১
লণ্ঠনের আলোয় দুলজোড়া ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে রাবেয়া। সোনালি রঙটা লালচে আলোয় ঝিকিয়ে ওঠে, কী সুন্দর! জীবনে একটা নাকফুল ছাড়া সোনা পড়া হয়নি কোনোদিন। এখন এই মুহূর্তে দুলজোড়া কী অদ্ভুত সুন্দর আর মায়ামায় লাগে রাবেয়ার। ঝুঁকে থাকা অবস্থা থেকে পাশ ফেরে ও, ভুলুর চোখ তেমনই হাসিখুশি; সেও তাকিয়ে আছে দুলজোড়ার দিকে। সময়ের হিসেব নেই, ছোট্ট দুলজোড়ায় বুঁদ ছিল রাবেয়া- এতক্ষণে আদুরে গলায় মৃদু অনুযোগ করে ভুলুকে, “দুল আইনবার কী দরকারটা আছিলো!”
কী দরকার ছিল তার বিবরণ দেয় না বটে ভুলু, বলে-“ভালো নাগিল, কিনি আননু। তোক কী সুন্দর মানাইবে জানিস!” মানাবে যে রাবেয়াকে তাতে এ তল্লাটের কারও দ্বিমত থাকবার কথা নয়। শ্যামলা ঢলঢলে মুখখানায় রাজ্যের মায়া রাবেয়ার, ও মুখে মানায় না এমন কিছু এ বিশ্বে নেই আর তাছাড়া সোনা মানায় না এমন মেয়েমানুষও আছে নাকি দুনিয়ায়? কতদিন থেকে একটু একটু করে কিছু টাকা জমিয়েছে তার উপর আজ একটা ভালো দাও মেরেছে-ডালিম বানিয়ার দোকানে কয়েকদিন থেকে দেখে রাখা দুলগুলো আজ ফেরার সময় কিনেই নিল ভুলু।
“আয়, তোক পিন্দে দ্যাও”-ভুলুর ডাকে ঘুমন্ত ছেলের দিকে একবার তাকিয়ে দুলজোড়া হাতে উঠে বসে রাবেয়া। ছেলে ঘুমাচ্ছে, নিশ্চিন্ত, না হলে এই সাত বছরের ছেলের সামনে ভুলুর কাছ থেকে দুল পড়িয়ে নিতে লজ্জ্বায় মরে যেত রাবেয়া। দুলের পেছন দিকের আংটা খুলে যত্ন করে পড়িয়ে দেয় ভুলু, হাসে বউকে দেখে। পাশের নড়বড়ে রংহীন কাঠের টেবিলটার এটা সেটা জিনিসের ফাঁক থেকে ছোট্ট আয়নাটা নিয়ে রাবেয়ার হাতে দেয়। আয়নার পেছনে কাচের ভেতরের হাতাবিহীন জামা পড়া নায়িকার চেয়েও উজ্জ্বল আর নিখাদ হাসি ঠিকরে পড়ে রাবেয়ার চোখেমুখে। খুব বড় নয় দুলজোড়া আকারে কিন্তু ছোট্ট শ্যামলা লতিতে কত আদরে জড়িয়ে আছে। নিজেকে দেখতে কী যে সুন্দর লাগে রাবেয়ার! আদুরে আধো স্বর ফোটে আবার-“কতগুলা টাকা নষ্ট হইল, কও তো!”
