মাঝে মাঝে যা শুনি, কিংবা যা পড়ি, তাতে মনে হয় কবি প্রজাতিটি বড়ই অদ্ভুত। ছোটবেলাতেও গুরুজনেরা হরহামেশাই কবিদের ব্যাপারে আমাদের সাবধান করে দিতেন। “বাড়ির উঠতি বয়সের ছেলেটা কিংবা মেয়েটা কবিতা লিখা শুরু করেছে”- খবরটা যেমন ভয়াবহ কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মত একটি পরিবারে আছড়ে পড়তে পারতো, তেমনি “কোন এক এলেবেলে কবির সাথে ডানপিটেটা ইদানিং ঘোরাঘুরি করছে”- এ খবরটাও “ইবোলা” আতঙ্কের তীব্রতায় আঘাত হানতে পারতো পরিবারটিতে; আর তার আনিবার্য ইফেক্ট—তৎক্ষণাৎ বেচারাকে কোয়ারেন্টাইন করে দেবার জন্য জোর তৎপরতা এবং অন্ধকার ভবিষ্যতের মূলোতপাটনের জন্য তুমুল ঝাড়ফুক আর নসিহত। তবে বিস্ময়ের সাথে এটাও দেখতাম যে কারণে অকারণে কোন এক বিখ্যাত কবিতার পংক্তি আউরিয়ে এসব হিপোক্রিট গুরুজনেরা আসর-আড্ডায় নিজেদের বিদগ্ধ-সংস্কৃতিবান হিসেবে উপস্থাপন করতেও পিছপা হতেন না! আসলে কবিদের সম্পর্কে এমন দ্বিমুখী চিন্তা ভাবনার যথেষ্ট অযুহাতও ছিল। এদের জীবন বৃত্তান্ত ঘাটাঘাটি করলে আমরা খুব সহজেই দেখতে পাই যে খুব কম কবিদের জীবনই সাদাসিধা-সুখী ছিল; প্রায়শই এদের পরিণতি ছিল ভয়াবহ ট্রাজিক। একে তো সবচাইতে সংবেদনশীল ইন্টেলেকচুয়াল হওয়ার সুবাদে সার্বক্ষণিক স্বাভাবিকতা-অস্বাভাবিকতার মনোস্তাত্বিক টানাপোড়েন, তার ওপর তো আছে জীবিকা নির্বাহের নিত্য তাগিদ; “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি” এক দারিদ্র-পীড়িত, বেচারা কবিরই শ্লেষ-জর্জরিত উপলব্ধি। কবিতা বেচে জীবন চালানো -আইডিয়াটা চিরকালই নিছক রোমান্টিকতা ছাড়া আর কিছুই না!
ঊনবিংশ শতাব্দীর এক কবির ইতিকথা পড়ে যারপরনাই চমৎকৃত হলাম সেদিন; একটি মেয়ের কাব্যিক স্বপ্নই আধুনিক প্রজন্মের একখানা অপরিহার্য দৈনন্দিন জিনিসের বুদ্ধি যুগিয়েছিল। বলা হয় যে ওর লেখা একটা যুগান্তকারী প্রবন্ধে (সাইন্টিফিক জার্নাল আর্টিক্যাল) প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছিল। সত্যিকার কম্পিউটারের জন্মেরও শত বর্ষ আগেকার কথা, ভাবা যায়!
[img][/img]
চিত্র-১ অ্যাডা লাভলেস বায়রন
মেয়েটার জন্ম ১৮১৫ সালে, ওর বাবার কেলেঙ্কারী আর খ্যাতি তখন লন্ডন সমাজের নিত্যদিনের মুখরোচক খোরাক। লর্ড বায়রনের একমাত্র সমাজ-স্বীকৃত সন্তান, মেয়েটির নাম অ্যাডা বায়রন। জগৎবিখ্যাত পিতৃদেবের কবিমনের অনেকটাই পেয়েছিল সে; যথারীতি সাথে জুটেছিল খামখেয়ালীপনা আর প্রচলিত আচার-বিচারের বিরুদ্ধ-স্রোতে গা ভাসানোর বাজে সব প্রবনতা। ভুক্তভোগী মা, অ্যানাবেলা, অ্যাডার মাথা থেকে সমস্ত কবিত্ত্ব মুছে ফেলার জন্যে ছিলেন বদ্ধ পরিকর। গণিত আর বিজ্ঞানের চাবুকে একমাত্র মেয়ের ভাবাবেগ পরিপূর্ণ হৃদয়টাকে কিভাবে বশে রাখা যায়, তাই ছিল অ্যানাবেলার সার্বক্ষণিক ধ্যান-জ্ঞান। বাপের কুকীর্তিতে ত্যাক্ত বিরক্ত অ্যাডাও এক পর্যায়ে “কবিতা তোমায় দিলেম ছুটি” বলেছিলো বটে, তবে যে জিনিসটি মানুষটির জেনেটিক কোডে, কোন এক উপরওয়ালার অমোঘ নির্দেশে, খোদাই করা আছে, তা কি কখোনো মুছে ফেলা সম্ভব? জেনেটিক কোড সম্পর্কে এহেন মন্তব্যে প্রগতিশীল, বিবর্তনবাদী পাঠককূল নির্ঘাত সাঙ্ঘাতিক বিরক্ত হল; এ ব্যাপারে পরবর্তী কোন লেখায় কিছু মজার কথা বলার ইচ্ছে আছে। যাইহোক, সত্যি বলতে কি, কবিতা আর অঙ্কের প্রতি যুগপৎ ভালবাসাই অ্যাডার চোখের সামনে উন্মোচন করে দিয়েছিল এক অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যের দ্বার, হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল অনাগত এক সম্ভাবনার শতাব্দী, দেখিয়েছিল এক “কম্পিউটিং মেশিনের” স্বপ্ন; যা এখনকার, অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীর, ধ্যান-জ্ঞান! অ্যাডার সময়টা যে এখনকার চাইতে খুব অন্যরকম ছিল, তা কিন্তু নয়। রোমান্টিক বিজ্ঞানের রমরমা দিনকাল চলছে তখন; উদ্ভাবনা আর আবিস্কারের নেশা ব্যাক্তিজীবনে সংক্রামিত রোগের মত ছড়িয়ে পড়ছিল দিনে দিনে। আজকের ডিজিটাল বিপ্লবের যুগে যেমন কম্পিউটার, মাইক্রোচিপ আর ইন্টারনেট আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে পুরোপুরি সংস্কার করে ফেলেছে; শিল্প বিপ্লবের সেই স্বর্ণ যুগে ঠিক তেমনি স্টীম ইঞ্জিন, যান্ত্রিক তাঁত (Mechanical Loom) এবং টেলিগ্রাফ মানব সভ্যতাকে হাজার পদক এগিয়ে দিয়েছিল। ঊনবিংশ আর একবিংশ, এ দুই শতাব্দীরই মূল মন্ত্র অনেকটা একই রকম- কল্পনা, ভালবাসা আর বুদ্ধির সম্মিলনে অভিনব প্রযুক্তির উদ্ভাবনা। এই দীক্ষাই অ্যাডাকে সৃষ্টি করতে শিখিয়েছিল অদ্ভুত এক “কাব্যিক বিজ্ঞান” (Poetical Science), যে জিনিসটিকে বিংশ শতাব্দীর এক কবি নাম দিয়েছিল “নান্দনিক মেশিন” (Machines with loving grace)।
অ্যাডা বায়রন যদিও তার সৃজনশীল আর বিদ্রোহী আত্মা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিল বাবার কাছ থেকে, কিন্তু প্রযুক্তির প্রতি ভালবাসার উৎস ছিল অন্যখানে। কবি বায়রন ছিলেন একজন “লাডাইট”(Luddite)। প্রযুক্তি মানুষের জীবিকা, সৃজনশীলতার জন্যে ভয়াবহ ক্ষতিকারক এবং যে কোন মূল্যে প্রযুক্তির প্রভাব থেকে মানব সভ্যতাকে রক্ষা করতে হবে- এ ধরনের মৌলবাদী প্রচারণার মাধ্যমে এই লাডাইটরা স্বস্তা জনপ্রিয়তা পেয়ে আসছে গত দুশ বছর ধরে। ১৮১২ সালে তরুণ বায়রন ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে যান্ত্রিক-তাঁত, পোশাক শিল্পীদের ধ্বংসের কারণ হবে। কল্পনার সাগরে পাল উড়িয়ে ভেসে বেড়ানো বায়রনের কাছে গণিত, বিজ্ঞান সবই ছিল অপ্রয়োজনীয় আবর্জনা। হবেই বা না কেন? কবিবর তখন ভিক্টোরিয়ান ইউরোপের শিল্প-সাহিত্যাঙ্গনে প্রবল বিক্রমে বেড়ে ওঠা রোমান্টিক বিপ্লবের অন্যতম পুরোধা; আর রোমান্টিক বিপ্লবের প্রধান যুদ্ধ ছিল শিল্প বিপ্লবের যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে। স্ত্রী অ্যানাবেলার অঙ্কপ্রীতি দেখে একসময় কৌতুক করে বলেছিলেন-“আমি জানি যে দুইয়ের সাথে দুই যোগ করলে চার হয়, তবে কোন যাদুকরী ক্ষমতার বলে আমি যদি দুইয়ের সাথে দুই যোগ করে পাঁচ বানিয়ে দিতে পারতেম তাহলে আমার আনন্দের কোন সীমাপরিসীমা থাকতো না”-এমনি অপছন্দ ছিল সংখ্যার যথার্থ্যতায়। “প্যারালিলোগ্রামের রাজকন্যা” নাম দিয়েছিলেন স্ত্রীকে, আদর করে। কিন্তু বিবাহিত জীবনে যখন বিষবাষ্প বইতে শুরু করল তখন সুর পরিবর্তন করে বললেন, “আমরা দুজনা যেন দুই সমান্তরাল রেখা, অসীম পর্যন্ত আঁকা; পাশাপাশি চলতে থাকবো অনন্তকাল, কিন্তু কখোনো মিলিত হব না”। বায়রনের বোহেমিয়ান জীবনযাপন, নিয়ন্ত্রণহীন নারী আসক্তি, ব্যাভিচার, খরুচে স্বভাব বিষিয়ে তুলেছিল আনাবেলার নিয়মপ্রিয় জীবন। তাই অ্যাডার জন্মও ওদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঠেকাতে পারে নি; সবকিছুর ল্যাঠা চুকিয়ে দিয়ে, লেডি বায়রন, মাত্র পাঁচ সপ্তাহের বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে পাড়ি জমালেন বাপের বাড়ি। জীবনে আর কখোনো দেখা হয়নি বাপের সাথে অ্যাডার।
“Is thy face like thy mother’s, my fair child!
Ada! Sole daughter of my house and of my heart?
When last I saw thy young blue eyes they smiled,
And then we parted.” (Childe Harold, canto3, Byron)
অ্যাডা যেন কোনভাবেই বাবার মত না হয় তার একটা পন্থা হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিল শক্ত গণিত শিক্ষা, “কবিসুলভ কল্পনা” নামের রোগ নিরাময়ের ওটাই যেন একমাত্র অব্যার্থ ওষুধ! মায়ের এত চেষ্টার পরেও পাগলামী পুরোপুরি দূর হয় নি জীবনের শুরুতে। কৈশোরেই এক বুড়ো শিক্ষকের সাথে পালাতে গিয়ে ধরা পরা, কারণে অকারণে মুড-মেজাজের ওঠানামা, হঠাত করেই সাইকোলজিকাল সমস্যা শুরু হওয়া, এসবই তার প্রমাণ। কিন্তু বায়রনিক আচরনের ক্ষান্ত দিয়ে বিজ্ঞান আর গণিত চিন্তায় নিজেকে সমর্পন করবার সিদ্ধান্ত নেয় একসময় ও, এর পেছনে কাজ করেছিল দুটো ঘটনা- কৈশোরোত্তীর্ন বেশ কিছুদিন দিন মার সাথে বৃটেনের সদ্য গজিয়ে ওঠা সবগুলো শিল্পকারখানা ঘুরে বেড়ানো, আর তখুনি পরিচয় হয় সে যুগের সমস্ত সুপারস্টার যন্ত্রপাতির সাথে; আর দ্বিতীয় ঘটনাটি চার্লস ব্যাবেজের (Charles Babbage) সাথে দেখা হওয়া।
অ্যাডা আমাদের যে কারো চাইতে অনেক ভাল গণিতবিদ হলেও, সে সময়ের সব ডাক সাইটে গণিতজ্ঞদের তুলনায় নিতান্তই সাধারন মানের ছিল। তাহলেও ওর অঙ্কের প্রতি ভালবাসা আর অস্বাভাবিক মুগ্ধতা, শিক্ষক ডি-মরগান, ম্যারি সমারভিলের মত প্রতিভাবান অঙ্কবিদদেরও অহরহ তাক লাগাতো। তার পথ ধরে ওর কবিমনটা যেন সর্বদা উশখুশ করত বেরিয়ে আসবার জন্য-“গণিত এমন একটা ভাষা যা দিয়ে বিশ্বব্রম্মান্ডের সমস্ত অপ্রকাশনীয় রহস্য প্রকাশ করা সম্ভব, এমন একটা মাধ্যম, রংতুলি; যা দিয়ে মানুষের তুচ্ছ, দুর্বল হৃদয় কপি করতে পারবে সৃষ্টিকর্তার সব মাস্টারপীস চালচিত্র”। এ ধরনের কথা দিয়েই ভরতি থাকতো মার কাছে লিখা চিঠিগুলো। “মা তুমি দেখ আমি কি হতে পারি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস-এভাবে যদি বিজ্ঞান আর অঙ্ক শিক্ষা চালিয়ে যেতে পারি তবে অচিরেই আমি হয়ে উঠবো একজন কবি; তবে বাবার মত না, এক ভিন্নধরনের পরিশীলিত কবি; কবিতা লিখব নতুন ভাষায়”। “কল্পনা” সম্পর্কে অন্যরকমের চিন্তাভাবনা ছিল ওর, ১৮৪১ সালে লেখা এক প্রবন্ধে ওর প্রশ্ন এবং উত্তর – “কল্পনা আসলে কি জিনিস? এটা পাঁচমিশেলী একটা ক্ষমতা। সত্যের অনুসন্ধিৎসা, বুদ্ধি আর আইডিয়ার নিত্য-নতুন, আর নিরন্তর প্রকারণ আর প্রয়াস। কল্পনা তার অভাবনীয় ক্ষমতায় চারপাশের অনাবিস্কৃত জগতে বার বার প্রবিষ্ট হয় অভুতপূর্ব তীব্রতা নিয়ে, সে জগতটা বিজ্ঞানের”।
অ্যাডার অন্যতম গুরু চার্লস ব্যাবেজ ছিলেন পলিম্যাথ (Polymath), সর্ববিদ্যা-বিশারদ। পদার্থবিদ্যা, তড়িৎকৌশল, গণিত, দর্শনশাস্ত্র, যন্ত্রকৌশল এমন কোন বিষয় নেই যাতে তিনি অবদান রাখার চেষ্টা করেননি। ওঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব – মেকানিক্যাল (ইলেক্ট্রনিক নয়) কম্পিউটারের জনক হিসেবে সর্বজন স্বীকৃতি। তরুন অ্যাডার সাথে ব্যাবেজের পরিচয় এক জলসা পার্টিতে। প্রতি বুধবার লন্ডন সমাজের সব রাঘব বোয়াল, জ্ঞানী-গুণীদের নিয়ে তিনি আয়োজন করতেন জমকালো গ্রান্ড পার্টি। নাচগান, ভুরিভোজন, মদ্যপান-এর কোন কমতি ছিল না, তবে তার সাথে সাথে চলত বিদগ্ধ সব আলোচনা; জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাদের টেলিস্কোপ তাক করে বসতেন আকাশের দিকে, গবেষকরা তদের বৈদুতিক আর মেকানিকাল কলকব্জার তেলেসমাতি কাজকারবার দেখাতেন; বুদ্ধিজীবিদের বুদ্ধিমত্তা আর ইন্দ্রিয়াসক্তদের ইন্দ্রিয়সেবার যেন মিলনমেলা ছিল এই জলসা। অ্যাডার অংশ নেয়া দিনে আয়োজিত হয়েছিল বিশেষ এক প্রদর্শনী-ব্যাবেজের নতুন এক আবিস্কার, ডিফারেন্স ইঞ্জিন(Difference Engine), মূল যন্ত্রের ছোটখাট এক মডেল। এই ছিল বিশ্বের প্রথম কম্পিউটিং মেশিন। পুরোটা ধাতব যন্ত্রাংশের সমন্বয়ে তৈরী যন্ত্রটি তখনকার বৈজ্ঞানিক সমাজে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। খাড়া খাড়া ধাতব সিলান্ডারে বসানো অসংখ্য সংখ্যার চাকতি দিয়ে, গিয়ার আর হাতল ঘুরিয়ে জটিল এক ডিফারেন্সিয়াল সমীকরণের সমাধান ছিল ওটার প্রাথমিক কাজ, আর তার জন্যে যে পলিনমিয়াল ফাঙ্কশনের টেবিল তৈরী করার দরকার তা এটি অনায়াসে করতে পারত। ব্যাপারটা কাগজে কলমে করা যতটা সহজ, একটা যন্ত্রের মাধ্যমে, বিশেষ করে ঊনবিংশ শতাব্দীতে মোটামুটি একখানা বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এতদিন এধরনের মেশিন বানাবার একটা প্রধান সমস্যা ছিল, তা হল ইকুইশন সমাধানের বিভিন্ন ধাপে বের করা সংখ্যার স্মৃতি ধরে রাখা পরবর্তি কোন ধাপে ব্যবহার করার জন্যে; যেটা করবার আভিনব মেকানিক্যাল উপায় বের করেছিলেন ব্যাবেজ সাহেব, কতগুলো সিলিন্ডার ছিল শুধু স্মৃতির (Memory)জন্যে। একটা যন্ত্রকে দিয়ে পুর্বপরিকল্পিত ক্রমিক অথবা ধারাবাহিক কাজ করানো হচ্ছে, যদিও তা কেবল সংখ্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, ব্যাপারটার সৌন্দর্যে অ্যাডা এতটাই মুগ্ধ হয়ে পরেছিল যে তৎক্ষণাৎ ও সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, ব্যাবেজের গবেষণায় যে ভাবে হোক ওকে ঢুকতে হবে।
[img][/img]
চিত্র ৩ - ডিফারেন্স ইঞ্জিনের মডেল
[img][/img]
চিত্র ৪ –ডিফারেন্স ইঞ্জিনের পরিপূর্ণ রূপ
অ্যাডার অবদান ব্যাবেজের ডিফারেন্স ইঞ্জিনের দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করনে। প্রথম আইডিয়াটার ব্যাপক সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ১৮৩৪ সালে ভদ্রলোক প্রস্তাব দিয়ে বসলেন নতুন এক যন্ত্রের, নাম দিলেন অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন (Analytical Engine)। শুধুমাত্র একটি সমস্যার সমাধান নয়, মেশিনটি হবে সর্বকর্মা (General Purpose),ব্যবহারকারির ইচ্ছে অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের ইকুয়েশন সমাধান করতে পারবে। মর্জি মাফিক, এক কাজ থেকে আরেক কাজে সুইচ করতে পারবে যে কোন সময়ে। এমনকি মেশিনটি নিজেই নিজের কাজের প্যাটার্ন পরিবর্তন করতে সক্ষম হবে বড় কোন সমাধানের মাঝামাঝি ধাপে। পরিবর্তনযোগ্য নির্দেশনা ঢোকানোর জন্য একধরনের পাঞ্চ কার্ড ব্যাবহারেরও প্রস্তাব করেন ব্যাবেজ (সেসময় যান্ত্রিক তাঁতে ডিজাইনের জন্যে পাঞ্চ কার্ডের প্রচলন ছিল, আর কে না জানে পঞ্চাশের দশকে পাঞ্চ কার্ডকেই বেছে নেয়া হয়েছিল আদি কম্পিউটারে তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসেবে)। ভদ্রলোকটির দেহ যে সময়ে ছিল মনটি যেন ছিল তারো একশ বছর ভবিষ্যতে!
অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিনের ব্যাপারে খুব কম মানুষই উৎসাহিত হল কারণ জিনিসটি ছিল কিছুটা তাত্ত্বিক, আর ব্রিটিশ সরকার ইতিমধ্যেই ব্যাবেজের প্রথম সংস্করণটি বানাতে এত টাকা ঢেলে ফেলেছিল যে এ বস্তুতে তাদের তরফ থেকে অর্থায়নের তেমন কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল না। তাই সাইন্টিফিক জার্নাল অথবা জনপ্রিয় প্রচারণাই ছিল এই আডিয়ার বাস্তবায়নের একমাত্র গতি। তবে ব্যাবেজ এই বিষয়ে অন্তত একজন গোঁড়া বিশ্বাসী পেয়েছিলেন, সে আমাদের আলোচিত কন্যাটি। চিঠির পর চিঠি লিখে গিয়েছিল অ্যাডা, যদি একটু হলেও ব্যাবেজের মন গলাতে পারা যায়। অ্যাডার প্রাথমিক উদ্দেশ্য-ব্যাবেজের অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন নির্মাণের অন্যতম সহকারী হওয়া। নানা ভাবে, কখোনো ইনিয়ে বিনিয়ে, কখোনো মারাত্মক ঔদ্ধত্ত ভরা ভাষার তুবড়িতে, কখোনো কাব্যিক মায়াজালে ভরা কথামালায় বোঝানোর চেষ্টা করতো একাজের জন্যে তার মত যোগ্য পৃথিবীতে আর কেউ নেই। অবশেষে একটি সুবর্ণসুযোগ মিলে যায় মেয়েটির।
অ্যাডার পাদটীকা (Notes)-
১৮৪২ সালের অক্টোবর মাসে তুরিন শহরে ইতালীয় বিজ্ঞানী কংগ্রেসের একটা সম্মেলনে নিমন্ত্রণ পান ব্যাবেজ সাহেব। অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন নির্মাণে অর্থায়নের আশায় রাজি হয়ে যান সেখানে একটা বক্তৃতা দিতে। ঠিক হয় ক্যাপ্টেন লুইজি মেনাব্রেয়া (তখন একজন তরুণ মিলিটারী ইঞ্জিনিয়ার, পরবর্তীতে ইতালীর প্রধান মন্ত্রী), ব্যাবেজের সাহায্যে, ফরাসী ভাষায় মেশিনটির বিস্তারিত টেকনিকাল বিবরণ দিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখবেন সম্মেলনে পাঠ করার জন্য। তখুনি এক বিজ্ঞানী বন্ধু অ্যাডাকে পরামর্শ দেয় মেনাব্রেয়ার প্রবন্ধের ইংরেজী অনুবাদ করে দিতে যেন তা সাইন্টিফিক মেমোয়ার (Scientific Memoir) নামে একটা জার্নালে পেপার হিসেবে ছাপা যায়। অ্যাডা তার সমস্ত মন-প্রাণ ঢেলে কাজটা করে ফেলে, তারপর পাঠিয়ে দেয় ব্যাবেজের কাছে। ব্যাবেজ একাধারে মুগ্ধ, একাধারে কিছুটা অবাক হয়ে ওকে লিখলেন-“আমি বুঝতে পারছি না যেখানে তুমি এ বিষয়ে এত পারদর্শী হয়েও কেন মৌলিক প্রবন্ধ না লিখে অনুবাদে হাত দিতে গেলে”। উত্তরে অ্যাডা জানালো যে চিন্তাটা ওর মাথায় একদমই আসে নি কারণ সেযুগে মহিলাদের মৌলিক সাইন্টিফিক পেপার প্রকাশ করার তেমন কোন দৃষ্টান্ত দেখা যায় না। পুরুষ প্রজাতির ভয়ংকর দাপটে ভরা সমাজে এটা খুব একটা অচিন্তিতপূর্ব ঘটনা ছিল না।
যাইহোক ব্যাবেজ পরামর্শ দিলেন প্রবন্ধে মেনাব্রেয়ার মূল লেখনীর অনুবাদের সাথে ওর কিছু নিজস্ব মতামত জোড়া লাগাতে। গুরুর আশীর্বাদ পেয়ে মহা উৎসাহে অ্যাডা শুরু করে দেয় “অনুবাদকের নোটস” নামে একটা নতুন অধ্যায় লেখার কাজ, যে অধ্যায় বিংশ শতাব্দীতে মানব সভ্যতার আরেকটি নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত করেছিল, প্রেরণা জুগিয়েছে অনেক প্রযুক্তি পাইওনিয়ারদের। মজার ব্যাপার যে ওর এই চ্যাপ্টারের আকৃতি হয় মূল প্রবন্ধের প্রায় দ্বিগুণ পরিমান, মোট শব্দসংখ্যা ১৯,১৩৬!
অ্যাডার নোটের চারটি উপাদান চির বিস্ময়ের কারণ হয়ে থাকবে। নোট-“এ(A)” তে উল্লিখিত সর্বকর্মা মেশিন (General Purpose Machine) হিসেবে এ যন্ত্রের পরিচিতিতে জোর দেয়াকে বলা যেতে পারে প্রথম উপাদান। উদাহরণ দিতে গিয়ে অ্যাডা লিখেছিল, “ডিফারেন্স ইঞ্জিন বানানো হয়েছিল যুদ্ধ জাহাজের নটিকাল টেবিল গণনার জন্যে, ∆^7 u_x=0 ফাঙ্কশনের ইন্টিগ্রাল সমাধানের মাধ্যমে। কিন্তু অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন শুধু একটি সমস্যার সমাধানে সীমাবদ্ধ থাকবে না, যে কোন ধরনের গাণিতিক সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে বেগ পেতে হবে না এটিকে”। নানা ধরনের সমস্যা কিভাবে যন্ত্রটিতে ঢোকানো যায় তার উপায় হিসেবে জ্যাকার্ডের যান্ত্রিক তাঁতে ব্যাবহৃত পাঞ্চ কার্ডের কথা উল্লেখ করে সে, যেটা দিয়ে জটিল সব ব্রোকেড ডিজাইনের চল ইতিমধ্যেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কম্পিউটার এবং মনুষ্যজগতের যোগাযোগ মাধ্যমের এহেন উপায়ের গুরুত্ব ব্যাবেজের চাইতেও অনেক বেশি বুঝতে পেরেছিল অ্যাডা। এই নোটটিতে লেখা-“জ্যাকার্ডের যান্ত্রিক তাঁত যেভাবে ফুলের সৌন্দর্য্য, পাতার সৌন্দর্য্য নিখুঁত ভাবে বুনন করে যেতে পারে, তেমনি আমাদের এই অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন সীমাহীন ভাবে বুনে চলতে পারবে গাণিতিক প্যাটার্ন, অ্যালজেব্রাইক ধাঁচ”- এ কি রসকষহীন কোন গণিতবিদের উক্তি, না কি ভাবের সাগরে হাবুডুবু খাওয়া কবিকথন?
নোট-“এ” থেকে বেরিয়ে এসেছিল আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কন্সেপ্ট। ওর লেখার কাছাকাছি বাংলা তর্জমা- “শুধু সংখ্যা নয়, যে কোন ধরনের প্রতীক (symbol) নিয়ে কাজ করা সম্ভব এই মেশিন দিয়ে। শব্দ, লজিক, সঙ্গীত; প্রচলিত যা কিছুতে প্রতীক ব্যাবহার করা হয় তা সব নিয়েই কাজ (operation), সৃজনশীল পরিবর্ধন (manipulate), ভান্ডারীকরণ (Store) করতে পারবে এই সর্বকর্মা যন্ত্র। দুটো প্রতীকি জিনিসের একে অপরের সাথে সম্পর্কের পরিবর্তন আর পরিবর্ধনের লক্ষ্যেই যন্ত্রটি কাজ বা অপারেশন করবে”। অ্যাডার “কাব্যিক বিজ্ঞানের” চরম বহিঃপ্রকাশ ওর লেখনীতে – “অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিনের প্রতীকি জিনিসের উপর কাজ করবার উদাহরণ হতে পারে গানের স্বরলিপি, বা মিউজিকাল নোটেশন নিয়ে নাড়াচাড়া। শব্দবিজ্ঞানের বিশেষ একটা গবেষণার বিষয়বস্তু সঙ্গীতের বিভিন্ন তান বা মিউজিকাল নোটের পারস্পরিক সম্পর্ক; আমার ধারনা যন্ত্রটির পক্ষে এসব তানের উপর গাণিতিক সমীকরণের সহায়তায় কাজ করে জটিল সব গান, বাজনা আর মিউজিকাল কম্পোজিশন লিখে ফেলা অসম্ভব কিছু হবে না”। কল্পনাপ্রবণতা আর যুক্তিবাদী মনের কি অপূর্ব সমন্বয়! একথা মনে হয় কারো জানতে বাকি নেই যে অ্যাডার এসব স্বপ্ন হাল আমলের কম্পিউটারের কাছে নস্যিসম। ওর বাবা, কবি বায়রন যদি তখন বেঁচে থাকতেন এবং মেয়ের যন্ত্রকে দিয়ে এমন বিশদ সঙ্গীত বানানোর দুরভিসন্ধির কথা শুনতেন, তবে তৎক্ষণাৎ অক্কা পেতেন!
অ্যাডার তৃতীয় অবদান, লিখা ছিল “নোট-জি(G)”-তে; ধাপের পর ধাপ, নিখুঁত ভাবে বর্ণনা করা কিছু যান্ত্রিক অপারেশনের নির্দেশনা, যাকে কিনা আধুনিক কম্পিউটারের জগতে বলা হয় প্রোগ্রাম বা অ্যাল্গোরিদম (Algorithm), চিত্র-৫। প্রোগ্রামটার প্রয়োগের উদাহরণ স্বরূপ বেছে নিয়েছিলেন “বার্ণোলীর সংখ্যামালা” (Bernoulli’s Series) তৈরী, নাম্বার থিউরীর অপরিহার্য এক বিষয়বস্তু। অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন কিভাবে এই সংখ্যামালা বানাতে পারে তা দেখাতে গিয়ে অ্যাডা কিছু ক্রমিক বা পারম্পরিক যান্ত্রিক কার্যক্রমের বিশদ বর্ণনা দেয়, তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সাবরুটিনের(Subroutine) অভিনব ব্যাবহার। যে কোন কম্পিউটার বিজ্ঞানীর কাছে সাবরুটিন বহুল পরিচিত একটা ব্যাপার (কতগুলো কাজ যদি প্রোগ্রামে কিছু সময় পর পর পুনরাবৃত্তি করতে হয়, তবে এগুলোর সমন্বিত রূপকে বলে সাবরুটিন)। ৭৫ টি পাঞ্চ কার্ড ভর্তি নির্দেশনা ব্যাবহারের প্রস্তাব করেছিল অ্যাডা বার্ণোলীর সংখ্যামালার একেকটি সংখ্যা উৎপাদনের জন্যে এবং একই কার্ড আর পূর্ববর্তী ফলাফল দিয়ে বের করে ফেলা যাবে একের পর এক সংখ্যা, অসীম পর্যন্ত।
ব্যাবেজ অ্যাডাকে এই সংখ্যামালা সমাধানের পদ্ধতি বের করতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু একেবারে মৌলিক কিছু উপাদান অ্যাডা জুড়ে দিয়েছিল “নোট-জি”-এর শেষে; একটা চিত্র আর একটা টেবিল যাতে সুন্দর ভাবে দেখানো হয়েছিল কিভাবে কম্পিউটারে ঢোকাতে হবে এই অ্যাল্গোরিদম; ওতে ছিল দুটো সাবরুটিন বা পুনরাবৃত্তিক চক্র, বিভিন্ন ধাপে বের করা ফলাফল জমা করে রাখবার জন্য স্মৃতি বা রেজিষ্টার, কাজ বা অপারেশন্স এবং মন্তব্য বা কমেন্টারী- একটা C++ প্রোগ্রাম-এ যা থাকে তা থেকে তেমন কোন পার্থক্য নেই। মুলতঃ এই চিত্র বা ডায়াগ্রাম-ই অ্যাডাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার বা কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর উদ্ভাবক হিসেবে!
[img][/img]
চিত্র ৫-কম্পিউটার প্রোগ্রামের নমুনা
ওর চার নম্বর অবদান অ্যালেন তুরিং-এর (Alan Turing) মত জিনিয়াস লোকদেরও রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছিল। এখনও যে প্রশ্ন নিয়ে বিদগ্ধ সমাজে তুমুল তর্ক-বিতর্ক চলছে, তেমনই একটি প্রশ্নের জবাব- যন্ত্র কি মানুষের মত চিন্তা করতে পারবে? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এ প্রশ্নের জবাবে অ্যাডা একটি নোটে লিখেছিল যে অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিনের মত মেশিনের পক্ষে কখনোই মানুষের মত চিন্তা করা সম্ভব নয়। এটাকে দিয়ে অচিন্তনীয় আর অভুতপূর্ব সব কাজ করানো যেতে পারে, তবে সবই হবে আমদের মর্জি মাফিক। একশ বছর পর বিখ্যাত অ্যালেন তুরিং অ্যাডার এই মন্তব্যের নাম দিয়েছিলেন-“লেডি লাভলেসের আপত্তি”।
অ্যাডা অগাস্টাস লাভলেস মনেপ্রাণে চেয়েছিল তার এই লেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান গবেষণা হিসেবে স্বীকৃতি পাক। সেটা গুরুর সাথে খানিকটা মনমালিন্যের কারণ হয়ে গেল। ব্যাবেজ চেয়েছিল বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তার কিছু রাজনৈতিক মতামত অ্যাডার এই নোটের সাথে জুড়ে দিতে, অ্যাডার নাম দিয়ে। এ নিয়ে বেশ কিছুদিন, এডিটরকে জড়িয়ে, ওর সাথে উত্তপ্ত বাক্য আদান-প্রদানও হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অ্যাডার অধিকারই প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যাবেজ সিদ্ধান্ত নেয় অন্য এক লেখায় তার সেসব মতামত ব্যাক্ত করবেন। তবে সেসময়ে উঁকি মারা ব্যাক্তিত্বের সংঘাতের কারণেই হোক, কিংবা অ্যাডার মানসিক অস্থিতিশীলতার কারণেই হোক, অ্যাডার সাথে ব্যাবসায়িকভাবে অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন বানানোর প্রস্তাবে শেষমেষ ব্যাবেজ আর রাজি হন নি। তবে সুন্দরভাবে প্রত্যাখান করেছিলেন, আর সেজন্যেই বেঁচে গিয়েছিল ওদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটি।
১৮৪৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে “সাইন্টিফিক মেমোয়ার” পত্রিকায় অবশেষে প্রকাশিত হয় অ্যাডার অনুবাদ আর পাদটীকা। চরম আত্মতৃপ্তিতে অবগাহন করার সুযোগ পেয়েছিল ক’বছর ও, জ্ঞানী-গুণী বন্ধুদের মাঝে সম্মানও বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণে। কিন্তু সেসবই ছিল ক্ষণস্থায়ী। ব্যাবেজ কখোনই তার মেশিনগুলো বানানো শেষ করে যেতে পারেন নি, শেষ জীবনটা কেটেছিল বড়ই হতদরিদ্র অবস্থায়। অ্যাডারও আর কখনোই লেখা হয়ে ওঠেনি কোন বিজ্ঞান প্রবন্ধ। জুয়া আর মাদকাসক্তিতে নিঃশ্বেষ হয়ে যার এই অসম্ভব কল্পনাবিলাসী কবি হৃদয়। তারপর ১৮৫২-তে জরায়ুর ক্যান্সার ইতি টানে অ্যাডার ছত্রিশ বছরের সংক্ষিপ্ত যন্ত্রণাময় জীবনের।
“আমি কেবলি স্বপন করেছি বপন
বাতাসে—
তাই আকাশকুসুম করিনু চয়ন
হতাশে।
ছায়ার মতন মিলায় ধরণী,
কূল নাহি পায় আশার তরণী,
মানসপ্রতিমা ভাসিয়া বেড়ায়
আকাশে।
কিছু বাঁধা পড়িল না শুধু এ বাসনা-
বাঁধনে।
কেহ নাহি দিল ধরা শুধু এ সুদূর
সাধনে।
আপনার মনে বসিয়া একেলা
অনলশিখায় কী করিনু খেলা,
দিনশেষে দেখি ছাই হল সব
হুতাশে”! -(কাল্পনিক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
-অনিরুদ্ধ বাশার
সূত্রঃ
1. Walter Isaacson, “The Innovators” (Simon & Schuster, 2014)
2. Richard Holmes, “The Age of Wonder” (Pantheon, 2008)
3. Portrait of Ada by British painter Margaret Sarah Carpenter (1836)
4. Lord Byron in Albanian dress painted by Thomas Phillips in 1813. Venizelos Mansion, Athens (the British Ambassador's residence)
মন্তব্য
লিখতে থাকুন। আর বানানের দিকে একটু মনোযোগ দেবেন।
Emran
ধন্যবাদ। এরপর আরো সাবধানী হব। তবে কতগুলো ফালতু অযুহাতঃ কিছুদিন আগে বাংলা অভিধানটা হারিয়ে ফেলেছি, আর অনেকদিন ধরে বিদেশে থাকার ফলে বাংলা লেখালেখীতে মরচে পরে গেছে, অথচ লেখালেখীর ইচ্ছে প্রায়ই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে! একটা যুতসই বাংলা spell checker এর সন্ধান পেলে বড়ই ভাল হত।
বাহ, লিখতে থাকুন।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ধন্যবাদ!
ধন্যবাদ!
তথ্যবহুল পরিশ্রমী লেখার জন্যে সাধুবাদ , নিয়মিত লিখুন।
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
লিখব অবশ্যই! উৎসাহের জন্যে ধন্যবাদ, @মাসুদ সজীব!
ভাল লেগেছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নতুন মন্তব্য করুন