লাউপেটু ছেলেটার পরনে কিছুই নেই। শুধুমাত্র কোমরের ঘুনচিতে দুটো ঘুঙুর বাঁধা। বয়স পাঁচ হবে হয়তো। গোল নায়ের মতো পেটখানা সামনে পেছনের দিকে হাত দুটো নবাবি কায়দায় যেন ওর গতরের বৈঠা ধরল।অচেনা কাউকে দেখলে চাঁদ চিলতে হেসে চার আঙুলে কপাল মেপে জানাবে- আত্তালামু আলাইকুম।
ওকে প্রায়ই স্কুলের পাশে,সেতুর কাছে , মাঠে দেখা যায়। নানার বাড়ি ওর জন্য স্বীকৃত । দাদা বাড়ির পরিচয় দেওয়ার উপায় কিংবা অধিকার কয়েক কানি জমির দলিলে চাপা পড়ে আছে। ওর বয়েসি ছেলেরা বগলে আরবি বর্ণমালার বইটা চেপে, বাবার ঝুলো টুপিটায় কপাল-চোখ ঢেকে ছোট্ট লুঙ্গি পেচিয়ে, নাকে সর্দি টেনে টেনে মসজিদে যায়। কেউ কেউ বাড়ি থেকে মসজিদে আসার মাঝ পথে পস্রাব করে এবং ঢিলার ধার না ধেরে মসজিদেও এসেও ক‘ফোঁটা ঝরিয়ে দেয়। তাতে কিছু আসবে যাবে না। কিন্তু ওর মসজিদে আসা নিষেধ।
কেউ যদি প্রশ্ন করে
- এই তর বাপের নাম কি?
- বাপ মইরা গেছে .
- মইরা গেছে ভালা কথাম কিন্তুক তর বাপের নাম কি আছিল?
- বাপ মইরা গেছে।
বাবার নাম জানা নেই। জানার কথাও নয়। নানী শিখিয়ে দিয়েছে কেউ জিজ্ঞেস করলে কইবি বাপ মইরা গেছে।
ছেলেটার বাবার নাম কি ছিল কিংবা কে হতে পারতো, বেঁচে আছে কি মরে গেছে এসব যারা খুব ভালো করে জানে তারাই ওকে বেশি বেশি প্রশ্ন করে তর বাপের নাম কি? ওরা মজা পায় খুব মজা।
ওর বাবা মা ওর জন্মের বীজ বপন করে ছিল কাজীর সাথে কলমা পড়ে কবুল না বলেই। রেজিষ্ট্রারে ওর বাবার নাম লিখা নেই কিন্তু ওর শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে, রন্ধ্রে বীজ বর্র্ণে লিখা বাবার নাম আতাউর। বর্ষাধোয়া কদম ফুলের মতো ফুটফুটো কিশোরী ছিল মোহনা। মোহনার পেটে ছেলেটার ভ্রুণ বয়স যখন তিন মাস পেরোল তখন ব্যাপারটা পুরো গ্রাম জানাজানি হয়। গ্রামে মোহনার ব্যাপারটা ছোট খাটো বিনোদনের পর্যায়ে পৌছায়। এ পাড়া ও পাড়া থেকে মহিলা কিশোরী তরুণী এমনকি ছেলে বুড়ো সবাই আসে দেখতে।
ঘটনার প্রথম থেকেই জানতো আতাউরের মা। আতউরের বাবা রহমত মোল্লা হুজুর মানুষ ,তাঁকে জানানো দরকার মনে করেনি মা। ছেলেকেও তেমন ভাবে শাসন করেনি। ঘটনার নায়ক হয়ে যখন আতাউরের নাম বলল মোহনা তখন রহমত মোল্লা গর্জে উঠল। আতাউরের মা বলল-
খবিসের কথা আগেই জানমতাম তুমারে কই নাই। ঘটনা এরম হইবো কেড জানতো।
রহমত মোল্লা ধমকাল
চুপ, এক্কবারে চুপ! মাইয়া মানুষ শয়তানের দড়ি, গলায়তো আল্লায় হাড্ডি দেয় নাই। এ কথা স্বীকার করন যাইবো না। পোলারে না কইরা দিবা, যা দেখবার আমি দেখতাছি।
রহমত মোল্লা গ্রামের অনেক কিছুই দেখেছে। এরকম ঘটনা গ্রামে আরো একটা ঘটেছিল। রহমত মোলার পরিষ্কার ফায়সালা একশ একটা দোররা ছেলে মেয়ে দুজন কেই।
মোহনা মেয়েটা বোকা, বেভুলো বেহুশ। কৈশরিক প্রেমে আরন্যিক মুগ্ধতায় ডুবে ছিল। হাওয়াখোলা পালের মতো উড়িয়ে দিয়েছে নিজেকে। কিন্তু আতাউর! দূর গাড়িয়াল ভাইয়ের গানের মতো ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে গেল।
সালিশ। গ্রামের মাতাব্বর জড়ো হল। রহমত মোল্লা হুজুর মানুষ সম্মানিত লোক। তাঁর ছেলে নিয়ে দরবার। তো কি হল? হুজুর সাহেব ফতোয়া ঝাড়ল একশ একটা দোররা, শুধু মাইয়ারে।
মাতাব্বররা বলল পোলারে কি দোষ মাইয়া মানুষ হইল আগুন, আগুনের কাছে মোম আইলে তো গলবেই। তো যাই হোক মামলা মোকদ্দমা করার দরকার নাই গ্রামের ইজ্জত যাইবে। তার চেয়ে ভালা হুজুর সাব মাইয়ারে দুই কানি ধানি জমি দলিল কইরা দেউক এডাই দরবার বিবেচনা করলা।
মোহনাকে দোররা মারা হচ্ছে। কচকচে কালচে সবুজ ধান গুচ্ছের মতো চুলে সুতাবুড়ির সুতা জড়িয়ে যে মেয়েটা মুকুট বানাতো সে মেয়েটার মাথাটা খুব নিচু। যেন সুতাবুড়ির পুরো আকাশটাই ওর মাথায় ভর করে আছে। পান খাওয়া খয়েরি প্রলেপ পরা দাঁতে খিলাল খুঁচিয়ে খাদ্যকণা বের করছে এইমাত্র রহমত মল্লার বাড়ি থেকে ভোজ ফেরত মাতাব্বররা।
শ্যাওলাটা পুকুর পাঁপড়ি ফাঁসা পালকের জল ছঁই না ছুঁই নৌকার উড়ে যাওয়ার মতো সময় গুলো চলে গেল।
মোহনা কি সুখে আছে? ঢাকায় কোন গার্মেন্টস কারখানায় কোন ছেলের সাথে ভাব জমিয়ে বিয়ে করেছে। রোজ রোজ মার খায়। নিজের জীবনের একচ্ছত্র অধিপতি কেউ কখনো হতে পেরেছ? কিছু ভুল, স্বার্থরসা মানুষ, প্রথার কাছি, ধর্মের সিসাগলা কঠিন বাঁধন ইত্যাদি জীবনটার অনেক কিছুই কেড়ে নেয়।
ওই ন্যাংটা পুটো ছেলেটা বেড়ে উঠেছে। ডিগডিগে বাঁশের ছিলকের উপর রোদ বৃষ্টি ছলকে পড়ার মতো ওর জীবনে দুঃখ কষ্ট পিছলে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। গ্রামের ছেলেরা ওকে ডাকে দশেরপুত। ছেলেটা চেয়ে দেখে বাবারা হাট থেকে মুরালির পুটলি নিয়ে এসে সন্তানদের দেয়, মায়েরা ছেলেদের গতর ধুয়ে দেয়। আদিখ্যেপণা করে ওর বয়েসিরা শুধুই বলে পেট ব্যাথা করতাহে আম্মা।
তবে পরশকাতর মাকড়শার জালে ক’ফোঁটা শিশির জমে যাওয়ার মতো ওর জীবনেও কিছু আনন্দ আছে। ওর সময় কাটে অপার আকাশ দেখে। পিঁপড়ের সারি আর পাখির বাসা গুণতে গুণতে। হুটপাট ঝড় আর ছুটছাট মেঘ নিয়ে দুয়ারে বেশেখ এলে ছেলেটা বৈশাখী বৃষ্টিতে শিলদাগা আম কুড়োয়।
- এই ছেরা কই যাইতাছস? এত দৌড়াছ ক্যান?
- পইড়া ব্যাথা পাবি।
- নানী রহমত মোল্লা ফুলু বাউলার চুল কাটতাছে দেইখ্যা আহি।
- হুইন্যা যা, তর লাইগা নতুন হাফপেন্ট আনছি, পইরা যা।
হাফপ্যান্ট পেয়ে দৌড় দিল ফুল বাউলার চুল কাটা দেখতে। দৌড়ে দৌড়ে ওর ঘুঙুর দুটো বাজছে।
আচ্ছা ছেলেটার নাম যেন কি ? নাম জেনে কী হবে? বরং আপনিই একটা নাম রেখে দিন না। আর বাবার নাম? রেজিস্টারে লিখা নেই, দুই কানি জমির দলিলে সে ঝামেলা চুকে গেছে। তাছাড়া গ্রামের ছেলেরা তো বলেই দশেরপুত।
(মজিবুর রহমান)rmozibur181@gmail.com
মন্তব্য
আপনাকে দিয়ে হবে। লেখালিখি চালুক
বানানের প্রতি যত্ন নিবেন।
সচলে স্বাগতম
সচেতন হবো, ধন্যবাদ।
ভয়াবহ সুন্দর গল্প। স্যালুট বস।
রাজর্ষি
রাজর্ষি , আপনি স্যালুট দিয়ে দিলেন,আপনাকে ধন্যবাদ জানালে প্রতিউত্তরটা বেশ ছোট হয়ে যাবে।
অসাধারণ একটি গল্প দিয়ে যাত্রা শুরু। ঝরঝরে বলার ভঙ্গিতে জীবনের সব অন্ধকার যেনো মুঠোবন্দি হয়েছে। শুভকামনা।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
ধন্যবাদ সাদিয়া সুলতানা , তবে আপনার গল্পের বুনন দেখে আমার ঈর্ষা হয়।
পড়তে ভাল লেগেছে। লেখালেখি চলুক। সচলে স্বাগতম।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ঘটনা পরিচিত হলেও লেখকের লেখার মুন্সিয়ানা চমৎকার। আমার কাছে স্পেশালি এটা ভালো লেগেছে --
"তবে পরশকাতর মাকড়শার জালে ক’ফোঁটা শিশির জমে যাওয়ার মতো ওর জীবনেও কিছু আনন্দ আছে। ওর সময় কাটে অপার আকাশ দেখে। পিঁপড়ের সারি আর পাখির বাসা গুণতে গুণতে। হুটপাট ঝড় আর ছুটছাট মেঘ নিয়ে দুয়ারে বেশেখ এলে ছেলেটা বৈশাখী বৃষ্টিতে শিলদাগা আম কুড়োয়।"
--- দৃশ্যটা চোখে ভাসছিল, ছেলেটা দৌড়াচ্ছে। খুব সুন্দর করে লিখেছেন যেখানে যত্নের ছাপ পাওয়া যাচ্ছে।
শুভকামনা রইলো।
অপর্ণা মিতু
অপর্ণা মিতু, খুব যত্নে পড়েছেন সে ছাপ পাওয়া যায়, ধন্যবাদ।
ঝরঝরে, ধারালো, চমৎকার গল্প!
রংতুলির রং রং উৎসাহের জন্য ধন্যবাদ।
আপনার লেখার হাত চমৎকার। চলুক গল্প লেখা।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
এই চমৎকার হাতে যদি একখানা ত্রিমাত্রিক গল্প লিখতে পারতাম , তাইলে আমিও হইতাম ত্রিমাত্রিক গল্পাকার!
দেখি কতক যেতে পারি।
অনেক ধন্যবাদ ত্রিমাত্রিক কবি ।
বর্র্ণে, আদিখ্যেপণা, ছঁই না ছুঁই, ব্যাথা, আরন্যিক, মোলার, পস্রাবজাতীয়, মাতাব্বর, কৈশরিক, ফুটফুটো, কথাম, করতাহে, বেহুশ-- এতো টাইপো+ বানানের সমস্যায় গল্প পড়তে আর ভাল্লাগলো না, দুঃখিত।
পরবর্তীতে প্রিভিউতে দেখে পোস্ট করবেন প্লিজ।
সচলে স্বাগতম। আরো লিখুন।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
চেষ্টা করবো পরবর্তী লেখাটা যাতে আপনি নির্বিঘ্নে পড়তে পারেন, ধন্যবাদ।
সচলে স্বাগতম। লিখতে থাকুন।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ধন্যবাদ সাক্ষী সত্যানন্দ
আপনার কলমের শক্তিমত্তা প্রশংসনীয়, নিবের মসৃণতা অনবদ্য। নিয়মিত অনুশীলনে একদিন সোনা ফলবে বলেই মনে হয়। সময় নিয়ে লিখুন, লেখা যেন গভীর চিন্তার ফসল হয়ে উঠে আসে। আমি লিখে দিতে পারি, আপনার হবে।
এটুকুর প্রয়োজন ছিল না। কারণ প্রকারন্তরে পুরো গল্পটার পরতে পরতে এই বক্তব্যই পরোক্ষে মিশে আছে।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
হ্যাঁ, গল্পের দুর্বল অংশটা ঠিক ধরেছেন, ছেঁটে নেব। অনেক উৎসাহ পেলাম, ধন্যবাদ।
ভাল লেগেছে।
অসাধারণ লেখনী.....অসাধারণ!
আমার বন্ধু রাশেদ
অসাধারণ উৎসাহ পেলাম, অসাধারণ !!!!
ধন্যবাদ আমার বন্ধু রাশেদ ।
সচলায়তনে স্বাগতম
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আপনার লেখার স্টাইলটা দারুণ। ভাল লাগল। সচলে স্বাগতম
সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল
আপনার ভাল লাগল জেনে আমরও অনেক ভাল লাগছে।
ধন্যবাদ সোহেল লেহস ।
শব্দ নিয়ে খেলা করতে আপনি যে বেশ পটু তা প্রথমেই বুঝে গিয়েছিলাম "চাঁদ চিলতে" হাসি আর "চার আঙুলে কপাল মেপে" জানানোয়। তবে পরে এসে "মায়েরা ছেলেদের গতর ধুয়ে দেয়" কথাটায় একটু হোঁচট খেলাম। এছাড়া আগাগোড়া ভালো লাগলো। আপনার ভাষাও এগিয়েছে তরতরিয়ে। আরো লেখা আসুক।
আচ্ছা, লাউপেটু মানে কি?
____________________________
লাউপেটু বলতে লাউয়ের মতো ঢোলা পেট বোঝাতে চেয়েছি , অপুষ্টিজনিত কারণে গ্রামের শিশুদের এমন পেট হয়ে থাকে ।
অনেক ধন্যবাদ প্রফেসর সাহেব !
আরও আসুক এমন গল্প।
শুভেচ্ছা
এমন উৎসাহ পেলে লিখতে সাহস পাই!!!!!
ধন্যবাদ মেঘলা মানুষ ।
খুব সুন্দর গল্প।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
ধন্যবাদ শিশিরকণা
সুন্দরভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে সমাজের একটা কলঙ্ককে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো হয়েছে...অসাধারন..চালিয়ে যান!!!..
সুন্দর লেখনির মাধ্যমে সমাজের একটি বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে...চালিয়ে যান....Abdullah Al Fuad
মন ছুঁয়ে গেল।
লিখতে থাকুন,
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
আপনার পপকর্ণের মর্যাদা রাখতে চেষ্টা করবো ।
ধন্যবাদ শাব্দিক।
খুব ভালো, লেখাটা চলুক।
আপনার শব্দ নিয়ে খেলা করাটা মুগ্ধ করেছে। লেখালেখি চলুক
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
ধন্যবাদ ভাই!!
মুগ্ধ হওয়ার মত লেখনি
এত ভালো লেখেন আপনি! মুগ্ধতার চূড়ান্ত!
দেবদ্যুতি রায়
দেবদ্যুতি রায় !!!!!!
নতুন মন্তব্য করুন