বঙ্গোপসাগরের বুকে এক টুকরো মাটি, বাংলাদেশের বৃহত্তম দ্বীপ, পূর্ব নাম শাহবাজপুর- বর্তমান নাম ভোলা। এর উত্তরে বরিশাল জেলা ও মেঘনা নদী, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে নোয়াখালী, লক্ষীপুর জেলা ও মেঘনা নদী এবং পশ্চিমে বরিশাল, পটুয়াখালী জেলা ও তেঁতুলিয়া নদী অবস্থিত। গ্যাস সমৃদ্ধ অঞ্চল, লবণ আন্দোলনের ইতিহাস বিজড়িত এই অঞ্চলে মেঘনা তেতুলিয়ার তীর ঘেষে রয়েছে ছোট ছোট জেলে পল্লী। মাছ ধরা মৌসুমকে সামনে রেখে পল্লীর মহিলা ও শিশু কিশোররা পালাগান গেয়ে রং বেরংয়ের সুতা দিয়ে জাল বোনে। এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এসব জাল টানানো হয়। তখন বাড়িতে বাড়িতে চলে উৎসব। [১]
এই সুন্দর জনপদেও পড়ে অসুরের থাবা। ভোলা জেলায় ২০০১ সালে হিন্দু ছিল ৭২ হাজার ২৭৫ জন। সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায় হিন্দু জনসংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৬১ হাজার ১৬২ জনে। ভোলা যে বরিশাল বিভাগে রয়েছে বরিশাল বিভাগের কোনো জেলাতেই হিন্দুদের সংখ্যা বাড়েনি। বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা—এই ছয়টি জেলায় ২০০১ সালের আদমশুমারিতে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল আট লাখ ১৬ হাজার ৫১ জন। ২০১১ সালের শুমারিতে সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে সাত লাখ ৬২ হাজার ৪৭৯ জনে। [২]
ভারতে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর এই অঞ্চলে লাগে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ছোবল। অবশ্য এর আগে ১৯৮৯ সালের ১৭ নভেম্বর বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দিরের শিলা স্থাপনকে কেন্দ্র করে ভোলা শহরে হিন্দুদের বাড়িঘর এবং মন্দিরে হামলা চালানো হয়। [৩] হিন্দুদের কাছ থেকে ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করা হয়। ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার চরপাতা ইউনিয়নের নলগোড়া গ্রামের সাধু সিংয়ের বাড়িতে ছিল ছয়টি পরিবার যাদের প্রধান ছিলেন লক্ষ্মী নারায়ণ সিং। লক্ষ্মী নারায়ণ ১৯৯২ সালের পরে জমিজমা বিক্রি করে চলে যান। ১৯৯২ সালের পর থেকে হিন্দু পরিবারগুলো চলে যেতে শুরু করে। [২]
কিন্তু আসল তাণ্ডব শুরু হয় ২০০১ সালে।
২০০১ সালের ১ অক্টোবর বাংলাদেশে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন শতকরা ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েও মাত্র ৬২ টি আসন পেয়ে বিরোধী দলে বসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আর দুই তৃতীয়াংশের বেশি আসন পেয়ে ক্ষমতায় যায় বিএনপি জামায়াতের চার দলীয় জোট। [৪]
ভোলার লালমোহন উপজেলার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত অন্নদাপ্রসাদ গ্রাম। ভোলা শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এই গ্রামখানা। ২০০১ সালের ২ অক্টোবরের রাতে অন্ধকারের জীবেরা যে তাণ্ডব চালিয়েছিল তা স্বাধীনতার পরে আর কোনদিন দেখে নি দেশবাসী।
সেদিন রাতে অন্নদাপ্রসাদ আক্রমণ করে বিএনপি জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। ১ অক্টোবর রাতে হামলা, ধর্ষণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি ঘটনায় লালমোহনের বিভিন্ন এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। নির্বাচনের পরদিন ২ অক্টোবর অন্নদা প্রসাদ গ্রামের আশপাশের গ্রামের হিন্দু মহিলারা নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছিল গ্রামের চার পাশের ধানক্ষেত ও জলাভূমি পরিবেষ্টিত ভেন্ডারবাড়ী। অর্ধশতাধিক মহিলা তাদের সম্ভ্রম রৰার জন্য সেখানে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সে বাড়িটিও সন্ত্রাসীদের নজর এড়ায়নি। শত শত বিএনপি সন্ত্রাসী ৮/১০টি দলে বিভক্ত হয়ে পরিকল্পিতভাবে ওই রাতে হামলা চালায়। একের পর এক দল হামলা চালিয়ে অসহায় হিন্দু পরিবারের মেয়ের ধর্ষণ করতে থাকে। শত চেষ্টা করেও মহিলা তাদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারেনি। অনেক সম্ভ্রম হারানোর ভয়ে, প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে আশপাশের জলাশয়ের ধানক্ষেতে। মহিলারা পানিতে ঝাঁপিয়ে সম্ভ্রম রক্ষার চেষ্টা চালালে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের পতাকাবাহী সন্ত্রাসীরা তাদের সন্তানদের পানিতে ফেলে দেয়ার হুমকি দিলে সন্তানদের জীবন রক্ষায় তারা উঠে আসতে বাধ্য করে। আর উঠে আসলেই তারা গণধর্ষণের শিকার হয়। এভাবে ধর্ষিত হয় আট বছরের শিশু, লাঞ্ছিত হয়েছে ৬৫ বছরের বৃদ্ধা, মা, মেয়ে, শাশুড়ি, পুত্রবধূকে ধর্ষণ করা হয়েছে এক সঙ্গে। এ সময় ছেলের চেয়েও ছোট বয়সী সন্ত্রাসী ধর্ষণ করেছে মায়ের চেয়েও বেশি বয়সের নারীকে। সন্ত্রাসীরা ছাড়েনি পঙ্গু নারী শেফালী রানী দাসকেও। পঙ্গু হওয়া সত্ত্বেও অন্যদের মতো সন্ত্রাসীদের কবল থেকে সম্ভ্রম বাঁচাতে শেফালী রানীও পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস। পঙ্গু শেফালী পালানোর চেষ্টাকালে পুকুর পাড়ে হলুদ ক্ষেতে পড়ে যায়। তখন দুই সন্ত্রাসী তাকে ধরে ফেলে এবং তার পরনের কাপড় ছিঁড়ে তাকে বিবস্ত্র করে দুই সন্ত্রাসী পালাক্রমে ধর্ষণ করে। সন্ত্রাসীদের পাশবিক অত্যাচারে এক পর্যায়ে শেফলী জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে স্থানীয় হাসপাতালে তার চিকিৎসা করানো হয়। সম্ভ্রম হারিয়ে অনেকেই লজ্জায়, ভয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়। একাত্তরের বিভীষিকা যেন আবার নেমে আসে তিরিশ বছর পর। এবং আরও দুর্ভাগ্যজনক বিষয় এই যে নরপশুরা তাদের হাজার বছরের প্রতিবেশী সেই অন্নদাপ্রসাদ গ্রামেরই অধিবাসী। কালকে যাদের চাচা বলে ডেকেছিল মেয়েরা তারাই আজ জাতীয়তাবাদের ঝাণ্ডা উড়িয়ে এল তাদের সম্ভ্রম লুট করতে। অন্তঃস্বত্বা মাকে বাধ্য হতে হল ধানক্ষেতে সন্তান প্রসব করতে। [৫] [৬]
সারা রাত চলে নরপিশাচদের তাণ্ডব।
চর অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের আট বছরের যে মেয়েটি ধর্ষিত হয়েছিল সে এখন আর বাড়িতে থাকে না। বাড়িতে ছিলেন ৮০ বছরের বৃদ্ধা ঠাকুরমা অবলা রানী বালা। ওই ‘কালিমার কতা’ ভুলতে পারবেন না তারা কোনো দিন।
লর্ড হার্ডিঞ্জের সব নির্যাতিত সংখ্যালঘু পরিবারের মনোভাবই এ রকম। তাঁরা একটি নিরাপদ, আশঙ্কামুক্ত জীবন দাবি করেছেন সরকারের কাছে। অনেকেই এলাকাছাড়া। এলাকাবাসীর বক্তব্য অনুযায়ী কেউ দেশ ছেড়েছেন, কেউ পাড়ি জমিয়েছেন অন্য জেলায়। অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের মেন্টর বাড়ির বিনোদ চন্দ্র দাস (৬০)বলেন, ‘আমরা সব সময় আতঙ্কে থাকি আবার যদি ২০০১ আসে। আবার যদি...।’ কান্নায় গলা বুজে আসায় কথা শেষ করতে পারেননি বৃদ্ধ। একটু সামলে নিয়ে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় এই এলাকার অনেক হিন্দুকে জীবন দিতে হয়েছে। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ দাঙ্গার সময়েও হামলা হয়েছে। ২০০১ সালে গেছে নারীর সম্ভ্রম।’
বিনোদ চন্দ্র দাস আক্ষেপ করে বলেন, লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নে ৪০ বছর হিন্দু চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন সেই ইউনিয়নে একজন হিন্দু ইউপি সদস্য হিসেবেও নির্বাচনে দাঁড়াতে ভরসা পান না, কারণ সংখ্যালঘু ভোটারই নেই। অনেকেই পৈতৃক ভিটা পরিচিত মুসলমানের হেফাজতে রেখে চলে গেছেন। জানা যায় এখানে ১৭ বছর ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন প্রিয় লাল নামের একজন বিশিষ্ট ধর্ণাঢ্য ব্যক্তি। তারপর চেয়াম্যান হয়েছিলেন দাশরত বাবু। [৭] [৮]
বিএনপি জামায়াতের দাবি ২০০১ সালের ঐ ঘটনা রাজনৈতিক বিষয়। কিন্তু এই রাজনৈতিক বিষয়ের ভিতরও যে সাম্প্রদায়িকতা লুকিয়ে আছে তার প্রমাণ ২০০১ সালের ২ অক্টোবর রাতে একটি হিন্দু পরিবারও নির্যাতনের হাত থেকে বাদ যায়নি। [৭] সেই আট বছরের মেয়েটিকে ধর্ষণের সাথে জড়িত ছিল স্থানীয় ইয়াছিন মাষ্টারের দুই ছেলে সেলিম ও বেল্লাল। [৮]
ভোলার থেকেও নৃশংস ঘটনা সে সময় ঘটেছিল। বাগেরহাটের ফকিরহাটের একটি ঘটনা। সেখানে বাবা মার সামনে ১৩ বছরের মেয়েকে ২২ জনে ধর্ষণ করে হত্যা করেছিল। সেদিন সেই মেয়েটির মার আহাজারী শোনার মানুষ কোথাও ছিল না।
মেয়েটির মা ধর্ষকদের হাত পা ধরে চীৎকার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ‘বাবারা, আমার মেয়েটি ছোট, ও মরে যাবে, তোমরা ওকে আজ ছেড়ে দাও, বাবা তোমরা পরে দুই চারজন করে এসো, এত কষ্ট আমার মেয়ে সইতে পারছে না,।- সেদিন কে শুনেছিল সেই মায়ের কথা?
মেয়ের মা যখন চিৎকার দিয়েছিল, ‘ও বাবারা, আমার মেয়ে আর আওয়াজ দিচ্ছেনা কেন’? তখন ২২ ধর্ষক মেয়েটির লাশ ফেলে হাসতে হাসতে চলে গিয়েছিল’।
এসব ঘটনার পর, চারদলীয় জোটের নেতা আবদুল মান্নান ভূইয়া জনসভায় বলেছিলেন, ‘পাঁচ বছর অত্যাচার নির্যাতন ভোগ করার পর একটু আধটু বাড়াবাড়ী তো হবেই’!
কিন্তু সম্মিলিত ঘটনা বিচার করলে ভোলার ঘটনাগুলোই অমানবিকতার শীর্ষে থাকবে। [৯]
দুঃখজনক বিষয় এটাই নানা সময় এই ঘটনাগুলোর বিচারের কথা উঠলেও তা আজও বাস্তবায়িত হয় নাই। এমনকি আওয়ামী লীগ বারবার এই বিচারের কথা বললেও এর কোন দৃশ্যত ফল দেখা যায় নাই।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখল তাদের ভূমিতে ইতিহাসের ভয়াবহ এক সন্ত্রাসী হামলার দৃশ্য। তার বিশ দিন পর পৃথিবীর আরেক প্রান্তের এক দারিদ্রপীড়িত দেশ দেখল মানবতাকে হত্যা করার দৃশ্য। ২০০১ সালের ভোলা আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই লজ্জার সাক্ষী হয়ে।
তথ্যসূত্রঃ
১। জেলা বাতায়নঃ ভোলা।
২। ১০ বছরে ৯ লাখ হিন্দু কমেছে, শিশির মোড়ল, দৈনিক প্রথম আলো, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১২।
৩। ১৯৮৯ বাংলাদেশ পোগ্রোম, নিঃসঙ্গ গ্রহচারী, মুক্তমনা ব্লগ, ১ আগস্ট ২০১৪।
৪। বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন, ২০০১, উইকিপিডিয়া।
৫। ভোলার ‘ভেণ্ডারবাড়ী’ এক অভিশপ্ত রাতের ভয়াবহ সাক্ষীমানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (১), দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৩ জুন,২০০১।
৬। সংখ্যালঘুশূন্য হচ্ছে ভোলার অন্নদাপ্রসাদ গ্রাম, আমাদের বরিশাল, ৬ অক্টোবর ২০১৩।
৭। নির্যাতিতরা এখনও বিচারের অপেক্ষায়- দৈনিক প্রথম আলো, ২৬ এপ্রিল ২০১১।
৮। এক যুগ পর কেন মেজর হাফিজের বিচার চান এমপি শাওন !- লিটন বাশার, বরিশাল টুডে, ৩০ এপ্রিল, ২০১৩।
৯। ২০০১ এর নির্বাচন পরবর্তী চারদলীয় জোটের সহিংসতা, নিউজডেস্ক, বাংলাদেশনিউজ২৪x৭.কম
একাকী মানব
মন্তব্য
এ নিয়ে ডক্যুমেন্টারি তৈরী হয়েছে। এটা পোস্টে এমবেড করে দিন।
অসহায় লাগে, খুব অসহায়
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ, পার্বত্য জেলা...... কিছুই বাদ নেই...
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা শুধু বইপুস্তকেই রয়ে গেল......
আমার বন্ধু রাশেদ
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন