সবার মত পালিয়ে যাওয়া কথাটা বলতে আমার ভীষণ সংকোচ লাগে। যাই করুক না তিনি, আমার মা তো! অথচ কেউ বুঝতেই পারে না আমার কষ্টটা। কেউ যখন ও প্রসঙ্গ তোলে আমি চুপ করে থাকি। এর থেকে বেশি আর কিই বা করতে পারি?
বাবা আমাদের গ্রামের শিক্ষিত মানুষদের একজন ছিলেন। একমাত্র বাবাই নিজের চেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। বাকিরা তো কেউ মেট্রিকই পাস করে নি। বাবা নাকি ওদের না পড়ার জন্য বেশ মারধর করতেন, দাদাজান এ নিয়ে বাবাকে কথা শোনালে বাবা ওদের নাকি পড়ার কথা আর কিছুই বলেননি। এ জন্য ওদের অবশ্য পরের দিকে যে অনুশোচনা হয়েছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
দাদাজান বাবাকে নিয়ে সবসময় গর্ব করত। দাদাজান এই গ্রামের মাথা বলতে গেলে। অশিক্ষিত হলেও কোথায় কি করতে হয় আমার দাদাজান খুব ভালভাবেই জানেন। এ জন্য যৌবন বয়সেই তার ধনসম্পদ হু হু করে বেড়ে যায়। তিন তিনটা বিয়ে করেন। প্রথমটা ছিল এ গ্রামেরই এক সাধারণ মেয়ের সাথে বিয়ে। পরেরটা বিক্রমপুরের আফসারুদ্দীন উকিলের কন্যা জুলেখাকে। আমার বাবা এই জুলেখারই সন্তান- আমার দাদী। বাবার জন্মের কিছুদিন পরই আমার দাদী পাগল হয়ে যান। দাদী মারা গেলে দাদাজান আবার বিয়ে করেন। বংশে পাগলামীর বীজ হয়তো সেখানেই শুরু।
আমার দাদীকে আমার বড় দাদী কখনও ভাল চোখে দেখেন নি। সবসময় নির্যাতন করেছেন। বড় দাদী ছিল সাধারণ ঘরের মেয়ে। আর আমার দাদী যেমন বড় ঘরের তেমনি রূপসী। সবচেয়ে বড় কথা বড় দাদীর কোন সন্তান ছিল না। ঈর্ষান্বিত হয়ে বড় দাদী সবসময় উনার সাথে দুর্ব্যবহার করতেন। অনেকে তো বলে উনার জন্যই আমার দাদী পাগল হয়ে যায়। দাদী পাগল হয়ে যাওয়ার পর উনাকে বেঁধে রাখা হত। কাপড়চোপড় ঠিক থাকত না। বড় দাদী মজা দেখার জন্য বাঁধন খুলে দিত। ছেড়ে দিয়ে বলত, “যা যা।” একদিন দাদাজান আবিষ্কার করেন দাদী বাজারে নেংটো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেবার বড়দাদীকে খুব পিটান দাদাজান। একদম রক্তারক্তি ব্যাপার। পরে এগুলো নিয়ে অনেক কাহিনী হয়।
ওসব কাহিনী থাক। বর্তমানের কথা বলি। আমার দাদাজান এখনো বেঁচে আছেন। বড় দাদী মারা গেছেন আমার জন্মেরও আগে। শুধু ছোট দাদীই আছে এখন। ছোট দাদীর পাঁচ সন্তান। আমার দুই চাচা আর তিন ফুপু। ফুপুদের তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এখানে থাকে আমার দুই চাচারা তাদের বউ বাচ্চাসহ। আর আমার বাবা। পাগল বাবা।
আগেই তো বলেছি বাবা ছিলেন এ গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত মানুষ। সবাই ধরেই নিয়েছিল বাবা শহরের বড় কোন অফিসার হবেন। শহরে চাকরি পাওয়ার পরপরই দেবীপুরের এক মেয়ের সাথে বাবার বিয়ে হয়। আমার মা। আমি দেড় বছরের যখন মা এ গ্রামেরই এক লম্পটের সাথে চলে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাদের হদিস পাওয়া যায় নি। প্রতিদিন দাদাজান বাবাকে যখন দেখতে আসেন আমার মাকে বাজারের মেয়ের সাথে তুলনা করে গালাগাল করেন। আমি চুপ করে শুনে যাই। বাবাকে দাদাজান খুব ভালবাসেন বোঝাই যায়। আমার নিজের দাদী ছিলেন প্রচন্ড রূপবতী। তাদের একমাত্র সন্তান বাবার জন্য দাদাজানের মায়ার শেষ ছিল না। বাবা পাগল হয়ে যাওয়ার পর হয়তো দাদীকে আরো বেশি মনে পড়ত দাদার।
বাবাকে ঘরের মধ্যে বেঁধে রাখা হত। জানালা দিয়ে বাবা মাথা বের করে থাকত। টকটকে লাল চোখ। মুখভর্তি গোঁফ-দাঁড়ি। মাঝে মাঝে দু-তিন মাস পর পর বাবাকে ইন্ডিয়ায় নিয়ে যাওয়া হত। দাদাজান এখনও আশা নিয়ে থাকতেন যে তার ছেলে ঠিক হবে। আবার আগের মত হবেন। গরমের সময় বাবার পাগলামী বেড়ে যায়। তখন সামনেই যাওয়া যায় না। গেলেই বাবা দাঁতমুখ খিচে হিসহিস করতে থাকে। কামড় দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু অন্য সময় বাবা বিশিষ্ট ভদ্র লোক। আমাকে দেখলেই জানালা দিয়ে মৃদু গলায় বলেন, “রবিন নাকি?”
“হ্যাঁ বাবা।”
“কিরে কেমন আছিস? এই দিকে আয় তো, তোকে তো দেখিই না।”
আমি সামনে যাই। বাবা অবাক হয়ে আমায় দেখেন। প্রতিদিনই দেখেন। আগের দিনের কথা তার মনে থাকে না। আস্তে আস্তে বলেন, “কি করিস রে তুই? বিয়ে করেছিস?”
“বাবা আমি এইটে উঠলাম।”
“ও,” বাবা খুব লজ্জা পেয়ে যান। তারপর বলেন, “ভাল করে পর। সামনে মেট্রিক আসছে। অংক আর ইংরেজীতে ভাল করতে হবে। একটা কিছু কর তারপর বিয়ে করিস।” যেন আমারই বিয়ে করার শখ জেগেছে। তারপর নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকেন, “দেবীপুরের মেয়েদের বিয়ে করিস না। ওদের বিশ্বাস করা যায় না। দেখলি না আমায় কিভাবে ছেড়ে গেল।”
“বাবা তোমার ক্ষুধা পেয়েছে? কলা খাবে?”
“কলা? আচ্ছা নিয়ে আয়।”
আমি কলা নিয়ে এসে দেখি বাবা জানালার শিক ধরে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। হয়তো মার কথাই ভাবছে। আমার খারাপ লাগে খুব। আমি কলা দিয়ে চলে আসি।
আমাদের বাড়িতে অবশ্য আমায় খুব আদর করা হয়। বাবার সুনামের কারণে আমাকে সবাই স্নেহ করে। আমার ছোট দাদী খুব ভাল মানুষ। বড় দাদীর মত কোন কুটনামি নেই তার। নিজে ভাল থাকলে মানুষের কেন ক্ষতি করব এই হল তার কথা। চাচারাও বাবার খুব ন্যাওটা ছিলেন। তারাও কোন উৎপাত করত না। আমাকে দেখলেই দুই চাচী ডেকে নিয়ে ভাত খাওয়ান। তবে আমার খারাপ লাগত এই ভেবে যে আমার নিজের কোন আবাস নেই। দাদাজানের সাথে ঘুমোই। চাচীদের যার যেদিন তরকারি ভাল তার ওখানেই খাই। ছোট দাদী আমায় বলেন, “ও রবিন এদিক আয় তো। বইটা পড়ে শোনা।” দাদী জীবনে একটাই বই পড়েছেন। মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু। আমিই পড়ে শোনাতাম। কিছু কিছু অংশ তো আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।
হোসেন-মস্তক পূর্বেই এক সুবর্ণ পাত্রে রাখিয়া এজিদ তদুপরি মূল্যবান বস্ত্রের আবরণ দিয়া রাখিয়াছিলেন; হোসেনের অল্পবয়স্কা কন্যা ফাতেমাকে এজিদ নিকটে বসাইলেন এবং বলিলেন, “বিবি, তোমার তো খর্জুর প্রিয়; এইক্ষণে যদি মদিনার খর্জুর পাও, তাহা হইলে কি কর?”“কোথা খর্জুর? দিন, আমি খাইব!”
এজিদ বলিলেন, “ঐ পাত্রে খর্জুর রাখিয়াছি, আবরণ উন্মোচন করিলেন দেখিতে পাইবে! খুব ভাল খর্জুর উহাতে আছে! তুমি একা খাইয়ো না, সকলকেই কিছু কিছু দিয়ো!”
ফাতেমা বড় আশা করিয়া খর্জুর-লোভে পাত্রের উপরিস্থিত বস্ত্র উন্মোচন করিয়া বলিলেন, “এ কী? এ যে মানুষের কাটা মাথা! এ যে আমারই পিতার”- এই বলিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। পরিজনেরা হোসেনের ছিন্ন মস্তক দেখিয়া প্রথমে ঈশ্বরের নাম, পড়ে নূরনবী মোহাম্মদের গুণানুবাদ করিয়া বলিতে লাগিলেন, “ঈশ্বর! তোমার মহিমা অসীম, তুমি সকলেই করিতে পার। দোহাই ঈশ্বর , বিলম্ব সহে না, দোহাই ভগবান আর সহ্য হয় না, একেবারে সপ্ততল আকাশ ভগ্ন করিয়া আমাদের উপর নিক্ষেপ কর! দয়াময়! আমাদের চক্ষের জ্যোতিঃ হরণ কর, বজ্রাস্ত্র আর কোন সময় ব্যবহার করিবে? দয়াময়, তোমাকে ধন্যবাদ দিয়াছি, এখনো দিতাছি। সকম সময়েই তোমার প্রতি নির্ভর করিয়াছি, এখনো করিতেছি; কিন্তু দয়াময়! এ দৃশ্য আর দেখিতে পারি না। আমাদের চোখ অন্ধ হউক, কর্ণ বধির হউক, এজিদের অমানুষিক কথা যেন আর শুনিতে না হয়। দয়াময়! আর কাঁদিব না। তোমাতেই আত্মসমর্পণ করিলাম।”
দাদী শুনতেন আর চোখ মুছতেন। মাঝে মাঝে দাদাজানও শুনতেন। উনার গলাও ধরে আসত। আমায় বলতেন, “রবিন, হাঁটতে যাবি? চল হেঁটে আসি। ভাল লাগছে না।” তখন দাদাজানের সাথে আমি হাঁটতে বের হতাম। দাদাজানের একমাত্র কথা বলার মানুষও ছিলাম আমি। আমরা ক্ষেতের আইল ধরে হেঁটে যেতাম। দাদাজানের কামলারা দাদাকে দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত। দাদার এত জমি যে একদিনে পুরোটা দেখা হত না। সাদা জোব্বা গায়ে আমার দাদাজানকে দূর দূর হতে দেখা যেত। আমি দাদাজানের সাথে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে সূর্যের দিগন্ত রেখা ছুঁয়েছে, ওখানে যেতে চাইতাম। কি সুন্দর ছোট ছোট সবুজ গাছপালা দূরে। ওদের উপর শেষ বিকেলের লাল সূর্য। দাদাজানও আমার মত ওদিকে যেতে চাইতেন। বলতেন, “কি আশ্চর্য! কাজের জন্য রাস্তা দিয়ে ওদিকে কত গেছি। মাঠ দিয়ে ওদিকে যেন যাওয়াই যায় না! খালি পিছায় যায় জায়গাটা !”
আছরের পর থেকে মাগরিব ছিল আমার সাথে দাদাজানের হাঁটার সময়। দাদাই বলে যেত। আমি খালি শুনে যেতাম। বেশির ভাগই দাদাজানের যুবক বয়সের গল্প। একদিন আমায় প্রশ্ন করল দাদাজান, “আচ্ছা রবিন, তোর এই ছোট দাদীটা কেমন বল তো?”
“ভালই তো !”
“সত্যি তো? তোর সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করে না তো? কিংবা কামাল জামাল? ওদের বউরা?”
“না দাদাজান, আমাকে কেউই খারাপ চোখে দেখে না।”
“কেউ কিছু বললে আমাকে বলবি, পিঠে গাছের ডাল ভাঙবো।” তারপর দাদা খিকখিক করে হাসে। আমি বলি, “দাদাজান হাসো ক্যান?”
“বুঝলি, তোর ছোট দাদীটা বোকাসোকা। তোর বড় দাদীর মত কুটনামি জানত না। জুলেখার কাহিনীটা হওয়ার পর তো আমি জেনে গেলাম বড় মাগীটার এইসব কুকীর্তির কথা। তারপর থেকেই তো টাইট দিতে শুরু করলাম। তোর ছোটদাদীর সাথে যখন বিয়ে হল বাসর রাতে তো দাদীর ঘোমটা তুলেই এক কষা থাপ্পড় দিলাম। তোর দাদী বিছানা উলটে পড়ে গেল। হা হা হা।”
“কেন থাপ্পড় দিলা কেন?”
দাদাজান হাসতে হাসতেই বলে, “তোর দাদী থাপ্পড় খেয়ে পড়ে যেয়ে তো পুরাই অবাক। আমি তোর দাদীর চুলে টেনে ধরে বলি, “শোন আমেনা! আমার আব্বাস ব্যাটা মা-মরা ছেলে। ওর মা পাগলী ছিল। ওর সাথে যদি খারাপ কিছু করিস তাহলে বুঝিস কিন্তু। বড়বউ তোর সাথে খারাপ কিছু করলে সাথে সাথে আমাকে বিচার দিবি। নিজে কিছু করতে যাস না।”
আমি চুপ করে শুনে যেতাম। বুঝতে পারতাম দাদাজান আমাকে এসব বলে খুশি করতে চাইছেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দুঃখী গলায় বলতেন, “ভাই রে! ক্যান যে এমন হইলো সব ! তোর বাপে মায়ের আদর পাইলো না। মা পাগলী হয়ে মারা গেল। তুইও পাইলি না। তোর মা পালায় গেল। তোর ব্যাটার যে কি হবে কে জানে। এমনটা হতে দেওয়া যাবে না আর। খবরদার রবিন কোন প্রেম পিরিতি করবি না। তোর বউ আমি এনে দিব। কোন ডিফেক্ট ছাড়া।”
আমার এরকম অবস্থাতেও হাসি পেয়ে যেত খুব দাদাজানের ইংরেজি শুনে। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে দাদাজান বেশ কিছু ইংরেজী আয়ত্তে এনেছিলেন। আমার কাছেও শিখে নিতেন মাঝে মাঝে।
ভালই চলছিল সব।
কিন্তু একদিন দাদাজান স্ট্রোক করে মারা গেলেন। আমার চেনা দুনিয়াটা মুহুর্তেই অচেনা হয়ে গেল।
দাদা মারা যাওয়ার পর একে একে আমার সব ফুপুরা আসল। সাথে সব ফুপারা আর আমার সব ভাইবোন। ফুপাদের কাউকেই আমার সহ্য হয় না। দাদাজান বলে, “এরা সবাই এই ধান্ধায় থাকে কখন আমি মরি। কারণ বুড়া মরলেই লাভ। পড়াশোনা তো তোর বাবার মত আর কেউ করে নি। সবগুলাই চোর। দেখিস আমি মরার কয়েকদিনের মধ্যেই এরা আমার সম্পত্তি নিয়ে কাড়াকাড়ি করবে।”
আমি অবাক দেখলাম দাদাজানের কথাই ঠিক। বড় ফুপা গলা খাঁকারি দিয়ে একদিন উঠানে সবাইকে ডাকল। কেশে নিয়ে বলল, “আব্বার মৃত্যুতে আমরা সবাই শোকাহত। কিন্তু শোক একটা মানুষকে কতদিন আর বাঁচিয়ে রাখবে। তাই কাজের কথায় আসি।”
সবাই নড়েচড়ে বসল। আমার মনে হল সবাই এই বিষয়টার জন্যই অপেক্ষা করছিল। দাদাজানের মৃত্যুতে মনে হল আমি যতটা কষ্ট পেয়েছি তার বিন্দুমাত্রও এরা পায় নি। আমার ছোট দাদী, চাচারাও যেন অচেনা হয়ে গেল। যে চাচীরা আমাকে দেখলেই ঠেসে ঠেসে ভাত খাওয়াতো তারা আমাকে এখন দেখেও না দেখার ভান করেন। ননদের বাচ্চাদের নিয়েই তাদের ব্যস্ততা। আমায় দেখে দাদাজানের খাস কামলা ভুট্টো দাদু চোখের পানি ফেলেন। অন্য কামলাগুলোও চুপ করে থাকে। বুঝতে পারি, আমার জন্য এরাই কষ্ট পাচ্ছে। একদিন রোকেয়া ফুপু আমাকে ডাকল। আমি তখন পড়ছিলাম। বলল, “অ্যাই রবিন, যা তো আমার জন্য পান নিয়ে আয়।” আমি দেখলাম ফুপুর ছেলে সাগর সামনে ঘোরাঘুরি করছে। বললাম, “ফুপু আমি তো পড়ছি সাগরকে আনতে দেই?”
ফুপু একটা ঠাস করে চড় দিয়ে বলল, “কেন ও আনবে কেন? তুই আনতে পাস না? এহ, পড়ে একদম দেশ উদ্ধার করবেন উনি। বাপটা পাগল মা’টা বেশ্যা আর উনার পড়ার তাল ধরছে।”
আমার সাথে সাথে চোখে পানি এসে গেল। ওরা সবাই আমার বাবা মা’কে নিয়ে উদ্ভট কথা বলতে লাগল। বাবার থেকে মাকে নিয়েই বেশি। যে লোকটা মাকে নিয়ে গিয়েছিল সেও নাকি মাকে ছেড়ে দিয়েছে। মা নাকি এখন খারাপ মেয়ে হয়ে গিয়েছে। যে কেউ নাকি আমার মায়ের সাথে... থাক! আর না বলি। এরা একবারও ভাবল না উনি যাই হোক না কেন আমার মা। আমি সহ্য করতে লাগলাম।
কয়েকদিনের মধ্যেই আমার স্থান হল বাড়ির কামলাদের সাথে। ওদের ঘরে রাতে থাকি। জামাল চাচা লজ্জিত মুখে আমাকে বলে, “এতজন মানুষ এসেছে। থাকার জায়গা নাই। একটু কষ্ট করে থাক। ওরাও তো মানুষ। কি সমস্যা?”
আমি কিছু বলি না। ফুপারা একে একে জমি ভাগাভাগি নিয়ে মারামারি কাটাকাটিতে লেগে গেল। একেকজনের একেকটা ডিমান্ড। ছোট দাদীকে ওর মেয়েরা কি বুঝিয়েছে কে জানে, সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের মত ব্যবহার করতে লাগল। দাদাজান নাকি কোন কিছু উইল করে যান নি। ওরা উকিল ডেকে নিয়ে সব ঠিকঠাক করে ফেলল। একদিন ওরকম সভা বসেছে। সেখানে আমাকে ডাকা হল। বড় ফুপা বলল, “দেখো বাবা রবিন, আমরা এতগুলো মানুষ। আমাদের অনেক চাহিদা। তোমার বাবাও তো পাগল আর তুমিও তো ছোট। তুমি এগুলো দিয়ে কি করবা? তার থেকে তোমাকে দুটো আবাদি জমি লিখে দিচ্ছি। ওই দিয়ে তোমাদের হবে না?”
আমি কিছু বলার আগে পিছন দিক থেকে কে যেন বলে উঠল, “না হবে না।”
সবাই হতভম্ব। পেছনে আমার বাবা আব্বাস হোসেন দাঁড়িয়ে আছে। একদম অচেনা লাগছে বাবাকে। কোথায় গেল বড়বড় চুল আর গোঁফদাড়ির জঙ্গল? বাবার মুখ ক্লিন শেভড। ছোট ছোট চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। গায়ে একটা সাধারণ পাঞ্জাবী, অথচ বাবাকে কি সুপুরুষ লাগছে! আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম বাবাকে দেখে। আমার দাদী যে সুন্দর ছিল সেটা বাবাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কেন যে মা বাবাকে ছেড়ে গেল!
