অসময়ের ঘুম, ভাংতেই সব কেমন লাগতে শুরু করল। পাশের স্টুডিওটাতে একটা ইন্ডিয়ান ছেলে থাকে। বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে হাটতে চলতে। ছেলেটা নতুন বিয়ে করেই চলে এসেছে পিএইচডির জন্য। ভাবেসাবে মনে হয় বেশ ধার্মিক গোছের। ঘুম ভেঙ্গেছিল পাশের রুমের পুজার মন্ত্র শুনে, কেমন যেন গা ছমছম করছিল। বিছানা নাই, নিজের ম্যাট্রেসটার উপর গুম হয়ে বসে ছিলাম বেশ কিছুক্ষন! শীতের বিকেলে গরম কফির কাপ হাতে নিয়ে বসে থাকতে খুব ইচ্ছা করছিল। সন্ধ্যা হতে খুব দেরী নেই। ঘরে খাবারও তেমন কিছু নেই। নাহ, বের না হলে হচ্ছে না!
বাড়ি থেকে বের হয়েই একটু সামনেই গ্রোসারী। জায়গাটা বেশ মজার, রাস্তায় বের হলেই অনেক পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হয়। কিন্তু সেদিন চাই নি পরিচিত কারও সাথে দেখা হোক। হেঁটে হেঁটে দোকানের সামনে পৌছে কি মনে করে আর দোকানে ঢুকলাম না। দোকানের মালিক দম্পতি লেবানিজ, প্রায়ই যাওয়া হত, তাই চিনে গিয়েছিল আমাকে! আমাকে দেখলেই সুন্দর একটা হাসি দিতেন! আর আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, “হাউ আর ইউ, মিস বিউটিফুল স্মাইল!” আমার মজাই লাগত! কখনও কখনও আসলে একটা মানুষের হাসিও অনেক বড় পাওয়া মনে হয়!
শীতের রাত, হাঁটতে ভালই লাগছিল, একা একা আস্তে আস্তে হেঁটে সামনের দিকে চলে গেলাম। একটু দূরে চায়না টাউন! এক টুকরো চীন দেশ, অনেক দেশেরই একটা ছোট গলি দখল করে থাকে। এই রাস্তাটা ধরে হেঁটে যেতে বেশ ভালই লাগে, খুব রঙ্গীণ সবকিছু। হঠাত ফোন বাজল, কে আর হবে, দেশে যখন ভোর সেখানে তখন সন্ধ্যা, মার ফোন, “অনেক ঠান্ডা, হাটতে হাটতে কথা বলতে পারছি না!” “ঠিক আছে, পরে কথা বলব”। পাশে একটা মাঝারী সাইজের চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। অনেকক্ষণ কিছু পেটে না পড়ায় ভাবলাম এখান থেকেই কিছু খেয়ে নেই। খাওয়া শেষ হতে বিল চুকিয়ে আবার হাঁটা ধরলাম। অল্প অল্প তুষার চারপাশ দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল। এই সময় ঠান্ডাটা অনেক বেশি থাকে, কেমন যেন ঠোঁটের চারপাশটা জমে যেতে চায়। কথা বলতেও কষ্ট হয়, কথা গুলো বেঁকে বুকে যায়!
কিছুক্ষণ পর অনুভব করলাম পেছনে একটা লোক দ্রুত হেঁটে পাশাপাশি চলে আসল! রাস্তাঘাট নির্জন, একটু ভয়ই পেলাম! কি ভেবে দাঁড়িয়ে গেলাম, যেন লোকটা পাশ কেটে সামনে চলে যায়। যা ভেবেছিলাম তাই, গেল না, আমি দাঁড়িয়ে পড়ায় আমাকে জিজ্ঞেস করল, “ডু ইয়ু হ্যাভ থ্রি ডলারস?, আই লস্ট এভ্রিথিং, মাই ওয়ালেট ইস লস্ট, এন্ড আই ডোন্ট হ্যাভ মানি!” আমি ভাবছিলাম, ওখানে হোমলেস মাতালের তো অভাব নাই, এমনই কিছু কিনা! কিন্তু তিন ডলার নাই, একথাই বা কিভাবে বলি! ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছিল আসলেই বিপদে পড়েছে! তাকে তিন ডলার দিয়ে জোরে হেটে জায়গাটা পার হলাম। পরে অবশ্য সবাই বলেছিল না দিলেই পারতে, এই ধরণের টাউটের কোন অভাব নাই পৃথিবীতে!
সামনেই আমার এক বন্ধুর বাড়ি। এই বাড়িটাতেই কয়েকদিন আগে একটা মেয়ে আত্মহত্যা করেছিল। কোন এক অজানা কারণে সে প্রথমে তার পোষা বেড়ালটাকে নিচে ফেলে দেয়, আর পরে নিজেই সাত তলা থেকে ঝাপ দেয়। আমরা খুব অবাক হয়েছিলাম, নিজে মরতে চায় ভাল কথা, বেড়ালটাকেও কেন মারতে হল? সে কি আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভেবেছিল বেড়ালটা তাকে ছাড়া কি করে বাঁচবে! ওই দেশে মানুষ একাকিত্ব সামলাতে বেড়াল কুকুরের সাথে খুব বেশি একাত্ব হয়ে যায়! অফিসের ড্যানিয়েল নামের এডমিনের এক মহিলাকে দেখেছিলাম একদিন তার বেড়াল হারিয়ে গিয়েছিল বলে খুব দুঃখ করে আমাকে বলেছিল, তুমি কি একটু প্রে করবে যেন আমার বেড়ালটা যেন ফিরে আসে? কালচার শক! আমাদের দেশে মানুষ সামলে কুল পাওয়া যায় না, আর কুকুর বেড়াল! সেই বেড়ালটার নাকি এইডস ধরা পরেছিল! "হিউম্যান ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস" কেন বেড়ালের উপর ভর করবে এটা ঠিক তখন জানা ছিল না! তার দুঃখটা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছিলাম যে, এই ভালবাসাটা বোঝার ক্ষমতা জাতিগত ভাবেই আমাদের একটু কম! ওই বাড়িটা সামনে আসতেই ওই মেয়েটার আর ড্যানিয়েলের কথা মনে পড়ল। এই দেশের শুভ্রতা কেন যেন অজান্তেই মনের কোনে মেঘ জমায়। বিষন্নতা বাড়তে বাড়তে এক সময় সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, আর মানুষের জীবনের প্রতি ভালবাসাটাই মরে যায়! অবশ্য পৃথিবী জুরেই বিষণ্ণতা এখন এপিডেমিক!
হাতে ক্যামেরাটা ছিল, ছবি তুলতে বেশ লাগে, মুহুর্তটা মুহুর্তেই ক্যামেরা বন্দী হয়ে সাথে থেকে যায় সারা জীবন। একদিন ছবি তুলতে তুলতে দুইজন শ্বেতাঙ্গ মানুষ, সম্ভবত দম্পতি, দুম করে ক্যামেরার ফ্রেমে চলে আসে! “উপস, সরি, উই স্পয়েল্ড ইয়োর ফটো!” “নো প্রবলেম, লেট মি টেক এনাদার নাইস ওয়ান!” ওনারা আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেছিলেন, “অলওয়েজ রিমেম্বার ইউ মেট ওয়ান অফ দা হ্যাপিয়েস্ট কাপলস অফ দিস ওয়ার্ল্ড!” ওনাদের খুব সুখের একটা মুহুর্ত হয়ত সবসময়ের জন্য বন্দী হয়ে থাকল আমার ক্যামেরায়! সুখ কখনো সবসময়ের জন্য থাকে না, জানি না ওনারা সারা জীবন একসাথে এরকম সুখী দম্পতি থাকবেন কিনা, কিন্ত আমার ভাল লেগেছিল ওই সময়ের মাঝে আমার এক মুহুর্তের অস্তিত্ব!
বাড়ির কাছের কফিশপটার আলো চোখে পড়ছিল দূর থেকে! কাছে আসতেই কফির গন্ধ, অনেকেই পড়ালেখার জন্য এসেছে, জায়গা না পেয়ে কফি হাতেই বেরিয়ে পড়ি। ঠান্ডা বাড়তে বাড়তে প্রায় অসহ্যের পর্যায়ে! সামনে পরিচিত এক বাঙ্গালী ভদ্রলোককে চোখে পড়ল! ওনাকে আমার ঠিক পছন্দ হয় না! মনের মধ্যে কেন যেন বারবার একটা ঝামেলার সঙ্কেত দেয়! এড়িয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি হেঁটে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ির ম্যানেজার মহিলাটার সাথে আমার বেশ ভাল সম্পর্ক, বয়স চল্লিশোর্ধ! ভদ্রমহিলা একা একাই থাকেন, কেউ খানিকক্ষণ গল্প করলে খুব খুশি হয়। তবে প্রথম দেখাতেই বুঝেছিলাম উনি মানুষ ভাল হলেও বেশ জটিল প্রকৃতির! কিছু মানুষ পৃথিবীর সবকিছুর মধ্যেই জটিলতা খুঁজে পায়! উনি তাদের মধ্যে একজন। একদিন দুঃখ করে বলছিলেন, ওনার লং ডিস্ট্যান্ট কৃষ্ণাং বন্ধুটির সাথে প্রায়ই ঝামেলা হয়! ভদ্রলোক তার প্রথম স্ত্রীর কাছে প্রতারিত হবার পর অন্য কোন সম্পর্কে খুঁটি গাড়তে পারেননি! ভালবাসা ব্যাপারটা সবার জন্যই অনেক কষ্টের। কারণ একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে একই ভাবে কখনোই ভালবাসতে পারে না! মানুষ বদলে যায়, বদলে যায় অনুভুতিগুলোও। কিন্তু একজন যদি বদলে যাওয়া রূপটাকে না সামলাতে পারে তখনই কষ্ট পায়! তবুও আমরা সবাই ভালবাসি, ওই একটু সময়ের আনন্দটাই পরের কষ্টগুলোকে সহ্য করায়। মাঝে মাঝে কিছু কথা কখনই খুব কাছের মানুষদের বলা যায় না! উনি আমার সাথে প্রায়ই এই কথা গুলো বলত। আমিও একজন ভাল শ্রোতা হিসাবে শুনে যেতাম। কিছু মানুষটার সাথে আর কখনও দেখা হবে কিনা জানি না, কিন্তু ওই ছোট সময়ের ছোট ছোট কথার মাঝে নিজের জীবনে অনেক কিছু উপলব্ধি করেছি।
… লেখাটা শুরু করেছিলাম একদম উদ্দেশ্যহীন ভাবে, খুব বেশি ভাবতে ইচ্ছা করছে না! অস্থিরতায় লেখালেখিটা বেশ কাজের! শুধু সেই কারণেই মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের নতুন একটা ফাইল খুলে আবল তাবল টাইপ করতে থাকি! অতঃপর ফেলে আসা এক সন্ধ্যার কয়েকটা মুহুর্ত টু পেজার লেখা হয়ে বের হল! আর চিন্তাগুলো যখন লেখা হয়ে যায়, পড়তে ভালই লাগে!
আনীকা
মন্তব্য
লেখা চলুক, মিস বিউটিফুল স্মাইল
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
সুন্দর হয়েছে, আর লেখা চাই।
- ওমেশু
হুম ....দানশীলা ফটোগ্রাফার
"ট্রোল"
যে জাতির মানুষরা নিজেদের ভালোবাসার সবটা কুকুর-বেড়ালের পেছনে খরচ করে ফেলে তারাই বোধকরি অন্য জাতির শিশুসহ সাধারণ মানুষদের ওপর বোমা ফেলতে কোন অনুশোচনাবোধ করে না। আমরা না হয় জাতিগতভাবে কুকুর-বেড়ালকে ভালোবাসায় একটু পিছিয়েই থাকি। আমরা না হয় আকাশ থেকে পড়া বোমায় নিহত নিরপরাধ মানুষগুলোর জন্য একটু কষ্ট পাই।
নিজেদের গর্বের জায়গাগুলো যারা চিনতে পারে না তারাই পদে পদে হীনমন্যতায় ভোগে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
জাতিগতভাবে কোন ভালোবাসা বোঝার ক্ষমতা আমাদের কম? কুকুর-বেড়ালের প্রতি ভালোবাসা না! অতিথি লেখক তো মনেহলো সেরকম কিছুই বলতে চাইলেন।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
.........আপনার এই অনুভূতিটাই আমার সাথে খাপে খাপ মিলে গেছে, হুম- চিন্তার ডালাটা একটু মেলে ধরে গুছিয়ে লিখতে পারলে তৃপ্তিটাই অন্যরকম হয়- মনে হয় যেন আমার চিন্তা বা এর প্রকাশটা অন্তত ছন্দবদ্ধ, প্রশান্তি আনয়নকারী
চলতে থাকুক আপনার অস্থিরতায় লেখালেখি......সময় কাটতে আরেকটা "সময়ের গল্প"র চেয়ে ভাল কিছু আর হয় না
বিষন্ন সুন্দর!
সুন্দর লেখা! বিষণ্ণ সুন্দর!
স্বাগতম আনীকা। আরো লেখ। তোমার লেখার হাত ভালো, লিখতে লিখতে আরো ভালো হবে। বাংলায় কি এটাই প্রথম লিখলে? ফেইসবুকের মন্তব্য না পড়লে আমি ধরতেই পারতাম না, কে? বেশ ভালো লাগছে।
এত চমৎকার লেখার আরো চমৎকার একটা নাম হতে পারতো। অবশ্য গোলাপকে যে নামেই ডাকি না কেন--------
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
প্রকৃতিপ্রেমিক - স্যার, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমি বাংলায় প্রায়ই লিখি, কিন্তু সচলে লেখা পোস্ট করছি কিছুদিন হল। কোন এক কারণে আমি এখানে কমেন্ট করতে সমস্যায় পরি। তাই ফেসবুকে মন্তব্য করেছি!
আসলে নিজের জাতিকে নিয়ে কখনো হীণমণ্যতায় ভুগি নি। সবসময় গর্বই করেছি বরং। নিজের পোষা কুকুর বেড়ালের প্রতি যে চরম ভালবাসা পশ্চিমাদের কাজ করে, আমি দেখেছি আমরা প্রায়শই সেটা খুব অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখি, কারণ আমাদের দেশে অনেক সময় মানুষেরাই থাকে অনেক অবহেলিত। একথাটাই বলতে চেয়েছিলাম। যদিও এটা সম্পূর্ণই আমার ব্যাক্তিগত মন্তব্য, আর ব্যাতিক্রম সবসময়ই থাকে। ভালবাসার ক্ষমতা আমাদের অনেক বেশি তাতে সন্দেহের কোনই অবকাশ নাই। কিন্তু অন্যের ভালবাসা বোঝার ক্ষমতাতে একটু ঘাটতি আছে বলে মনে হয়েছে আমার।
আনীকা
নতুন মন্তব্য করুন