কেমন করে এ নাম হল কেউ জানে না। এটা কিন্তু নিছক আদর বা ওরকম কিছুর নাম নয়। উনাকে জিজ্ঞেস করলে বৃদ্ধা মিটমিট করে হাসেন। পায়েলের মা অবশ্য বলেন, আম্মা যখন সুস্থ ছিলেন তখন নাকি বেশ ভাল ম্যাজিক দেখাতে পারতেন। সে কারণেই সবাই তাকে এ নাম দিয়েছিল। তিনি ম্যাজিক শিখেছিলেন তার বড় ভাইয়ের কাছে। উনি ছিলেন শখের যাদুকর। পায়েলের নানুমণি হাত সাফাইয়ের ম্যাজিক প্রাকটিস করে করে এমন দক্ষ হয়ে গিয়েছিলেন যে তার বড় ভাইয়ের থেকেও হাত সাফাইটা তিনি ভাল করতে পারতেন। আজকাল অবশ্য দেখেন না একদমই। সামনেই একটা চোখের অপারেশন করতে হবে। ডাক্তার নাকি বলেছেন, ডায়াবেটিকসটা কন্ট্রোলে আসলেই নাকি অপারেশন হবে।
পায়েল অবশ্য এতকিছু বোঝে না। সে চায় তার নানুমণি আবার সুস্থ হয়ে যাক। খুব ছোটবেলায় নানুমণি তাকে ম্যাজিক দেখাতেন। বলতেন, বড় হলে তাকেও শিখিয়ে দেবেন। সে এখন অনেক বড় হয়েছে। সামনের বছরই টেনে উঠবে। সবাই তার নানুমণিকে যাদুমণি ডাকলেও সে কেন যেন এ নামে ডাকে না। সত্যি কথা বলতে, নামটা তার পছন্দ নয়।
বৃদ্ধা থাকেন পায়েলের বড়মামার সংসারে। ওটাকেই পায়েল নানুবাড়ি বলে জানে। একটা সময় পুরো বাড়িটার প্রাণ ছিলেন তিনি। এখন অবশ্য তার ঘরটা ছাড়া কোথাও তাকে পাওয়া যায় না। শরীর খুব দুর্বল হয়ে গিয়েছে তার। বিছানা থেকে নেমে বাথরুম আর বাথরুম থেকে বিছানা এর মাঝেই চলাচল তার। নামায পড়েন বিছানায় বসে। আগে খুব সুরেলা কন্ঠে কোরান পড়তেন। পাড়ার অশিক্ষিত দরিদ্র মহিলাগুলো তার কাছে আসতো। এখন কিছুই দেখেন না।
দৃষ্টি ঘোলা হয়ে গিয়েছে তার।
তিনি সামনে দেখেন কেমন একটা আলো-অন্ধকার। মাঝে মাঝে সেটা নড়ে উঠলে বুঝতে পারেন কেউ তার সামনে এসেছে। তিনি জানালার পাশে বসে থাকেন। আকাশের দিকে চেয়ে থাকেন। অসম্ভব প্রিয় আকাশটা আর তার চোখে ধরা দেয় না।
অদ্ভুত একটা জীবন। যেন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা।
তার দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে আজাদের সংসারেই তিনি থাকেন , ওর দুইটা ছেলে দাদীকে ভীষণ ভালোবাসে। পাশের খাটে ওরা দুই ভাই ঘুমায়। মাঝে মাঝে তার ঘরে তারা মারামারি লাফালাফি করে আর তিনি চেঁচাতে থাকেন, “তোরা খুব বেড়ে গেছিস। আজাদ আসুক, তোদের শিক্ষা দেবো। হতচ্ছাড়া কোথাকার !” ছেলে দু’টা আরো মজা পায়। আরও বেশি দুষ্টামি করতে থাকে।
মেয়ে স্বপ্না থাকে শহরের উল্টোদিকে। প্রায়ই পায়েল আর প্রীয়মকে নিয়ে দেখতে আসে। পায়েল তার বড় নাতনী। একে কোলেপিঠে তিনি মানুষ করেছেন বলে এই মেয়েটার প্রতি টান তার বেশিই বলতে গেলে। ছোট ছেলে বিদেশে থাকে। মাঝে মাঝে ফোনে কথা-বার্তা হয়। ওখানে এক বিদেশীকে বিয়ে করে থিতু হয়েছে। সবাই বলে, আসাদের নাকি পুতুলের মত দুইটা বাচ্চা। একটা ছেলে একটা মেয়ে। খুব সুন্দর নাকি দেখতে। তিনি অবশ্য দেখতে পান না। মাঝে মাঝে ওরা তাকে হ্যালো বলে ভিডিও কলিংয়ে। তিনি বুঝতে পারেন, ঐ প্রান্তে হয়তো কিছু সুন্দর সুন্দর মুখ তাকে দেখছে। অথচ তিনি দেখতে পাচ্ছেন না।
তার কেমন যেন লজ্জা লজ্জা করে।
তিনি পুরোটা সময় জানালার পাশে বসে বসে পুরোনো দিনের কথা ভাবেন। কেউ আসলে তার সাথে কথা বলেন। অনেক স্মৃতি মনে পড়ে তার। স্বপ্নার আব্বার কথাও মনে পড়ে। মনে পড়ে তার শ্বশুরবাড়ির কথা।
তিনি মারা গিয়েছেন প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে। অথচ এখনও তার স্মৃতি তাকে কাতর করে দেয়। শ্বশুরের কথা ভেবে চোখের পানি ফেলেন। আব্বাজানের কোন মেয়ে ছিল না। তাকে তাই নিজের মেয়ের মত আদর করতেন। স্বপ্নার আব্বার ম্যাজিকে তেমন আগ্রহ নেই। বৌ সবাই ম্যাজিক দেখায় এটা তার ভালো লাগতো না। মুখে না বললেও ঠিকই বোঝা যেত । কিন্তু শ্বশুর হয়েও আব্বাজান তাকে খুব উৎসাহ দিতো। বলতেন, “কোটে পাইবেন এমুন মাইয়া বাহে? মোর বেটিকনা কি সোন্দর যাদু দেখাইবার পারে !” তিনি শহর থেকে তার বৌমার জন্য টুকটাক ম্যাজিকের জিনিসপাতি নিয়ে আসতেন। তার নিজেরও শেখার ইচ্ছা ছিল খুব। স্বপ্নার বাবা এটা নিয়ে তাকে কত কথাই যে শুনিয়েছেন !
এসব ভেবে তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ে।
স্বপ্নার আব্বার ম্যাজিকে আগ্রহ না থাকলেও ভ্রমণের নেশা ছিল খুব। প্রায়ই কোন বন্ধুকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়তেন। আসতে আসতে হয়তো এক-দুই মাসও পার হয়ে যেত। এ জন্যই আব্বাজান তাকে সঙ্গ দিতেন। একবার কোথা থেকে জানি তার জন্য একটা খুব সুন্দর হার নিয়ে এসেছিলেন। আজও হারটা তার কাছে আছে। তিনি যত্ন করে রেখে দিয়েছেন। স্বপ্নার আব্বা ঠাট্টা করে বলেছিলেন নাতনীর বিয়েতে দিতে। তিনি সেই কথা মনে রেখে আজও ওটা নিয়ে রেখে দিয়েছেন, পায়েলের বিয়েতে দিবেন বলে।
একবার তাকে নিয়ে স্বপ্নার আব্বা বেড়াতে গিয়েছিলেন একটা পাহাড়ি জায়গায়। তিনি আজও মনে করতে পারেন সেই সব দিনগুলোর কথা। একটা চমৎকার বাংলোয় তারা উঠেছিলেন। বাংলোটা ছিল উনার বন্ধুর। একটা পাহাড়ের উপর বাংলোটা । কি সুন্দর ! সেখান দাঁড়িয়ে যেন আকাশের মেঘও ছুঁয়ে দেখা যায়। যে আকাশটাকে তিনি সারাজীবন ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলেন এই পাহাড়ে এসে মনে হচ্ছিল তাকে ধরা দিয়েছে। আনন্দে তার চোখ ভিজে উঠছিল। স্বপ্নার বাবার হাত ধরে অনেকক্ষণ ঐ জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।
তবে এই স্মৃতিটা অম্লান হয়ে আছে এগুলো ছাড়াও, শুধুমাত্র একটা গন্ধের জন্য।
হ্যাঁ, একটা গন্ধ। পাহাড়ি ফুলের গন্ধ।
যে গন্ধ শুনে আজ থেকে প্রায় বাষট্টি-তেষট্টি বছর আগে এক বৃষ্টি ভেজা ভোরবেলায় তিনি মাতাল হয়ে গিয়েছিলেন। তার পাশের ঘুমন্ত পুরুষকে এত আপন মনে হচ্ছিল যেটা আর কখনই লাগেনি। সেই গন্ধে তিনি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। সব কিছুই তার মিথ্যা মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এই পৃথিবীতে তারা দুজনই শুধু সত্য, আর ঐ গন্ধটা যেন সেই সত্যকে সুন্দর করেছে। তিনি নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন যখন, মনে হচ্ছিল বায়ুতে সেই গন্ধটা মিশে তার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। তার অন্তরকে পুণ্য করে দিচ্ছে।
গন্ধটা আসছিল বিছানার পাশের খোলা জানালা থেকে। বৃষ্টির ছাটে কাল রাতে তারা দুজন মাখামাখি হয়ে গিয়েছিলেন, তবুও জানালা বন্ধ করেন নি। সেই জানালাটা দিয়ে শুধু আকাশটা দেখা যাচ্ছে এখন। ভোরের আকাশে মেঘের আনাগোনা ছিল ভীষণ। জানালার পাশে হয়তো কোন গাছে ফুল ফুটেছিল। সেই পাহাড়ি ফুলের গন্ধই তার মন জুড়িয়ে দিয়েছে। তার তখন খুব ইচ্ছে করছিল সেই পাহাড়ি ফুলটা দেখতে। কিন্তু অদ্ভুত এক মাদকতায়, একটা লজ্জা পাওয়া আলস্যে তার শরীর ডুবে গিয়েছে। তাকে জড়িয়ে ধরা ঘুমন্ত এই পুরুষটিকে ছেড়ে তিনি বিছানা থেকে নামতে পারলেন না একদম। তিনি নিঃশ্বাসের সাথে সেই গন্ধটা শুধু নিতে লাগলেন।
আস্তে আস্তে তিনি আবার ঘুমিয়ে পড়লেন।
যখন ঘুম থেকে উঠলেন তখন বেলা হয়ে গিয়েছে। সেদিনই ছিল সেখানে তাদের শেষ দিন। ঘুম থেকে উঠে ব্যস্ততার সাথে তিনি রেডি হতে থাকলেন।
ভোরের সেই ফুলের গন্ধ তার মনে থাকল না।
মনে পড়ল যখন তিনি ট্রেনে করে সেই পাহাড়ি জায়গাটা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছেন। চরম অতৃপ্তিতে তিনি কাতর হয়ে উঠলেন। উনাকে জিজ্ঞেস করলেন পাহাড়ি ফুলের কথা। উনি যুতসই উত্তর দিতে পারলেন না। তিনি ব্যাকুল হয়ে গেলেম ফুলটাকে জানার জন্য, সেই পাহাড়ি ফুলের অদ্ভুত গন্ধটা আরেক বার নেওয়ার জন্য।
আজও প্রায়ই তার সে গন্ধটার কথা মনে হয়। মনে হয় আরেকবার যদি ঐ গন্ধটা নিতে পারতেন ! প্রায়ই ভাবেন, তবে কাউকে বলতে পারেন না। এই গন্ধটা তার ব্যক্তিগত হয়ে গিয়েছে, এটা গোপন করার মাঝে একটা সুখ খুঁজে পান।
তার জীবন এভাবেই কাটে।
পরের মাসে তার চোখের অপারেশন হল। তিনি আস্তে আস্তে দেখতে শুরু করলেন। তবে বেশিক্ষণ না। চোখ দিয়ে অতিমাত্রায় পানি পড়ে । ডাক্তার তাকে কাল চশমা দিয়েছেন। বলেছেন এক মাসের মধ্যে চোখ স্বাভাবিক হলে পাওয়ার চশমা দেবেন। তখন তিনি শুধু দেখতেই পাবেন না, পড়তেও পাবেন।
তিনি কোরান পড়ার জন্য মুখিয়ে আছেন। আল্লাহ্র কাছে শুকরিয়া করতে হবে।
এতদিন পর তিনি দেখতে পাচ্ছেন বলে বেশ একটা হইচই পড়ে গেল। তিনি প্রায় সাত- আট বছর পর দেখছেন। নাতি নাতনিরা আসে আর বলে, “যাদুমণি বল তো আমি কে?” তিনি চিনতে পারলেও ইচ্ছে করে ভুল বলেন, ওরা আরও বেশি খুশি হয়।
এর মধ্যে তার মেয়ে স্বপ্না তাকে তার বাসায় নিয়ে গেল। আম্মা তার ওখানে কিছুদিন থাকবেন। পায়েল আর প্রীয়মের খুশি আর ধরে না। পায়েল তাকে তার ঘরে নিয়ে গেল। পায়লের ঘরের পাশেই একটা বাগান। ওর বিছানার পাশে জানালা দিয়ে বাগানটা দেখা যায়। পায়েল নিজেই নাকি করেছে। তিনি কথা দিলেন কাল সকালে অবশ্যই বাগান দেখতে যাবেন। তার শরীর দুর্বল জন্য স্বপ্না একটা হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করেছেন। প্রীয়মের কাজ হবে উনি কোথায় যেতে চান সেখানে নিয়ে যাওয়া। প্রীয়ম সানন্দে রাজী হল। তিনি পায়েলের ঘরে গেলেন বিশ্রামের জন্য। তার শরীর দুর্বল হয়ে গেলেও তিনিও বেশ আনন্দ পাচ্ছিলেন।
তার মনে হল এই পৃথিবীটা যেন আরও রঙ্গিন হয়ে উঠেছে। হুট করে স্বপ্নার বাবার কথা তার মনে পড়ল, সবাইকে নতুন করে যেভাবে দেখছেন তাকেও যদি দেখতে পেতেন !
রাতে স্বপ্নার সাথে ঘুমিয়ে পড়লেন। তার এই নাতনিটার সাথে অনেকদিন পর প্রাণ খুলে গল্প করলেন । মনে হল, তিনিও একটা কিশোরী হয়ে গিয়েছেন। তিনি পায়েলকে কথা দিলেন ওকেও ম্যাজিক শেখাবেন।
অনেকদিন পর তার একটা গাঢ় ঘুম হল।
তার ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। পায়েল তার পাশে ঘুমিয়ে আছে। হুট করে একটা গন্ধ তার নাকে এসে লাগলো। সেই গন্ধটা ! এতদিন পরও ঠিকই চিনে নিলেন সেই গন্ধটা। আজও ঠিক তেমনই আছে। সেই মাদকতা আজও তার বৃদ্ধ শরীরকে উতলা করে দিল। তার বুক ধকধক করতে লাগল। গন্ধটা যেন তাকে আবার সেই তরুণী করে দিয়েছে। তার শরীর কাঁপতে লাগলো। তিনি বিছানা থেকে নামলেন। কাল রাতে তো এই গন্ধটা পান নি? পায়েল এই পাহাড়ি ফুল কিভাবে পেল? এই ফুলের গন্ধ কি শুধু ভোরেই পাওয়া যায়?
তিনি সাবধানে জানালার দিকে গেলেন। জানালাটা বিছানা থেকে বেশ দূরে। তার দূর্বল শরীরের বাঁধা সত্ত্বেও তিনি এগোতে লাগলেন। এই ফুলটাকে তিনি দেখবেনই, এই পাহাড়ি ফুলটাকে জানতেই হবে।
কিন্তু হুট করে তার পা কাঁপতে লাগল। আর এগোতে পারলেন না। তিনি মেঝেতে পড়ে গেলেন।
আর উঠলেন না।
এবারও তার পাহাড়ি ফুলটা জানা হল না।
রাসিক রেজা নাহিয়েন
মন্তব্য
এবারও তার পাহাড়ি ফুলটা জানা হল না.......
দেবদ্যুতি রায়
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
বাক্যগুলো আরেকবার পড়ে দেখবেন কি? একটু চেক করলেই অন্যরকম পরিপূর্ণতা আসবে মনে হচ্ছে। শুভকামনা।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
রাসিক রেজা নাহিয়েন
নতুন মন্তব্য করুন