কাগজে-কলমে “গণহত্যা জাদুঘর” হলেও ভিলনুসবাসী এই ভবনকে এখন “কেজিবি জাদুঘর” হিসেবেই জানেন। মাঝের কয়েকটি বছর জার্মান এস-এস বাহিনী কর্তৃক এই ভবন ব্যাবহারের ইতিহাস বাদ দিলে বাকি পুরোটা সময়ে এই ভবনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি এবং কুখ্যাত গুপ্ত-পুলিশ এনকেভিডির কার্যক্রম। আজও অকু গাতভে ধরে চলতে চলতে অনেকে বয়োবৃদ্ধ এই শতবর্ষী দালানটির পাশে এসে থমকে দাঁড়ান, তাদের অনেকে পথ বদল করে সাততাড়াতাড়ি অন্য পথ ধরেন। মূর্তিমান বিভীষিকার মতো এই ভবনের অতীত স্মৃতি তাদের অনেককেই আজও তাড়া করে বেড়ায়।
ট্রাম থেকে নেমে রাজপথের অন্য সব ভবনের মাঝে এই ভবনটি খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়না। কারণ শুধুমাত্র এ ভবনের দেয়ালের গায়েই কেবল খোদাই করা অজস্র মানুষের নাম, হটাৎ দেখলে মনে হয় পুরো ভবনটিই যেন বিশাল এক এপিটাফ। “আন্তানাস পানাভাস ১৯১৩-১৯৪৬”, “জনাস পেত্রাউস্কাস ১৯২৩-১৯৪৫”, “ব্রনিউস পেত্রাউস্কাস ১৯১২-১৯৪৫”- পাথরের দেয়ালে খোদাই করা এমনি আরও কত কত নাম, সবগুলো পড়তে গেলে হয়তো সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে অনন্ত প্রহর। কেজিবি আর এনকেভিডির হাতে খুন হওয়া এই সহস্র শহীদের নামগুলো অহর্নিশ পথিকদের বলে দেয় আমরা আজও বেঁচে আছি তোমাদেরই মাঝে, থাকবো চিরকাল।
বার্লিন প্রাচীর পতনের পর পরই হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ হামলে পড়ে পূর্ব-জার্মানির কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা স্তাযির সদর দপ্তরে, টেনে-হিঁচড়ে অনেকেই বের করে আনে স্তাযির আর্কাইভে থাকা নিজেদের বা পরিজনদের নামের ফাইলগুলো। ঘটনার হতচকিতায় স্তাযি ঠিক সময় করে উঠতে পারেনি পুরনো দলিল-দস্তাবেজ ধ্বংস করার। ঠিক তেমনটি এই ভিলনুসে ঘটলে হয়তো বাঁচানো যেত কেজিবির অতীত কর্মকাণ্ডের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। লিথুয়ানিয়া স্বাধীন হয় ৯১’র শুরুতে, কিন্তু কেজিবি তারপরও কয়েক মাস কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায় লিথুয়ানিয়া থেকে। আর এই সময়ের ভেতরই তারা ধ্বংস করে ফেলে এই ভবনের ভূগর্ভে সংরক্ষিত সব আর্কাইভ, গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রমাণ। তাহলে কেন ভিলনুসবাসী স্বাধীনতার পর পরই এই ভবনের দখল বুঝে নিলনা? আসলে পূর্ব-বার্লিনের অধিবাসীদের সাথে তাদের পার্থক্যটি এখানে যে, বার্লিনবাসী নিকট অতীতে আর কখনো আর কোনও বহিঃশক্তির পদাবনত ছিলোনা। বার্লিন প্রাচীরের পতন মানেই যে সোভিয়েত বলয় থেকে নিশ্চিত মুক্তি, সেই বোধই খুব সম্ভবত তাদের সাহস যোগায়। অন্যদিকে লিথুয়ানিয়া বিগত দু’শতকের বিভিন্ন সময়েই ছিল রাশিয়ার করতলে, তাই স্বাধীন হবার পরও স্বাধীনতার স্থায়িত্ব নিয়ে শঙ্কা তাদের মনে ছিল আরও কিছুকাল। খুব সম্ভবত এ সব কারণেই চটজলদি এ ভবনের দখল বুঝে নিয়ে কেজিবির সাথে সম্মুখ-সমরে যাবার মতো সাহস তারা করে উঠতে পারেনি স্বাধীনতার অব্যাবহিতকাল পরও।
কেজিবি এই ভবনে ঘাঁটি গাড়ার পর পরই প্রাসাদপ্রম এই ভবনের গা ঘেঁষে লাগানো হয় অসংখ্য পাইন গাছের চারা, পথ চলা কোনও পথিকের দৃষ্টি যেন স্বচ্ছ কাঁচের ওপারের অন্ধকার অধ্যায় পর্যন্ত না পৌঁছয় সেজন্যেই এই ব্যবস্থা। পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে সেই পাইনগুলোই আজ পরিণত হয়েছে মহীরুহে। পাইনের এই দেয়াল পেরিয়ে দেখা পেলাম জাদুঘরে ঢোকবার মূল দরজার।
ছবিঃ জাদুঘরে ঢোকবার মুখে পাইনের দেয়াল
ভবনটি ত্রিতল হলেও কেবল প্রথম, দ্বিতীয় এবং ভূগর্ভস্থ কক্ষগুলোতেই দর্শনার্থীদের প্রবেশাধিকার সীমিত। প্রথম তলাটি মূলত সাজানো হয়েছে পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে লিথুয়ানিয়ান পার্টিজানদের সংগ্রাম আর তদানীন্তন সোভিয়েত সরকারের নিষ্পেষণের খণ্ডচিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে। এ তলায় ছড়িয়ে রাখা নিদর্শনগুলো সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমে মনে হয় বলা ভালো কিছু সমসাময়িক ইতিহাস।
জাতি হিসেবে লিথুয়ানিয়ানরা রাশানদের থেকে পৃথক হলেও সেই জার আমল থেকেই রাশিয়া ক্রম-ধাবমান এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটির পশ্চাৎপানে। লেনিনের সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অল্প কিছু সময়ের জন্যে স্বাধীনতা পায় লিথুয়ানিয়া। কিন্তু প্রলম্বিত স্বাধীনতার সেই স্বপ্নও দুঃস্বপ্নে পরিণত হয় সহসাই। মস্কোয় ক্ষমতায় তখন স্তালিন, ওদিকে হিটলার তার কামানগুলোর মুখ পোল্যান্ডের দিকে তাক করে ততদিনে বাজিয়ে দিয়েছেন আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের দামামা। হিসেব কষে রাশিয়া বুঝে নেয় হিটলারের সাথে বরং সন্ধিচুক্তি করাই ভালো, নিজের সীমানায় যুদ্ধও ঠেকানো গেলো আর অন্যদিকে এই দামামায় নিজের হাতছাড়া হওয়া কিছু পুরনো রাজ্যও মুফতে ফেরত পাওয়া গেলো। ভাতৃত্ব আর সহমর্মিতার জয়ধ্বনি তোলা সমাজতন্ত্রের সাথে জাতীয়তাবাদ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো। মস্কোর অদূরে নান্দনিক উদ্যানে ঘেরা এক বাগানবাড়িতে যখন স্তালিন আর হিটলারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সেই রুটি ভাগাভাগির চুক্তি সাক্ষরের পর শ্যাম্পেন পানে মত্ত, লাল-বাহিনীর কমান্ডার তখন তার বুট জোড়া পালিশ করছেন আসন্ন লিথুয়ানিয়া অভিযানের জন্যে।
জুন মাসটি লিথুয়ানিয়ায় বড় মনোহর সময়ের মাস, এ সময় পাইন আর ওক গাছগুলো সাজে নব-পল্লবে, বুড়ো চেস্টনাট গাছগুলোর পাতায় পাতায় শুরু হয় শীতের নিদ্রা ভেঙে জেগে ওঠা পাখিদের কিচিরমিচির। চারদিকে বিরাজ করে এক অদ্ভুত প্রশান্তিকর পরিবেশ। কিন্তু ৪০’র জুন মাসটি ছিল অন্য বছরগুলোর তুলনায় একটু অন্য রকম। কারণ এই জুন মাসেই লিথুয়ানিয়ার মানুষ কিছু অচেনা আগন্তুকদের আবিষ্কার করে তাদের রাজপথে- ক্রেমলিনের নির্দেশে সেদিন যারা এসেছিলো তাদের স্বাধীনতা হরণ করতে। শুধু সেটুকু পর্যন্ত হলেও হয়তো সহনীয় হতো, কিন্তু এবার সোভিয়েত বাহিনী এসেছিলো একটি নতুন মিশন নিয়ে। স্তালিন বুঝে গিয়েছিলেন রাশিয়ার বলয়ে থাকা এই ক্ষুদ্র দেশগুলো যতদিন তাদের জাতিসত্ত্বাকে আঁকড়ে থাকবে ততদিনই তাদের বাগে আনাটা কঠিন হবে। তাই সহজ সমাধান হল যদি তাদের কক্ষপথের মূল কেদ্রবিন্দুতে থাকা সেই জাতিসত্ত্বাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে একটি মিশ্র-জাতি উদ্ভব করা যায়। সেই যোজনা থেকেই শুরু হল লিথুয়ানিয়াদের ব্যাপক স্থানান্তকরন প্রক্রিয়া। গুপ্ত-পুলিশ এনকেভিডির তালিকায় উঠে গেলো সেকালের লিথুয়ানিয়ান সমাজের প্রতিভূ ব্যক্তিবর্গ, সামরিক বাহিনীর অফিসার, কবি, সাহিত্যিক, যাজক- সোজা কথায় যাদের যাদের সমাজতন্ত্রের শত্রু বলে প্রতিভাত হল তাদের নাম। তালিকায় থাকা সকলের দুয়ারে মাঝ রাতের আঁধারে পৌঁছে গেলো এক চরমপত্র- এখুনি বাক্স-পেঁটরা বেঁধে তৈরি হয়ে নাও পরিবার-পরিজন সহ, তোমাদের চলে যেতে হবে অজানা এক গন্তব্যে। যাদের তুলে নেয়া হল তাদের কাউকে পাঠানো হল সুদূর সাইবেরিয়ার সুমেরু নিকটবর্তী তুন্দ্রা অঞ্চলগুলোতে, আবার কাউকে পাঠানো হল কিরঘিযস্থানের বিরান তৃণভূমিমণ্ডিত জনবিরল কিছু শহরে। হতভাগা এই মানুষগুলো জানলোওনা কি তাদের অপরাধ, রাতের নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ভেদ করে তাদের বহনকারী মালবাহী ট্রেনগুলোই বা চলেছে কোন গন্তব্যে। সেসব উত্তর না হয় অজানাই থাকুক, কিন্তু সেই কালিন্দী রজনীর অজানা যাত্রার কথাই বা তাদের পরিজনরা জানবে কীভাবে? কেউ কেউ বুদ্ধি করে দু’ছত্র লিখে ছুঁড়ে দিলেন ট্রেনের কামরার ভাঙা ফোকরের মাঝ দিয়ে, যদিবা সেই পত্র পথচলতি কারও নজরে পড়ে আর তার মাধ্যমে পৌঁছে যায় স্বজনদের হাতে, সেই আশায়। কিন্তু সেসব পত্র কি আদৌ পৌঁছেছিল তাদের স্বজনদের হাতে? কিছু নিশ্চয়ই পৌঁছেছিলো, নতুবা এই জাদুঘরে তেমনি দু-একটি চিঠি আমার দৃষ্টিগোচর হল কি করে। স্তালিনের সময়ে এমনিভাবে প্রায় দেড় লক্ষ লিথুয়ানিয়াদের পাঠিয়ে দেয়া হয় অন্যত্র, আর তাদের শূন্য স্থান পূরণ করা হল রাশিয়া থেকে নিয়ে আসা বাস্তু-সন্ধানীদের দ্বারা।
ছবিঃ কাজাখ বন্দী শিবিরে এক বন্দী, নাৎসি ক্যাম্পের মতো এখানেও বন্দীদের চেনা হতো কেবল একটি সংখ্যা দিয়ে
ছবিঃ পার্টিজানদের ব্যবহৃত টাইপ-রাইটার
ছবিঃ পার্টিজান প্যারাট্রুপারদের ব্যবহৃত যোগাযোগ যন্ত্র
ছবিঃ পার্টিজান নেতাদের ছবি এবং নানা চিঠি
৪১’ এ হিটলার আর স্তালিনের মধুচন্দ্রিমা সমাপ্ত হবার পর পরবর্তী তিন বছর লিথুয়ানিয়া আবার চলে যায় জার্মানদের খপ্পরে, যদিও ৪৪’র গ্রীষ্মেই সোভিয়েত বাহিনী নাৎসিদের হটিয়ে আবার দখল করে নেয় লিথুয়ানিয়া। আর তার পরই পুনরায় শুরু হয় অর্ধ-শতাব্দীব্যাপী সোভিয়েত আগ্রাসন। এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে স্বল্প-পরিসরে হলেও শুরু হয় সশস্র সংগ্রাম। পার্টিজান গ্রুপগুলো ছড়িয়ে যায় সারা দেশে। গহীন অরণ্যের আচ্ছাদন আর টিলার খাঁজে নির্মিত বাঙ্কারগুলো থেকে চলতে থাকে তাদের সশস্ত্র প্রতিরোধ। স্তালিন অবশ্য নির্মমভাবে দমন করলেন এই বিদ্রোহ। মোটামুটিভাবে ষাটের দশকের শেষ পাদের মধ্যেই সমস্ত বিপ্লবীদের নির্মূল করে ফেলা হয়। কিছু পার্টিজান নেতা পালিয়ে গেলেন পশ্চিমের দেশগুলোতে, তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য লাভের আশায়। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বনেতারা সে সময়ে স্তালিনের সাথে কোনও বিবাদে জড়াবার মতো প্রস্তুত ছিলেননা। মাত্রই তারা একটি বিশ্বযুদ্ধের ধকল সামলে উঠেছেন, ঠিক সে সময়েই আরেকটি বড় যুদ্ধে জড়াবার মতো রাজনৈতিক ও সামরিক ঝুঁকি তারা নিতে চাইলেন না। আর এর ফলে বলির পাঁঠা হতে হল লিথুয়ানিয়ানদের। বিশ্বনেতাদের এই নীরবতার সুযোগে সোভিয়েত নেতারা তাদের মুঠো আরও শক্ত করে নিলেন লিথুয়ানিয়ায়। আর এইসব দমনকাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করে কেজিবি এই ভবনটিকে কেন্দ্র করে। প্রথম তলার কক্ষগুলোতে সংরক্ষিত আছে নির্বাসনে পাঠানো সেসব মানুষদের অসংখ্য ছবি, বিবর্ণ কালির অস্পষ্ট চিঠি, কেজিবি অফিসারদের ব্যবহৃত পোশাক, শ্রমশিবিরের নারীদের সূচি-কর্ম, স্বাধীনতাকামী নেতাদের ছবি, পার্টিজানদের বাঙ্কার খুঁজে বার করার কেজিবির ব্যবহৃত অস্ত্র, সামরিক পোশাক, আরও কত কি। বলপূর্বক দেশান্তর, নির্যাতন, সংগ্রাম প্রভৃতির অসংখ্য আলোকচিত্রের পাশাপাশি আরও কিছু ছবি কিন্তু দৃষ্টিগোচর হল যেগুলো সম্পূর্ণ অন্য এক গল্পের আভাষ দেয়, আর সে গল্প হল বহমান জীবনের গল্প। স্বভূমি থেকে পাঁচ ছ’হাজার মাইল দূরের সেই শ্রমশিবির তথা ‘গুলাগ’ গুলোতে থেমে থাকেনি বন্দীদের জীবন। রবিবাসরীয় প্রার্থনা, বিবাহবন্ধন, সমবেত-সঙ্গীত, এমন অনেক চিত্র নির্দেশ করে আর সব কিছু হারিয়ে গেলেও সম্মুখে ধাবমান জীবন সর্বদা খুঁজে ফিরে অল্প কিছু উপাদান, আর সেগুলো হল মুক্তি, আনন্দ আর স্বপ্ন।
ছবিঃ মঙ্গোলিয়ার সীমান্তবর্তী এক বন্দী-শিবিরের নারী রাজনৈতিক বন্দীর ব্যবহৃত জামা
ছবিঃ বন্দী শিবিরের এক নারীর সূচি-কর্ম- শৃঙ্খলের ওপাশেই মুক্তির চাঁদ
ষাটের দশকের মাঝেই পার্টিজানদেরতো দমন করা হলই, এরপর এ দেশে শক্ত ভিত্তি তৈরি করা হল লিথুয়ানিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির। স্থানীয় লিথুয়ানিয়ানদের পার্টিতে ভেড়াবার জন্যে কাউকে টোপ দেয়া হল দামি এপার্টমেন্টের, কাউকে প্রলোভন দেখান হল ক্রিমিয়ার মতো কৃষ্ণ-সাগরতীরবর্তী অবকাশ কেন্দ্রে ছুটি কাটাবার, কাউকে ভয় দেখান হল মিথ্যে অভিযোগের, আর সর্বশেষ পন্থা হিসেবে কারাভোগের খড়গ তো ছিলই। পার্টিজানদের তৎপরতা কিছুটা কমবার পর কে-জি-বির প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় সাধারণ মানুষের জীবনে অযাচিত শৃঙ্খল-বন্ধন এবং সাড়া লিথুয়ানিয়ায় নিশ্ছিদ্র জাল বিস্তার। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, লিথুয়ানিয়া স্বাধীন হবার পর জানা যায় এ দেশের প্রতি চার জনের এক জন কোনও না কোনও ভাবে কেজিবির সাথে পূর্বে সম্পর্কিত ছিল। এই জাদুঘর ভবনের দ্বিতীয় তলার ঘরগুলো সাজানো হয়েছে সেইসব ইতিহাসকে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে। একটি ঘরে কেবল থরে থরে সাজানো অদৃশ্য-কালি বা রাতের আঁধারে দেখবার মতো বিভিন্ন গোয়েন্দা সরঞ্জাম। সে ঘরের পাশের ঘরটি “আড়ি-পাতা” ঘর। এ ঘর থেকেই আড়ি-পাতা হতো সন্দেহজনক তাবৎ টেলিফোন সংযোগে। কোটের হোল্ডারে ঝোলান কেজিবি অফিসারের কোট, টেবিলের একপাশে রাখা হেডফোন, পাশে রাখা জলের গ্লাস, উল্টে রাখা ডায়েরির পাতা- সব মিলিয়ে মনে হয় দু’দশক নয়, যেন দু’দিন আগে এই কক্ষের শেষ অফিসারটি বিদায় নিয়েছে এ ঘর থেকে।
ছবিঃ আড়িপাতা ঘর
ছবিঃ কেজিবি অফিসারদের ব্যবহৃত পোশাক
ছবিঃ কেজিবির প্রোপাগান্ডামূলক কিছু পুস্তিকা
পলেস্তরা খসা এক দেয়াল আর তাকে আঁকড়ে ধরে পাতালে চলে যাওয়া এক সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলাম জাদুঘরের ভূগর্ভস্থ তলটিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রারম্ভে তৎকালীন এনকেভিডি কর্তৃক এই তলটি নির্মাণের পর কেটে গেছে প্রায় সত্তরটি বছর, কিন্তু আজও এই তলের সবগুলো কক্ষ মোটামুটি অবিকৃত। যদিও কক্ষগুলোর ভেতরের চুনকাম বেশ নতুন বলে মনে হল। আমি ভাবলাম হয়তো এই ভবনকে জাদুঘরে রূপান্তরের পর কক্ষগুলো সংস্কার করে নতুন করে রঙের প্রলেপ দেয়া হয়েছে। পরে জেনেছিলাম, আমার ধারণা ভুল। আলো-বাতাসবিহীন সেঁতসেঁতে সেই ঘরগুলোর অবসন্ন আর বিষাদময় পরিবেশে থাকতে থাকতে বন্দীরা এক সময় চেষ্টা করতো আদিম গুহাবাসী মানুষের মতো দেয়ালের গায়ে নিজেদের কথা লিখে রাখতে। আর সেসব লেখা মুছবার জন্যে কেজিবিকে প্রতি বছরই নতুন করে রঙের প্রলেপ দিতে হতো দেয়ালগুলোর গায়ে, আর তাই আজও এই দেয়ালের রঙগুলো এতটা সজীব। ঘুরে ঘুরে প্রতিটি কামরার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম এখানেই তো মিশে আছে কত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, চাঁপা কান্না আর আর্তনাদ। গোচরে এলো প্রতিটি সেলের ছোট্ট খিড়কী জানালার কাঁচেও বাইরে থেকে সাদা রঙের প্রলেপ দেয়া, যাতে বাইরের জগতের রঙ কি সেটাই যেন বন্দীরা এক সময় ভুলে যায়। কি নির্মম এক ব্যবস্থা। ভেবে অবাক হলাম এই অন্ধকার শীতল প্রকোষ্ঠগুলোতে কি করে বন্দীরা বছরের পর বছর দিনাতিপাত করতো। যে কোনও সুস্থ মানুষকেও এখানে রাখা হলে বছর নয়, কেবলমাত্র কয়েক মাসের মাঝেই অবসন্নতায় মৃত্যু অবধারিত। স্তালিনের সময়ে যখন এই তলটি নির্মিত হয়, তখন বন্দীদের শোবার জন্যে কোনও তাকিয়ার ব্যবস্থাও ছিলনা, কনকনে শীতের দিনগুলোতেও বন্দীদের শুতে হতো হিমশীতল মেঝেতে। ক্রুসচেভের সময় অবশ্য পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটে, বন্দীদের সরবরাহ করা হয় অতি আবশ্যকীয় অল্প কিছু দ্রব্য। আর সব কক্ষগুলো দেখতে অনেকটা এক রকম হলেও দুটো কক্ষ একেবারেই আলাদা। এর একটি ব্যবহৃত হতো গুম-ঘর হিসেবে। স্তালিনের সময় নামকাওয়াস্তে বিচারের মাধ্যমে প্রায় এক হাজার রাজনৈতিক বন্দীকে মাথার পেছনে পিস্তল ঠেকিয়ে খুন করা হয় এই ঘরটিতে, যাদের অনেকের সমাহিত করার স্থান আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। হয়তোবা তাদের অশরীরী আত্মা আজও ঘুরে বেড়ায় এ ঘরের চার দেয়ালের মাঝে। খুব বেশিক্ষণ এ ঘরের সামনে দাঁড়াবার মনোবল আমার ছিলোনা, অনেকটা যেন তাই ছিটকে চলে এলাম সেখান থেকে। অন্য ঘরটি এক বিশেষায়িত নির্যাতন ঘর, এটি অবশ্য বানানো হয়েছিলো সত্তরের দশকে। এ ঘরের বৈশিষ্ট্য হল শব্দ শোষণের জন্যে চারদিকে লম্বা পুরু চাদরের প্রলেপ দিয়ে পুরো ঘরটিই মোড়ানো, যাতে করে নির্যাতিতদের প্রলাপ আর আর্তনাদ কিছুতেই অন্য বন্দীদের কানে না যায়। ওদিকে ততোক্ষণে আমার মাথা ঝিমঝিম করছে, একদিনে বইবার মতো যথেষ্ট মানসিক চাপই বটে। জলদি পা চালিয়ে তাই ওপরে উঠে এলাম।
ছবিঃ ভূগর্ভস্থ বন্দীশালায় যাবার সিঁড়ি
ছবিঃ ভূগর্ভস্থ বন্দীশালার ঘর
ছবিঃ ভূগর্ভস্থ বন্দীশালার ঘর
ছবিঃ মৃত রাজনৈতিক বন্দীদের কিছু ছবি
ফিরবার আগে ভাবলাম জাদুঘরের অতিথি বইতে কিছু কথা লিখে যাই। চলতি পাতায় লেখা অন্য আগত দর্শনার্থীদের কিছু কথা নজরে এলো। একজন লিখে গেছে, “আমরা কেন বন্ধু হতে পারিনা?”। আমস্টারডাম থেকে আগত একজন লিখে গেছে, “এখানে আনন্দ নেই, তবে আছে বিগত কালো ইতিহাসকে জানবার উপাদান”। আর আমি শুধু বাংলায় লিখে এলাম তিনটি শব্দ, “মনুষ্যত্বের জয় হোক”।
মন্তব্য
লেখার শেষে নাম লিখে ভুলে গিয়েছিলাম, অতিথি লেখক হিসেবে সেটা এখন সংযুক্ত করার কোনো উপায় আছে কি?
জীবনযুদ্ধ
জানার শেষ নাই। ছবির ফাঁকে ফাঁকে বর্ণনা ভাল লেগেছে। পরের বার লেখা পোস্টের সময় নামখানা আছে কিনা প্রিভিউতে আগেই দেখে নিবেন। শুভকামনা।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
ধন্যবাদ সুলতানা
জীবনযুদ্ধ
মর্মান্তিক ইতিহাস। পৃথিবীকে নূতন দিশা দেখানোর কাণ্ডারি দেশের কি ভয়ংকর রূপ!
লেখা ভালো লেগেছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
লেখা ভালো লাগবার জন্যে ধন্যবাদ, আপনিও ভালো লেখেন
জীবনযুদ্ধ
মাথায় শুধু দ্যা পিয়ানিস্টের দৃশ্যপট ঘুরছে....
আমার বন্ধু রাশেদ
মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ
জীবনযুদ্ধ
মনুষ্যত্বের জয় হোক
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
পৃথিবীর ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত সেটা হবে কিনা সন্দেহ, মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ
জীবনযুদ্ধ
নতুন মন্তব্য করুন