সংসদীয় নির্বাচন এমনিতেই আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থার সবচেয়ে বড় খুঁটি, আর এই বছর ৫ই জানুয়ারী আমাদের দেশে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে গেল, তা বিভিন্ন কারণে আরো অনেক বেশী আলোচিত/সমালোচিত। বি এন পির নির্বাচন বয়কট, অর্ধেকের বেশী আসন বিনা ভোটে প্রার্থী নির্বাচন, এর আগের নির্বাচনগুলি থেকে দৃশ্যত কম ভোট পড়া, ভোট জালিয়াতির অভিযোগ এসেছে।
নির্বাচন শেষ হয়ে যাওয়ার পর, এই নির্বাচনে অংশ নেয়া ভোটারের সংখ্যা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দঁড়িয়েছে। নির্বাচন কমিশনের হিসাব নিয়ে আপত্তি উঠেছে, এমন অবস্থায় বেসরকারী বা স্বাধীন কোনো প্রতিষ্ঠানের হিসাব/জরিপ নিয়ে একটা আগ্রহ তৈরী হয়েছে। ভবিষ্যতে এই নির্বাচন নিয়ে আরো আলোচনার বিস্তর সম্ভাবনা রয়েছে, তাই ভাবলাম, নির্বাচনের ভোটার অংশগ্রহণ সংখ্যা নিয়ে আলোচনার কিছুটা হলেও মূল্য আছে।
সরকারী দলের জন্য বেশী ভোটার সংখ্যার হিসাব অবশ্যই সুবিধাজনক, আর বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর জন্য ঠিক বিপরীত। এখন প্রশ্ন: আসল ভোটার অংশগ্রহণের পরিসংখ্যান কী?
বিভিন্ন সূত্র ঘেঁটে (প্রথআলো অনলাইন ডেস্কের মতো "ইন্টারনেটে পাওয়া" তবে সূত্র সহ ) যা পেলাম সেটাই এখানে তুলে ধরছি। ভবিষ্যতে কারো হয়তো কাজে লাগতে পারে।
আসুন আগে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কী বলে দেখে নেই, তারপর অন্য বেসরকারী সংস্থা।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন তথ্য:
আশ্চর্যজনকভাবে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের কোনো ফলাফল বা পরিসংখ্যান ইলেকশন কমিশনের ওয়েবসাইটে(http://www.ecs.gov.bd/) নেই। ওয়েবসাইটের মেনুতে "নির্বাচন->ফলাফল" বলে যে অপশন রয়েছে, তাতে ২০১৪ সালের কোনো ধরনের তথ্য নেই। অপরদিকে ২০০৮ সালের নির্বাচনের ফলাফল দেয়া রয়েছে প্রতিটা আসনের ডিটেলস সহ। নির্বাচনের ১১ মাস পরেও কোনো ধরনের তথ্য না থাকাটা বিস্ময়কর।
ঐ সময়কার পত্রিকা গুলো ঘেঁটে(http://is.gd/aTsa4U) নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত যে হিসাব পাওয়া যায়, তা এরকম----১৩৯টি আসনে ভোটাভুটি হয়েছে, সেখান মোট ভোটার চার কোটি ১৫ লাখ, এর মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট দিয়েছেন। দেশের মোট নিবন্ধিত ভোটার নিয়ে তারা কিছু বলেনি, তবে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটার তালিকা ধরলে, সর্বমোট ভোটার ৯ কোটি ১৯ লক্ষ, এর মধ্যে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছেন ১৮%, বাকিরা হয় ঐ আসনে ভোটাভুটি না হওয়ায় ভোট দিতে পারেননি, অথবা অনুপস্থিত।
এবার তুলনা করার জন্য বেসরকারী সূত্রগুলো খোঁজার চেষ্টা করলাম।
ইন্টারন্যাশনাল আইডিয়া:
The International Institute for Democracy and Electoral Assistance (International IDEA) is an intergovernmental organization with a mission to support sustainable democracy worldwide. এনাদের অয়েবসাইটে "ভোটার টার্নআউট বাই কান্ট্রি" নামে যে আপশন আছে, তাতে বাংলাদেশের ২০১৪ সালের ভোটের মোট ভোটার সংখ্যার উল্লেখ রয়েছে। ৯ কোটি বিশ লক্ষ সাত হাজার একশ তের নিবন্ধিত ভোটের বিপরীতে ৪ কোটি ৭২ লক্ষ বাষট্টি হাজার একশ আটষট্টিটি ভোট পড়েছে, যা মোট ভোটের ৫১ শতাংশ। ভোটের সংখ্যার একক পর্যন্ত এতো নিখুঁত পরিসংখ্যান বেশ আগ্রহোদ্দীপক, এবং এই সংখ্যাগুলো তাদের নিজেদের নয়, সূত্র হিসাবে দেওয়া রয়েছে আরেকটি ওয়েবসাইটের নাম http://www.electionguide.org/
ইলেকশনগাইড ডট অর্গ:
এই ওয়েবসাইট তৈরী করেছে International Foundation for Electoral Systems (IFES), এটা ইউএসএইডের অর্থে প্রতিষ্ঠিত একটা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, ওয়াশিংটন ডিসিতে। উপরের ইন্টারন্যশনাল আইডিয়ার সংখ্যাগুলি এই ওয়েবসাইট থেকেই পাওয়া। এই পরিসংখ্যানের উৎস কী? বাংলাদেশের তথ্যগুলোর উৎস এখানে সরাসরি বলা নেই, তবে তাদের "এবাউট" পাতাটিতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ভোটের ফলাফলের জন্য তারা শুধুমাত্র অফিশিয়াল ইলেকশন অথরিটি (অর্থাৎ বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন ) বা ঐ দেশের এম্বেসী এদের ওপর নির্ভর করেন। সুতরাং ধারণা করা যায়, এই সংখ্যাগুলি আমেরিকার বাংলাদেশ এম্বেসী , অথবা নির্বাচন কমিশন থেকে সরবরাহ করা। (নির্বাচন কমিশনের প্রদত্ত তথ্যের সাথে কিছুটা গড়মিল থাকার কারণ হতে পারে স্থগিত হওয়া ৮টি আসনের ফল পরে যোগ হওয়া)
ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশ:
"২৯টি সিভিল সোসাইটি প্রতিষ্ঠানের/সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত হয় ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডব্লিউজি)" এর জরিপের হিসাবই এখন পর্যন্ত আমার পাওয়া একমাত্র বেসরকারী তথ্যবহুল সূত্র। (http://is.gd/95i0BJ) ঢাকায় অবস্থিত এই সংস্থা ৭৩টি সংসদীয় আসনের(যেসব আসনে নির্বাচন হচ্ছে তার মধ্যে) হাজার দেড়েক ভোটকেন্দ্রে প্রায় সাড়ে আট হাজর নিজস্ব পর্যবেক্ষক নিয়েগ করে। দিন শেষে তাদের হিসাবে, মোট ভোট পড়ে ৩০ শতাংশ, (যেসব জায়গায় নির্বাচন হয়েছে) জাল ভোট ইত্যাদি বাদ না দিয়ে। সর্বনিম্ন ঢাকা-১৭তে ৭ শতাংশ আর গোপালগঞ্জ-১ এ ৭৪ শতাংশ। ৩০% এর এই হার, তাদের হিসাব মতে, দেশের গত দুটি নির্বাচনের তুলনায় লক্ষণীয়ভাবে কম (২০০১ এ ৭৪% আর ২০০৮ এ ৮৮%।)
এই ডাটাকে ধরে, মোটা দাগে বলা যায়, যেহেতু দেশের অর্ধেকের বেশী আসনে একজন মাত্র প্রার্থী থাকায় কোনো ভোটাভুটি হয় নি, তাই দেশের মোট ভোটারের ১৫ শতাংশ বা তারো কম তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছেন/করেছেন।
অন্যান্য সূত্র (যেগুলোর মেথডলজির কোনো উল্লেখ নেই, তাই এগুলোর মূল্য প্রশ্নসাপেক্ষ):
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক অ্যাডভোকেট এ কে আজাদ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, বেশির ভাগ ভোট কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ছিল শতকরা শূন্য ভাগ থেকে ১০ ভাগ পর্যন্ত। কিছু কিছু আসনে সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২৫ ভাগ।
ফেয়ার ইলেকশন মনিটিরিং অ্যালায়েন্স ফেমা’র প্রধান মুনিরা খান জানিয়েছেন, নির্বাচনে সব মিলিয়ে ১০ শতাংশেরও কম ভোটার ভোট দিয়েছেন।
----যান্ত্রিক বাঙালি
মন্তব্য
দরকারী আলোচনা।
ধন্যবাদ, আপনার চোখে অন্য কোনো জরিপ চোখে পড়লে জানাবেন।
---যান্ত্রিক বাঙালি
মানবাধিকার কমিশন কীভাবে ভোটার তথ্য পায় এবং সেটা কীভাবে তারা সংগ্রহ করে সেটা খতিয়ে দেখা জরুরী। আবঝাপ মেঠো বক্তৃতা দিয়ে মিডিয়া ফোকাস পাওয়াতে অনেকেরই লালচ দেখা যায়। পরে এই লালচের জন্য ক্ষতিগ্রস্থ হতে হয় আমাদের সবাইকে।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
এদের কোনো ওয়েবসাইট খুঁজে পাইনি, যেটা আছে তা হোলো ঐ সময়ের পত্রিকার রিপোর্ট, যেখানে তাদের বিবৃতির কথা বলা হয়েছে। ঐ বিবৃতিতে তাদের কোনো মেথডলজির উল্লেখ ছিল কিনা জানিনা(আন্দাজ করতে পারি ছিলনা)। সেই তুলনায় ইডাব্লুজির মেথডলজি অনেক পরিষ্কার করে লেখা।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, একতরফা নির্বাচন হচ্ছে দেখে অনেকেই জরিপ করার আগ্রহ হারিয়েছেন, বা পরবর্তীতে ডিটেলস রিপোর্ট দেবার প্রয়োজন মনে করেননি। ইডাব্লুজি আরেকটি ডিটেলড রিপোর্ট দেবে বলেছিলো, কিন্তু সেটার কোনো অস্তিত্ব তাদের পেজে পাইনি।
----যান্ত্রিক বাঙালি
ইলেকশনগাইড বা ইন্টারন্যশনাল আইডিয়ার প্রদত্ত ভোট নাম্বারে আরেকটা জিনিস খেয়াল করলাম, এদের নাম্বারগুলি পুরোই "গাঁজাখুরি", তাদের দাবী মতে "প্রদত্ত ভোট" এর সংখ্যা ৪৭ মিলিয়ন, যেখানে বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশনের হিসাবেই "মোট ভোটার সংখ্যা"ই এর থেকে কম। সূত্র না থাকায় এমনিতেও এদের ভ্যালু ছিলনা, এই উদ্ভট সংখ্যাগুলি খেয়াল করার পর এদের নিয়ে আর সময় নষ্ট করার মানে দেখি না।
------যান্ত্রিক বাঙালি
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে আগে পরে এবং দেশে বিদেশে বহু কথা বলা হয়েছে। তবে লেখকের পরিসংখ্যান বিষয়ক লেখাটি সত্যিই গবেষনা যারা করেন তাদের জন্যে ইতিবাচক। তবে ২০১৩ সালের বাংলাদেশের রাজনইতিকপরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বলতে গেলে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন এদেশের অস্তিত্বের প্রশ্নে এক ইতিবাচক পদক্ষেপ বলেই মনে হয়েছে। একটি স্বাধীন দেশে বিদেশী প্রভুদের এবং তাদের দোশরদের প্রেসক্রিপশনে একটি সাধারন নিরবাচন করতে হবে এবং তাও আবার কিছু অরাজনৈতিক ব্যক্তির সমন্বয়ে তৈরী একটি অনির্বাচিত সরকারের অধীনে এটা মেনে নেওয়া যায় না। এবং আমি মনে করি যে দলের অধীনেই হোক না কেন জাতীয় নির্বাচন হতে হবে রাজনৈতিক সরকারের অধীনেই ।
এপ্রসঙ্গে এক্তী পুরানো কথা মনে করিয়ে দিতে চাই যে, নির্বাচন গনতন্ত্রের একটি প্রক্রিয়া কিন্তু একমাত্র নয়।
২০১৪ এর জাতীয় নির্বাচন কতটুকু ইতিবাচক হয়েছে সেই প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা এই লেখায় করতে চাইনি, পরিসংখ্যানেই সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছি। আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ।
---যান্ত্রিক বাঙালি
নতুন মন্তব্য করুন