বাবা বড়ফুপাকে বললেন, “দুলাভাই আব্বা উইল ঠিকই করে গিয়েছে। আমি রেজিস্ট্রি অফিসে খোঁজ নিয়েই এসেছি। সেখানে আব্বার পুরোনো বন্ধু হাশেম চাচাই সব বের করে দিল। বিষয়-সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা করেই দিয়েছে আব্বা। শহরে উকিলের সাথে যোগাযোগ করেছি। উনি এই আসল বলে।”
সবদিকে কানাকানি পড়ে গেল। আব্বাস ঠিক হয়ে গিয়েছে, আব্বাস ঠিক হয়ে গিয়েছে! বড়ফুপা বিব্রত ভঙ্গিতে বাবাকে বললেন, “তুমি কবে ঠিক হয়ে গেলে আব্বাস?”
বাবা আমার ঘাড়ে হাত রাখল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।
বাবার ঠোঁটের কোণে আমি একটা সুস্থ মানুষের হাসি দেখতে পেলাম।
রাসিক রেজা নাহিয়েন
মন্তব্য
ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না, শেষের দিকে হঠাৎ করে আব্বাস সুস্থ হয়ে গেলেন কি করে?
তবে, জায়গা জমির বিষয় নিয়ে মানুষ যে অমানুষের মত আচরণ করে -এটা ঠিক কথা।
মানুষের লোভ মোটামুটি অসীম।
আপনার এই লেখাটায় হুমায়ূনের ছায়া আছে বলে মনে হচ্ছিল। এটাকে অনেকেই সমালোচনা করেন, আমি করি না (আমার ব্যাক্তিগত মত)। আমি সাধারণ, বোকাসোকা টাইপের পাঠক। যেটা পড়ে ভালো লাগে, সেটা পড়ি। এটা ভালো লেগেছে, শুধু শেষের দিকটায় বেশি তাড়াহুড়ো করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে।
ভালো থাকুন, শুভেচ্ছা
মেঘলা মানুষ, শুভেচ্ছা নিবেন।
টাইপিংয়ে একটা ভুল যে পুরো গল্পকেই আক্রান্ত করে বুঝতেই পারছেন। গল্পটি ব্লগে পোস্ট করার সময় কয়েক লাইনের একটা প্যারাই গায়েব করে দিয়েছি নিজের অসাবধানতায়। অতিথি লেখক হওয়ায় লেখা সম্পাদনার অপশনও নেই। তবুও গল্পটি আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম,সত্যিই।
হুমায়ূন আহমেদ পড়েই তো বড় হলাম। হয়ত লেখক হওয়ার স্বপ্নটাও তাঁর লেখা থেকেই পেয়েছি ! তাই আমার লেখায় প্রিয় লেখকের ছায়া থাকবে এই তো স্বাভাবিক। নিজেকে এখনও সেরকম উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারি নি যে সবার প্রভাববলয় থেকে বেড়িয়ে আসতে পারব। তবে আশা রাখি, সেইদিন হয়ত সত্যিই আসবে।
ভাল থাকবেন।
রাসিক রেজা নাহিয়েন
প্রথম বাক্যটির কৌতুহল থেকে পড়ে গেলাম। ভাল লেগেছে।কমতিটা মন্তব্য থেকে বুঝে নিলাম। যে প্যারাটা গায়েব হয়েছে মন্তব্যে দিয়ে দিলে কেমন হয়? পড়ে নিতাম। ভাল থাকুন।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
ধন্যবাদ সুলতানা সাদিয়া। মন্তব্যের মাঝে গল্পের অংশটি আমি না জুড়ে দেওয়াই শ্রেয় মনে করছি। এমন যদি হত, প্রথম মন্তব্যতেই আমি জুড়ে দিতাম- তাহলে হয়ত খারাপ হত না। কিন্তু বিভিন্ন মন্তব্যের ফাঁকে গল্পের অংশটি ভাল দেখাবে না। আর এটিই হয়ত পরেরবার আমায় সতর্ক করবে।
ভাল থাকুন।
রাসিক রেজা নাহিয়েন
আপনার গল্প বলার ক্ষমতা আছে , গল্পে আসলেই গল্প থাকে । বলয়মুক্তি খুব তাড়াতাড়ি হবে বলে আমর বিশ্বাস। আব্বাসের সুস্থ হওয়ার ব্যাপারটা আরেকটু বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার জন্য কিছু কথার দরকার ছিল । গল্প ভালো লেগেছে ।
মজিবুর রহমান
ধন্যবাদ মজিবুর রহমান আপনার মন্তব্যের জন্য। আগেই বলেছি, প্যারা মিস হয়ে গিয়েছে।
ভাল থাকুন।
রাসিক রেজা নাহিয়েন
গল্প ভালো লাগেনি।
সিনেমাটিক কিংবা অনেক বেশি নাটুকে মনে হলো। গল্প বুননে, চরিত্রের কথোপকথনের অনেক জায়গায় খাপছাড়া/বেমানান লেগেছে। যেমন রবিন বলছে,
গল্পের বয়ানকারী প্রথম পুরুষ রবিন, সেক্ষেত্রে সে বাবার ভাইদের ওদের বলার কথা কি? সেটা ওনাদের হবার কথা।
খাপছাড়া লাগলো। এমন আরো কিছু জায়গায় এমনটা রয়েছে। আশা করি পরের লেখায় এদিকগুলো দেখবেন।
তবে একেবারে বাবার শেষদিকে বাবার হুট করে সুস্থ হয়ে ওঠা অবাস্তব/সিনেমাটিক মনে হয়েছ, গল্পটা সেখানেই মার খেয়েছে।
আরো লিখুন।
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
মাসুদ সজীব, অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। পরবর্তীতে নিজের দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারব আশা রাখছি। আপনার তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ আমার দুর্বলতা কাটাতে সাহায্য করুক।
রাসিক রেজা নাহিয়েন
গল্পটা পড়লাম। শুরু থেকে যেমন ভালো লাগছিলো শেষে এসে সেটা আমার কাছে খুব দ্রুত ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা মনে হচ্ছিলো। যেমনটা হ্যাপি এন্ডিং হয়ে গেলো হুট করে। অবশ্য আপনি বলেছেন একটা প্যারা বাদ পড়ে যাওয়াতে এমন লাগছে।
রবিনের দাদার সংলাপগুলো শুরুতে যেমন শুদ্ধ ভাবে এসেছে পরে আবার চেঞ্জ এসেছে দেখলাম! মানে বলতে চাচ্ছি ফ্লো টা একরকম থাকেনি তাই আমার চোখে লাগছিলো।
শুভকামনা রইলো আপনার জন্য।
অপর্ণা মিতু
অর্পণা মিতু, ধন্যবাদ দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। সংলাপের ব্যাপারে বরাবরই আমি কাঁচা ! নিজের তাড়াহুড়ো স্বভাবের কারণে খেয়ালই করিনি বিষয়টি।
রাসিক রেজা নাহিয়েন
লেখা বেশ ভালো হয়েছে। এডিট করতে মডুদের কাছে পত্র দিয়ে দেন শীঘ্রি।
ধন্যবাদ বন্দনা আপনার মন্তব্যের জন্য। পরবর্তীতে সতর্ক হওয়ার অঙ্গীকার নিয়েই এ যাত্রায় আর এডিট করছি না।
রাসিক রেজা নাহিয়েন
উন্নতি হচ্ছে দেখে ভালো লাগলো!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
ধন্যবাদ উৎসাহ দেওয়ার জন্য।
রাসিক রেজা নাহিয়েন
আরো চর্চা দরকার মনে হয়....ভালোর কোন শেষ নেই.....আশা করি আরো ভালো ভালো লেখা পাবো
আব্দুল্লাহ আল ফুয়াদ
বাস্তবতার খেতা পুড়ি! হ্যাপি এন্ডিং দেখে ভাল লাগল।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন