জার্মান শেফার্ডের ঠ্যাং

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ০২/০১/২০১৫ - ৮:২৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


আজ ফেসবুকে একজন নতুন প্রস্তাবিত বেতন স্কেল শেয়ার করেছে। সর্বোচ্চ বেতন পাওয়া আমলার বাড়ীতে নেয়া অর্থের পরিমাণ সোয়া লাখ টাকার উপরে। দেখে পুলকিত হয়েছি। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। রিজার্ভ বাড়ছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ঘটছে। নতুন বেতন স্কেল চালু হলে, জিডিপি আরো বাড়বে। ( অবশ্য জিডিপির প্রতি আমার কোন আলাদা মায়া মহব্বত নেই। আই বি এ তে কিছু অর্থনীতি পড়েছিলাম। জিডিপির প্রবৃ্দ্ধি নির্ভর করে খরচ কতটা বাড়লো তার উপর। কেউ যদি কামনায় উত্তেজিত হয়ে , স্ত্রীর সাথে সহবাস করে, তবে জিডিপির কোন উন্নতি হবে না। কিন্তু কেউ যদি শেরাটনে রুম ভাড়া করে লিগ্যাল এসকর্ট কল করে তবে জিডিপি বাড়বে। কেউ যদি পিকক বারে গিয়ে মদ খায় তবে জিডিপি বাড়বে। কিন্তু একজন মহীয়সী মা যদি সন্তানকে দুগ্ধ দান করে করে ম্যামারী গ্লান্ডে ব্যথা করে ফেলে, তবেও জিডিপির কোন বৃদ্ধি ঘটবে না। এক অন্তপূরবাসিনী বাসন মেজে মেজে হাতে কড়া বানিয়ে ফেললেও জিডিপির কোন লাভ নেই।) সরকারী চাকুরীজীবিদের বেতন বাড়ানো উচিত এতে কোন সন্দেহ নেই। বেসরকারী কিছু সেক্টর যেমন ব‌্যাংক, টেলিকমে যাঁরা কাজ করেন, তাদের বেতন গড় পড়তা চাকুরীজীবিদের চেয়ে বেশী। তাই প্রতিযোগীতায় টিকে থাকতে হলে সরকারী চাকুরীজীবিদের বেতন বাড়ানো কোন বিকল্প নেই। কিন্তু ব্যাংক টেলিকম পুরো বেসরকারী সেক্টরের প্রতিনিধিত্ব করে না। বেসরকারী চাকরীর স্পেক্ট্রাম বেশ দীর্ঘ। এখানে গার্মেন্টস, এমনকি আরো ক্ষুদ্র পরিসরে বাসার কাজের বুয়ারাও পর্যন্ত স্পেক্ট্রামের অংশ। শুধুমাত্র ব্যাংক কিংবা টেলিকমকে রেফারেন্স হিসাবে ধরলে সেটি হবে হ্রস্বদৃষ্টি। সমাজের এক অংশের মানুষের কল‌্যাণ সাধন করতে গিয়ে, অন্য একটি বৃহৎ অংশকে প্রতিযোগীতায় দূর্বল করে দেয়াটা কাম্য নয়। বাজারে গিয়ে সরকারী চাকুরীজীবি পিয়ন যদি ১০০ টাকা দিয়ে মাছ কিনে আনে , তবে তাঁর ছেলেমেয়েরা হয়তো খুশি হবে। কিন্তু গার্মেন্টসের একজন কর্মী যদি এই দাম দিতে না পারে, তবে তার সন্তান হয়তো মাছের তরকারীর আশায় বসে থেকে, লবন দিয়ে ভাত খাবে। আর স্কুলে জীবনের লক্ষ্য রচনা লিখতে গিয়ে সে আর লিখবে না সে বুয়েটে পড়তে চায়। সে লিখবে সরকারী চাকুরীজীবি হতে চায়। যেকোন ধরণের হলেই চলবে। কেননা বুয়েটের ছেলেদের প্রস্তাবিত পিয়নের বেতনের চেয়ে কম বেতনে চাকুরী অফার করতে দেখেছি। সরকারী পিয়নের বেতন যদি তের হাজার টাকা হয়ে, তবে গার্মেন্টেসরে শীর্ণ মেয়েটি , যে দিন রাত্র পরিশ্রম করে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে- এক কথায় সরকারকে জীবিত রেখেছে, তার দোষ কোথায়? সরকার সরকারী চাকুরীজীবিদের অধিকার নিশ্চিত করতেই পারে, কিন্তু বেসরকারী অগণিত শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় কি করছে? তারা কি পাশ্চাত্যের মত সমতুল্য ন্যুনতম বেতন নিশ্চিত করতে পারবে? বরং সরকারী বেতনের এক্সট্রাভেগেন্ট প্রকল্পে অসংখ্য মানুষ প্রতিযোগী সুবিধা হারাবে। সরকারী চাকুরীজীবিদের বেতন অবশ্য বাড়ানো উচিত। কিন্তু অন্যদের ব্যাপারে সরকারের পরিকল্পনা কি সেটাও সরকারকে স্পস্ট করতে হবে। এবং দুটোই সাজুয্যপূর্ণ হওয়া চাই।


একটা আষাঢ়ে গল্প বলি। ধরা যাক নতুন বেতন স্কেল চালু করা হয়েছে। একজন বিশেষ উর্ধ্বতন কর্মকর্তার বেতন গিয়ে দাঁড়ালো লাখ টাকার উপর। সে সদ্য বিদেশ সফর শেষে ফিরে এসেছে। আমেরিকার অনেক কিছুই তার ভালো লেগেছে। একটি বুদ্ধিমান জার্মান শেফার্ড দেখে তার ভীষণ ভালো লেগেছে। সে একটা জার্মান শেফার্ড কিনে আনলো-যার প্রতি তার অসীম মমতা। একদিন কুকুরটির একটা পা দরজার চিপায় পড়ে ভেঙ্গে গেলো। তিন পা জন্তুটির প্রতি তার মমতা তিনগুণ হলো। কুকুরটিকে পুষতে তার মাসে ছয় হাজার টাকা খরচ হয়। তিনি এটা বহন করতে পারেন। তার বাসায় কাজের বুয়ার স্বভাব ভালো না। কুকুরের মাংস থেকেও মাংস চুরি করে। সাহেবের স্ত্রী ভীষণ বিরক্ত। " তোমার অভাব থাকলে আমাকে বলো। চুরি করবে কেন?" উনি দয়ার সাগর। বুয়ার বেতন দু'শ টাকা বাড়িয়ে দু'হাজার টাকা করে দিলেন। বুয়া স্বামী পরিত্যাক্তা। তিন ছেলে-মেয়ে। একুনে চারজন।

সৈয়দ মুজতবা আলীর পন্ডিতমশাই বলে একটা গল্প পড়েছিলাম। বড়লাট এসেছেনে বিদ্যালয়ে। বড়লাটেরও একটা কুকুরও ছিল। সেটিও তিন ঠ্যাং-এর। পণ্ডিতমশাইয়ের পরিবারের মাসের পুরো খরচ আট টাকা । কুকুরের মাসিক খরচ ২৪ টাকা। ( টাকার অংকটা আমার ভালো মনে নেই)। পণ্ডিত মশাই পুরো ক্লাশ কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁর পুরো পরিবার লাট সাহেবের কুকুরের কয় ঠ্যাং-এর সমান?

আজ যদি সৈয়দ মুজতবা আলীর পণ্ডিতমশাই চিতা থেকে উঠে এসে প্রশ্নটি করেন, বুয়ার পুরো পরিবার জার্মান শেফার্ডের কয় ঠ্যাং-এর সমান? উত্তরটা কিন্ত পাল্টাবে না।

এই হলো স্বাধীনতা। ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, মতিউর, মোস্তফা কামাল আর লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে লাট সাহেব, আ্ইয়ুব খান অথবা বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর তফাৎ কি খুব বেশী?

(সরকারী চাকুরীজী্বিদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। সরকারী উর্ধ্বতন কর্মকর্তার উদাহরণ এনেছি, শুধুমাত্র মুজতবা আলীর গল্পে বড়লাট সরকারী চাকুরীজীবি ছিলেন বলে। এর বদলে সুবিধাভোগী শ্রেণীর যে কেউ হতে পারে । এমনকি আমিও। রাষ্ট্রের নামে, তন্ত্রের নামে , ধর্মের নামে আমরা সবাই একই কাজ করছি যা উপনিবেশিক শাসকরা করে গেছে।)

হলুদ ঘাস
টরোন্টো


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

এই হলো স্বাধীনতা। ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, মতিউর, মোস্তফা কামাল আর লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে লাট সাহেব, আ্ইয়ুব খান অথবা বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর তফাৎ কি খুব বেশী?

