তানিয়া হিলি। অস্ট্রেলিয়ান এই বিজ্ঞানী দুই বছর ধরে আছেন এদের সাথে - ছয়মাস পর বাড়ি ফিরে যাবেন জনকে বিয়ে করতে। এই খবর শুনে আমাদের ব্যাচেলর গোষ্ঠির বুকে একটু মোচড় দিলেও মানতেই হলো দু'জনকে মানিয়েছে বেশ। EMEG-তে কাজ করতে এসেই দুজনের পরিচয় - পরিণয়। সে গল্প আর কখনো।
সৈকত থেকে বেড়িয়ে আমরা চললাম পাহাড়ের দিকে। পাহাড়ের উপর মিলিটারী ক্যাম্প তাই ওদিকে যাওয়া যাবে না। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে হর্ন বিল সীগালের কলোনি, কোথাও দেখা যাচ্ছে সীগালের ডিম আবার কোথাও উড়তে না শেখা বাচ্চার দল। এই দ্বীপে এদের একমাত্র শত্রু হচ্ছে গুইসাপ গোত্রীয় গিরগিটি। গরমে ওগুলোর দেখা পাওয়া গেল না।
ওশেনোগ্রাফার তানিয়া আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন
মা গাংচিল
ও তার বাচ্চারা
অরিক্সের দল থেকে ছুটে আসা দুটি হরিণ
হঠাত বাঁক ঘুরতেই চোখে পড়ল এক পাল হরিণ। এই দূর সমুদ্র মাঝে অরিক্স কোথা থেকে এলো বুঝতে পারছিলাম না। জনকে জিজ্ঞাসা করতে জানালো এগুলো বাইরে থেকে এনে ছেড়ে দিয়েছে সরকার। দ্বীপে কিছু সবুজ বনায়নের চিন্তাও আছে এদের। সম্প্রতি জানতে পারলাম এই দ্বীপটিকে ঘিরে শারজাহ সরকার একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
ঘুরে ফিরে এলাম লাঞ্চ করতে। পুলিশ কুকের রান্না করা চিকেন বিরিয়ানি আর মাটন কোর্মা দিয়ে খাসা লাঞ্চ সারলাম। লাঞ্চের পর আমাদের কাজ ছিল সৈকত পরিস্কার করা। কিন্তু গরমের প্রচন্ডতায় তা বাতিল করা হলো - আমরা সৈকতের ধারে একটা উঁচু মঞ্চে নরম কার্পেটের উপর গা এলিয়ে দিলাম। পরিবেশন করা হলো খেজুর আর গোলাপের পাপড়ি দেয়া চা - খোদার কসম এমন সুস্বাদু চা এখন পর্যন্ত আমি দুবাইতে পাই নি। এরপর মেজর আলী খুলে দিলেন তার গল্পের ঝাঁপি। আগেই বলে নিচ্ছি এগুলো মেজর আলীর মুখ থেকে শোনা - ঐতিহাসিক সত্যতা যাচাই করি নি।
মুক্তোর জন্য পারস্য সাগর তথা আরব সাগরের সুনাম সেই ৭০০০ বছর আগে থেকেই চলে আসছে। হীরা যখন দুস্প্রাপ্য ছিল তখন আগুন রঙা বা গোলাপী মুক্তো ছিল রাজা বাদশাদের শান শওকতের প্রতিক।তখন আরব সাগরের কূলের সব গোত্রই মাছ ধরা আর মুক্তো আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করত। সবচেয়ে বেশি পরিমানে মুক্তো মিলত আজকের বাহরাইনের আশে পাশে। এখনো বাহরাইনের উপকূল প্রাকৃতিক মুক্তো আহরণের জন্য পৃথিবী বিখ্যাত।
আগুন রঙ্গা মুক্তো - মেজর সাহেবের বাবা এটি তুলেছিলেন
