লেখার জন্য কেউ অপেক্ষা করছে ভাবতে ভালোলাগে, সেই একজনটা না’হয় হোক আমার অবচেতন মন কিংবা দু’একজন সত্য বন্ধু।
রবিবার গুলো কেটে যায় আলসেমি না করে, রাজকন্যা কঙ্কাবতীর মতো কফিতে আয়েশি চুমুক দেয়া হয় না আজ ক’মাস। তবে মাথার ভেতর লেখা চলে, অবিরাম নতুন ভাবনা উঁকি দেয়।
দেশ ছেড়ে আসার পর টের পেলাম এইখানে মানুষ বাংলায় কথা বলে না। বন্ধু বানানো খুব একটা সহজ ছিলো না। কথোপকথন, রসিকতা, জীবনধারা সবকিছুই নতুন। প্রবাসে আমার বয়স তিন বছর চার মাস। “সিডিসি’’র মতে শিশু তিন বছর পর রং এর পার্থক্য চেনে, ভালোবাসা বুঝতে পারে এবং এক পায়ে ভর করে দাঁড়াতে শেখে।
ভাবছি, নতুন সংস্কৃতি আর ভাষায় বুদ্ধি বৃদ্ধি হচ্ছে নাকি বন্দী হচ্ছে।
“মে” মাস, মাস্টার্স শেষ হবার পর শুনলাম পনের দিন পর সমাবর্তন হবে। আগে কখনো এমন উৎসবে অংশগ্রহন করি নি, বন্ধু সিনথিয়ার পুরো পরিবার ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আসছে। ওদের পরিবারে এমন ডিগ্রি ওর-ই প্রথম। হই রই কাণ্ড। আমি দ্বিধায় ভুগছি, আড়ম্বর করবো না চেপে যাবো । আব্বু আম্মু কে বলার পর বললো--- “ও আচ্ছা”, তোর পড়াশুনা কবে শেষ হবে? বিয়া শাদী কবে করবি?
অফিসে কাউকে জানাইনি, ছুটি নেবার কোন চেষ্টা করলাম না। সমাবর্তনের দ্বিতীয় দিন, শনিবার, অফিস ছুটি, যার বাসায় থাকি তাকে জানালাম সমাবর্তনের দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানে যাবার কথা, সাথে কাছের কিছু বন্ধুদের।
শনিবার সকাল আটটা, বন্ধুরা সবাই রেস্তোরাঁয় অপেক্ষা করছে, ওদের দেখে চমকে গেলাম মনে হল, সাত সমুদ্দুর পার করা রাজপুত্র আর রাজকন্যারা তাদের সবচাইতে ভালো পোষাকে আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছে, পরে শুনেছি সারা সপ্তাহ ধরে ওরা ওই দিনের পরিকল্পনা করছিল, ড্রাই ওয়াশ এবং টাই পরার মতো জটিল কর্মযজ্ঞের ভেতর দিয়ে এদের যেতে হয়েছে। সময়মত সবাই অডিটোরিয়ামে উপস্থিত হলাম। অনুষ্ঠানের নিয়ম মোটামুটি সহজ। একেকজনের নাম ঘোষণা হচ্ছে, সে শিক্ষার্থী মঞ্চে গিয়ে সম্মাননাপত্র নিয়ে আসছে, আর গ্যালারীতে থাকা পরিবারের সদস্যরা অতি উৎসাহে হাত তালি দিচ্ছে। স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এর ডিন আমার নাম ঘোষণা করলেন, মঞ্চে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম, আর শুনলাম বন্ধুদের হর্ষধ্বনি । যার বাসায় থাকি ও শুভেচ্ছা কার্ডে লিখেছিলো, চাইলে ও আমার “মা” হবে। আমার বন্ধুদের মধ্যে ভাই বোন খুঁজে নেওয়াটা অসম্ভব ছিল না। আমার মেন্টর ক্রিস আসতে পারে নি, কিন্তু ওর আশি বছর বয়সী মা ফুল হাতে দাঁড়িয়েছিল। বাল্যবন্ধু ক্যামেরা হাতে নিয়ে ছোটাছুটি করছে। “ফ্যামিলি পোর্ট্রেট'” টা হয়ত এরচেয়ে পারফেক্ট হতে পারতো না।
আমার নদী পছন্দ। সমাবর্তন শেষে আমরা সবাই গেলাম শহর থেকে দু’ঘন্টা দূরে “রেড রিভার” নামে ছোট্ট শহরে। রাতে থাকার জন্য একটা কেবিন ভাড়া করা হয়েছে। আমরা যখন পৌঁছাই , তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। তাই কেবিন এর আশপাশটা দেখা হয় নি। অনেকরাত পর্যন্ত আড্ডা হল, এর পর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে খুব ভোরে পানির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় । বাইরে তখন ঘন কুয়াশা, বিছানা থেকে কম্বল টেনে বেরিয়ে পড়লাম, কেবিনের পেছনের দরজা দিয়ে। বের হতেই চোখে পড়লো স্রোতস্বিনী নদী । চোখে পানি টলমল করছে, এত সুন্দর, এত সাধরণ, খুব সহজেই চেনা কোন সৃতির সাথে মেলানো যায়!!! বেঞ্চিতে বসে পড়লাম, একটু বাদে বাকি বন্ধুরাও এসে যোগ দিলো । সবাই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একটা আজব পানকৌড়ির দিকে। ঘণ্টা খানেক ধরে পানকৌড়িটা একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো । নদীটার যেখান থেকে আরম্ভ সেখানে গিয়ে স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে, তারপর সাঁতার কেটে শেষ সীমানায় পৌঁছুচ্ছে , এরপর উড়ে গিয়ে আবার সেই আগের জায়গায় গিয়ে গা ভাসাচ্ছে। কী আজব, নিজের স্বস্তির সীমানার বাইরে ওই পানকৌড়ি পর্যন্ত যেতে চায় না। কি জানি বাকিরা কি ভাবছিলো।
কর্ণফুলী ঘিরে আমার বেড়ে ওঠা, শৈশব, বন্ধুদের সাথে হই হুল্লোড় আর সুরমায় প্রেমিকের সাথে প্রথম চুম্বন, কথা কাটাকাটি এবং সূর্যাস্ত। গঙ্গার কথা প্রায়ই শুনেছি পিনাকীর মুখে, লন্ডনের এগসি নদীর পাশে গড়ে ওঠা শহরে বেড়ে উঠেছে নিক, আন্দারস এর জন্ম ফ্লোরিডায় জেন্সেনএ , ভিন নদীর কথা কখনো বলতে শুনিনি অষ্ট্রিয়ার মারকাস কে, আর জিনা সবসময় গল্প করেছে লস আলামসের ছোট্ট নাম্বে নদীর কথা। কিন্তু ওই একটা মুহূর্তে, খুব দূর্লভ কিছু সবাই খুজে পেয়েছিলো হয়তো , নানা রঙের, ছ’জন মানুষ একটা সম্পূর্ণ অচেনা নদী দেখে তন্ময় হয়েছিলো। হয়তো কারো কারো চোখে দু একফোঁটা নীল রঙের পানি , সাদা কালো দু একটা স্মৃতি কিংবা শূন্যতা ছিলো। কিন্তু পানকৌড়িকে হার মানিয়ে নিজের স্বস্তির বলয় ডিঙিয়ে চেনা নদী থেকে হাজার মাইল দূরে আমরা ভালবাসছিলাম একজন আরেক জনকে।
মন্দ না, তিন বছরের শিশুর মত এই নতুন সংস্কৃতি শিখিয়েছে রঙের পার্থক্য আর দিয়েছে নানা রঙের মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ভালবাসার সন্ধান।
ওটা ছিল আমাদের শেষ বাইরে একসাথে বেড়ানো, এরপর পিনাকী চলে যায় আইওয়া্তে, মারকাস আয়ারল্যান্ডে, জিনা কলোরাডো, আন্দারস বোলডারে। কি অদ্ভুত, সময়, জীবিকা আর স্বপ্নের পিছনে ছুটে চলা এই আমরা কতো সহজে ভালবাসার মানুষগুলোকে বিদায় জানাই। আমি খুব কাঁদছিলাম ওদের বিদায় দেবার সময়।
এরপর আবার নতুন সেমিস্টার আর গবেষণার কাজ শুরু হল, সময় পালিয়ে যাচ্ছিলো, শোক করার সময় নেই। এর মধ্যেই আবার ভালবাসা অনুভব করতে শুরু করেছি। টের পাই দেরী করে বাসায় আসলে কিছু বন্ধু মুঠোফোনে খবর নেয়, সব ঠিক আছে কিনা জানতে চায়।তাহলে কী ভালবাসার মানুষরা বার বার ফিরে আসে নতুন কোন রঙে, নতুন কোন মুখশ্রীতে ?
হবে হয়তো।
এক পায়ে ভর করে দাঁড়ানোর গল্পটা আরেক সময় বলি, কফি প্রায় শেষ ...।
ফিনিক্স
লস আলামস
মন্তব্য
নেক্সট পর্ব দেড় মাস পরে দিলে থাপড়ে মাড়ির দাঁত ফেলে দেব।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
রাজকন্যা কঙ্কাবতীরর মতো কফি খাওয়ার ব্যাপারটা বুঝলাম না!
লেখা চলুক।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
কঙ্কাবতী যদি এখনকার কালে জন্মাতো তাহলে সে নিশ্চয়ই কফি পান করতো। সেই আয়েশী রাজকন্যা কঙ্কাবতীর কফি পানের দৃশ্যটা কল্পনা করো, তাহলে বুঝতে পারবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
বাঃ! খুব ভাল লাগল। তিথীর মত অত বকাবকি করছিনা। তবে একটু তাড়াতাড়ি পরের পর্ব দিলে আমাদের অপেক্ষাটা বেয়াড়া রকম লম্বা হতনা এইটুকু জানিয়ে রাখছি।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
খুব ছিমছাম একটা লেখা। ডিয়ার ডায়েরি টাইপ লেখা পড়তে আমার খুব ভালো লাগে।
শুভকামনা রইলো।
অপর্ণা মিতু
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
আমরা অনেকেই আপনার কফির জন্য অপেক্ষা করি কিন্তু! সময় সুযোগ মত লিখুন।
নতুন বছরের অনেক অনেক শুভেচ্ছা
নতুন মন্তব্য করুন