হেসে উড়িয়ে দেয় ভুলু। কত টাকাই বা আর? ওসব নিয়ে ভাববার দরকার নেই রাবেয়ার, একদমই না। রাত অনেক হলো, রাবেয়া বরং আসুক এবার ওর বুকে, খুশিতে ভরপুর মুখখানার সাথে সমস্ত অন্তরটা নিংড়ে দিক আজ রাতে। ভুলুরও মন আজ এত খুশি অনেকদিন পর। ইস! বউটাকে সেই বিয়ের সময় একটা নাকফুল ছাড়া আর কী-ই বা দিতে পেরেছে ও? রাবেয়ার গরীব বাপও তো দিতে পারেনি কিছু। না, বউটা মুখফুটে কিছু চায়নি কোনোদিন। কিন্তু যখনই অন্য কারও কিছু নিয়ে গল্প করেছে, ভুলু খেয়াল করেছে মুখচোখ কী উজ্জ্বল হয়ে ওঠে রাবেয়ার! কতবার ভুলু ভেবেছ বৌটাকে কিনে দেবে ভালো ভালো জিনিস। সে কি আর সহজে হয়? বাপরে! এই একজোড়া দুল কিনতেই নয় নয়টা বছর পার হয়ে গেল! সে যাক, আজ মন খুব ভালো ভুলুর। ঘুমের ছেলের দিকে তাকিয়ে বউয়ের হাত থেকে আয়নাটা নিয়ে টেবিলে রেখে দেয় ভুলু।
২
ভুলুর কাজ নিয়ে খোঁটা শুনতে শুনতে অভ্যেস হয়ে গেছে রাবেয়ার। তা ঠিক, ভুলু যা করে, কোনো মানুষ সচেতনভাবে তা করার কথা ভাবেই না হয়তো। মানুষকে ঠকিয়ে বা কখনও সরাসরিই পকেট মেরে টাকা আনে ভুল, এ তল্লাটের আর সব মানুষের চেয়ে বরং আরও ভালোভাবে কথাটা জানে রাবেয়া। বিয়ের পর এ নিয়ে অনুযোগ অভিযোগের শেষ ছিল না, কষ্টও কি কম ছিল? এক এক সময় তো আব্বার উপর এমন রাগ হতো। কী এমন দোষ করেছিল রাবেয়া! জেনেশুনে কারও কোনো ক্ষতি তো দূরের কথা, কাউকে জোরে কথাটি পর্যন্ত বলেনি কোনোদিন। রাগ হতো নিজের উপরও, কেন পালিয়ে যেতে পারে না এ বাড়ি থেকে।
কিন্তু তারপর একটু একটু করে ও কি ভালোবাসেনি ভুলুকে? বেসেছে, সংসারে অভাব আছে, কখনও কখনও ঝগড়াঝাটিও যে নেই তাও নয় কিন্তু সে কার সংসারে না থাকে? ভুলু মানুষটা যে ভালো, এটাই রাবেয়ার কাছে অনেককিছু। ভুলুর আর সব ভাই যারা কিনা ‘হালাল’ রোজগার করে ভালো পয়সাপাতি কামায়, ভুলুকে নিয়ে কথা বললে প্রকাশ্যেই মুখ টিপে হাসতেও ছাড়েনা-তাদের সব ভালোমানুষি দেখা হয়ে গেছে রাবেয়ার। বুড়ো মা’টাকে কেউই দেখল না, বিয়ে করে সব কেমন টপাটপ আলাদা হয়ে গেল। অথচ ভুলু নিজের সাথেই মাকে রেখেছে,গরীব শ্বশুরবাড়ির মানুষদেরও খোজখবরের কমতি করে না। রাবেয়া জানে, রোজগারটা যেমনই হোক না কেন, মানুষটা বড় ভালো ভুলু।
সকালবেলায় মাচান থেকে সবচেয়ে ডগডগে লাউটা ছিঁড়ে নিয়ে আসে রাবেয়া; জিয়ল মাছ আছে, রাঁধবে তাই দিয়ে, ভুলু বড় ভালোবাসে, শাশুড়িও। কথাটা মনে হতে একটু হাসিও আসে রাবেয়ার, মা ছেলের পছন্দগুলো বড় মিলে যায় ভুলু আর শাশুড়ির। শফিকুলের সাথে নিজের পছন্দের মিল আছে কি? কে জানে, ও ভাবেনি এমন করে কোনোদিন।
ঘরের সামনে বসে রোদ পোহাতে পোহাতে শাশুড়ি খুশি হয়ে ওঠে লাউটা দেখে। “শাটি মাছ দিয়া আন্দিবেন, মাও? মুই কাটি দ্যাওচে।” শ্বাশুড়িটা খারাপ না রাবেয়ার, অবশ্য যখন মেজাজ খারাপ থাকে, রাজ্যের খারাপ কথা বলে আর ছেড়ে যাওয়া ছেলেদের জন্য প্রায়ই ঘ্যানঘ্যান করে- তা করুক, বুড়োমানুষ! মনে কিছু নেয় না রাবেয়া। বটি আর মাছ জিইয়ে রাখার বাঁকানো কানাভাঙা পাতিলটা এনে দিয়ে চুলা ধরাতে যায় রাবেয়া, ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে পেঁচিয়ে একটা খোঁপা করে নেয়। হাত লেগে দুলগুলো বুঝি একটু দুলে ওঠে, ডান হাত দিয়ে ডানকানের দুলটা একটু নেড়ে দেখে রাবেয়া।
৩
ক’দিন জ্বরে ভুগে আজ সকালে বেরিয়েছে ভুলু। আজ বেরোতে দিতে তেমন ইচ্ছে ছিল না রাবেয়ার। কিন্তু কী করবে, টাকাপয়সা তেমন নেই, পরশু কিস্তি আছে-তাই ভুলু যখন সকালে খেয়েদেয়ে বাইরে যেতে চাইল, তখন নিষেধ করেছিল বটে কিন্তু তেমন জোরালো করে বলতে পারল কই? কিন্তু ভুলু সেই যে বেরিয়ে গেছে, রাবেয়ার মন বসছে না কিছুতেই।
দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে খেয়ে শফিকুল খেলতে গেছে, শাশুড়ি মাদুর পেতে ঘুমাচ্ছে ঘরের দরজার পাশের একচিলতে জায়গায়। ঘরের ভেতর সেই তখন থেকে উসখুস করছে রাবেয়া। বাইরে কার পায়ের আওয়াজ, বিছানা ছেড়ে শাড়িটা ঠিক করে বাইরে আসে। বাটিতে বড়ই মাখা নিয়ে এসেছে রূপালি, পাশের বাড়ির এই ছটফটে মেয়েটার সাথে খাতির ভালোই রাবেয়ার। “ভাবি, তোমার জইন্যে আননু। খাও, বড়াইগুলাত মজা আচে”-বাটিটা এগিয়ে দেয় রূপালি।
“পাকের ঘর থাকি দুইখান পিড়া নিয়া যা, আমের গাছটার তলত বসিস”- বাটিটা হাতে নেয় না রাবেয়া, কলপাড়ে গিয়ে মুখ ধুয়ে আসে। বড়ইগুলো ভালোই আর রূপালি মাখিয়েছেও যত্ন করে, একই বাটি থেকে ভাগ করে খেতে থাকে রাবেয়া আর রূপালি। বড়ইমাখার টকে-ঝালে আর এটা সেটা গল্পে বিকেলটা কেটে যায়, সকালবেলা থেকে সঙ্গী হওয়া অস্বস্তিটা অনেকটাই কেটে যায় রাবেয়ার। তারপর একসময় আমগাছের তলায় ঝুপ করে সন্ধ্যে নামলে এঁটো বাটি হাতে বাড়ি চলে যায় রূপালি, শফিকুল খেলে ফিরে আসে; শাশুড়ি ওঠে ঘুম থেকে, রাতের রান্না চড়াতে যায় রাবেয়া।
শফিকুল নতুন পাওয়া বইগুলো নিয়ে বিছানার উপর পড়তে বসেছে, স্কুল এখনও ভালো করে শুরু হয়নি। কিন্তু নতুন বইয়ের একটা নেশা আছে বোধহয়, ছেলে একদিনও পড়তে বসতে ভোলে না আজকাল। শাশুড়ি মোড়ায় বসে গল্প করে এটা সেটা, রাবেয়া শাশুড়ির গল্প শোনার পাশাপাশি ছেলের পড়ার দিকেও মন দিতে চেষ্টা করে। বাইরে অসহিষ্ণু পায়ের শব্দ, বিছানা থেকে নেমে প্রায় দৌড়েই বাইরে আসে রাবেয়া। আবছা অন্ধকার উঠানেই ধপ করে বসে পড়েছে ভুলু। রাবেয়ার মাথার ভেতর সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়-“কী হইচে তোমার? কী হইচে, কতা কন না ক্যান?”
পরদিন সকালে রাবেয়াকে কোনো কাজ করতে দেয় না শাশুড়ি। কাল রাতে অনেক দেরিতে শুয়েছে সবাই। ভুলুর স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লেগেছিল, ততক্ষণ যে কেমন করে কেটেছে, ওরাই কেবল জানে সেটা। তারপর ঘুমিয়েছে, ঘুমের মধ্যেও ককিয়ে উঠেছে বারবার। ভুলু বলেনি কিছু, কেঁদেছে অনেকক্ষণ। না বললেও ঠিক বুঝেছে রাবেয়া, এই নয় বছরে এর আগেও দু’বার এমন হয়েছিল, পকেট মারতে গিয়ে ধরা পড়েছিল দু’বারই। তবে এবার জ্বরের কারণে বোধহয় অবস্থাটা বেশি খারাপ। বেলা বোধহয় অনেক হলো, ভুলু এখনও ঘুমাচ্ছে। মাথা ধরা নিয়ে বিছানার একপাশে পড়ে থাকে রাবেয়া। বাড়ির বাইরে কাদের গলা, তন্দ্রাটা ঝট করে কাটতে চায় না, বুঝে উঠতে সময় লাগে রাবেয়ার। কিন্তু এত মানুষ দেখেই বোধহয় শাশুড়ি খেঁকিয়ে ওঠে-“এই সক্কালবেলাত তোমরা ক্যানে? কী দরকার?”
বিছানা ছেড়ে উঠতে যায় রাবেয়া, কানে আসে চৌকিদারের হাসি। গায়ে কাঁটা দেয়, এই মানুষটাকে আজরাইলের মতো মনে হয় রাবেয়ার, বাইরে যেতে পা সরে না। হাসির দমক থামিয়ে ‘পানু চকিদার’ বলে,“ক্যানে আসচি, তা দেইখপার পাইমেন অ্যালা। ভুলু কোনটে?” আতঙ্কিত রাবেয়া তাকায় ঘুমন্ত ভুলুর দিকে। কখন যেন ঘুম ভেঙ্গেছে ভুলুর, রক্তলাল চোখজোড়া মেলে তাকিয়ে আছে এদিকেই। কিসের একটা আকুতি ভুলুর চোখে, রাবেয়ার কাছে সে কি আশ্রয় চায়? রাবেয়া কোথায় পাবে সেই আশ্রয়? মাথা নয়, পৃথিবীটাই বুঝি টলে ওঠে রাবেয়ার।
পানু চৌকিদার হার মানার পাত্র নয়, আর চুপিসারে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে চাইলে সে এত মানুষ নিয়ে আসত না, জানে রাবেয়া। তাই গতকাল শহর পেরিয়ে সেই লালবাগ বাজারে পকেটমারার অপরাধে ধরা পড়ে এবং গণধোলাইয়ের হাত থেকে কোনোরকমে পালিয়ে আসা ভুলুকে যখন সে বিচারের জন্য নিয়ে যেতে এসেছে রাবেয়াদের কিছুই করার থাকে না। অভুক্ত অসুস্থ রক্তলাল চোখের ভুলুকে যখন একপ্রকার বেঁধেই প্রাইমারি স্কুলের দিকে নিয়ে যায় পানু ও তার সঙ্গীরা মিলে, রাবেয়ার চোখের জল সব তখন বাষ্প হয়ে গেছে। শাশুড়ি আছাড়িবিছাড়ি কাঁদছে তখন, রাবেয়ার চোখে একফোটা জল নেই।
সন্ধ্যের পর স্কুলের মাঠে বিচার হবে ভুলুর; চেয়ারম্যান, মেম্বারকে খবর দেয়া হয়েছে। ঘরের দরজায় বসে থাকা রাবেয়াকে রূপালির মা বলে গেছে তখন, পানুকে হাজার দুয়েক টাকা দিতে পারলে হয়ত খানিকটা মেরে ধরেই ছেড়ে দেবে ভুলুকে, না হলে না জানি কোন ফাঁসিয়ে পাঠিয়ে দেবে থানায়, কে জানে। এও বলেছে, পানুর যখন কারও কাছ থেকে টাকা খসাবার ‘খায়েশ’ হয়, তখন তাকে এমন করেই হেনস্থা করে ও।
নগদ টাকা নেই, রাবেয়ার মনে পড়ে দুলগুলো বেচলে কিছু টাকা হবে বটে। সেই দুল! ক’দিন আগের রাতটার কথা মনে পড়ে রাবেয়ার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রূপালির মাকে নিতে বলে দুলজোড়া। না, অত টাকা নেই রূপালিদের। রূপালির মা-ই বুদ্ধিটা দেয়, চৌকিদারের বউই হয়ত নেবে, দুলজোড়া সুন্দর আছে বেশ।
দুপুরের দিকে পানু চৌকিদারের বাড়ি যায় রাবেয়া, স্কুলের জায়গাটা একরকম দৌড়েই পার হয় ও, তাকাতে পারে না ওদিকে, ওর ভেতরেই কোনো একটা ঘরে ভুলু আছে, অসুস্থ, ক্ষুধার্ত। আজ, এই প্রথমবার রাবেয়ার গলা কান্নায় বুজে আসতে চায়, পা সরতে চায় না। কিন্তু কাঁদবার সময় নয় এটা। পানুর বাড়িতে গিয়ে ওর বউয়ের হাত ধরে কাঁদে। দুলজোড়া আগেই খুলে আঁচলে বেঁধে রেখেছিল রাবেয়া, বউয়ের হাতে দিতে গেলে হা হা করে ওঠে পানু-“ দুলটুল দিয়া কী করমো, কওতো? বোজেন তো, এইগুলা এলাকার মান-সম্মানের ব্যাপার।”
না, এই মুহূর্তে এলাকার মান-সম্মানের ব্যাপার মাথায় ঢোকে না রাবেয়ার। আর তাছাড়া লালবাগ এখান থেকে কতদূর, ওখান থেকে খবর কী করে এখানে চলে এলো এত তাড়াতাড়ি, সেও ভাবার সময় নয় এখন। দুলজোড়া পানুর বউয়ের হাতে দিতে যায় রাবেয়া, বউ পানুর সম্মতির জন্য তাকায়; ট্যারা চোখে দেখে পানু আবার বলে-“দুল ফিরি নিগাও, ভুলুর বউ। মুই দ্যাকো, কী করা যায়, চ্যারম্যানোক কয়া দ্যাকো কী কয়। তোমরা অ্যালা বাড়ি যাও।”
না, বাড়ি যেতে চায় না রাবেয়া এখন। দুলগুলো বেচতেই হবে, নগদ টাকা নেই একদম। ধরা গলায় পানুর বউকে অনুরোধ করতে থাকে ও-“ন্যাও, বৌদি। দুলগুলা ভালো আচে কিন্তুক, নয়া দুল। আর হামার শফিকুলের বাপক হ্যানা দ্যাকেন”-ভুলুর কথা বলতে গিয়ে রাবেয়ার চোখ ঠেলে কান্না আসে এবার।
পানু এবার এগিয়ে আসে বৌয়ের কাছে-“তোমরা তো আচ্চা নাছোড়, বাহে। দ্যাকো দুলগুলা মুই।” বউয়ের হাত থেকে দুলগুলো নিয়ে চোখের সামনে ধরে। হঠাৎ করে সামনে ঝোঁকার কারণে কাঁধ ছাড়িয়ে যাওয়া ফাইভ স্টার কলপের দৌলতে চৌকিদারের কুচকুচে কালো চুলগুলো সামনে চলে আসে ।
রাবেয়ার মনে হতে থাকে এবার একটা গতি হবে নিশ্চিত। চোখ মুছে শুকিয়ে খটখটে হয়ে আসা ঠোঁটজোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে ও অপেক্ষা করে। শকুনচোখে পর্যবেক্ষণ করার পর দুলগুলো বউয়ের হাতে দেয়-“এত করি যকন কওচে, দীপুর মাও, নিবার পারিস দুলগুলা। তা শোনো ভুলুর বউ, দুলগুলা তো ঝালাই করা দ্যাকোচে আর সোনাও আচে খুব কম। বাজারোত পাঁচশর বেশি হবার নায়-মুই সাতশ পইয্যন্ত দেইম। এলাও ভাবো এই দামোত দিবেন না দিবার নান।”
রাবেয়ার ভাবাভাবির কিছু নেই। ও জানে, দুলগুলোর বাজার দর যতই হোক না কেন, পানু চৌকিদার সাতশর বেশি দেবে না। আর দামে কীই বা এসে যায়? বলে-“দাম ক্যানে কওচেন? ওগুলা থুইয়া দ্যাও, খালি শপিকুলের বাপোক হ্যানা দ্যাকেন। থানাত পাটান না, দাদা।”
পানুকে চিন্তিত দেখায় এবার, রাবেয়া বোঝে এর সবটাই ভান। কী বলবে তাই শোনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে ও। চিন্তিত মুখেই পানু এবার বলে-“ঠিক আচে। কিন্তু থানাত না পাটের চাইলে তো ঝামেলা আচে। চ্যারম্যান, মেম্বার আইসপে, ওমরা তো এই কতা শুনির চাবার নায়”-মনে মনে কী হিসাব করে পানু-“অবিশ্য ওমাক চা পানের জইন্যে এই হাজার তিনেক টাকা দিলে কাম হবারও পায়। বোজেনও তো, দুনিয়াত সবায় টাকা পাইলে খুশি।”
বোঝে রাবেয়া; অন্তত আজকের ঘটনায় ওর বোঝাপড়া বেড়ে গেছে হাজারগুণ। কিন্তু মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে এবার, দুলজোড়া দিয়ে দিয়েছে পানুর বৌকে। আর কোথায় টাকা পাবে ও? বাড়িতে বেচে দেবার মতো কিছু নেই। ধার? পকেটমার, বাটপারের বউকে কে ধার দেবে টাকা? মাথা ঘুরতে থাকে, পানুর উঠানেই ধপ করে বসে পড়ে রাবেয়া এবার।
পতনের শব্দে ওর দিকে তাকায় পানু আর পানুর বউ দু’জনেই, বউয়ের হাতে রাবেয়ার ছোট্ট দুলজোড়া রোদে ঝিলিক খেলে যায়। বউ এগিয়ে এসে রাবেয়াকে ধরে, “দিদি, এত চিন্তা না করেন তো।”
পানু মনে হয় ঝিলিক খাওয়া দুলগুলোর দিকে একবার তাকায়, আবার রাবেয়ার দিকে ফেরে-“দ্যাকো ভুলুর বৌ, ম্যানেজ করির পান নাকি। আচ্চা, যাও, দুলের দাম মুই দিয়া দেইম, সাতশ নোয়ায়, হাজারে দ্যাওচে। তোমরা আর খালি দুই হাজার টাকা যোগাড় করো কোনোমতে। মোরটে থাইকলে তো দিয়া দিনু হায়, মুইও তো অ্যালা দিবার পাওচে না।”
একটু কি আফসোসের শব্দে জিহ্বা নাড়ে পানৃ? ওর বউ কি রাবেয়ার কষ্ট আর অসহায়তা সত্যিই অনুভব করে? এসবে কিচ্ছু যাচ্ছে না এখন রাবেয়ার। ও চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পায় সন্ধ্যার পর বাজার ফিরতি মাঠভর্তি মানুষের সামনে পানু চৌকিদারের লাঠির মারে পশুর মতো চিৎকার করছে ভুলু আর মাঠভর্তি মানুষের চোখে নীরব জান্তব উল্লাস, হয়তো আরও অনেকেরই হাত নিশপিশ করছে-একটা জলজ্যান্ত বাটপারকে মারার উত্তেজনা কি কম? আর তারপর-ভ্যানে টেনে হিচড়ে তোলা, সারাদিন ক্ষুধায় কষ্ট পাওয়া, অভুক্ত শরীরে লাঠির পর লাঠির মার হজম করা ভুলুর একজোড়া চোখ, ভ্যানের পেছনদিকে তাকিয়ে কেবল একজোড়া আশ্রয় খুঁজে ফেরা চোখ…..
রাবেয়ার শরীরটা বসে থেকেও কেমন টলে ওঠে ঢেউ লাগা জলের মতো, প্রাণপণ চেষ্টায়ও নিজেকে বসিয়ে রাখতে পারে না আর। পানুর বউ দু’হাতে জাপটে ধরে ওকে; ডান হাতে তখনও দুলজোড়া ধরা, ঘরে রাখবার সময় হয়নি।
দেবদ্যুতি
মন্তব্য
" শ্যামলা ঢলঢলে মুখখানায় রাজ্যের মায়া রাবেয়ার, ও মুখে মানায় না এমন কিছু এ বিশ্বে নেই আর তাছাড়া সোনা মানায় না এমন মেয়েমানুষও আছে নাকি দুনিয়ায়"?
---- সকাল বেলায় আমার এক অন্যমাত্রার ভাললাগা কাজ করেছে গল্পটা পড়ে।
--------------
রাধাকান্ত
আপনার মন্তব্য এই মুহূর্তে আমার জন্যও অনেক ভালোলাগার ধন্যবাদ
গপ্পো ভালো লেগেছে। যদিও গল্পের নাম-ই প্রথমে পরিণতি সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়ে দিচ্ছে তারপরও দমবন্ধ করা একটা উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পেরেছেন গল্পের গাঁথুনি দিয়ে। এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী দিক মনে হলো। আলো লিখুন, শুভেচ্ছা
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে পড়েছেন বলে, শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বলেও। নামটা নিয়ে নিজেও ভেবেছি, কী করি বলুন তো, মাথায় এলোই না কিছুতে অন্য একটা সুন্দর নাম
"রাবেয়ার শরীরটা বসে থেকেও কেমন টলে ওঠে ঢেউ লাগা জলের মতো, প্রাণপণ চেষ্টায়ও নিজেকে বসিয়ে রাখতে পারে না আর। পানুর বউ দু’হাতে জাপটে ধরে ওকে; ডান হাতে তখনও দুলজোড়া ধরা, ঘরে রাখবার সময় হয়নি।"
ভালো লিখেছেন
মহাবিশ্বের পরিব্রাজক
ধন্যবাদ
মন খারাপ হোয়ে গেল গল্পটা পড়ে। সেদিকে গল্প সার্থক।
টাইপো আছে কয়েকটা।
টাইপো আছে কয়েকটা।
পানৃ-পানু
ভুল-ভুলু
-সো ।
টাইপোগুলো ধরিয়ে দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ, আর কষ্ট করে পড়েছেন বলে তো বটেই.....
ভাল লাগল ৷
ধন্যবাদ
ভাল লেগেছে
-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...
ভালো লেগেছে বলে ধন্যবাদ
ওহে বালিকা, তোমার ছোটগল্পের ফ্যান হয়ে যাচ্ছি । হপ্তায় হপ্তায় সচলে এমন গল্প পেলে বেশ হয়।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
লইজ্জ্বা, লইজ্জ্বা; কী যে বলেন এইসব....
ভালো লাগলো গল্পটা।
এখন তো টাইপো ঠিক করার সুযোগ নেই, যখন সুবিধাটা পাবেন তখন দুল 'পরা' করে নেবেন কেমন!
আরো লিখুন।
এই ‘পরা’ আর ‘পড়া’র ধন্দে পড়ে যাই কতবার, ইস! অনেক ধন্যবাদ, কেমন সুন্দর করে একটা ভুল ধরিয়ে দিলেন
আপনার নতুন লেখার অপেক্ষায়
প্রিয় মাসুদ সজীবের মন্তব্যে সহমত। আপনার লেখার হাত কিন্তু খুব ভাল। ছোট ছোট বিষয়ের বর্ণনা আর শব্দের সুচারু গাঁথুনি খুব সুন্দর।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
ধন্যবাদ সাদিয়া’পু। আপনার নতুন লেখার অপেক্ষায় আছি.....
ভাল লাগলো গল্পটা। যদিও কিছুটা মন খারাপ হয়েছে। লিখতে থাকুন।
মহান অতন্দ্র।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
সূক্ষ সূক্ষ মুহূর্তগুলো দারুণ সব শব্দের বন্ধনে জড়িয়েছেন- এটা ভালো লেগেছে। তাছাড়া আঞ্চলিক শব্দের বিস্তর প্রয়োগ গল্পের আবেদনকে বহুগুনে বাড়িয়ে তোলে.....লেখাটা সার্বিকভাবে প্রাঞ্জল আর বেশ কয়েকটা লাইন মন ছুঁয়ে গেছে.....চালিয়ে যান সাথে আছি
অসংখ্য ধন্যবাদ আর ভালোলাগা আপনার মন্তব্যের জন্য সাথে থাকার জন্য আরও ভালোলাগা
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
শেষটায় এসে মন খারাপ হল। (তারমানে গল্পটা সত্যিই ভালো হয়েছে!)
শুভেচ্ছা
শেষটা লিখতে গিয়ে আমারও মন খারাপ হয়েছে .......
খুব সুন্দর একটা মন খারাপের গল্প।গল্পটা পড়ার পর কেন যেন রাগও লাগছে।কিন্তু রাগটা কার ওপর হলো ঠিক বুঝতে পারছি না।
তাহলে তো রাগটা আমার উপরেই হয়েছে আপনার তা রাগ হলো বলে কি নিজের নামটাও লিখতে নেই প্রিয় পাঠক? আপনাকে চিনতেই পারলাম না যে, রাগ ভাঙাই কী করে বলুন তো?
নতুন মন্তব্য করুন