মেজর আলী বলে চললেন - গ্রীষ্মের সময় সব পুরুষেরা বেড়িয়ে যেত জাহাজে করে। এক একটি মুক্তো আহরণকারী জাহাজে ১৮ থেকে ২০ জন মত ক্রু থাকত যাদের মধ্যে ১০-১২ জন ডুবুরি আর সমসংখ্যক সাহায্যকারী।ডুবুরীরা মাথায় মসলিনের বা সিল্কের একটি পাতলা কাপড় মাথায় জড়িয়ে প্রায় ২০০ ফুট গভীরে চলে যেত (free diving), এই কাপড়টা ক্ষতিকর কোনো জেলিফিসের বিষ থেকে ডুবুরীর মুখটাকে বাঁচাত । পায়ে বাধা থাকত দড়ি যা নিয়ন্ত্রণ করত জাহাজে থাকা ডুবুরীর সাহায্যকারী। ডুবুরি আর এই সাহায্যকারীর মধ্যে সমঝোতাটা খুব পোক্ত হতে হত - কারণ ওই দড়ির সিগনালের মাধ্যমেই ডুবুরি জানান দিত কখন ডুবুরিকে টেনে তুলতে হবে। ডুবুরীর নাকে কচ্ছপের খোল দিয়ে তৈরী এক ধরনের ক্লিপ থাকত নি:শ্বাস কন্ট্রোলের জন্য, কানের ফুটো বন্ধ করত মম দিয়ে। কোমরে থাকত চামড়ার একটা থলে, ঝিনুক রাখার জন্য - আর থাকত একটা ছুরি কোনো বিপদ আপদ হলে বাঁচার জন্য।
এক একবারের ডুবে ২০-২৫টা ঝিনুক উঠত - সারাদিনের ঝিনুক জমিয়ে ডেকের উপর রাখা হত যাতে ঝিনুকগুলো রোদে শুকিয়ে মুখটা খুলে যায়। সারা রাত ডেকে থাকার পর সকাল বেলা ফজরের পর ক্যাপ্টেনের কঠোর নজরদারিতে খোলা হত ঝিনুক।সাধারণত প্রতি ১০০টা ঝিনুকের মধ্যে ৫-৬টাতে মুক্তো মিলত, অবশ্য ক্যাপ্টেনের আহরণের জায়গা চেনা আর ডুবুরীর দক্ষতার উপর নির্ভর করে সংখ্যাটা বেড়েও যেত। জাহাজের মুক্তো ভাগ করার পদ্ধতি নির্ভর করত জাহাজের পিছনে কে কতটা বিনিয়োগ করেছে তার উপর। জাহাজের মালিক ও ক্যাপ্টেন সবচেয়ে বড় হিস্যা পেত - এর পর ডুবুরি ও তার সাহায্যকারী, এর পর পেত বাকি মাঝি মাল্লার দল।
বিকেলে সমুদ্রের নীল জলে দাপাদাপি আর ফটো সেশন করে আমরা ফিরে চললাম পুলিশ ক্যাম্পে। হাতমুখ ধুয়ে আমরা যে যার মত পুল বা ফুসবল খেলতে খেলতে ডিনার কলের অপেক্ষা করতে লাগলাম। চমত্কার বারবিকিউ ডিনার সেরে আমরা দুই দল ভাগ হয়ে গেলাম সমুদ্রতট টহল দিতে। ভরা পূর্নিমার আলোতে পুরো দ্বীপ উদ্ভাসিত - কোনো ইলেকট্রিক বাতি নেই যে চাঁদের আলোতে বাগড়া দিবে।চাঁদের আলোয় ঢেউ ভাঙ্গা সমুদ্রের এই রূপ কোথাও দেখিনি।
গাড়ির হেড লাইট আর চাঁদের আলোয় আধিভৌতিক পরিবেশ - এই ছবি তুলতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল
এর মধ্যে খবর এলো আমাদের আরেকটা দল একটা কচ্ছপের দেখা পেয়েছে - আমরা দ্রুত পা চালিয়ে পৌছে গেলাম কচ্ছপ শিকার থুক্কু বাচানোর জায়গায়। গিয়ে দেখলাম একটা মাঝারি সাইজের একটা কচ্ছপকে চেপে ধরে আছে এমেগ এর ফিল্ড এজেন্টরা। তানিয়া আমাদের জানালেন আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা একটা একদম নতুন স্যাম্পল পেয়েছি। এই কচ্ছপটা আগে কোনো বিজ্ঞানী দলের নজরে পড়েনি - কারণ এটার গায়ে কোনো ট্যাগ নেই। কচ্ছপের খোলটা চিংড়ির খোসা বা মানুষের নখের মতই অনুভূতিহীন , আর এটা খসেও পরে না। তাই সারা পৃথিবীর সমুদ্রবিজ্ঞানিরা যখনি কোনো কচ্ছপের দেখা পান, তার খোলে বা নখে একটা ধাতব ট্যাগ পড়িয়ে দেন। ট্যাগে একটা নাম্বার থাকে যেটা ডাটাবেস এ সার্চ করলে ওই নাম্বারধারী কচ্ছপটি কবে কোথায় বিজ্ঞানীদের নজরে এসেছিল তা জানা যায়। সেই একই উদ্দেশ্যে এই কচ্ছপটাতেও ট্যাগ পরিয়ে দিলেন তানিয়া - তারপর ওটা গুট গুট করতে করতে সাগরে ফেরত গেল।
ট্যাগিং চলছে
এরপর আমরা ফিরে এলাম আমাদের ক্যাম্প হাউস এ। ছেলেদের জন্য একটা ভিলা আর মেয়েদের জন্য আরেকটা। কিন্তু রাতে আমাদের কারুরই ঘুম আসছিল না - বাইরের উঠোনে বসে সবাই মিলে রাজা উজির মারতে শুরু করলাম। সবাই বলে কেবল বাঙালি নাকি আড্ডা পাগল - কিন্তু আমাদের সেদিনের আড্ডায় ছিল ভারতীয়, শ্রীলংকান, লেবানিজ, পাকিস্তানি, ফিলিপিনো, ব্রিটিশ, আমিরাতি নারী পুরুষ, কেউই কিন্তু রাজা উজির মারতে কম গেল না।
এরই মাঝে ক্যাম্পের পুলিশ দল আমাদের জন্য নিয়ে এলো বিস্কিট আর কফি - এটা ওদের কেউ আনতে বলে নি, ওরা নিজেরাই নিয়ে এসেছিল। পুলিশগুলো ইংরেজি বলতে পারত না - আমাদের মধ্যে যারা আরবি ভাষী ছিল তাদের মাধ্যমে জানলাম এরা আমিরাতি পুলিশে কাজ করলেও এসেছে সুদান আর তিউনিশিয়া থেকে। লোকালয় থেকে দুরে, এই মৃত দ্বীপে পরে আছে এই আশায় যে একদিন তাদের আত্তীকরণ হবে আমিরাতি মূল স্রোতে- তারা পাবেন আরব আমিরাতের পাসপোর্ট। কারো কারো হয়ত ২০ বা ২৫ বছর লেগে যাবে। তবু তারা চেষ্টা চালিয়ে যাবে - এরকম আরো অনেকের সাথেই পরিচয় হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিদেশী কেউ পাসপোর্ট পায় না - ব্যতিক্রম হচ্ছে আরবি ভাষী কিছু দেশের মানুষ যারা এসব দেশে অনেক দিন ধরে থেকে কোনো শেখের হয়ে কাজ করছে বা সরকারী চাকরি নিয়ে আছে। এই প্রসঙ্গে পড়ে আরেকদিন লেখার ইচ্ছা আছে।
একটু পরে ভোরের এল ফুটে এলো - কথায় বলে ফজরের পর নাকি আল্লাহ বেহেস্তের জানালা খুলে দুনিয়াতে বেহেস্তি হাওয়া বইয়ে দেন। সেদিন ভোর বেলা আরব সাগরের খোলা হাওয়া গায়ে মেখে আমার অন্তত কথাটি সত্য মনে হযেছে। এমন প্রাণ জুড়ানো হাওয়া দেশের বাইরে খুব কমই পেয়েছি। ভোরের আবীর মেখে সূর্যটা যখন সাগরের মাঝ থেকে উঠে এলো, সে দৃশ্যের বর্ণনা করা আমার মত আদার ব্যাপারীর পক্ষে সম্ভব না। সে কাজটি বরং কোনো কবির জন্যই উঠানো থাক।
মরুচারী
মন্তব্য
সুন্দর সব ছবি এবং সেই সাথে লাগসই বর্ণনা। ভালো লাগলো
মরুচারী
সাবলীল উপস্থাপনা। একটানে পড়ে ফেললাম।
আচ্ছা মুক্তা আহরণের পর ঝিনুকগুলো কি বেঁচে থাকে?
ধন্যবাদ আপনাকে - ধৈর্য্য ধরে পড়ার জন্য
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আপনার প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই, অন্য কোনো পাঠক যদি জানান তবে বাধিত হব।
মরুচারী
বাহ চমৎকার! ছবি এবং বর্ণনা।
মরুচারী
দুএক জায়গায় বানান ভুল হয়েছে যেটা আমার নজর এড়িয়ে গেছে। কিন্তু সম্পাদনার কোনো লিংক তো পাচ্ছি না !!
মরুচারী
সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল
বাহ!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
মরুচারী
কচ্ছপ নিয়ে আরও জানার অপেক্ষায় থাকলাম
facebook
আমি কিন্তু আগেই বলে নিয়েছিলাম দাদা আমি কচ্ছপ সম্পর্কে কিছুই শিখিনি এই সফর থেকে।
মরুচারী
চমৎকার পোস্ট।
এহসান সাবির।
নতুন মন্তব্য করুন