সবারে বাসিব ভাল ...

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১২/০১/২০১৫ - ৮:৩০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ফ্রান্সের শার্লি এঁবদো পত্রিকায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হত্যাকান্ড নিয়ে ফেইসবুকে আর বিভিন্ন সোশাল মিডিয়ায় তোলপাড় চলছে । এই ঘটনার বদৌলতে আরো একবার টের পেলাম আমাদের দেশে কি পরিমাণ মৌলবাদী গোঁড়া চিন্তাভাবনার প্রসার বাড়ছে । সরাসরি এই খুনকে সমর্থন করা ভয়ংকর চিন্তাভাবনার লোকজনের সংখ্যা দেখে দেখে আঁতকে উঠেছি । কিন্তু এরা ছাড়াও ফেইসবুকে আরেক শ্রেনী আছে, যাদের বক্তব্য আমার মনে হয়েছে আরও বেশী ভয়ংকর ! যাদের বক্তব্য আপাতদৃষ্টিতে খুবই শান্তিময়, মহৎ, বেশ সুশীল । তাদের বক্তব্যের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে, শার্লি এঁবদোর , কিংবা যে কারোর , দরকারটা কি কাউকে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করার ? কাউকে বিদ্রুপ না করলেই তো আর ক্ষেপে গিয়ে সে খুন করতে বাধ্য হয়না । ঠিক যেন মেয়েদের প্রতি অশালীনতার অভিযোগ ! মেয়েরা খারাপ পোষাক পরে বলেই না ছেলেরা রেইপ করতে উষ্কানি পায় ! কাজেই উভয় দলই সমান দোষে দোষী !!

এই পোস্টটা লিখেছি তাদের জন্য , যারা একটু চিন্তা করতে পারে, কিন্তু কনফিউজড এই ব্যাপারগুলা নিয়ে, কারণ তারা শান্তিপ্রিয়, ধর্মের ওপর সরাসরি আক্রমণ অপছন্দ করে । এই প্রশ্নটার উত্তর পাওয়া তাদের জন্য অনেক জরুরী বলে আমার মনে হয়, যে কেন গনহারে সবাইকে শ্রদ্ধা করা সম্ভব না । কারণ কথাটা শুনতে বেশ ভালো বলে লোকে বিভ্রান্ত হয় ।

এইকথা মনে হতে পারে যে, হুদাই ধর্ম/ধর্মগুরুদের নিয়ে (অথবা যে কাউকে নিয়ে) ব্যাঙ্গচিত্র আঁকার প্রয়োজনটা কি ? তাদের কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করার দরকারটাই বা কি ? অনেক সাধারণ মানুষের কাছেই এই কনসেপ্টটা আদর্শ মনে হয়, যে সবার মতামতকে শ্রদ্ধা করে নিজের নিজের ধর্ম পালন করলেই তো হয়, শুধু শুধু অন্যকে আক্রমণ করা কেন ? এইটা সাধারনভাবে শুনতে খুবই ভাল লাগে, ইনফ্যাক্ট আমিও আগে অনেকটা এরকম ভাবতাম । "সবারে বাসিব ভাল, করিব না আত্মপর ভেদ" ! কিন্তু মুশকিলটা হয়ে গেল অন্যখানে । সবাইরে ভালবাসতে গেলে, শ্রদ্ধা করতে গেলে, যেই পাকিরা আমার দেশের মানুষ মেরে সাফা করে দিল, তাদেরও তো ভালবাসা লাগে ! আচ্ছা, একজন ধর্ষকের চিন্তাভাবনাকে আপনি শ্রদ্ধা করেন ? পেডোফাইলকে ? ধরেন আপনাকে সে কিছুই করেনাই, করছে অন্যদের । তাহলে আপনি কি এভাবে ভাববেন, তাকে তার মত থাকতে দিলেই তো হয় । আমাদের দেশের রাজনৈতিক সব নেতাদের চিন্তাভাবনাকে আপনি শ্রদ্ধা করেন ?

এখানে সমস্যাটা হচ্ছে, মানুষ শুধু চিন্তায় সীমাবদ্ধ থাকেনা, সে যা ভাবে তাকে কাজে পরিনত করতে চায় । রাজনীতিবিদরা, ধর্মগুরুরা, তাদের চিন্তাভাবনা জোর করে অন্যের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে, যারা দ্বিমত করে তাদের ওপরও । তালেবানদের আবদার, মেয়েরা পড়াশোনা করতে পারবেনা । তাদের পছন্দের আইন দেশে চালু করতে হবে । না হলে তারা নারী, শিশু, সাধারন মানুষ, কাউকে ছাড় দেয়না । আপনি তাদের এই কার্যকলাপকে শ্রদ্ধা করেন ? যদি না করেন, তাহলে তাদেরকে বাধা দেয়ার আদৌ কেনো প্রয়োজন আছে বলে কি আপনি মনে করেন ? তারা বলবে, এটাই তাদের ধর্ম । হাজার শিশুকে খুন করে হলেও সারা দুনিয়াকে তাদের বিশ্বাস মানতে বাধ্য করাই তাদের দায়িত্ব । আপনি তাদের ধর্ম পালনে বাধা দিতে চান কেন ?

অন্যের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আগে, তার অনুভূতিটাতো শ্রদ্ধা করার মত কিছু হতে হবে, নাকি ? এখন কারো যদি মনে হয়, ক্লাস ফোরের বেশী পড়াশোনা করে আমি তার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে ফেলতেছি, তাহলে তার অনুভূতিকে শ্রদ্ধা করার কোনো উপায় তো আমি দেখিনা !

সবাই নিজের ধর্ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে গেলে কি পরিমান বিশৃঙ্খলা লাগবে জানেন ? প্রত্যেক ধর্মের একটা মূল দায়িত্ব হচ্ছে নিজের ধর্মকে যতটা সম্ভব ছড়িয়ে দেয়া । আপনি যদি বিধর্মী আর নাস্তিকের বিশ্বাসে আঘাত করতে থাকেন, তাদের বাধ্য করতে থাকেন আপনার ধর্ম পালন করতে, তারা আপনাকে ছেড়ে কথা কইবে কেন ?
এইযে প্রতিবছর কুরবানী উৎসব করছি আমরা, এতে করে হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাসে কি সরাসরি আঘাত হানছিনা ? প্রত্যেক রাস্তায়, গলিতে গরু জবাই করার সময় আমরা কি ভাবি, এই গলিতে একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীও থাকে হয়ত, তার কেমন লাগছে ? আপনি অন্যের শ্রদ্ধার বস্তুকে খুন করে ফেলবেন, আর আশা করবেন, তারা আপনার ধর্মকে, বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করবে ? আপনি যে গরুজবাই করছেন, সে কি আপনি হিন্দু ধর্মবিদ্বেষী বলে ? আজকে যদি কোনো হিন্দু ধর্মাবলম্বী রাগের মাথায় আপনাকে খুন করে, তাহলে কি এটা বলা যাবে যে, আরে আপনিই তো আগে তার শ্রদ্ধার ওপরে আক্রমণ করছিলেন, সুতরাং তার দোষ নাই ।

না । আমরা খুনাখুনীর মত চরম পর্যায়ে যাওয়া কোনোভাবেই কোনো অজুহাতেই সাপোর্ট করতে পারিনা । কাজেই সভ্য সমাজে লোকে নিজের মতামত, নিজের আপত্তি, বক্তব্য প্রকাশ করার ক্ষেত্রে, লেখালেখিকে বেছে নেয় । সব কথা সরাসরি বলা যায়না । আর ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য হিউমার আর স্যাটায়ার একটা দারুন অস্ত্র । সভ্য সমাজ স্যাটায়ারকে ব্যবহার করে এমন সব বক্তব্য প্রকাশ করতে, যেটা সরল গদ্যে বললে তার ধারটা বোঝা যায়না । যেমন আমেরিকায় ওবামাকে নিয়ে কার্টুন ছাপা হয়, সব রাজনীতিবিদ, ধর্মগুরু এমনকি যীশূকে নিয়েও হরদম ব্যঙ্গচিত্র/মেম নানাকিছু প্রকাশ হচ্ছে । এগুলো বন্ধ বা নিষিদ্ধ করে দিলে আসলে পরিস্থিতিটা আরও খারাপই হবে । ক্ষোভ লেখার মাধ্যমে বেরুতে না পারলে হাতাহাতির মাধ্যমে বেরুবে ।

সহজ আর সোজা কথা হল, আপনি যদি আপনার বিশ্বাস প্রচার করার অধিকার চান, আমারও আমার অবিশ্বাস প্রচার করার অধিকার থাকতে হবে । আমার অবিশ্বাস প্রচারে যদি আপনার অনুভূতিতে আঘাত লাগে, তাহলে আপনার বিশ্বাস দিয়েও তো আমার অনুভূতি আক্রান্ত হচ্ছে ! ধার্মিকরা বলবেন যে, কেউ তো আর অন্যকে ধর্ম পালন করতে বাধ্য করছেনা । কেউ ইচ্ছা করলে ধর্ম পালন না করুক । কিন্তু ঘটনা কি আসলেই তাই ? পাকিস্তানে শরীয়াহ আইন প্রচলনের জন্য বোমাবাজিগুলো তাহলে কিসের নিদর্শন ? আইএসআইএস তাহলে করছেটা কি ? বাদ দেন ওদের কথা, আমাদের দেশে হেফাজত আর আরও সব ইসলামী দলগুলোর দাবীর ব্যাপারে কি বলবেন ? অনায্য আবদার, বোমাবাজি এসবের বিরুদ্ধে কেউ রাস্তায় নেমে তো তাদের পেটাচ্ছেনা, জোর করে তাদের মুখও বন্ধ করছেনা কেউ । স্রেফ লেখালেখি দিয়ে, স্যাটায়ার দিয়েই প্রতিবাদ করছে । আপনি যদি মনে করেন সেটা যুক্তিযুক্ত নয়, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর কোনো ভিত্তি নাই, তাহলে আপনিও লেখা দিয়েই সেটার প্রতিবাদ করেন । বিদ্রুপের প্রতিবাদে দ্বিগুন বিদ্রুপ করেন ।

আপনার মতামত সবার কাছে গ্রহনযোগ্য হবে এটা আশা করাটাই একটা বোকামী । দুনিয়াতে সবরকম মানুষ আছে । কেন সবাই আমাকে শ্রদ্ধা করছেনা, কেন সবাই আমার আদর্শকে আঘাত করছে, এই চিন্তাটাই বরং রিডিকিউলাস ! আপনি গায়ের জোরে সেটাকে শ্রদ্ধা করাতে পারবেননা । কোনো বিশ্বাস আপত্তিকর মনে হলে সেটার প্রতিবাদ করার অধিকারও লোকের থাকতে হবে । আপনাকেও তখন সেই বিশ্বাসটাকে লজিক দিয়েই ডিফেন্ড করতে হবে । অ্যান্ড আ লজিক মাস্ট স্ট্যান্ড অন ইটস ওউন মেরিট । আপনি যদি বিশ্বাস করেন, আলোর গতি ঘন্টায় ৪ মাইল । তাতে কারো তেমন কিছু যায় আসেনা । লোকে সেটাকে নিয়ে হয়ত হাসাহাসি করতে পারে, কিন্তু এর বেশী কোনো ক্ষতি নাই । কিন্তু আপনার বিশ্বাস যদি এমন হয়, যে নিয়মিত বিষ খেলে আপনার স্বাস্থ্য ভাল থাকবে , তখন আমি সেটার প্রতিবাদ করবই, শ্রদ্ধা করতে পারবনা । আর আপনি যদি বিশ্বাস করেন যে আপনার এবং সবার বাচ্চাকে ছোটবেলা থেকে বিষ খাওয়ানো অভ্যাস করাবেন, তাহলে আমি অবশ্যই কঠিন ভাষায় আপনার বিশ্বাসকে আক্রমন করব । যতই আপনি অন্যের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধার দোহাই দেন !

এখন কথা হচ্ছে , ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ স্যাটায়ারের সেই ভাষা এত জঘন্য হওয়ার দরকার কি ? আর একটু সহনীয় করা যায়না যেন লোকের নরম দিলে আঘাত 'বেশী' না লাগে ? আসলে অভিযোগ যত গুরুতর হবে, প্রতিক্রিয়াও ততটাই কুৎসিত হবে । এখন আমি যদি পাকেমন পেয়ারু রাজাকারদের বিরুদ্ধে বলতে যাই, আমার মুখ দিয়ে তো আর মধু ঝরবেনা ।

পুটুকে পুটুই বলতে হবে, বলদকে বলদই বলতে হবে । বলদ যদি সেজন্যে কান্না জুড়ে দেয় যে এত কুৎসিত ব্যবহার কেন হচ্ছে, তাকে শ্রদ্ধা করতে হবে, তাইলে তো আর লাভ হবেনা ।

---- অগ্নির


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

মন খারাপ প্রতিটি ধর্মের উপস্থিতিই যে বাকি (n-১) সঙ্খ্যক ধর্মানুভূতিতে আঘাত- এই সোজা সত্যটা মানুষ বুঝলেই ল্যাঠা চুকে যেত, কিন্তু কেউ বুঝতে না চাইলে তার জন্য লাঠ্যৌষধিই শ্রেয়। আচ্ছা, কার্টুনিস্ট আর স্যাটায়ারিস্টরা বিরক্ত হয়ে যদি কোনদিন তুলি-কলম ফেলে বন্দুক তুলে নেন? তখন??

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ । আপনার ট্যাগলাইনটাই আসলে আমার পোস্টের সারকথা হাসি
"যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?"

মরুদ্যান এর ছবি

চলুক

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

ময়ুখ কিরীটি এর ছবি

চিন্তার নতুন কিছু দ্বার খুলে দিলেন......

Extremist স্বল্পশিক্ষিত আত্নঘাতীরা না...নির্বোধ তথাকথিত উচ্চশিক্ষিতরাই মন খারাপ

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

ভালো লাগলো

____________________________

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।