গল্প শ্রবণের ক্ষেত্রে আমাদের কিছু অভ্যস্ততা আছে। সেই অভ্যস্ততা মেনেই শীতকালে শীতের গল্প শুনি আমরা, গ্রীষ্মকালে গরমের, ডিসেম্বরে শুনি বিজয়ের গল্প, মার্চে যুদ্ধের। কিন্তু গল্প কথন রীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। পেশাদার বক্তা বাদে বেশীরভাগ মানুষের গল্পই পরম্পরাহীণ। পরিস্থিতির প্ররোচনায় স্মৃতির পাঁজর আঁকড়ে ধরে জীবনের গল্পগুলো উঠে আসে সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে। সময় কিংবা কালের প্রচলিত চলন উপেক্ষা করেই বর্ণিত হয় তারা । গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, বসন্তের সীমারেখা ভেঙে যায়। ভেঙে যায় সন, তারিখের পর্যায়ক্রম মেনে চলার অভ্যস্ততার গণ্ডি। ঠিক তেমনটিই ঘটল আমাদের আলাপচারিতার ক্ষেত্রেও। রাজশাহীর শাহ মখদুম কলেজের অধ্যক্ষ ড. তসিকুল ইসলাম ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজশাহীতে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের গল্প শুরু করলেন বর্ষপঞ্জীর মধ্যমাসে। গল্প শুরু হতে না হতেই গজিয়ে উঠল তার শাখা-প্রশাখা। ঘটল প্রসঙ্গান্তর। গল্পের মধ্যে অন্য গল্প উঠে এল। প্রাসঙ্গিকভাবেই জানা গেল তসিকুল ইসলামের ছোটবেলার গল্পও।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের গল্প বর্ণনাকারী তসিকুল ইসলামের জন্ম কিন্তু ১৯৫৩ সালের ১১ জানুয়ারি। রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানার বালিয়াঘাটা গ্রামে জন্ম তাঁর। বাবা সাজ্জাদ আলী ছিলেন কৃষিজীবী। মা জায়েদা খাতুন গৃহিনী। বাবা মায়ের একমাত্র পুত্রসন্তান তসিকুল ইসলামের ছোটবেলার গল্প তাই কষ্টের মলিন কাগজে মোড়ানো। শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তির জোরেই কাশিমপুর ফজলুল হক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭০ সালে এস.এস.সি. পাস করলেন তিনি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ডিগ্রী কলেজ থেকে অতিক্রম করলেন উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার গণ্ডি। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় ভর্তি হলেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি শুরু করলেন নানা ধরনের সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। সেই সব কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতিতে দেশ ও দশের প্রতি সৃষ্টি হল দায়িত্ববোধ।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে অধ্যাপনায় যোগ দেবার কিছুদিন পর ভাষা আন্দোলন বিষয়ক গবেষণাকাজ শুরু করলেন তসিকুল ইসলাম। রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনের একটা স্বচ্ছ চিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করলেন তিনি। ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত বিভিন্ন বই পুস্তকের সাহায্য নিলেন, পর্যালোচনা করলেন তৎকালীন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন, পরীক্ষা করলেন প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত, দলিল দস্তাবেজ। এছাড়াও রাজশাহীর বিশিষ্ট ভাষাসংগ্রামীদের সাথে পৌনঃপুনিক কথোপকথনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত বেশ কিছু অপ্রকাশিত সত্যের কাছে পৌঁছলেন তিনি।
সে সব সত্যের মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য কোনটি? জানতে চাইলাম গবেষক তসিকুল ইসলামের কাছে।
উত্তরে তিনি জানালেন একটি শহীদ মিনার নির্মাণের কথা। তসিকুল ইসলামের গবেষণালব্ধ তথ্যানুসারে রাজশাহী কলেজের নিউ মুসলিম হোস্টেলের প্রধান ফটকসংলগ্ন সামান্য অভ্যন্তরে নির্মিত সেই শহীদ মিনারটিই বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার!
তসিকুল ইসলামের উচ্চারিত বাক্যটি কৌতূহলের জন্ম দিল আমাদের মধ্যে। সেই কৌতূহল নিবারণের দায় নিজের কাঁধেই তুলে নিলেন তিনি। নিস্তরঙ্গ গল্পটি এবার বাঁক বদল করল! শুরু হল উত্তেজনায় ভরা নতুন গল্প!
নতুন এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র স্বাভাবিকভাবেই রাজশাহীর ভাষাসংগ্রামীরা। এ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু, এ্যাডভোকেট মহসীন প্রামাণিক, এ্যাডভোকেট সৈয়দ আমীর হোসেন স্পেন, ডাক্তার এস. এম. এ. গাফফার, সাংবাদিক সাইদউদ্দিন আহমদ, আবদুল মালেক খান, এ্যাডভোকেট মো. আব্বাস আলীসহ রাজশাহীর প্রায় সকল ভাষাসংগ্রামীদের বক্তব্য অনুসারে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ক্রোধে উন্মাতাল ছিল সংগ্রামমুখর রাজশাহীর রাজনৈতিক অঙ্গন।
ঢাকায় ছাত্র-জনতার সমাবেশে পুলিশের গুলিবর্ষণে হতাহতের খবর রাজশাহীতে এসে পৌঁছানো মাত্রই শুরু হয়েছিল খণ্ড খণ্ড মিছিল। সন্ধ্যা গাঢ় হবার পর রাজশাহী কলেজের নিউ মুসলিম হোস্টেলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল একটি ছাত্রসভা। সেই সভায় পরদিনের কর্মসূচী হিসেবে রাজশাহীতে সর্বাত্মক হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত তো হয়ই, এছাড়াও গৃহীত হয় ভাষা শহীদদের স্মরণে একটি মিনার কিংবা স্তম্ভ নির্মাণের ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত।
অনন্য সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তখনই কাজ শুরু করে ছাত্ররা। তাঁদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে এলাকার বেশ কিছু সাধারণ মানুষ। ২১ ফেব্রুয়ারি সারা রাত ধরে কাজ করে তাঁরা। ইট এবং কাদা দিয়ে নিউ মুসলিম হোস্টেলের প্রধান ফটকের সামনে নির্মিত হয় বাংলাদেশের প্রথম শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ।
স্মৃতির অতলে চাপা পড়া এই গল্পের ভিত্তি কি শুধুই রাজশাহীর ভাষাসংগ্রামীদের প্রদত্ত বক্তব্য কিংবা গৃহীত জবানবন্দী? খানিকটা সংশয় ভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করি আমরা।
না, প্রশ্নের উত্তরে দৃঢ়স্বর তসিকুল ইসলামের। তিনি একটি আলোকচিত্রের প্রতি দৃষ্টি দেবার অনুরোধ জ্ঞাপণ করলেন এবার। প্রয়াত ভাষাসংগ্রামী এ্যাডভোকেট মহসীন প্রামাণিকের সৌজন্যে প্রাপ্ত সেই আলোকচিত্রটি বিস্ফারিত চোখে প্রত্যক্ষ করলাম আমরা।
হ্যাঁ, একটি শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ প্রতিভাসিত সেখানে! এবং ড. তসিকুল ইসলামের গবেষণালব্ধ তথ্যানুসারে এটিই বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার!
দীপংকর চন্দ
মন্তব্য
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
অনেক অনেক ধন্যবাদ সুলেখক।
আপনার উপস্থিতি অনুপ্রেরণাদায়ক ভীষণভাবে।
আমার শুভকামনা অনিঃশেষ জানবেন।
ভালো থাকবেন। সবসময়।
দীপংকর চন্দ
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ অনেক অনেক এক লহমা।
আপনাদের অনেকের অনেক লেখাই পড়া হয়।
অনুভূতি প্রকাশ করা হয় না মন্তব্যে হয়তো কিছু সঙ্গত কারণে!
আমার শুভকামনা কিন্তু থাকছেই সকলের প্রতি, সকলের প্রতিটি লেখায়, সকলের মন্তব্যে, সকলের উপস্থিতিতে। অনিঃশেষ।
ভালো থাকবেন। সকলে। সবসময়।
দীপংকর চন্দ
ফেব্রুয়ারীর উপযুক্ত পোস্ট!
অনেক অনেক ধন্যবাদ জানবেন।
এবং কৃতজ্ঞতা।
এবং শুভকামনা। অনিঃশেষ।
ভালো থাকবেন। অনেক। সবসময়।
দীপংকর চন্দ
পাড়ায় পাড়ায় প্রায় শহীদ মিনার চোখে পড়ে । একদিন ছাড়া বাকি ৩৬৪ মনে হয় এগুলো অবাঞ্চিত !
------------
রাধাকান্ত
ধন্যবাদ অনেক অনেক ভাই।
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয়, গর্বের ভাষা আন্দোলন গর্বের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অন্তরে সমুজ্জ্বল থাকলে চেতনা-স্মারকের ভৌত কাঠামোর মূল্যায়ন হবে পরম নিশ্চিতিতে।
আমার শুভকামনা অনিঃশেষ জানবেন।
ভালো থাকবেন। সবসময়। অনেক।
দীপংকর চন্দ
একদমই অজানা তথ্য। কোথাও পড়িনি রাজশাহীর এই ঘটনার কথা।
পড়েছি সেই জানা ঢাকা মেডিকেলের কথা। কিন্তু তারিখ হিসেবে অবশ্যই রাজশাহী এগিয়ে।
দারুণ একটা তথ্য দিলেন ভাইয়া
অনেক অনেক ধন্যবাদ আয়নামতি।
বিনীত ভাবে জানাচ্ছি, একদম অজানা তথ্য সম্ভবত নয় এটি!
কেউ কেউ নিশ্চিত জানেন!
আমি শুধু বিষয়টিকে বিভিন্ন গ্রহণযোগ্য সূত্রে যাচাই বাছাই করেছি। তথ্যসহ এবিষয়ে কথা বলেছি বেশ কয়েকজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় অতি সুপরিচিত গবেষক-লেখক ভাষাসংগ্রামীর সাথে- যাঁদের মধ্যে কারো কারো প্রত্যক্ষ সংযুক্ততা ছিলো ঢাকায় নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারের সাথে।
আগে বা পরের বিষয়টি মূখ্য নয় তেমন, তবে সঠিক ইতিহাস যে কোন মূল্যেই প্রতিষ্ঠিত হয় একসময়। অন্তত মহাকালের বিভিন্ন ঘটনা সে কথাই নিশ্চিত করে আমাদের।
অনিঃশেষ শুভকামনা জানবেন।
ভালো থাকবেন। সবসময়।
দীপংকর চন্দ
অজানা তথ্য জানলাম। ভাল লাগা পোস্টের জন্য। সকল ভাষা সৈনিকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
ধন্যবাদ অনেক অনেক সুলতানা সাদিয়া।
এবং কৃতজ্ঞতা।
অামার শুভকামনা অনিঃশেষ জানবেন।
ভালো থাকবেন। অনেক। সবসময়।
দীপংকর চন্দ
অনেক কিছু জানলাম যা জানবার দরকার ছিল । ধন্যবাদ দীপঙ্কর দা ।
গল্পে গল্পে লিখেছেন অনেক কিছু
এতদিনে হল জানা কে নিয়েছে ইতিহাসের পিছু
মহান অতন্দ্র
অনেক অনেক ধন্যবাদ মহান অতন্দ্র।
আপনার উপস্থিতিতে ভালো লাগা অনেক।
অনিঃশেষ শুভকামনা জানবেন।
ভালো থাকবেন। সবসময়। অনেক।
দীপংকর চন্দ
এই শহিদ মিনারটির কথা জানতাম আগে থেকেই, কাজের সূত্রে তথ্যটা জানার দরকার ছিল বলেই হয়তো। তবে এ নিয়ে প্রচার-প্রচারণা নেই বলেই হয়ত আমাদের জানতে অনেক সময় লেগে যায়। অনেক ধন্যবাদ বিষয়টি নিয়ে লিখবার জন্য।
দেবদ্যুতি
অনেক অনেক ধন্যবাদ দেবদ্যুতি।
যে তথ্যগুলোর সঠিক, সেগুলো অন্যদের সাথে ভাগ করে নিন ভাই। লিখুন সকলে।
সম্মিলিত চেষ্টায় আমরা স্পর্শ করবো একদিন আমাদের সুন্দর ইতিহাসকে।
আমার শুভকামনা অনিঃশেষ জানবেন।
ভালো থাকবেন। অনেক। সবসময়।
দীপংকর চন্দ
জানা ছিল না। আপনার লেখার ধরনও ভালো লেগেছে।
স্বয়ম
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন