বাংলাদেশে সাংবাদিকতার এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশের সকল ক্রান্তিকালীন সময়ে সাংবাদিক এবং সংবাদ মাধ্যমগুলো গঠনমূলক এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছেন। সেই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জনগণ সাংবাদিক এবং সংবাদ মাধ্যমগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, আমাদের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্বের দাবীদার, যা কিছু ভাল তার সাথে চলবার প্রত্যয় ব্যক্তকারী ‘প্রথম আলো’র মধ্যে নীতি এবং আদর্শের ঘাটতি ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে।
বিগত দেড় দশকের চেয়েও বেশী সময় ধরে চলা প্রথম আলো বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবর এবং রিপোর্ট পরিবেশনের মাধ্যমে নিজেরাই সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। নিকটবর্তী সময়ে সম্পাদক মতিয়ুর রহমান এবং যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান সুপ্রিম কোর্টে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আদালত অবমাননার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি লাভ করেন। উল্লেখ্য যে তাদের এই ক্ষমা প্রার্থনার ঘটনা বা আদালত অবমাননার অভিযোগ – কোনটিই প্রথম নয়। এতে করেই সাংবাদিকতাতে তাদের নীতিহীনতা, সুবিধাবাদিতা আর অসাধু চর্চার নজির স্থাপিত হল – তা বলব না। তবে গত দুই/তিন দিনে দুইটি বিশেষ ঘটনার উপর প্রথম আলোর রিপোর্টিং তাদের নীতি এবং দায়িত্বজ্ঞান সম্পর্কে প্রশ্ন করার যথেষ্ট কারন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রথমেই আসে বিএনপি চেয়ারপারসনের সাথে অমিত শাহর কথিত টেলিফোন সংলাপের বিষয়টি। ৭ তারিখ রাতে বিএনপির মারুফ কামাল খান সাংবাদিকদের জানান যে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রধান অমিত শাহ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ফোন করে তার কুশলাদি জানতে চেয়েছেন। বিষয়টি আপাত দৃষ্টিতে খুব সাধারন দেখালেও বাংলাদেশের রাজনীতি সচেতন মহলের কাছে এর তাৎপর্য অনেক। একটি গোষ্ঠী অনেক দিন ধরেই বলে আসছিল যে আওয়ামী লীগের সাথে ভারতের কংগ্রেস পার্টির ঐতিহাসিক সখ্যতা বিজেপির জন্য খুব একটা স্বচ্ছন্দের হবে না এবং ভারতের নতুন বিজেপি সরকারের সাথে বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্কের অবনতি হতে পারে – যা কিনা আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মেয়াদ পূরণ করার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হতে পারে। মজার ব্যাপার হল – এই ব্যাখ্যাটি বিএনপিপন্থী বিশ্লেষক, গবেষকরা ভারতের নির্বাচনের আগে বিভিন্ন সুরে এবং আঙ্গিকে প্রচার করে যাচ্ছিলেন (সূত্র)। কিন্তু নির্বাচনের পরে দেখা গেল মনমোহন সিং-এর মতই মোদি সরকার বাংলাদেশের সাথে উষ্ণ সম্পর্কে আগ্রহ দেখাল(উদাহরনঃ ল্যান্ড বর্ডার এগ্রিমেন্ট এবং তিস্তা চুক্তির জন্য মমতার উপর চাপ প্রদান)। এতে করে গত ৬ মাসে বিএনপি শিবিরে হতাশা দেখা দেয়। যেই দলের জন্ম ক্যান্টনমেন্ট কেন্দ্রিক ষঢ়যন্ত্রের পথ ধরে, যে দল গঠিত হয়েছে নানা মতের নানা পথের আদর্শহীন এবং সুবিধাবাদী নেতৃত্ব দিয়ে সেই দলের নেতা/কর্মী/সমর্থকদের কাছে আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মাধ্যমে ক্ষমতার পট পরিবর্তন একটি সুপ্রিয় সমাধান। অবাক হব না, যদি তাদের মধ্যে একটি বিরাট অংশ ৭৫-এর ১৫ই আগস্ট বা ২০০৪-এর ২১শে আগস্টকে প্রকাশ্যে বা মনে মনে সমর্থন করে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে তারা দুইটি বিষয়ে হতাশ বোধ করছিল – এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে ৭০এর দশকের মত ভারতের সাথে ‘পাঙ্গা’ নিতে আগ্রহী নয়। আর দ্বিতীয়ত দিল্লী আর ওয়াসিংটনের সমর্থন ছাড়া আমাদের সামরিক, বেসামরিক সুশীলদের একটি ১/১১ করার মুরাদ নেই। রাস্তার আন্দোলন আর যাই হোক এই সুবিধাবাদী এবং সুবিধাভোগী নীতিহীন লালু/ভুলুদের দিয়ে হবে না। তাই যখন-ই অমিত শাহ-র খবরটি আসল দীর্ঘদিন ধরে ঝিমিয়ে পড়া বিএনপি-জামাতের শুভাকাংক্ষী সুজন/সজ্জনমহল নড়ে চড়ে বসল। প্রথম আলো বড় করে অনলাইন সংস্করণে এই খবর প্রচার করল। একি সময়ে খবর আসল মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্রের ছয় জন কংগ্রেসম্যান সরকারের স্বৈরাচারী কর্মকান্ডের বিরূদ্ধে যুক্ত বিবৃতি দিয়েছে। কুটনৈতিক এবং রাজনৈতিক উভয় বিচারেই এই বিবৃতি যথেষ্ট গুরুত্ববহন করে, আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে এই দুই ঘটনার সময়কালটি। অবৈধ ক্ষমতার পালাবদলে যাদের আনন্দ এই ঘটনার প্রেক্ষিতে তারা আহ্লাদিত হবে –সেটাই স্বাভাবিক – আর বাংলাদেশের সামরিক বেসামরিক সুশীলদের প্রথম পছন্দ প্রথম আলো পত্রিকা এই দুই খবরকেই বেশ প্রাধান্য প্রদান করবে- সেটি আরো স্বাভাবিক।
দুইদিনের কম সময়েই গনেশ উল্টে যায়। বেসরকারী টিভির এবং অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর অনুসন্ধাণী রিপোর্টে বের হয়ে আসে যে অমিত শাহর ফোনের বিষয়টি সম্পর্কে ভারতীয় দুতাবাস বা বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ নেতৃত্ব ওয়াকিবহাল নয় (বাংলনিউজ এবং কালের কন্ঠের খবরের স্ক্রিন শট এখানে দেয়া হল)। এমনকি এবিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা সরাজ নিজে অমিত শাহর কাছে জানতে চেয়েছেন বলেও খবর প্রচারিতে হতে থাকে। প্রথম আলোর অনলাইন ভার্সনে এ বিষয়ে কোন গবেষনালব্ধ রিপোর্ট না দিয়ে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির দুই নেতার যথাক্রমএ মাহবুবুল আলম হানিফ এবং মারুফ কামালের বক্তব্য পাশাপাশি প্রকাশ করা হয় (মূল পেইজ এবং মারুফ কামাল/হানিফের সংবাদ সম্মেলনের খবরের স্ক্রিন শট দেয়া হল)। রিপোর্ট দেখে যে কারও মনে হতে পারে – অমিত শাহ-র ফোনের ব্যাপারে সংশয়টি আসলে আওয়ামী নেতৃত্বের মস্তিষ্কজাত। এখানে যে একাধিক সংবাদ মাধ্যমের নিজস্ব প্রতিবেদন থেকে ক্রমেই বোঝা যাচ্ছে যে অমিত শাহ ফোন করেন নি –সেটি সুচতুরভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এবং প্রথম আলোর নিজস্ব কোন রিপোর্ট অনলাইন ভার্সনে দেয়া হয়নি (পরে প্রিন্ট ভার্সনে অবশ্য আলাদা রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়)। এতে করে দুইটি উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা হতে পারে – প্রথমত পাঠকদের আরো বিভ্রান্ত করা। যখন কিনা বিএনপির মিথ্যার বেড়াল থলে থেকে বেরিয়ে যাবার উপক্রম তখনো এক ধরনের ধোয়াশা তৈরী করে রাখা। দ্বিতীয়ত – বিএনপির মিথ্যাচারকে আড়াল করার জন্য পুরো বিষয়টিকে দুই দলের ঝগড়া-ঝাটির আরো একটি উদাহরণ হিসাবে প্রকাশ করা। আমাদের দেশের রাজনীতি বিমুখ আর রাজনীতিতে সংশয় রাখে এমন লোকজন এই খবর দেখে ভাবতেই পারে যে – “অমিত শাহর ফোন নিয়ে এত মাতামাতির কি দরকার? এই দুই দল আছেই একে অপরের পেছনে লাগতে”, এর উদাহরণস্বরূপ সাবেক বিতার্কিক এবং টিভি উপস্থাপক আব্দুন নুর তুষারের ফেসবুক স্ট্যাটাসটি দেখা যেতে পারে (স্ক্রিন শট দেয়া হল)। জনাব তুষার আর তার মত সুশীল ব্যাক্তিবর্গ জানেন যে দুই দলকে সমানভাবে গালি দিলে ফেসবুকে লাইকের কমতি হবে না।
এরি মধ্যে একি দিনে খবর আসে যে মার্কিন কংগ্রেসের কেউ কোন বিবৃতি প্রদান করেন নি। যাদের নাম ব্যাবহার করা হয়েছিল তারা নিজেরাই এজন্য উষ্মা প্রকাশ করেন। আরো জানা যায় যে তারেক রহমানের এক সহচর লন্ডন থেকে এই জাল বিবৃতি সরবরাহ করেন। প্রথম আলোর অনলাইন এবং প্রিন্ট উভয় ভার্সন এই খবরটিকে পুরোপুরি চেপে যায়। আগে উল্লেখ করা সেই হানিফ সাহেবের বিবৃতির অংশ হিসাবে অনলাইন ভার্সনে খবরটি উল্লেখ করা হয়। কিন্তু আলাদাভাবে খবরটি প্রকাশ করার সততা বা সাহস তারা দেখাতে পারল না। প্রধানমন্ত্রী তনয় সজীব হোসেন জয়ের ফেসবুক স্ট্যাটাসে প্রথম আলোসহ কিছু সংবাদ মাধ্যমের এবিষয়ে ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।
ইতিপূর্বে প্রথম আলোর অনেক রিপোর্টে জামাত-বিএনপির বদলে ‘দুর্বৃত্ত’ (সূত্র)শব্দটির ব্যাবহার অনেকের কাছেই একধরনের পক্ষপাতমূলক ক্ষমাভিক্ষুক অবস্থান বলে মনে হয়েছে। কারন তারা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের রিপোর্টে ‘ছাত্রলীগ’ বলতে দ্বিধা বোধ করে না। প্রথম আলো ক্রমেই প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রতিভু হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণের পাঠক মন্তব্য এবং ‘লাইক’-এর বাহার দেখলেই বোঝা যায় যে পত্রিকাটি ‘আমার দেশ’-এর টার্গেট মার্কেট দখল করে নিয়েছে আবার একই সাথে সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত শহুরে শ্রেনীকেও ধরে রাখার চেষ্টা করছে। এই মিডিয়া দানবের কার্যক্রম সম্পর্কে আমাদের আরো সাবধানী হবার সময় হয়েছে।
- লেখক 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ'
মন্তব্য
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আমার ধারণা, খবর দু'টিই যে ডাঁহা মিথ্যা, এটা খবর প্রকাশ করার আগে প্রথম আলো সহজেই বুঝতে পেরেছে। খবর প্রকাশ করে ক্ষতি যা করার করে ফেলেছে প্রথম আলো। আজ যদি পুরো ১ম পাতা জুড়ে দুঃখ প্রকাশ করে বা ক্ষমা চায়, তাতে প্রথম আলোর কিছু যায় আসে না। কারণ এর দু'কানই কাটা। তারপরও পাঠকের কাছে ক্ষমা চাইবে না প্রথম আলো। তবে আদালত মইত্যাচোরারে তলব করলে সেটা আলাদা কথা। বরং খবর দু'টি যে ডাঁহা মিথ্যা, এ তথ্য প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কিভাবে আরও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যায়, এই নিয়ে প্রথম আলো এক্সপেরিমেন্ট করছে এখন।
সোজা কথা, সরকার, দেশ বা বাঙালির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার কোনই উপাদান নেই, এমন খবর বা ছবি 'প্রথম আলো' খুঁজে বের করাটাই এখন পাজল।
কংগ্রেস সদস্যদের যে বিবৃতির দাবী বিএনপি করেছিলো, সেই বিবৃতির কোনো কপি কি তারা দেখিয়েছিলো সাংবাদিকদের? (আমার ঠিকমতো ফলো করা হয়নি)
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ঘ্যাচাং
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
দুঃখজনক ভাবে প্রথম আলোর এই ভণ্ডামি ভূমিকা তার জন্ম থেকে চললেও কেউ তাকে ঘাঁটায় না। আওয়ামী লীগের হাজার ক্ষতি করলেও তারা নিজেরাই প্রথম আলোকে তোয়াজ করে চলে
-রিফাত রহমান
নতুন মন্তব্য করুন