বেতনের আলোচনায় কেন স্বাধীনতা প্রাসঙ্গিক - সেটা পরিষ্কার হল না। তবে ১৯৭২-৭৫ সময়ে বাংলাদেশের কিছু লোকের মুখে প্রায়ই শোনা যেত "ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়" অথবা "আইয়ুবের আমলই ভাল ছিল"। এসব কথার সঙ্গে আপনার বক্তব্যের মিল খুঁজে পাওয়াটা একটু রহস্যজনক।

Emran

মাসুদ সজীব এর ছবি

এখনো অনেক পাপিস্থানমনা আর ইতিহাস অজ্ঞর কাছ থেকে শুনা যায় পাপিস্থান আমলেই ভালো ছিলাম অ্যাঁ

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

মাসুদ সজীব এর ছবি

লেখার বিষয়বস্তু, উদাহারণ সব কিছুই ভালো ছিলো কিন্তু সেখানে দোষটা স্বাধীনতার ঘাড়ে বসালেন কেন সেটাই বুঝতে পারলাম না। সরকারের ভুল নীতির জন্যে কি স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যায়? স্বাধীনতার ব্যাপ্তি কি এতই ক্ষুদ্র?

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

অতিথি লেখক এর ছবি

দেশের একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা এমনকি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা লোকজন ব্যাংকে একটা চাকরীর জন্য হন্যে হয়ে দৌড়াতে দেখেছি। কেউ পায় সে সোনার হরিণ, কেউ হাপিত্যেশ করে।বেসরকারী গুটিকয় কোম্পানি ছাড়া বাকিগুলোতে চাকরীর ইন্টারভিউতে আক্ষরিক অর্থে মাছের দরদাম চলে লজ্জাজনক স্যালারীর জন্য।এগুলো দেখভাল করা, নিম্নতম সুযোগ সুবিধার স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করার ব্যাপারটা সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বলে মনে করি।

রাজর্ষি

এক লহমা এর ছবি

লেখাটির উদ্দেশ্য কোনটি ছিল?

(১) এইটি বলা যে বাংলাদেশ এখনো সেই আদর্শ অবস্থানে পৌঁছাতে পারেনি যেখানে তার নাগরিকেরা যার যার কাজের যথোপযুক্ত বেতন পাবে, কাজের প্রকৃত গুরুত্ব অনুসারে। সরকারের উচিত এই দিকে নজর দেওয়া এবং এই ঘাটতি পূরণে সর্বশক্তি নিয়োগ করা।

(২) স্বাধীনতা পাওয়া দেশটি যখন উপরে বিবৃত কাজটি ইতিমধ্যেই করে ফেলতে পারেনি এই স্বাধীনতা না পেলেও দেশের বেশীর ভাগ মানুষের কিছু আসত যেত না।

উদ্দেশ্য প্রথমটি ছিল ধরে নিলে বলি - দাবী মহৎ। কিন্তু জীবিকার অসাম্য নির্মূল করার প্রতিশ্রুতিতে বিভিন্নদেশে যে সাম্যবাদী শাসনব্যবস্থা গুলি এসেছিল, তাদের বর্তমান হাল দেখে মনে হয় কি যে এই সময়ে বাংলাদেশের সরকারের ঐ পথ ধরার কোন বাস্তবতা বা যৌক্তিকতা আছে? উত্তর 'হ্যাঁ' হলে আর কোনও কথা নেই, থামলাম। উত্তর 'না' হলে বলতে হয়, প্রচলিত শাসনব্যবস্থায় যে যে কাজগুলি করে অসাম্যটার সাথে লড়তে লাগে, বাজারের অবস্থা বিচারে সরকারী কর্মচারীদের বেতনের বৃদ্ধি তার বাইরে নয়। অন্যান্য দরকারি কাজগুলি এই সরকার কতটা করছে বা করছেনা সেটার আলোচনা এই লেখায় ছিলনা। শুধু করবার দাবীর কথাটি আছে। দাবী, আবারো বলি - মহৎ।

উদ্দেশ্য দ্বিতীয়টি হলে এই লেখাকে প্রলাপ অথবা উস্কানি বা দুটোই বলে ধরে নিতে লাগে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

সরকারি চাকুরীজীবীদের সংসারে টানাটানি হয় না, চাকুরি যাবার ভয় নেই,অনিশ্চয়তাও নেই। কঠিন জীবন বেসরকারি চাকরিজীবীদের শুধু

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।