ফ্রান্সের শার্লি এঁবদো পত্রিকায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হত্যাকান্ড নিয়ে ফেইসবুকে আর বিভিন্ন সোশাল মিডিয়ায় তোলপাড় চলছে । এই ঘটনার বদৌলতে আরো একবার টের পেলাম আমাদের দেশে কি পরিমাণ মৌলবাদী গোঁড়া চিন্তাভাবনার প্রসার বাড়ছে । সরাসরি এই খুনকে সমর্থন করা ভয়ংকর চিন্তাভাবনার লোকজনের সংখ্যা দেখে দেখে আঁতকে উঠেছি । কিন্তু এরা ছাড়াও ফেইসবুকে আরেক শ্রেনী আছে, যাদের বক্তব্য আমার মনে হয়েছে আরও বেশী ভয়ংকর ! যাদের বক্তব্য আপাতদৃষ্টিতে খুবই শান্তিময়, মহৎ, বেশ সুশীল । তাদের বক্তব্যের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে, শার্লি এঁবদোর , কিংবা যে কারোর , দরকারটা কি কাউকে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করার ? কাউকে বিদ্রুপ না করলেই তো আর ক্ষেপে গিয়ে সে খুন করতে বাধ্য হয়না । ঠিক যেন মেয়েদের প্রতি অশালীনতার অভিযোগ ! মেয়েরা খারাপ পোষাক পরে বলেই না ছেলেরা রেইপ করতে উষ্কানি পায় ! কাজেই উভয় দলই সমান দোষে দোষী !!
এই পোস্টটা লিখেছি তাদের জন্য , যারা একটু চিন্তা করতে পারে, কিন্তু কনফিউজড এই ব্যাপারগুলা নিয়ে, কারণ তারা শান্তিপ্রিয়, ধর্মের ওপর সরাসরি আক্রমণ অপছন্দ করে । এই প্রশ্নটার উত্তর পাওয়া তাদের জন্য অনেক জরুরী বলে আমার মনে হয়, যে কেন গনহারে সবাইকে শ্রদ্ধা করা সম্ভব না । কারণ কথাটা শুনতে বেশ ভালো বলে লোকে বিভ্রান্ত হয় ।
এইকথা মনে হতে পারে যে, হুদাই ধর্ম/ধর্মগুরুদের নিয়ে (অথবা যে কাউকে নিয়ে) ব্যাঙ্গচিত্র আঁকার প্রয়োজনটা কি ? তাদের কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করার দরকারটাই বা কি ? অনেক সাধারণ মানুষের কাছেই এই কনসেপ্টটা আদর্শ মনে হয়, যে সবার মতামতকে শ্রদ্ধা করে নিজের নিজের ধর্ম পালন করলেই তো হয়, শুধু শুধু অন্যকে আক্রমণ করা কেন ? এইটা সাধারনভাবে শুনতে খুবই ভাল লাগে, ইনফ্যাক্ট আমিও আগে অনেকটা এরকম ভাবতাম । "সবারে বাসিব ভাল, করিব না আত্মপর ভেদ" ! কিন্তু মুশকিলটা হয়ে গেল অন্যখানে । সবাইরে ভালবাসতে গেলে, শ্রদ্ধা করতে গেলে, যেই পাকিরা আমার দেশের মানুষ মেরে সাফা করে দিল, তাদেরও তো ভালবাসা লাগে ! আচ্ছা, একজন ধর্ষকের চিন্তাভাবনাকে আপনি শ্রদ্ধা করেন ? পেডোফাইলকে ? ধরেন আপনাকে সে কিছুই করেনাই, করছে অন্যদের । তাহলে আপনি কি এভাবে ভাববেন, তাকে তার মত থাকতে দিলেই তো হয় । আমাদের দেশের রাজনৈতিক সব নেতাদের চিন্তাভাবনাকে আপনি শ্রদ্ধা করেন ?
এখানে সমস্যাটা হচ্ছে, মানুষ শুধু চিন্তায় সীমাবদ্ধ থাকেনা, সে যা ভাবে তাকে কাজে পরিনত করতে চায় । রাজনীতিবিদরা, ধর্মগুরুরা, তাদের চিন্তাভাবনা জোর করে অন্যের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে, যারা দ্বিমত করে তাদের ওপরও । তালেবানদের আবদার, মেয়েরা পড়াশোনা করতে পারবেনা । তাদের পছন্দের আইন দেশে চালু করতে হবে । না হলে তারা নারী, শিশু, সাধারন মানুষ, কাউকে ছাড় দেয়না । আপনি তাদের এই কার্যকলাপকে শ্রদ্ধা করেন ? যদি না করেন, তাহলে তাদেরকে বাধা দেয়ার আদৌ কেনো প্রয়োজন আছে বলে কি আপনি মনে করেন ? তারা বলবে, এটাই তাদের ধর্ম । হাজার শিশুকে খুন করে হলেও সারা দুনিয়াকে তাদের বিশ্বাস মানতে বাধ্য করাই তাদের দায়িত্ব । আপনি তাদের ধর্ম পালনে বাধা দিতে চান কেন ?
অন্যের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আগে, তার অনুভূতিটাতো শ্রদ্ধা করার মত কিছু হতে হবে, নাকি ? এখন কারো যদি মনে হয়, ক্লাস ফোরের বেশী পড়াশোনা করে আমি তার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে ফেলতেছি, তাহলে তার অনুভূতিকে শ্রদ্ধা করার কোনো উপায় তো আমি দেখিনা !
সবাই নিজের ধর্ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে গেলে কি পরিমান বিশৃঙ্খলা লাগবে জানেন ? প্রত্যেক ধর্মের একটা মূল দায়িত্ব হচ্ছে নিজের ধর্মকে যতটা সম্ভব ছড়িয়ে দেয়া । আপনি যদি বিধর্মী আর নাস্তিকের বিশ্বাসে আঘাত করতে থাকেন, তাদের বাধ্য করতে থাকেন আপনার ধর্ম পালন করতে, তারা আপনাকে ছেড়ে কথা কইবে কেন ?
এইযে প্রতিবছর কুরবানী উৎসব করছি আমরা, এতে করে হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাসে কি সরাসরি আঘাত হানছিনা ? প্রত্যেক রাস্তায়, গলিতে গরু জবাই করার সময় আমরা কি ভাবি, এই গলিতে একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীও থাকে হয়ত, তার কেমন লাগছে ? আপনি অন্যের শ্রদ্ধার বস্তুকে খুন করে ফেলবেন, আর আশা করবেন, তারা আপনার ধর্মকে, বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করবে ? আপনি যে গরুজবাই করছেন, সে কি আপনি হিন্দু ধর্মবিদ্বেষী বলে ? আজকে যদি কোনো হিন্দু ধর্মাবলম্বী রাগের মাথায় আপনাকে খুন করে, তাহলে কি এটা বলা যাবে যে, আরে আপনিই তো আগে তার শ্রদ্ধার ওপরে আক্রমণ করছিলেন, সুতরাং তার দোষ নাই ।
না । আমরা খুনাখুনীর মত চরম পর্যায়ে যাওয়া কোনোভাবেই কোনো অজুহাতেই সাপোর্ট করতে পারিনা । কাজেই সভ্য সমাজে লোকে নিজের মতামত, নিজের আপত্তি, বক্তব্য প্রকাশ করার ক্ষেত্রে, লেখালেখিকে বেছে নেয় । সব কথা সরাসরি বলা যায়না । আর ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য হিউমার আর স্যাটায়ার একটা দারুন অস্ত্র । সভ্য সমাজ স্যাটায়ারকে ব্যবহার করে এমন সব বক্তব্য প্রকাশ করতে, যেটা সরল গদ্যে বললে তার ধারটা বোঝা যায়না । যেমন আমেরিকায় ওবামাকে নিয়ে কার্টুন ছাপা হয়, সব রাজনীতিবিদ, ধর্মগুরু এমনকি যীশূকে নিয়েও হরদম ব্যঙ্গচিত্র/মেম নানাকিছু প্রকাশ হচ্ছে । এগুলো বন্ধ বা নিষিদ্ধ করে দিলে আসলে পরিস্থিতিটা আরও খারাপই হবে । ক্ষোভ লেখার মাধ্যমে বেরুতে না পারলে হাতাহাতির মাধ্যমে বেরুবে ।
সহজ আর সোজা কথা হল, আপনি যদি আপনার বিশ্বাস প্রচার করার অধিকার চান, আমারও আমার অবিশ্বাস প্রচার করার অধিকার থাকতে হবে । আমার অবিশ্বাস প্রচারে যদি আপনার অনুভূতিতে আঘাত লাগে, তাহলে আপনার বিশ্বাস দিয়েও তো আমার অনুভূতি আক্রান্ত হচ্ছে ! ধার্মিকরা বলবেন যে, কেউ তো আর অন্যকে ধর্ম পালন করতে বাধ্য করছেনা । কেউ ইচ্ছা করলে ধর্ম পালন না করুক । কিন্তু ঘটনা কি আসলেই তাই ? পাকিস্তানে শরীয়াহ আইন প্রচলনের জন্য বোমাবাজিগুলো তাহলে কিসের নিদর্শন ? আইএসআইএস তাহলে করছেটা কি ? বাদ দেন ওদের কথা, আমাদের দেশে হেফাজত আর আরও সব ইসলামী দলগুলোর দাবীর ব্যাপারে কি বলবেন ? অনায্য আবদার, বোমাবাজি এসবের বিরুদ্ধে কেউ রাস্তায় নেমে তো তাদের পেটাচ্ছেনা, জোর করে তাদের মুখও বন্ধ করছেনা কেউ । স্রেফ লেখালেখি দিয়ে, স্যাটায়ার দিয়েই প্রতিবাদ করছে । আপনি যদি মনে করেন সেটা যুক্তিযুক্ত নয়, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর কোনো ভিত্তি নাই, তাহলে আপনিও লেখা দিয়েই সেটার প্রতিবাদ করেন । বিদ্রুপের প্রতিবাদে দ্বিগুন বিদ্রুপ করেন ।
আপনার মতামত সবার কাছে গ্রহনযোগ্য হবে এটা আশা করাটাই একটা বোকামী । দুনিয়াতে সবরকম মানুষ আছে । কেন সবাই আমাকে শ্রদ্ধা করছেনা, কেন সবাই আমার আদর্শকে আঘাত করছে, এই চিন্তাটাই বরং রিডিকিউলাস ! আপনি গায়ের জোরে সেটাকে শ্রদ্ধা করাতে পারবেননা । কোনো বিশ্বাস আপত্তিকর মনে হলে সেটার প্রতিবাদ করার অধিকারও লোকের থাকতে হবে । আপনাকেও তখন সেই বিশ্বাসটাকে লজিক দিয়েই ডিফেন্ড করতে হবে । অ্যান্ড আ লজিক মাস্ট স্ট্যান্ড অন ইটস ওউন মেরিট । আপনি যদি বিশ্বাস করেন, আলোর গতি ঘন্টায় ৪ মাইল । তাতে কারো তেমন কিছু যায় আসেনা । লোকে সেটাকে নিয়ে হয়ত হাসাহাসি করতে পারে, কিন্তু এর বেশী কোনো ক্ষতি নাই । কিন্তু আপনার বিশ্বাস যদি এমন হয়, যে নিয়মিত বিষ খেলে আপনার স্বাস্থ্য ভাল থাকবে , তখন আমি সেটার প্রতিবাদ করবই, শ্রদ্ধা করতে পারবনা । আর আপনি যদি বিশ্বাস করেন যে আপনার এবং সবার বাচ্চাকে ছোটবেলা থেকে বিষ খাওয়ানো অভ্যাস করাবেন, তাহলে আমি অবশ্যই কঠিন ভাষায় আপনার বিশ্বাসকে আক্রমন করব । যতই আপনি অন্যের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধার দোহাই দেন !
এখন কথা হচ্ছে , ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ স্যাটায়ারের সেই ভাষা এত জঘন্য হওয়ার দরকার কি ? আর একটু সহনীয় করা যায়না যেন লোকের নরম দিলে আঘাত 'বেশী' না লাগে ? আসলে অভিযোগ যত গুরুতর হবে, প্রতিক্রিয়াও ততটাই কুৎসিত হবে । এখন আমি যদি পাকেমন পেয়ারু রাজাকারদের বিরুদ্ধে বলতে যাই, আমার মুখ দিয়ে তো আর মধু ঝরবেনা ।
পুটুকে পুটুই বলতে হবে, বলদকে বলদই বলতে হবে । বলদ যদি সেজন্যে কান্না জুড়ে দেয় যে এত কুৎসিত ব্যবহার কেন হচ্ছে, তাকে শ্রদ্ধা করতে হবে, তাইলে তো আর লাভ হবেনা ।
---- অগ্নির
মন্তব্য
প্রতিটি ধর্মের উপস্থিতিই যে বাকি (n-১) সঙ্খ্যক ধর্মানুভূতিতে আঘাত- এই সোজা সত্যটা মানুষ বুঝলেই ল্যাঠা চুকে যেত, কিন্তু কেউ বুঝতে না চাইলে তার জন্য লাঠ্যৌষধিই শ্রেয়। আচ্ছা, কার্টুনিস্ট আর স্যাটায়ারিস্টরা বিরক্ত হয়ে যদি কোনদিন তুলি-কলম ফেলে বন্দুক তুলে নেন? তখন??
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ । আপনার ট্যাগলাইনটাই আসলে আমার পোস্টের সারকথা
"যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?"
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
চিন্তার নতুন কিছু দ্বার খুলে দিলেন......
Extremist স্বল্পশিক্ষিত আত্নঘাতীরা না...নির্বোধ তথাকথিত উচ্চশিক্ষিতরাই
ভালো লাগলো
____________________________
নতুন মন্তব্য করুন