পারুলের সংসার

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৫/১২/২০১৪ - ৯:৩৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শীতকাল আসি আসি করছে। দুপুরের দিকে এটা বেশ টের পাওয়া যায়। ছোট ছেলেটাকে খাইয়ে বিছানায় দিয়ে এসে পারুল রান্না ঘরের সাফসুতরো করতে করতে শাড়ির আঁচলটা একটু ভালো মতো জড়িয়ে নেয় পিঠের কাছটায়। ঠাণ্ডা বাতাসটা সবার আগে সে তার পিঠেই টের পায়। এই বাসাটার সমস্যা হলো কলঘরটা মূল বাড়ির বাইরে। এই একগাদা বাসন, হাড়ি পাতিল এখন সেখানে গিয়ে ধুতে হবে। এখন কি আর ইচ্ছে করে এগুলি ধুতে! আলসেমি করে রান্নাঘরের সকালের কাজগুলোও জমিয়ে রেখেছিলো। দুপুরের এই সময়টায় খেয়েদেয়ে আরাম করে একটা ঘুম দিতে পারলেই যেন আরাম হতো। এ কথা মনে হতেই একটা বড় করে হাই তুললো পারুল। কয়েকদিন ধরেই পারুল তার স্বামীকে বলছিলো একটা কাজের মানুষ রেখে দেয়ার কথা। স্থায়ী না হোক অন্তত ছুটা কাজের মানুষ হলেও চলে যেতো। কিন্তু তার স্বামী সোবহান এই ব্যাপারটা শুনে খুব একটা পাত্তা দেয়নি তাকে। উল্টো দুই কথা শুনিয়ে বলেছিলো - বেশি আরামে থাকলে তো ধরারে সরা জ্ঞান করবা। পা আর মাটিতে দিয়া চলতে চাইবা না। কষ্ট করতে শিখো, পোলাদেরও শিখাও দুনিয়ার হালচাল। চাইলেই যদি সব পাওয়া হইয়া যায় তাইলে তো পোলারা আর কামকাইজ কইরা খাইতে শিখবো না। এরপর সোবহান অন্য প্রসঙ্গে কথা ঘুরিয়ে নেয়। লোকটা সবসময় খালি পন্ডিতি কথা বলে। খুব বেশি কিছু কী পারুল চেয়েছিলো তার স্বামীর কাছে? এমন তো না যে সোবহানের টাকা পয়সা নিয়ে সমস্যা আছে। মাসে মাসে দুবাই থেকে বেশ ভালো টাকাই পাঠায় তার স্বামী। কিন্তু প্রতিটা টাকার হিসেব যেন সোবহানের মুখস্থ। এদিক সেদিক করাটা বেশ কঠিন। পারুলও কী বোকা নাকি? যে কাজে যত টাকা খরচ লাগবে সেটা পাঁচশো, হাজার টাকা বাড়িয়েই সে তার স্বামীকে হিসেবের খরচের ফর্দ ফোনে জানিয়ে দেয়। একটু একটু করে ভালো টাকাই পারুল জমিয়েছে। গত মাসেই ব্যাংকে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসেছে, মোট তিন লাখ একুশ হাজার জমেছে। কিন্তু এই একাউন্টের খবর সোবহান জানে না এখনো। যে জিনিস কারো জানার সম্ভাবনা নেই, সেটা খামোখা আগ বাড়িয়ে বলতে যাওয়াই বা কেন ! ব্যাংকের জমা বই,চেক বই,এটিম কার্ড সব পারুল তার বড় বোন বকুলের কাছে রাখতে দিয়েছে।
সোবহান তার বড় বোন বকুল,মেজো বোন পান্না,ছোট বোন,ওর ভাই রফিক কাউকেই পছন্দ করে না। তাদের সাথে যোগাযোগ রাখাও পছন্দ করে না। কারণটা খুবই সামান্য। এরা নাকি মিথ্যা কথা বেশি বলে। আরে এই যুগে সত্যি কথার দাম আছে নাকি? দুই চারটা মিথ্যা বললে কী এমন ক্ষতি! না সেটা চলবে না,সোবহানের কাছে কথা আর কাজের মিল না থাকলে সে মানুষকে সে দেখতেই পারে না। বেশ কয়েকমাস আগেই পারুল আর তার দুই ছেলের বকুলদের বাসায় যাবার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সে। আচ্ছা পারুলের বাসার কাছাকাছিই তার তিন বোনের বাসা। এতো কাছাকাছি থেকে পারুল না যায় কীভাবে! আর সোবহান যেহেতু বাংলাদেশে থাকে না,তাকে আর জানাবার দরকারই বা কী সে কোন বোনের বাসায় যায় না যায় !- এমনটাই বলেছে তার ছোট বোন শাহানা। বুবু, তোর কী এতো দরকার রে যে দুলাভাইয়ের কাছে তোর সব জমাখরচ দেওন লাগবো! আমারে দেখস না, জামাইরে টাইটের উপরে রাখি,আর সব কথা ব্যাটা মাইনসের জাইন্যা কাম কী! তাগো কাম টাকা কামাইবো আর রাইতে আইসা একটু আদর সোহাগ করবো।

শাহানা পারুলের পিঠাপিঠি বোন। তাই সম্পর্কটা বেশ সহজই তার সাথে। একেকদিন বিকেলে পারুলরা একেক বোনের বাসায় গিয়ে আড্ডা দেয়। পারুলের বাসায় আড্ডা কমই হয়। শুধু যে বাসায় বোনেরাই আসে তা তো আর না। বকুল আপার তিন ছেলে, পান্নার দুই জন, শাহানার দুই জন আর পারুলের দুই জন মিলে পুরো বাসাটা একেবারে ভরে যায়। তারউপর আছে বিকেলের নাস্তার খরচ। এই কথা সোবহানকে জানালে কী আর রক্ষে থাকবে! উল্টো শুনিয়ে দিবে - তোমার বোন আর বোনের বাচ্চা গো খাওয়ার খরচ যোগাইতেই কী আমি বিদেশ আইছি নাকি? মাসে কয়দিন তোমাগো এমন বেড়াইতে হয়, খাওয়াইতে হয়! মাসে একবারের খরচ পাইবা এইসব ফালতু কামে। আর বেশি ইচ্ছা হইলে যাও চান্দা তুইল্যা তোমরা খাও গা! পারুলের বাসায় হিসাবে তিন থেকে চার বার এরকম আড্ডাবাজি হয়। সেই হিসাবে মাসে কম হলেও তিন চার হাজারের কম লাগে না। আর সবদিন মোগলাই, গ্রিল, নান খাওয়ানো যায় নাকি? মাসে একবার হলেও তো পোলাও, মাংস এর ব্যবস্থা করতে হয়। এই কারণে সোবহানের কাছে অসুখের বাহানা, বড় ছেলে পাপনের আরও একটা এক্সট্রা কোচিং এ ভর্তি, ছোট ছেলে রিমনের চশমার ফ্রেম ইত্যাদি নানান কারণ দেখিয়ে আরও পাঁচ হাজার টাকার একটা হিসাব তাকে দেখাতেই হয়। পারুল তো মিথ্যা কথা বলতে চায় না কিন্তু অন্য বোনদের সাথে একটু তাল মিলিয়ে চলতে গেলে ওকে তো বাধ্য হয়ে একটু ছলচাতুরীর আশ্রয় নিতেই হয়। তার মনের হাওয়া বুঝেই মাঝে মাঝে সোবহান তাকে বলে - আইচ্ছা তোমার একটু গরীব থাকলে কী এমন সমস্যা ? লোকটা বোকা নাকি! যার স্বামী বিদেশ থাকবে সে কেন গরীবের মতো চলবে! তার স্বামী তো বিদেশে বন্ধু-বান্ধব সমাজ নিয়ে চলে না। কিন্তু এখানে তো পারুলকে একটা সমাজ নিয়ে চলতে হয়। এই যে ছোট ছেলেটা রোজ রোজ মুরগী দিয়ে ভাত খেতে চায়,প্রতি শুক্রবারে চাইনিজে গিয়ে খেতে চায়, পাপন বসুন্ধরা গিয়ে জুতো কিনতে চায়, কী যেন নাম হাসপাপী,পাওয়ার,এপেক্স আর কী কী যেন আছে ওসব! সে সবের দাম কি আর চারশো পাঁচশো? চার পাঁচ হাজারের কমে কী ঐ জুতো কেনা যায়! সোবহান এর কাছে এসব বলতে গিয়েই তো পারুলকে শুনতে হয়েছে -
আমরা বাটার স্যান্ডেল পিন্দা বড় হইছি। পোলারেও তাই কিন্যা দেও। খালার বাসায় যাইয়া যাইয়া, খালাতো ভাইদের দামী দামী জিনিসপত্র দেইখ্যা দেইখ্যা যেহেতু তোমার পোলাগো চাহিদা বাড়ছে, তাইলে সেইখানে তাদের যাইতে দিও না, এই আমার শেষ কথা।
সে কি খেয়ে মানুষ হয়েছে, কি পরেছে না পরেছে এসব হিসেব করলে কী আর এই যুগে চলবে ! তবুও মানুষটার কড়া নির্দেশ টাকা থাকলেই যাতে যত্রতত্র খরচ না করি, সঞ্চয়ী হই। স্বামী তো না যেন ভাসুর। উঠতে বসতে তার এতো জ্ঞানের কথা শুনতে এখন আর ভালো লাগে না। পারুলের ইচ্ছে করে তাকেও দুটো কড়া কথা শুনিয়ে দিতে। ঘর ভাড়া,খাবার খরচ,ছেলেদের স্কুল,কোচিং এর বেতন এসব মিলিয়ে যত গুনে গুনে টাকা পাঠায় লোকটা,কেমন লাগে! এর বাইরেও তো কতো খরচ থাকতে পারে। সেখান থেকে আবার পারুলকে তার মা- বাবার হাত খরচের জন্যও কিছু টাকা জমাতে হয়। বিয়ে হয়ে গিয়েছে বলে পারুলের কাছে তো তার মা- বাবা পর হয়ে যায়নি। সোবহানকে শুরুতে না জানিয়েই পারুল টাকাটা তার মায়ের হাতে দিয়েছিলো। কিন্তু সত্যি কথা তো বেশিদিন আর চাপা থাকে না। পারুলই কথায় কথায় মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলো। মানুষটা শুনে বলেছিলো -
তুমি তোমার বাবা-মা'কে খরচ দাও ভালো কথা। এতে তোমারই নাক উঁচা হইলো বাপের বাড়িতে। কিন্তু তাই বইল্যা আমার সাথে লুকোচুরি খেলো,কথা লুকাও কেন বুঝলাম না।
পারুল এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি সে সময়। একটু ব্যস্ততার ভান করে 'ইশ রানতে হইবো,বেলা হইয়া গেলো'বলে বিছানা ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়েছিলো। সোবহান বিদেশ থেকে আসলে সকালের এই সময়টা ছাড়া পারুল তার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে পারে না। ছেলে দুটোও এ সময়ে স্কুলে থাকে। সোবহানই পারুলকে ডেকে নিয়েছিলো। বিছানায় যাবার পর তাকে বুকের কাছেও টেনে নিয়েছিলো মানুষটা। কিন্তু তার মিথ্যে কথাটা ধরা পরে যাবার পড়েই মানুষটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেলো। পারুলের বাঁধনটা আলগা করে হাত দুটো মাথার নিচে দিয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো। বিছানার পাশের সাইড টেবিল থেকে নিয়ে নিশ্চয়ই সিগারেটও ধরিয়েছিলো। পারুল সেটা দেখার আর সুযোগ পায়নি, তাড়াহুড়া করে রান্নার অজুহাতে শোবার রুম থেকে বেরিয়ে এসেছিলো। তারপর পারুল আবারো তার বাবা-মা'কে টাকা পাঠিয়েছিলো কিন্তু সোবহানের কাছে ভাব ধরেছিলো সে আর পাঠায় না টাকা। আর বাবা-মায়ের জন্য বরাদ্দকৃত টাকাটা পারুল নতুন একটা ডিপিএস খুলেছে ব্যাংকে এটা বলেই যোগাড় করে নিয়েছে। কী দরকার খামোখা সোবহানকে সব কথা জানিয়ে। তার বড় বোন বকুলও একই কথা বলে। মাথা খাটাইয়া কাজ করতে শিখ। তোর দুলাভাই যে টাকা কামায় সবই যদি তারে হিসাব নিকাশ দিতে থাকতাম আজকা কী আমি মিরপুরের মতো জায়গায় তিন কাঠা জমি রাখতে পারতাম ? গয়নাগাটি বানাইতে পারতাম! -সে এক খিলি পান মুখে দিয়ে আয়েশ করেই কথাটা একবার বলেছিলো। বকুল আপার টাকা পয়সার অভাব না থাকলেও মা-বাবার জন্য তাকে কখনো খরচ করতে দেখা যায় না। আর বকুল আপার সাথে তো তার শ্বশুরবাড়ির যোগাযোগ তেমন নাই বললেই চলে। প্রায়ই দেখা যায় কথাচ্ছলে পারুলের ছোট ছেলেটাকে বলে -
খালাগোটা খাইয়া পিন্দাই তো বড় হইতাছস!বলে রিমনের মাথাও আলতো করে একটা চাঁটিও মেরেছিলো।পারুলের ব্যাপারটা ভালো লাগেনি। ভালো রিমনেরও লাগেনি। তাইতো বাসায় ফিরতে না ফিরতে সোবহানকে ফোন করে জানিয়েও দিয়েছিলো -
জানো বাবা, আজকে না বড় খালামণি আমার মাথায় ঠুয়া মারছে। বলে আবার খ্যানখ্যানে সুরে কাঁদলোও। বড় বড় করে চোখ পাকিয়েও রিমনকে চুপ করাতে না পেরে পারুল ফোনটা নিজের কানে নেয়। নানান কথার বাহানাও শেষ রক্ষা হয় না, পারুলের মুখ থেকে সোবহান বের করেই ছাড়ে রিমনকে কেন তার খালা মেরেছে। সোবহান আর্তনাদ করেই যেন অনেকটা বলে ওঠে -

বৌ রে,অনেক চাহিদারে গলা টিপ্যা মাইরানিজের রক্ত পানি করা টাকা পাঠাই যাতে তোমরা ভালো থাকতে পারো। আমার পোলাপানরে তোমার বইনেরা পালে এই কথাও আমার শুনতে হইলো! বারবার মানা করনের পরেও তুমি এখনো ঐ বাড়িতে যাও? তোমার শরম করে না?
সোবহানের মুখে এই কথা শুনে কেন যেন পারুলেরও খুব মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। খালা হয়ে কী ভাগ্নেকে দুই কথা ঠাট্টা করেই বলতে পারবে না? এমন সব কথায় মাথা গরম হয়ে যায় কেন লোকটার? সোবহানের সংসারে কী কম কষ্ট করেছে পারুল! কম কম খেয়ে, পরে সে কী টাকা জমায়নি? সে টাকা তো বকুল আপার কাছেও ব্যবসায় খাটিয়েছে। মাসে চার হাজার টাকার লাভও দিবে বলেছে। এসব কী আর সোবহানকে বলা যাবে? বোনের বাসায় সপ্তাহে দুই তিন দিন খাওয়াদাওয়া করায় পারুলের বাজার খরচ থেকেও তো টাকা বেঁচে যাচ্ছে। ঈদে-চান্দে ছেলেদের জন্য জামাকাপড়ের খরচটাও তো বকুল আপাই দেয়, মাঝে মাঝে মেজো বোনও পাঠায়। এভাবে যে তার বোনেরা সোবহানের সংসারে কতো টাকা বাঁচিয়ে দিচ্ছে সে হিসেব তো আর তার স্বামী জানে না,জানলে এভাবে এখন গলা উঁচিয়ে ঝগড়া করতো না। তাই পাপন, রিমনকে যদি তার বোনেরা দু'চার কথা শোনায় ক্ষতি কী! বিপদে আপদে তো তাদেরই কাছে পায় পারুল। বোনদের বুদ্ধি শুনেই তো পারুল তার শ্বশুর বাড়িতে না গিয়ে শহরে ঘর ভাড়া করে থাকছে, না হলে ননাস, দেবর,শ্বশুর-শাশুড়ির খরচ টানলে কী আর পারুল এভাবে টিপে টিপে সংসার থেকে টাকা বাঁচাতে পারতো! কই সোবহান পারুলের বাবার বাড়ির লোকদের উপরে একটু কৃতজ্ঞ থাকবে তা নিয়া খালি আছে তার আত্মসম্মান, সততা এসব নিয়ে। এসব দিয়ে কী আর টাকা পাওয়া যাবে? গত মাসেই তো পান্না আপা একটা শাড়ি কিনে দিলো, কোটা শাড়ি নীল আর হালকা আকাশী শেডের। সোবহানকে সে শাড়ি পরে ছবিও পাঠিয়েছিলো। দেখে জানিয়েছিলো সুন্দরই লাগছে তাকে, শাড়িটা নতুন নাকি? পারুল সে কথার উত্তর না দিয়ে ফোনে পাপন আর রিমনকে ধরিয়ে দিয়েছিলো।কথায় কথায় সে শাড়ির খবরও চাপা পড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আজকে লোকটা শুরু করলো কী! এই যে রাগারাগি করছে থামছেই না। বকুল আপাকে ফোন দিয়ে সে জিজ্ঞাসাবাদও করবে কেন রিমনকে বাজে কথা বলেছে, মাথায় মেরেছে। ইশ এই ঝামেলা যে কতদূর গিয়ে গড়াবে কে জানে! বকুল আপাও ছেড়ে দেয়ার পাত্রী না। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সেও কী সোবহানকে কয়েক কথা শোনাবে না! পারুলের বড় বোনও সোবহানকে পছন্দ করে না। সে কারণটা অবশ্য তার কাছেও পরিষ্কার না। বকুল আপার মাঝে একটা ছোঁক ছোঁক করার অভ্যাস ছিলো সোবহানকে ঘিরে। সে সময় বকুল আপার স্বামী দেশের বাইরে ছিলো। পারুলরা সাবলেটে বকুলদের সাথেই এক বাসায় থাকতো। সোবহানও ছুটিতে তখন দেশে। পারুল তখনই খেয়াল করেছে বকুল আপার ব্যাপার। স্বামী নিয়ে পারুল যে ঘরে শুয়েছে তার পাশের ঘরেই তার বড় বোন ছটফট করছে, এটা পারুল ভালোই বুঝতো। একটু পর পর ডাইনিং এ গিয়ে পানি খাওয়া, বারান্দায় পায়চারী করা,বাথরুমে যাওয়া-আসা, ছিটকিনি লাগানো সবই পারুল ঘুমের ভান ধরে টের পেতো। কতো কতো দিন তার স্বামীরও বকুল আপার প্রতি আগ্রহ আছে কিনা পরীক্ষা করতে পারুল বাজার করার নাম দিয়ে, নিজের বাচ্চাদের স্কুল থেকে আনার নাম দিয়ে তাদের দুইজনকে খালি বাসায় রেখে বেড়িয়ে গেছে! বাসায় ফিরে দেখেছে সোবহানও নেই। হয়তো তার পিছু পিছুই বেড়িয়ে গেছে সেও। বকুল আপার শোবার ঘরে ঢুকেও দেখেছে, সে গায়ের ওড়না ফেলে বিছানায় ফ্যানের নিচে শুয়ে মুখ হা করে বাতাস গিলছে। ভাবখানা এমন পারলে আস্তো মানুষ গিলে খায়। জ্যান্ত পুরুষ মানুষ! মানুষ চুরি করতে চাইলে তার জন্য সুযোগের দরকার হয় না। ইচ্ছে জাগাটাই যথেষ্ট, চোখের সামনে চাইলেই সে চুরি করতে পারে; হোক সে নারী বা পুরুষ মানুষ। বকুল আপার সাথে সোবহানের যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক হয়নি বা সে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে হতে ভেঙেও যায়নি তারই বা নিশ্চয়তা কী! না হলে বকুল আপা বা সোবহান একে অপরের প্রতি এতোটা শত্রুতার ভাব পোষণ করবে কেন। নিজের বোনকে তো আর এসব নিয়ে জিজ্ঞেস করা যায় না তাই নিজের পুরুষ মানুষটাকেই চিপে চিপে তেল বের করতে হয়। পান্না এতোটা চালাক চতুর না হলে পারুলের ছোট বোন শাহানার কাছে এসব ব্যাপারে বেশ ভালো জ্ঞানই হয়েছে এখন।
সোবহানের বলতে দেরি বকুল আপাকে ফোন করতে দেরি হয়নি। ফোন রাখার বিশ মিনিটের মাথায়ই আবার ফোন করেছে সে পারুলকে। ফোনে সে কী তর্জন গর্জন করছে লোকটা! পারলে এখনই বাংলাদেশে চলে এসে এর একটা বিহিত করে যায় এমন আর কি! পারুলের বড় বোন নাকি সোবহানকে বলেছে –
আপনের মতো মাইনসের কাছে আমাগো বইনরে বিয়া দিয়া ভুল করছি। চাইলে আমাগো বইনরে আমরাই পালতে পারি। মাসে মাসে বিশ হাজার টেকা দেওনের ক্ষমতা আমাগোও আছে! আর আমার বইন এমন বুড়ি হইয়া যায় নায়, কোমর নাচাইলে এমনেই ব্যাটা মানুষ গিল্যা খাইতে আইবো… ইত্যাদি আরও নানান কথা।
সেই থেকে শুরু পারুলের দুর্দশা। বাবার বাড়ি সঙ্গ ছাড়তে পারেনি আর তার বড় বোনের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা, পারুলের ক্রমাগত মিথ্যা কথা সবকিছু মিলিয়েই বোধহয় এই দুর্দশা তার জীবনে নেমে আসতে দেরি করেনি। দুই মাস হলো সোবহান টাকা পাঠায় না। ফোনে কথাও বলে না। পারুল বেশ কয়েকবারই ফোন দিয়েছে, সোবহান লাইন কেটে দিয়েছে। এতে যে পারুল ভীত হয়ে দুশ্চিন্তায় দিন পার করেছে তাও নয়। বরং তারও রাগ বেড়েছে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। তাই বলে যে পারুলের সংসারের খাওয়া –পড়া থেমে আছে তাও নয়। এইতো সেদিন বাড়িওয়ালা এসে তাগাদা দিয়ে যাওয়াতে গলার দেড় ভরি ওজনের হারটা সে তার বড় বোনের কাছে বন্ধক দিয়ে দিতে চাইলো। আপা ভালো মানুষ বলে বন্ধক নিতে রাজি হয়নি। বললো –
না বাপু, বন্ধক মন্ধকের দরকার নাই। আমি এই হার পিন্দা পিন্দা ঘুরুম আর তুই লম্বা লম্বা শ্বাস ফালাবি আমার ঘাড়ের উপরে এইটা হইবো না। বেচনের হইলে একবারে বেইচ্যা দে, নাইলে থাউক।
শেষ পর্যন্ত পারুলকে হারটা বিক্রি করতেই হয়েছে। দুই মাস চলেছেও সে টাকা দিয়ে। তার বড় আপা এখনো সেই তিন লাখ একুশ হাজার টাকার কোনও ইন্টারেস্ট তাকে দেয়নি। তার স্বামী সোবহান আর কয়দিনই বা রাগ করে থাকবে। ছেলেদের দিয়ে ফোন করে টাকার কথা বললে ঠিকই টাকা দিবে - এই আশাতেই আছে পারুল। আর বেশি সমস্যায় পড়লে খালাতো ভাই ফারুকতো আছেই। তাকে ফোন দিয়ে মিনিট পাঁচেক গল্প গুজব করলে সে নিশ্চয়ই পারুলদের খোঁজ খবর নিতে বাসা পর্যন্ত আসবেই। ফারুক ভাইয়ের সাথে তার বিয়ে হলেও হতে পারতো কিন্তু পারুলের একমাত্র ভাই কেন যেন নিজেদের আত্মীয়ের মাঝে সম্বন্ধ করতে রাজি হলো না কে জানে ! এমনিতে ফারুক ভাইকে পারুলের পছন্দই ছিলো। একবার বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াতেও নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু অন্যের উপরে ভরসা করে কয়দিন চলা যাবে, সে চিন্তাও যে পারুলের মনে উঁকি দেয়নি তা তো না। কিন্তু সোবহানের সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে পারুলও গলা চড়িয়ে বলেছিলো – আমার যেমনে চলতে সুবিধা হয় অমনেই চলুম। তোমার ভাই বইনেরা কী আইসা আমাগো মা-পোলাদের খোঁজ খবর লইয়া যায় না একবেলা বাজার কইরা দিয়া যায়? সোবহানও কী ছেড়ে দেয়ার মানুষ? সেও তেমনি গলা উঁচিয়ে বলেছে – আমার মা- ভাই- বইনের লগে তো তুমিই যোগাযোগ রাখতে চাও না। তাগো একটা আত্মসম্মান বইলা ব্যাপার আছে, তাই তোমার ইচ্ছারেই তারা সম্মান দিয়া তোমারে তোমার মতন থাকতে দিছে। আর আমি টাকা কামাই তোমাগো লাইগ্যা, মানুষের সাহায্য, টাকা পয়সার আশায় থাকবা কিয়ের লাইগ্যা? এরপর এক কথা দুই কথা থেকে পারুলও বলেছে – হ, যাও তোমার ভাত আমি খামু না, তোমার সংসারও আমি করুম না। রাগের মাথায় মানুষ তো কতো কিছুই করে, কতো কিছুই বলে। সেসব কী আর ধরে রাখলে চলে! না হয় সোবহানের বংশ নিয়ে, মা-বাপ তুলে দুই একটা গালি মুখ ফসকে বেরই হয়ে গিয়েছিলো পারুলের, তাই বলে কী এমন রাগ হয়ে থাকতে হবে মানুষটার? আর সোবহানও তো কম না, সেও সাথে সাথে বলে দিলো –
আইচ্ছা সংসার যখন করবেন না, আপনারেও আমি তালাক দিলাম। বলে পর পর তিনবার তালাক, তালাক, তালাক বলে বাইন তালাক দিলাম বলে মানুষটা ফোন রেখে দিলো। আর কতো নিষ্ঠুর সাথে সাথে সম্বোধনটাও বদলে তুমির জায়গায় আপনি আপনি করে কথা বললো। সেই থেকে পারুলের মনটা খারাপ হলেও সে তার বোনদের ব্যাপারটা জানায়নি। আর জানাবেই বা কেন, পারুল নিজেও খুব গুরুত্ব নিয়ে সোবহানের তালাক বিষয়ক ব্যাপারটা নিয়ে ভাবেনি। সময়ের সাথে সাথে রাগ কমে আসলে এমনিই ঠিক হয়ে যাবে এমনটাই ধরে নিয়ে পারুল সময় অতিবাহিত করছিলো। মাঝে কিছুদিন বোনদের বাড়িতে যাওয়া-আসা সে নিজেও কমিয়েছিলো কিন্তু দুই ছেলের তাদের খালাদের বাসায় যাতায়াত আগের মতোই রয়ে গেছে। আর ছেলেগুলোই বা কেমন ধারার কে জানে, একবার তাদের বাবার কথা জিজ্ঞেস করে না। যা চায় তাই তো পেয়ে যায় চাইলেই তারা বুঝবে কী পারুলের মাথায় কী বিশাল বোঝা চেপে বসেছে। ভালো লাগে না এই দুশ্চিন্তা আর সংসারের ঝামেলা। মন চায় লাথি মেরে রেখে কোথাও চলে যায়। রিমনকে দিয়ে আজকেই ফোন করাতে হবে তার বাবাকে। ছোট ছেলেটা সোবহানের অনেক আদরের। হয়তো ছেলের গলার আওয়াজে বাবার মন গললেও গলতে পারে। কিন্তু সত্যিই লোকটা তাকে তালাক দিয়ে দিয়ে দিলো নাকি এই দুশ্চিন্তাও গত কয়েকদিনে পারুলকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। টেলিভিশনে একবার একটা নাটিকায় দেখেছিলো, মুখে মুখে তালাক উচ্চারণ করলে নাকি তালাক হয় না। তাই শুরুর দিকে পারুল সেটা পাত্তা না দিলেও যখন একদিন দুইদিন করে পুরো দুই মাস পার হয়ে গেলো, তখনই পারুলের মাঝে এই দুর্ভাবনার উদয় হয়েছে। সত্যিই যদি লোকটা সংসার না করতে চায় তখন পারুলের গতি কী হবে এই দুই বাচ্চা নিয়ে। সামনে বড় ছেলেটার এসএসসি পরীক্ষা, ছোটটা ক্লাস টু তে উঠবে। এতো খরচ সামনে, ঘর ভাড়ার ব্যবস্থা না করতে পারলে বাড়িওয়ালাও তো থাকতে দিবে না। না হয় এক দুই মাসের জন্য সে ভাড়াটা আপাতত না নিতে পারে কিন্তু তাই বলে তো সেটা মউকুফ করে দেয়নি। দুধওয়ালা হারুন ভাইয়ের বিলও বাকি আছে, লন্ড্রিতে বাকি পড়েছে। সোবহান বারবার বলতো,
এতো ভালো ইস্ত্রী আইনা দিলাম, ঘরেই কাপড়চোপর ইস্ত্রী কইরা নাও। নবাবী কম করো, কাজ কর্মের মাঝে থাকলে শরীরটাও ভালো থাকবো। বাতের ব্যথায় আহা উহু করতে হইব না। লোকটার কথারে পাত্তা দিলে তো এখন বকেয়া টাকা পরিশোধ নিয়া চিন্তা করতে হতো না। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে পারুল মোবাইলটা হাতে নিয়ে সোবহানের নাম্বারে ফোন করে।সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর! পারুল কিছু সময় চুপ করে থাকে, কথা বলতে গিয়ে তার বুক কাঁপে। লোকটা তার গলার আওয়াজ পেয়ে লাইন কেটে দিবে না তো নানান ভাবনার ফাঁকে কখন যে পারুল একবার ভাঙা ভাঙা গলায় বললো ‘হ্যালো’ তারপর মনে হলো ফোনের ভেতরের হিমালয়ের একরাশ ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকে গেছে কিংবা পুরো পৃথিবী শব্দশূন্য হয়ে গেছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই, কেমন একটা শো শো করে বাতাস বইছে। পারুলের এতো শীত লাগছে কেন? চারদিক কেমন ঘোলা ঘোলা লাগছে।
“ঐ মা, কান্দো কেন? মা কী হইছে ?” রিমনের ডাকে পারুলের সম্বিত ফিরলে টের পায় অপরপ্রান্তে সোবহান ফোনের সংযোগ কেটে দিয়েছে। চোখ মুছে রিমনকে কোলে তুলে নেয় পারুল। “ তোর শয়তান বাপের যন্ত্রণায় কী আর শান্তি পাইলাম? গোলামের পুত…আরও কিছু অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে পারুলের খেয়াল থাকে না রিমন বড় বড় চোখ তুলে তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
“ আমার আব্বুরে গালি দিতাছো কেন? আমি বইল্যা দিমু কিন্তু ”। এ কথা বলার পর রিমনের পিঠে অবধারিত ভাবে পারুলের নির্দয় হাতের কয়েকটা কিল এসে পড়ে। একেকটা শুয়োরের বাচ্চারে পেটে ধরছিলাম। বাপটা যেমন জ্বালাইয়া খাইলো, পোলাগুলিও। বলতে বলতে পারুল সোবহানের মোবাইলে আবার ফোনের লাইন ধরতে চেষ্টা করে। শোন, তোর বাপেরে কইবি, আমাগো লাইগা টেকা পাঠাইতে, নাইলে কিন্তু বুঝিস না খাইয়া থাকন লাগবো, স্কুলেও আর পড়তে পারবি না। রিং হইতাছে, নে কথা ক।
এতদিন পর রিমন তার বাবার সাথে কথা বলতে গিয়ে এক অবোধ্য আবেগে পড়ে তার মায়ের গুছিয়ে বলা কথাগুলো ভুলে গেলো। শিশু রিমনের মনের এক রাগের প্রকাশই পেলো সোবহান।
আব্বু, তুমি আমারে ফোন করো না কেন? মোবাইলের স্পীকার অন করা ছিলো ওপাশে সোবহানের কথাগুলিও পারুল স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলো। ইশ কী তেজের কথা!
রিমন তোমার দরকার হইলে তুমি আমারে ফোন দিও। তোমার কী লাগবো তুমি আমারে ফোন কইরা জানাইয়ো। আমি তোমার দাদীর কাছে পাঠাইয়া দিমু। গ্রামে গিয়া নিয়া আসবা।
সোবহানের কথাগুলো পারুলের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিলো। সে রিমনকে শিখিয়ে দিলো বলতে, তোর বাপেরে ক টেকা পাঠাইতে। ফোনের অপরপ্রান্তে পারুলের এই ফিসফিসানি সোবহানের কান এড়ায় না।
না, আব্বু আমি কোথাও যামু না। আমার যা দরকার সব আমারে আমার আম্মুই দিবো বলছে। তুমি আমাদের টাকা পাঠাইয়া দাও।
সোবহানের শুনতে ভীষণ খারাপ লাগছিলো বোধ হয় এসব নিয়ে কথা বলতে। তাই সে বলে –
বাবা, তুমি ছোট মানুষ। এইসব টাকা- পয়সা নিয়া তুমি কথা বইলো না। তোমার কথা বলতে মন চাইলে তুমি আমারে ফোন দিও। আর কেউ যাতে আমারে ফোন না দেয়। তোমার মা’কে বইলো বেশি টাকা টাকা না করতে। তাকে কাজ করে টাকা আনতে বলো।তারপর লোকটা ফোন রেখে দেয়। মানুষের নিষ্ঠুরতার একটা সীমা থাকা দরকার। পারুলকে যে বললো টাকা নিজে কামাই করে নিতে, সে টাকা কামাবে কোথা থেকে। শিক্ষাগত যোগ্যতা তো এইচএসসি পাশ, তাও টেনেটুনে তৃতীয় বিভাগে। সোবহান অনেকদিন বলেছিলো –
ঘরে বইসা তো খালি খাও, ঘুমাও আর বইনগো লগে গল্পগুজব করো। আমিও তো নাই যে আমারে তোমার সময় দেওন লাগে। এই সুযোগে তো পারো ডিগ্রীতে ভর্তি হইয়া যাইতে। প্রাইভেটে পরীক্ষাটা দিয়া ফালাও। পারুলও হাসতে হাসতে বলছিলো –
হ খাইয়া আর কাম নাই, এই বুড়া বয়সে আমি আবার পোলাপাইনগো লগে কলেজে ভর্তি হই গা, মাইনসে হাসবো। আমার পড়ালেখা কইরা কী হইবো, একবারে তো বিয়া পাশই কইরা ফালাইছি। সেসবই এখন অতীত। পারুলের বয়স এখন আটত্রিশ। এই বয়সে এইচএসসি পাশের তৃতীয় শ্রেণীর যোগ্যতা নিয়ে কী কোনো কিন্ডারগার্টেন স্কুলেও কাজ পাওয়া যাবে কিংবা কোনো প্রাইভেট টিউশনির কাজ, পারুল ভেবে তল পায় না। এমনিতেই তার শরীরটা ভালো লাগে না। রাত হলেই বাতের ব্যথা বাড়ে, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা তো আছেই। শরীরটা যেন আরও দুর্বল লাগে তার। আর এতো দুশ্চিন্তার ছাপ এখন পারুলের শরীরের সর্বত্র, চোখের নিচে কালি গভীর হয়ে পড়েছে, মাথার চুলও বয়সের সাথে সাথে কমে গেছে। চুলে শ্যাম্পু করলে চুল একটু ফোলা ফাঁপা দেখালেও সোবহানের গতবার দেশে আসার সময় নিয়ে আসা শ্যাম্পুও শেষের পথে। হিসেব করে করে খরচ করতে হয়। মুখের মেছতার দাগগুলোও যেন আগের চেয়ে বেড়েছে। পারুলের গায়ের রঙটা বেশ উজ্জ্বলই বলা চলে, তাই মেছতার দাগগুলো মোটামুটি স্পষ্ট হয়েই ফুটে থাকে।
বকুল আপাদের বাসায় কাল পরশু যাবে বলে ভাবে পারুল। কয়েকবছর ধরেই আপার কাছে টাকাগুলো ব্যবসায় খাটছে। বছরের হিসাব ধরে বিগত লাভের টাকা গুলো আনতে হবে, না হলে আগামী মাস কতোটা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাবে সেটা ভাবার মতো দুঃসাহস পারুলের হয় না। ইতিমধ্যেই সোবহান পারুলের বড় ভাই রফিককে ফোনে জানিয়ে দিয়েছে সে আর সংসার করতে ইচ্ছুকও না পারুলের সাথে। ভাইয়ের দায়িত্ববোধ থেকে রফিক পুরো ব্যাপারটা জেনেও সোবহানকে প্রশ্ন করেছিলো কী কারণে এতো দ্রুতই সোবহান তার বোনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। প্রত্যুত্তরে সোবহান জানিয়েছিলো –
আরে ভাই, এতো দ্রুত কেমনে কন ? আপনের বইনের সাথে আইজ সতেরো বছরের সংসার আমার। এই সতেরো বছরে তারে আমি ঠিক করতে পারি নাই। তাও মাইন্যাই নিছিলাম কিন্তু আপনার বইন যে মুখ দিয়া আমারে, আমার মা- বাবারে গালি দেয়, তার সাথে এরপর আর সংসার করি কেমনে? তাছাড়া আপনার বইন তো মনে করে সে এখনো যথেষ্ট নায়িকার মতো দেখতে। তার ব্যবস্থা অন্য জায়গায় আপনেরা করতে পারবেন। আর আমার পোলাপানরে আমার কাছে দিয়া দেন।
এরপর রফিক অনেক অনুনয় করেন সোবহানের কাছে। পারুলের হয়ে তিনি ক্ষমা চান। তার বোনকে মেনে নিতে বলেন। আর তিনিও যে দুশ্চিন্তায় পড়ে যাননি পারুলকে নিয়ে তারই বা নিশ্চয়তা কী। তিনি হয়তো ভেবেছেন মানসম্মান খুইয়ে ছোট বোনের স্বামীর কাছে যদি ক্ষমা প্রার্থনা করে হলেও বোনের সংসারটা টেকানো যায়, অন্তত তার ঘাড়ে এসে তো আর বোন আর বোনের দুই বাচ্চার খরচ এসে পড়বে না। আর রফিকের আয়ও তেমন নেই বলতেই চলে। যাও একটা এনজিওতে কাজ করতো সেটাও কোন কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। কপালগুনে ধনী শ্বশুর বাড়ি পেয়ে যাওয়াতে নিজের সংসার খরচ শ্বশুর বাড়ি থেকেই পেয়ে যায়। এই অবস্থায় বোন যদি তার সংসার নিয়ে এসে ওঠে, তাহলে কাঁকনের সাথে তার অশান্তি চরমে পৌঁছাবে। তার বৌ কাঁকন একেবারে শুরু থেকেই রফিকের পরিবারের কাউকে পছন্দ করতে পারেনি। অশিক্ষিত, গেঁয়ো ভূত, কৌশলী কতো কিছুই না রফিককে শুনতে হতো তার বৌয়ের কাছে। তাই রফিকও বরাবর তার মা- বোনদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বেই থেকেছে, কাঁকনকেও রেখেছে।
পারুল বিকেলের দিকে রেডি হয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে যখন বড় বোন বকুলের বাসায় যাবার জন্য দরজায় তালা লাগাচ্ছিলো, সে সময়েই মেজো বোন পান্না দৌড়াতে দৌড়াতে পারুলের বাসায় আসলো। পিছু পিছু বকুল, শাহানাও। তিন বোনকে এমন একসাথে দেখলে পারুলের বুকটাও কোনো অমঙ্গল আশংকায় কেঁপে ওঠে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় তাদের দিকে। কিছুক্ষণ পর বকুলকে জানায় –
তোমাগো বাড়িতেই যাইতাছিলাম। ভালাই হইলো তোমরা আইছো। ঘরে লও। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে ছোট আরেকটা মানিব্যাগ বের করে পাপনের হাতে পঞ্চাশটা টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললো – সিরাজ মিয়ার দোকান থেইকা আলুর চপ, পেঁয়াজি লইয়া আয় সবার লাইগা।
পারুলরে তোর কপাল পুড়ছে! চপ আর পেঁয়াজি খাইয়া কী করবি! মেজো বোন পান্নার কোথা শুনে পাপনের পা যেন নড়ে না। কিন্তু শাহানা তাড়া দিয়ে ওকে দোকানে পাঠালে পারুল ঘরের দরজা খুলে তার বোনদের বসতে দেয়। কী হইছে তোমরা কিছু কইতাছো না কেন ? পারুলের আর্তনাদ যেন ছড়িয়ে পড়ে টিনশেডের এই ঘরখানায়। কীরে শাহানা কী হইছে? কস না কেন !
শাহানায় আর কী কইবো! আইজ তোর জামাই তোরে তালাক নোটিশ পাঠাইছে পান্নার ঠিকানায়। মায় ও বাড়ি থেইকা ফোন কইরা জানাইছে একটা নোটিশ আমাগো বাড়ির ঠিকানায় গিয়া বইলা পৌঁছাইছে আইজ সকালে। পারুলের বোর বোন আয়েশ করে বিছানায় একটা বালিশে হেলান দিয়ে বসতে বসতে বলে। পারুল বিস্ফোরিত চোখে তার বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখের পলক পড়ে না যেন। নাকি আসলে পারুল কিছুই দেখছে না এটাও তাকে দেখে বোঝা যায় না ঠিকমতো। মানুষ কতো নিষ্ঠুর হইলে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে দেখছস? পান্নার প্রশ্নে পারুলের ভাবান্তর হয় না। মাস শেষ হলে বাড়িওয়ালাকে ঘর ভাড়া দিতে হবে এই চিন্তাই পারুলের মাথায় ঘোরপাক খেতে থাকে। বাড়িওয়ালার মূল বাড়ি থেকে পারুলদের টিনশেডের এই দুই রুম, একটু আলাদা করা রান্না ঘর, একটা ছোট আঙিনার মতো এই বাসাটার ভাড়া মাস শেষ হলে সাড়ে পাঁচ হাজার। একটু সবুজের ছোঁয়া আছে বলেই নিচ তলা হলেও সোবহান পছন্দ করে বাসাটা নিয়েছিলো। কিন্তু এলাকাটা শহরের শেষপ্রান্তে বলে বাড়ি ভাড়া তুলনামূলক অন্যান্য জায়গা থেকে কমই।
ঐ ছেমড়ি কথা কস না কেন? পারুলের বড় বোন তার গায়ে মৃদু একটা ধাক্কা মেরে জিজ্ঞেস করে। পারুলের ভাবনার ছেদ পড়লে সে বলে -কী কমু?
কী কইবি মানে? এমন চুপচাপ হাত গুটাইয়া বইয়া থাকলে হইবো নি? সোবহানের এতো বড় সাহস হইলো কই থিকা তোরে তালাক দেয়। টুকটাক ঝামেলা সব সংসারেই থাকে। তাই বইলা তালাকের নোটিশ পাঠাইয়া দিবো? নিশ্চয়ই তোর জামাইয়ের মাথায় এইসব বুদ্ধি কেউ ঢুকাইছে, নাইলে এতো বছরে তো দেহি নাই রাও পারতে।
এইসব কে আর ঢুকাইবো বুবু, বুঝো না? নিশ্চয়ই পাপনের ফুপুর কাম, পান্না ফোড়ন কেটে বলে।
দুলাভাই যে বিদেশে থাইক্যা কারো লগে আকাম কুকাম করে না তারই বা গ্যারান্টি কী! শাহানা আরেক ধাপ এগিয়ে এসব বলে পারুলের সবকিছু কেমন এলোমেলো করে দেয়।
ঐ চুপ থাক তুই। শাহানাকে ধমকে বলে ওঠে ওর বড় বোন বকুল । বুদ্ধি বাইর করন লাগবো এই ব্যাটারে কেমনে চিপা দিয়া ধইরা টেকা আদায় করন যায়। এমনে এমনেই পারুলের জামাইরে ছাইড়া দিমুনি আমরা? শুন সোবহান যে তোরে তালাকের নোটিশ দিছে এইগুলি নিয়া ওগো বাড়ির কারো লগে কিছু কইস না, দেখ আগে ওরা কিছু জানায় নাকি। আর কেউ কিছু কইলে ওর চরিত্র নিয়া কথা তুলবি। ওগো গ্রামের একটা মাইয়া আছে না, কী জানি নাম – রাহিমা মনে হয়। ঐ ছেমড়ি যে এহনো আবিয়াইত্তা আর হেইডার কারণ সোবহান পারলে এই বদনাম তুইল্যা গ্রামে ছড়াইয়া দিবি। এতো সহজে আমাগো বইনেরে ছাইড়া দিবো এইটা আমরা হইতে দিমু না, কী কস তোরা? বলে বকুল তার অন্যান্য বোনদের দিকে সমর্থনের আশায় তাকায়। আর আমাগো পারুলরে ছাড়তে হইলে তার পোলাপাইনের খোরপোশ, এক কালীন টেকা আর দেনমোহরের পুরা টেকা শোধ দেওন লাগবো। আছে নি হেই মুরোদ ফকিরা ব্যাটার ? কী রে কথা কস না কেন পারুল। আমরা থাকতে তোর চিন্তা কীয়ের?
বকুলের নিশ্চয়তায়ও পারুলের দুশ্চিন্তা কমে না। দেনমোহরের পুরো টাকাই সোবহান বিয়ের দিনই যে শোধ করে দিয়েছিলো এই হট্টগোলে সেটা মনে পড়লেও সে আর এটা নিয়ে কথা তোলে না তার বোনদের কাছে। বাস্তব যে কী কঠিন সেটা পারুল এখন হাড়ে হাড়েই টের পাচ্ছে। তার বোনদের সংসারে খরচের বহরের সাথে নিজের সংসারের তুলনা দিতে গিয়েই তো আজ তার এই অবস্থা। খুব তো বলেছিলো বকুল আপা, তোগো মা-পুতের সংসার চালাইতে কয় টেকা আর লাগবো! লইয়া যাইস বিশ হাজার টেকা প্রতি মাসে। এটা যে শুধু কথার কথা ছিলো না সেটা সে সময়ে বিশ্বাস করলেও এখন আর সে কথায় পারুল ভরসা খুঁজে পায় না। গতমাসেই একবার ইঙ্গিত দিয়েছিলো –
তুমি না কইছিলা পাপনের বাপে খরচ না পাঠাইলে তুমি সাহায্য করবা, ভুইল্যা গেলা নি? এই কথায় তার বড় বোন হেসেই খুন।
আরে তোর টেকা লাগলে নিবি, সমস্যা কী? দরকারে আমার বাইত্তে আইসা থাক না, সমস্যা কী! কিন্তু আপার ঐ বলা পর্যন্তই। কয়দিন পরেই জানিয়েছিলো তার শাশুড়ি এসেছে বাসায়। কয়েক মাস থাকবে। তার ছেলের পরীক্ষা, বাসায় আবার কাজের মানুষ নাই, ছুটিতে গেছে ইত্যাদি নানান কাহিনী। এরপর পারুলের আর বুঝতে থাকেনি বিপদে পড়লে কেউই কারো না। কিন্তু এই পারুল কী কম করেছে তার বোনদের জন্য? তার দুলাভাইয়ের বিদেশে যাবার টাকার অর্ধেক তো সোবহানের কাছ থেকেই নিয়েছিলো। আর মেজো বোন পান্না, তার জন্যও কী কিছু করেনি পারুল? তার বাচ্চা হবার ডেলিভারির খরচ সব পারুল দিয়েছিলো সোবহানকে না জানিয়ে। পান্নার স্বামীর যখন চাকুরী ছিলো না তখন ওদের চার মাসের সংসার খরচ, ছোট বোনের বিয়েতে কানের গয়নাটা পারুলই দিয়েছিলো। তবে সে খবরটা সোবহানকে জানিয়েই করেছিলো। কিন্তু আজ কেউ কী এগিয়ে আসবে পারুলের এই বিপদে? নাকি সব বোনেরা আহা উহু করেই পালিয়ে যাবে, সে দুশ্চিন্তা কিছুতেই পারুলের মাথা থেকে যায় না। এর মাঝে শাহানাই পাপনের আনা আলুর চপ, আর পেঁয়াজি প্লেটে ঢেলে খাওয়া শুরু করেছে। রিমনটা সস দিয়ে খাবে বলে বায়না করছে। উফফ এ সব কিছুই পারুলের কাছে অসহ্য লাগতে থাকে। এদিকে বিপদের শেষ নেই আর তার বোনেরা আছে খাওয়া দাওয়া নিয়ে।
কী করে পারুল, চা চু কিছু খাওয়াবি না নাকি? মেজো বোনের আবদার শুনে মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে পারুলের। ঢং, নিজের বাসায় গিয়া চা বানাইয়া খাও গা। কিন্তু এই কথা পারুলের গলার কাছে এসেই মিলিয়ে যায়, বলা হয় না।
হ চা পাতা আছে। কিন্তু দুধ নাই। রঙ চা খাইতে হইবো। বলেও পারুল রান্না ঘরে যাবার প্রতি আগ্রহ দেখায় না। ঝিম মেরে বসেই থাকে বিছানায়।আপা, আমার যে টেকাগুলা তোমার ব্যবসায় লাগাইছো, অইখান থেইকা তো লাভের মুখও দেখলাম না। সামনের মাসের ঘর ভাড়া দেওন লাগবো। বাসায় গিয়া তোমার পোলার হাতে দশ হাজার টেকা পাঠাইয়া দিও, আমি এর লাইগ্যাই বিকালে তোমার বাসায় যাইতে নিছিলাম, বলে পারুল তার বোনের দিকে তাকায়। পারুলের কথায় বকুল খাওয়া থামিয়ে ওর দিকে তাকায়। হঠাৎ করেই প্রসঙ্গটা পারুল তোলাতে তার বোন একটু থমকে যায় ঠিকই কিন্তু সাথে সাথেই বলে –
হ, আজকাই তো কইলি। টেকা তো আর লগে লগে থাকে না। দেহি ব্যবস্থা কইরা তোরে জানামুনে।
না, আজকাই দেওন লাগবো। আর কয়দিন পরেই ভাড়া দেওন লাগবো। ঘরে বাজারও বাড়ন্ত। পারুল এমন ভাবে তার অভাবের বয়ান দিতে থাকে যে এই দশ হাজার টাকাতেই বুঝি ওর সারাজীবনের অভাব দূর হয়ে যাবে। কিন্তু পারুলের আকুলতা, প্রয়োজনের সাথে পাল্লা দিয়ে দিয়ে বকুল বোধহয় পেরে ওঠে না,তাই সে উশখুশ করতে থাকে। অকারণেই পান্নাকে বলে, কী রে বাড়ি যাবি না। এইবার ওঠ। বাইত্তে গিয়া তো রান্ধন বাড়ন আছে। সে কথা শুনে পান্না, শাহানা তারাও উঠে দাঁড়ায়। এই মুহূর্তেই যেন তাদেরও মনে পড়ে যায় বাড়িতে তারাও অনেক কাজ ফেলে এসেছে। বলা তো যায় না কখন না পারুল তাদের কাছেও আবার হাত পেতে বসে। কিন্তু পারুলের মাঝে আর কোনো অস্থিরতা দেখা যায় না। বোনদের বাড়ির মূল দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেবার ব্যাপারেও আজ যেন তার চরম উদাসীনতা অথচ অন্যান্য দিন হলে সে তাদের বিদায় দিতে গিয়ে একেবারে গলি ছেড়ে মেইন রাস্তায়ও চলে আসতো। আজ যেন সে কথা সবাইই বিস্মৃত হয়েছে। পারুল তার পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মেঝেতে একমনে আঙুল ঘষতে থাকে।

পারুল তার বোনদের বিদায় দেবার পর ঘরের টুকটাক কাজ সেরে ছেলেদের খাইয়ে-দাইয়ে বিছানায় পাঠিয়ে দেয় ঘুমাবার জন্য। কিন্তু আজ রাতে তার আর ঘুম আসে না। তার চারদিকে যেন অভাবের প্রচণ্ড শব্দ ঝনঝনিয়ে উঠতে থাকে। পুরো ঘর জুড়ে তাদের দীর্ঘশ্বাস, এলোমেলো পায়চারীতে পারুল ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠতে থাকে। পারুলের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, ফ্যানের বাতাসও অপর্যাপ্ত মনে হয়। জানালাটা খোলাই আছে। ফ্যানের বাতাসে পর্দাটা একেক সময় সরে গিয়ে খোলা আকাশটাকে দৃশ্যায়মান করে দিচ্ছে। বাইরে অন্ধকারটা কেমন ঘন, প্রাণহীন লাগে। গভীর করে শ্বাস টেনে নেয় পারুল। নিজের কৃতকর্মের জন্য তার কী দুঃখবোধ হচ্ছে কিনা সে নিজেও যথেষ্ট নিশ্চিত হতে পারে না। সোবহানের জন্যও গভীর কোনো দুঃখবোধ পারুলের আসে না, একই সাথে অনেক কিছুই তার মাঝে খেলা করে। মাস শেষে বাড়ি ভাড়া, বাজার খরচ, দুটো জামার অর্ডার দিয়েছিলো সেগুলির টাকা, ছেলেদের কোচিং এর টাকা, মুখে মাখার ক্রীম, আসন্ন শীত উপলক্ষ্যে ঘরের সবার জন্য গরম কাপড়, তার মায়ের জন্য সোয়েটার, মোজা আরও কতো কতো খরচ। এক ফাঁকে শাহানার বলা কথাও মনে পড়ে, এইখানে খরচে না কুলাইতে পারলে জিনিসপত্র বেইচ্যা মায়ের বাড়িতে যাও গা, এইটাই ভালো। মায়ের বাড়িতে যেতে হলেও পারুলকে বর্ষাকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নৌকায় মালামাল নেয়ার খরচ কম এটাও এই দুঃসময়ে সে বিস্মৃত হয়নি। রঙচঙে শাড়ি পড়ে, ঠোঁটে কড়া করে লিপিস্টিক দিয়ে খালাতো ভাই ফারুকের সাথে কবে, কোনদিন ঘুরতে গিয়েছিলো সেটাও এক লহমায় তার স্মৃতিতে খেলে যায়। সেই ফেলে আসা একটা ক্ষণিকের সুখস্মৃতি এই গভীর রাতেও তার মনে একটা সুখের দোলা দেয়। কিন্তু পাশপাশি এসব ভাবতে ভাবতে পারুলের যন্ত্রণা বাড়ে , কানে বাজতে থাকে সোবহানের কণ্ঠস্বর –
আইচ্ছা, আমরা যদি একটু গরীব থাকি সমস্যা কী! পেট ভইরা খাইতে পারলেই তো হয়। এতো বড়লোক হওনের দরকার কী!
আসলেই তো লোকটা ঠিক বলেছিলো। খেয়েপরে থাকতে পারলেই তো হয়। এইতো জীবন, এইতো সুখ! পর্দার ফাঁক দিয়ে খোলা আকাশ যেন একরাশ অন্ধকার পারুলের ঘরে প্রবেশ করিয়ে দেয় এই মাঝরাতে। চারদিকের ঘুটঘুটে অন্ধকার একটা সময় যেন তার বুকের ভেতরেই ঢুকে যায় গুমগুম বিকট শব্দ করতে করতে।

সমাপ্ত

পরিচয়: অপর্ণা মিতু


মন্তব্য

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

ছুটি কাটাচ্ছি শ্বশুরবাড়িতে। মোবাইল থেকে ব্লগে ঢোকা ঝামেলা, তাছাড়া পিঠাপায়েস খেয়ে লেখা-পড়া বন্ধ। কিন্তু এক ই দিনে তোমার দু গল্প সচলে অাসার অানন্দে লগইন করলাম। দীর্ঘ সাত বছরের গ্যাপে লেখার জগতে অাসার পর তুমি অামার অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিলে। তাই তোমার অাজকের অানন্দের অংশীদার হতে পেরে ভাল লাগছে। সচলের প্লাটফরম খুব মার্জিত। অাশা করি পথচলা সুন্দর হবে অার তুমিও তাড়াতাড়ি সচল হবে।
লেখা নিয়ে বলি এখন। অামার বন্ধু বলে তোমার লেখা শুধু ভাল বলবো এত ক্ষতিকারক চাটুকার অামি না তুমি জানো। কারণ তোমার লেখায় ভুল অামিই বেশি ধরি। সম্ভবত পুরুষ থেকে বের হয়ে এ টা তোমার প্রথম গল্প লেখার চেষ্টা ছিল। গল্পের প্রেক্ষাপট পরিচিত তবু পারুলদের গল্প কথন ফুরায় না। ব্লগে দীর্ঘ গল্প অনেক পাঠকের ধৈর্যচু্যতি ঘটায় তবু অামরা যারা গল্পভূক তারা সব চেটেপুটে পড়ে নেই। ফিরছি অারো দুদিন পরে। কথা হবে।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক এর ছবি

মোবাইল থেকে বাংলা লেখা আমার খুব ঝামেলা লাগে। এই গল্পটা পোস্ট দিয়েছিলাম প্রায় সপ্তাহ দুয়েক লাগে।ভেবেছিলাম আর আসবে না বোধহয়। একই দিনে দুইটা পোস্ট আসাতে নিজেই বিব্রত হচ্ছি।যদিও আমার এখানে কিছু করার নেই।
লেখালেখি করে এটা আমার দ্বিতীয় সম্মানি যা এই গল্প লিখে তোমার কাছে পেয়েছি। তুমিও আমার অনুপ্রেরণা লেখালেখির জগতে।
ভালো থেকো।

মাসুদ সজীব এর ছবি

প্রথম লেখায় অভিনন্দন। হাসি

(১) প্যারা করে না দিলে পড়ার ধৈর্য্য থাকে না কিংবা পড়তে কষ্ট হয়, আগামীতে এই দিকটা খেয়াল রাখবেন আশা করি।

(২) গল্পের প্লট পরিচিত, পরিণতি পূর্ব অনুমিত হলেও গল্পের মাঝে যে হাহাকারবোধ জাগ্রত করতে পেরেছেন তাতেই আপনার গল্প অনেকাংশে সফল। আশাকরি বিষয় নির্বাচনে আরেকটু নীরাক্ষাধর্মী হবেন, তাহলে আপনার থেকে আরো অনেকগুলো ভালো গল্প পাবো। শুভেচ্ছা

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

অতিথি লেখক এর ছবি

প্যারা করাই ছিল তবে স্পেস দেয়াটা জরুরী ছিল। আশা করছি পরবর্তীতে ঠিক হয়ে যাবে।
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। শুভকামনা আপনার জন্যও।

অপর্ণা মিতু

মেঘলা মানুষ এর ছবি

কঠোর সমালোচনার জন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমার কথাগুলো সাধারণ পাঠকের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই নেবেন আশা করি।

কাহিনী গতনুগতিক লেগেছে। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অনেক বেশি সংলাপ/ বর্ণনা গল্পটাকে লম্বা করেছে।
পারুলের সাথে তার বোনদের সম্পর্কের ইতিবৃত্ত পড়তে পড়তে একসময় গল্প পড়ে শেষ করার আগ্রহই হারিয়ে যাচ্ছিল।

গল্পের মূল বক্তব্য আছে কিনা সেটাও বুঝতে পারছি না।
পারুলের স্বামী সোব‌হানকে অতিরিক্ত 'টাইপড' লেগেছে।
সোব‌হান 'কন্ট্রোলফ্রিক', তবুও তার প্রায় প্রতিটা কাজকে যুক্তিযুক্ত বলে দেখানোর একটা প্রবণতা ছিল গল্পে।এক কথায় সোব‌হান টাকাপয়সা নিয়ে পারুলকে একরকমের মানসিক পীড়ন করেছে পুরো গল্পে। অথচ, শেষের "আইচ্ছা, আমরা যদি একটু গরীব থাকি সমস্যা কী! পেট ভইরা খাইতে পারলেই তো হয়। এতো বড়লোক হওনের দরকার কী! আসলেই তো লোকটা ঠিক বলেছিলো।"‌ ‌ -এই ধরণের কথা সোব‌হানকে আরও মহৎ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। অথচ, সে স্ত্রী-ছেলেদের দুইমাসের খরচ পাঠায় নি।

"স্বামীর কথামত চল নাই, এখন ধরা খাও" এরকম একটা জিনিসই কেবল মাথায় এসেছে গল্পের শেষে।
লেখক যদি পুরুষ হতেন তবে এই লেখাটাকে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার একটা প্রকাশ বলা যেত।

সমালোচনা করার জন্য আবার দুঃখপ্রকাশ করছি। আশা করছি ব্যক্তি আক্রমণ হিসেবে নেন নি।
লেখক-পাঠকের আলোচনার সুযোগ থাকাটাই তো ব্লগের মজা!

আপনার কাছ থেকে আরও ভালো ভালো লেখার প্রত্যাশা থাকল।

ভাল থাকুন, শুভেচ্ছা হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

মেঘলা মানুষ, আপনার মন্তব্যকে ব্যক্তি আক্রমন হিসেবে দেখার প্রশ্নই আসে না। খুব স্বাভাবিকভাবেই দেখছি। পাঠক-লেখকের আলোচনা করার সুযোগ থাকলে কেন সেটা কাজে লাগানো হবে না।

অফটপিকে একটা ব্যাপার বলি, আমি উত্তম পুরুষে লিখতে লিখতে টাইপড হয়ে যাচ্ছিলাম। তাই নামপুরুষে লেখাটা আমার জন্য একটা পরীক্ষা ছিল সচল বন্ধু সাদিয়ার কাছে। আর সংক্ষেপে লিখতে গেলেও সেটা কীভাবে যেন দীর্ঘ হয়ে যায়।

আপনার মন্তব্যটা সত্যিকারের পারুল আর সোবহানকে দেখাতে পারলে ভালো লাগতো। ঘটে যাওয়া ঘটনাটাই তুলে ধরেছি মাত্র। আশেপাশেই কিছু " সোবহান" আছে যারা নিজেদেরকে সবসময় " পারফেক্ট" ভাবে এবং তাদের মতের বাইরে গেলে তারা কোনোকিছুই স্বাভাবিকভাবে হজম করতে পারে না যে কারণে পারুলের এই পরিণতি । তবে দাম্পত্য সম্পর্কে মিথ্যে একটা বিশাল ইস্যু, যা নিয়ে সাবধান থাকা উচিত।
নারী বা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা আসলে উদ্দেশ্য ছিলো না।

আপনিও ভালো থাকবেন। আপনার ব্লগ ঘুরে দেখবো একটু সময় পেলেই। শুভকামনা রইলো।

অপর্ণা মিতু

মেঘলা মানুষ এর ছবি

চলুক

মেঘলা মানুষ এর ছবি

এর সাথে ৯৫% ভাগ মিল আছে এমন একটা পরিবারকে আমিও চিনতাম। ভদ্রমহিলা নিজেও ব্যাংকে চাকরি করতেন, স্বামী প্রবাসী। বোনের পরিবারে কিছু টাকা বিনিয়োগ করার পরে নানা ঘটনা ঘটে এবং ঘটনা তালাক অবধি গড়ায়। পুরো সমাজ মোটামুটিভাবে স্বামীর পক্ষ নেয় - যে সে ঠিক কাজই করেছে।

আমাদের সমাজে পুরুষের আয়কে তার নিজের সম্পত্তি হিসেব গণ্য করার প্রবণতা আছে। অথচ, স্ত্রীরও যে সেখানে অধিকার আছে সেটা সমাজ (এমনকি অনেক নারীও) মেনে নিত প্রস্তুত না। পারুল যদি তার বাবা-মাকে সাহায্য করে সেখানে সোব‌হানের বাগড়া দেবার কিছু নেই। টাকা সোব‌হান আয় করলেও সেই টাকা থেকে পারুলের অধিকার আছে নিজের বাবা-মাকে সাহায্য
করার।

আপনার গল্পের বকুল আপাকে 'অসৎ' হিসেবে চিহ্নিত করাই যথেষ্ঠ ছিল। তাকে পরপুরুষের উপর আগ্রহী দেখিয়ে সোব‌হানকে আরেকদফা 'চরিত্রবান' হিসেবে উপস্থাপন করাটাও ভালো লাগে নি।

এরকম ঘটনা যে বাস্তবে ঘটে, সেটা আমি ও দেখেছি। তবে, একই ঘটনা দেখার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা আলাদা হতেই পারে।
ভালো থাকুন, আরও লিখুন।

শুভেচ্ছা হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

নারীদেরও যে স্বামীর উপার্জনে একটা অধিকার থাকে সেটা নারীমাত্রই বুঝবেন। আপনার মতব্য পড়ে ভালো লাগে যে আপনি খুব খুব সুন্দর করে যুক্তি উপস্থাপন করেন।

আপনি যে ভাবে দেখছেন সেভাবে যে আমিও ভাবিনি সেটা নয়। সোবহানকে চরিত্রবান দেখানর পেছনে কিছু হাস্যকর কারণ ছিলো যা বলতে চাচ্ছি না। ঐ যে বলেছিলাম না সত্যিকার সোবহান আর পারুল যদি এগুলি দেখত আর পড়ত!

আপনিও ভালো থাকুন।

মরুদ্যান এর ছবি

গল্প শেষ করতে পারিনাই, তার আগেই আগ্রহ শেষ।

লেখা চলুক। চলুক

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি তেমন ভালো লিখিয়ে নই, তাই হয় আগ্রহ চলে গেছে। হাসি
শুভকামনা রইলো।

অপর্ণা মিতু

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।