বোকা ট্রি-হাগারদের অপেক্ষায়

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১৪/১২/২০১৪ - ৬:৫২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সুন্দরবনের সৌন্দর্য ঠিক সহজলভ্য না। আপনি শখের ঘুরুঞ্চি হলে সম্ভাবনা অনেক যে সুন্দরবন আপনাকে হতাশ করবে, সকাল থেকে সন্ধ্যা সেই একই রকম খাল, সেই একই রকম গাছপালা। টুপ করে নৌকা থেকে নেমে যে আপনি একটু হেঁটেহুটে বেড়াবেন তার কোন সুযোগ নেই এই ধারালো শ্বাসমূলের ম্যাংগ্রোভ বনে। সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ বেঙ্গল টাইগার, কিন্তু সুন্দরবনে পঞ্চাশবার গিয়েও আপনি বাঘমামার সাক্ষাৎ নাও পেতে পারেন। ২০১১ থেকে ১৪ এর মধ্যে সুন্দরবনের চারটা রেঞ্জেই যাওয়ার সুযোগ হয়েছে ওয়াইল্ডটিমে ‘বাঘ বাঁচানো’র এক অদ্ভুত চাকরির সুবাদে। বন্ধুরা সবাই বাঘের মাসী বলে পচালেও বনের মাঝে বাঘের ব ও দেখতে পাইনি, খালের পারে পাগমার্ক বা বাঘের পায়ের ছাপ, আর একবার সদ্য ওই এলাকা ত্যাগ করা বাঘের তীব্র গন্ধই আমার বন্য বাঘের সবচেয়ে কাছে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ।আমার সুন্দরবন গহীন রাতে খালের ধারে জোনাকির অলস ওড়াউড়ি, আচমকা গাছের ডালে একটা ঈগলের ডানার ঝাপ্টা। এই নিতান্ত নিস্তরঙ্গ, চুপচাপ, রহস্যঘেরা বনে দিনের পর দিন বসে থাকতেও আমার ক্লান্তি হবেনা, এই বন আমার ভেতরে ঢুকে গেছে, আজকে যখন তাকে চরম বিপদে দেখছি, কষ্টটাও আসছে ভেতর নিংড়ে।

ওয়াইল্ডটিমে কাজ শুরু করার পরপর-ই বনের পাশের মানুষগুলোর জন্য একটা সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন তৈরির সাথে জড়িয়ে যাই। অনেক বছরের গবেষণার ওপর গড়ে ওঠা পর সেই ক্যাম্পেইনের নাম দেওয়া হয় ‘সুন্দরবন মায়ের মতন’।এই ক্যাম্পেইন তৈরির সময় সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় ছিলো বনের পাশের গ্রামবাসীদের জীবনটা বোঝা । সুন্দরবনে অনেক জায়গায় বন আর গ্রামের মাঝে দূরত্ব ঢাকার কোন একটা চিপা গলির প্রস্থের সমান । গ্রামে বাঘ ঢুকে পড়ে, গ্রামবাসীর গরু ছাগল মেরে রেখে যায় । জীবিকার সন্ধানে বনে ঢোকা অনেকে প্রতি বছর বাঘের আক্রমণে মারা পড়ে । কমনসেন্স বলে সুন্দরবনের পাশের সাধারণ রহিম করিমের জন্য বাঘকে ঘৃণা করাই স্বাভাবিক, কিন্তু অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, সবাই একযোগে বলছে, "বাঘ না থাকলে এই বন বেঁচে থাকবেনা, আর বন বেঁচে না থাকলে আমরাও মুছে যাবো ।" তাদের জন্য এই বন ঘুরতে যাওয়ার জায়গা না, পোস্টারে ব্যানারে ব্যবহারের জন্য প্রতীকী বিষয় না । এই বন তাদের জীবন, জীবিকা, নিরাপত্তা, অস্তিত্বের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে । দেশের হোমড়া চোমড়া নীতিনির্ধারকদের যেই যুক্তি আপনি শত আলোচনাসভায় বোঝাতে পারবেন না, সেই যুক্তি হৃদয়ে জেনে তারা প্রতিদিন যুদ্ধ করে বেঁচে আছে । সুন্দরবন আসলেই এই সাধারণ মানুষগুলোর জন্য মায়ের মতন ।

বাঘ সংরক্ষণের জন্য ওয়াইল্ডটিমের অনেক চমৎকার উদ্যোগ আছে । ২০১২ সাল থেকে ক্যাম্পেইন চলছে, ৪৯টা ভিলেজ টাইগার রেস্পন্স টিম গ্রামে বাঘ ঢুকে পড়ার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছে স্বেচ্ছাসেবামূলক ভাবে, কাজ হচ্ছে বন্যপ্রানি অপরাধ নিয়ে । দু মাস আগে যখন এই ভালোবাসার জায়গাটা ছেড়ে আসি, পুরোদমে তখন আমার বন্ধুরা বাঘ রক্ষায়, সুন্দরবন রক্ষায় কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

সিডরের মতন দুর্যোগ হিসেব কষে বের করা যায়না, সেই মহাবিপদ থেকেই সুন্দরবন জেগে উঠেছিলো । ভাঙ্গা ডালপালার মাঝ থেকে, বনের পাশের মানুষগুলোকে বুক দিয়ে আগলে, বেঁচে ছিলো তো বনটা আমাদের। তারপর একদিন আমরা ইচ্ছে করে, একটা অবশ্যম্ভাবী বিপদকে দেখেও না দেখে, একটা সতেজ বনকে, বনের অগুনতি প্রাণকে বিষাক্ত তেলে ডুবিয়ে মেরে ফেললাম । এই কাজের দায়ভার আর কারো ওপর নয়, এই দায়ভার আমার ওপর, এই দায়ভার আপনার ওপর । দেশচালানো রাজনীতিবিদরা তাদের মতন আছেন, কিন্তু আপনি আমি কি কোনদিন সরব হয়েছি পরিবেশ নিয়ে? টিভি সিনেমায় অনেক দেখেছি প্রাচীন কোন গাছ উন্নয়নের নামে কেটে ফেলার কথা হলে ওই গাছ জড়িয়ে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে, সেই থেকে পরিবেশবাদী এক্টিভিস্টদের জন্য ট্রিহাগার কথাটা এসেছে । দেশে এমন কিছু দেখলে আমরা খুব একচোট হাসবো, তারপর বাড়ি এসে টবের গাছে পানি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়বো । নিজের চেয়ে বড় কিছু যে থাকতে পারে, নিজের জীবনকালের পরেও যে পৃথিবীটাকে বেঁচে থাকতে হবে, আমরা খুব সহজে সেটা ভুলে যাই । ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার বাইরেও যে দেশের এই ১৬ কোটি মানুষেরও কিছু দায়িত্ব আছে, আমরা কেনো মনে রাখিনা ? দেশ বিদেশের হাজারো রাজনৈতিক খবর, সেলিব্রিটি কড়চা, খেলাধুলার পরিসংখ্যান মনে রাখি, তাও কেনো আমরা খোঁজ রাখিনা যে সুন্দরবন, বাংলাদেশের শেষ বন্য আশ্রয়ের মধ্য দিয়ে তেলবাহী জাহাজ যাচ্ছে ? কেন শুধু প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য হিসেবে ইন্টারনেটে সুন্দরবনকে ভোট দিয়েই আমাদের দায়িত্ব শেষ আমরা এইটা মনে করি? কেনো শুধু অন্য কোন সংস্থা, অন্য কোন উদ্যোগ, অন্য কোন দলনেতার জন্য আমরা অপেক্ষা করে যাবো ?

কেন আমরা কিছু করিনা? কেন আমরা কিছু বলিনা ?

আমি ও আমরা কিবোর্ড চেপে যাবো, এর মাঝে সুন্দরবনের গাছেরা শ্বাস নেওয়া ভুলে যাবে, বালুর ওপর লুটিয়ে থাকবে মরা কাঁকড়া, নদীর বুকে ভেসে উঠবে মরা মাছ, হারিয়ে যাবে ডলফিন । তারপর একদিন খালের পারে আর কোন বাঘের পায়ের ছাপ থাকবেনা, আর কেউ বনের মাঝে বাঘের ডাক শোনার গা ছমছমে অনুভূতিটা পাবেনা ।

সুন্দরবনের সৌন্দর্য সহজলভ্য না, খুব সহজে আমরা তাকে ধরেও রাখতে পারবো না । কি ক্ষতি হয় একবার একটু কঠিন কিছু করলে? গামলা নিয়ে তেল সাফ করে এইবার বেশিদূর আগানো যাবেনা, কিন্তু পরেরবার যখন শুনবেন বন ধ্বংস করে, পাহাড় কেটে, বনের প্রাণী, সাগরের প্রবাল হারিয়ে ফেলে দেশে উন্নয়ন হচ্ছে, একটু গাছ জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষ্যাপাটে বোকা মানুষ হয়েই দেখেন, হয়তো একবার মানুষ হাসবে, হয়তো দুইবার তাচ্ছিল্য করবে, কিন্তু একবার না একবার আপনি একটা ভুলকে ঠ্যাকাতে পারবেন । আর যদি নাও পারেন, বাড়ি ফিরে যেই ঘুমটা দেবেন সেটা হয়ত একটু কম অশান্তির হবে ।

- অনন্যা

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

লেখাটির জন্য ধন্যবাদ --

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

আমি ও আমরা কিবোর্ড চেপে যাবো, এর মাঝে সুন্দরবনের গাছেরা শ্বাস নেওয়া ভুলে যাবে, বালুর ওপর লুটিয়ে থাকবে মরা কাঁকড়া, নদীর বুকে ভেসে উঠবে মরা মাছ, হারিয়ে যাবে ডলফিন । তারপর একদিন খালের পারে আর কোন বাঘের পায়ের ছাপ থাকবেনা, আর কেউ বনের মাঝে বাঘের ডাক শোনার গা ছমছমে অনুভূতিটা পাবেনা ।

সত্যিই।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

মেঘলা মানুষ এর ছবি

সমস্যা মোকাবিলার প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত সমস্যার অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়া। তারপর, কাজে নামা।
আর, চোখ বুজে থাকলে তো থাকাই যায়। মুশকিলে আসানের স‌হজ তরিকা মনে হয় এটাই মন খারাপ

মাসুদ সজীব এর ছবি

চলুক

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

ফাহিম হাসান এর ছবি

এই লেখাটার দরকার ছিল। এ ধরনের বিপর্যয় বাই স্ট্যান্ডার ইফেক্টকে ট্রিগার করে। এই মুহুর্তে অনলাইন অ্যাক্টিভিজমের পাশাপাশি সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা দরকার যাতে সামুদ্রিক জলযানগুলোর যাত্রাপথ বিষয়ক একটা নীতিমালা গঠন করা হয়।

নজমুল আলবাব এর ছবি

সুন্দরবনটাকে আমরা বুঝি মেরেই ফেল্লাম

তাহসিন রেজা এর ছবি

মন খারাপ

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

সবজান্তা এর ছবি

আমার কাছে সবচে বড় সমস্যা মনে হয় যেটা-

নিজের চেয়ে বড় কিছু যে থাকতে পারে, নিজের জীবনকালের পরেও যে পৃথিবীটাকে বেঁচে থাকতে হবে, আমরা খুব সহজে সেটা ভুলে যাই ।

এ শুধু সুন্দরবন না, আরো অনেক কিছুর ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করি। প্রাণিজগতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে যে মানুষের অনেক দায়িত্ব রয়েছে পুরো জীবজগতের ব্যাপারে, এ সত্যটা বুঝতে আমরা অনেকেই অক্ষম। সুন্দরবনের ক্ষতি কতোদিনে পূরণ হবে, কিংবা আদৌ হবে কিনা, সে উত্তর জানি না। কিন্তু এটা বুঝি, এ ধরনের বিপদ ভবিষ্যতেও হবে, যদি আমাদের সীমাহীন লোভকে দমন না করতে পারি, যদি পরিবেশের জন্য আমাদের মধ্যে ভালোবাসা না জাগাতে পারি।

আমি মোটাদাগে নিরাশাবাদী মানুষ, তাই আমার ধারণা সুন্দরবনসহ আমাদের আশেপাশে যতোটুকু প্রকৃতি এখনো বেঁচে আছে, তাদের আমরা খুব দ্রুতই ধ্বংস করবো। অনুমানটা ভুল হলে খুশি হতাম।

অভিমন্যু . এর ছবি

চলুক

________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি

অতিথি লেখক এর ছবি

‘দেশের হোমড়া চোমড়া নীতিনির্ধারকদের যেই যুক্তি আপনি শত আলোচনাসভায় বোঝাতে পারবেন না, সেই যুক্তি হৃদয়ে জেনে তারা প্রতিদিন যুদ্ধ করে বেঁচে আছে । সুন্দরবন আসলেই এই সাধারণ মানুষগুলোর জন্য মায়ের মতন ।’

আসলেই তাই। মানুষ আর প্রকৃতির সম্পর্কটা যে কোনোভাবেই সাংঘর্ষিক বা শাসনের নয় তা প্রকৃতির সান্যিধ্যে থাকা মানুষ (হাজার ঝড়-ঝঞ্জা সত্ত্বেও) ঠিকই বোঝে। আপাত তত্ত্ববুদ্ধিহীন সাধারণ মানুষেরা সাধারণ নয় অসাধারণ। অসাধারণত্ব তাদের বেঁচে থাকার মধ্যেই। সুন্দরবনকে এখন এই অসাধারণ মানুষেরাই আক্ষরিক অর্থে বাঁচানোর চেষ্টা করছে।

অনেক ধন্যবাদ লেখাটার জন্য----

স্বয়ম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।