হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি। গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেয়ে চোখে জল ঝড়ানো ভুলে গেছেন? পাশের বাড়ির বিট্টুকে হাওয়াই মিঠাই খেতে দেখেও আর পুরোনো দিনে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না? আপিসে জমতে থাকা ফাইল দেখে নিজেকে চিত্রগুপ্ত ছাড়া আর কিছু ভাবা যাচ্ছে না? ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে গ্লোবাল ওয়ারমিং এর ঝাপটাগুলোও কি গায়ে এসে লাগছে? আর, ছোট্টো তিতির রোজ পাহাড়-নদী-সমুদ্রের ছবি আঁকছে, আর আপনি সেটা ব্যাজার মুখে দেখে ছুড়ে ফেলছেন?
আর চাপ নেই... চলুন বেড়িয়ে পড়ি।
কি ভাবছেন?
ভাবছেন, “আরে বাবা বেড়িয়ে পড়ি বললেই তো আর বেড়িয়ে পড়া যায় না।” ভাবছেন, “অন্তত বেড়িয়ে পরার আগে একবার ফেলুদা হতেই হবে - জায়গা সম্পর্কে খুঁটিনাটি জানতে হবে, নোটবইয়ে নোট করতে হবে, মস্কুইটো ক্রিম রাখতে হবে, টর্চ-ছুড়ি-সেফটিপিন দেখে দেখে নিতে হবে, হোটেল বুকিং করতে হবে......”
উফ, বাবুমশাই, আপনি বড্ড সেকেলে। এখন বেড়িয়ে পড়তে হলে আর ফেলুদা-কাকাবাবু হতে হয় না। শুধু বলতে হয়, “চলো, লেটস গো...”। অজানাকে জানতে আবার অত পড়াশুনো কেন? পিঠে রাকস্যাক নিয়ে বেড়িয়ে পড়ুননা মশাই। গুগুল ম্যাপ আছে, নেভিগেশন আছে, আরে বাবা, সাইবার ওয়ার্ল্ড আপনাকে মাকড়সার জালের মত বেঁধে রেখেছে। আপনি একা নন। আর ফেইসবুকে একটা জম্পেস স্ট্যাটাস মেরে দিলেই কেল্লাফতে, লিখতেই পারেন, “ গোইং টু ডিসকভার সামথিং”।
তো বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে নিন। আপনিও বেরিয়ে পড়ুন আমাদের মত।
হ্যাঁ, আমাদের মত, আমাদেরও তেমন কোনো প্ল্যান ছিল না।
আমরা? আমরা মানে সাতজন। বেড়াল, গেছোদাদা, গেছোবৌদি,বুধো, উধো, হিযিবিজবিজ, আর শ্রী ব্যাকরণ শিং, (বি. এ. খাদ্য বিশারদ)। কি? একেবারে হ জ ব র ল, তাইনা? তাই বলে ভাববেন না যে গাঁজাখুরি। এই কাহিনী কোনো অংশেই কল্পনাপ্রবন নয়, আর বাস্তবের সাথে এর প্রচুর মিল।
ছুটির দিন দেখে আমরা সবাই পৌঁছে গেলাম হাওড়া স্টেশন। হাওড়া-যশবন্তপুর ই-টিকিট কাটাই ছিল। ট্রেনের সময় আটটা পঁয়ত্রিশ। ভারতীয় রেল তো সবারি জানা!!! ট্রেন ছাড়ল কুড়ি মিনিট লেটে। আমরা সবাই খেতে ভীষণ পছন্দ করি। তাই শুভস্য শীঘ্রম ভেবেই যত তাড়াতাড়ি পারলাম টিফিন শেষ করে দিলাম। ব্যাকরণ শিং যে এই রেসে জিতবেন, তা আগেই জানা ছিল। খাওয়া শেষে খানিক গ্যাঁজানো, তারপর যে যার বার্থ তুলে লম্বা ঘুম।
রেইলগাড়ির দুলুনিতে কুম্ভকর্ণ হয়ে পরার উপায় নেই। ব্রহ্মপুরে গাড়ি থামবে বেশ ভোরে। গেছোদাদাই টিমের লিডার। এদিকে সকাল হতেই ব্যাকরণ শিঙের খাই-খাই রব। ঠিক হল, এখানে ব্রেকফাস্টটা সেরেই রওনা হব গোপালপুর। বুধো-উধো দুজনেই ইঞ্জিনিয়ার। ওদের আবার খাবার পর সুখটান না দিলেই নয়। হিজিবিজবিজ দিব্যি মানুষ, ক্যামেরা হাতে খুটখাট করাটা ওর অভ্যেস। আর আমি বেচারা বিড়াল, এতগুলো দাদার মাঝে ফের রুমাল হয়ে যাওয়ার অবস্থা।
খাওয়া হল। অটো ঠিক করল গেছোদাদাই। ব্রহ্মপুর থেকে গোপালপুর প্রায় আধা ঘন্টার জার্নি। রাস্তা বেশ ভালো। রাস্তার পাশেই ছোটো বাড়ি, দেওয়াল জুড়ে নক্সা- কোনোমতেই বোর হতে দিচ্ছিল না। ঠিক গোপালপুর ঢোকার আগেই মস্ত গেটে ‘ওয়েলকাম’ লেখাটা আপনার চোখে পড়বেই। তারপর কিছুদূর গিয়ে একটা বাঁক, শুনতে পাচ্ছিলাম ঢেউ ভাঙ্গার আওয়াজ। চোখে দেখার আগেই দূরের থেকে এই শব্দটাই যেন রক্তে অ্যাড্রিনালিনের পরিমাণটা অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। শব্দ শোনার আর চোখে দেখার মাঝের সময়টা যেন কাটটেই চায় না। আমরা সবাই উদগ্রীব হয়ে বসে ছিলাম, কখন দেখব তাকে। অবশেষে সে এল। যতদূর চোখ যায়, শুধুই সে। মনের সমস্ত যন্ত্রণাকে মুছে দিয়ে দু হাত ছড়িয়ে সে কাছে টেনে নিল আমাদের।
এরই নামতো সমুদ্র। আচ্ছা, কি রঙ এটা? নীল? নাকি নীল-সবুজ? সেটা পরীখ্যা করতেই বোধহয় হিজিবিজবিজ দৌড়ে গেল বিচে। খানিক বাদে দেখলাম তা নয়। গেছোবউদির পেছনে কোন অ্যাঙ্গেলে সমুদ্রকে রেখে ফটো তুললে তা ফেইসবুকে বেশী লাইক পাবে তার মাপঝোক করতেই তিনি ক্যামেরা নিয়ে ছুটে গেছেন। বাকিরা পা ভেজাতে নেমে গেছি জলে। না নেমে থাকা যায় নাকি?
হোটেল একেবারে বিচের ওপর। আগের থেকে বুকিং করে রাকার যে খুব একটা দরকার আছে তা নয়। এই জায়গাটা বেশ নির্জন। আপনাকে অযথা ডিস্টার্ব করার লোক নেই। স্থানীয়রা বেশিরভাগই জেলে – এই সমুদ্র এদের চোখ সওয়া। আর মধ্যবিত্ত যারা আছেন তারা উইকএন্ডে এসে হুল্লোড় করে যায়, তাছাড়া বাকি দিনগুলোতে তাদের দেখা মেলা ভার।
হোটেলের ঘরে গিয়েই লাগেজ এক কোনায় ঢিল মারলাম সবাই। টাওয়েল সাথে নিয়েই একছুট জলে। গেছোদাদা দেখাতে যাচ্ছিলেন তিনি গাছেও যেমন, জলেও তেমন। কিন্তু গেছোবউদি তো আনকোরা। তাই গেছোদাদা ঢেউএর নীচে একটু ডুবতেই গেছোবউদির সে কি চিৎকার!!! আর ব্যাকরণ শিং? তিনি এখানেও প্রচুর জল খেলেন, প্রায় হাবুডুবু অবস্থা। কিন্তু হিজিবিজবিজ বাঁধিয়ে বসলেন এক কান্ড। প্রায় শরীরটাকে মাটির সাথে সুইয়ে দিয়ে তিনি কাঁকড়ার ছবি তুলতে গেলেন, আর তখনি এল এক প্রকান্ড ঢেউ। ব্যাস, ক্যামেরা জলে। সত্যজিতের গল্পে আগেও একবার গোপালপুর দর্শন তার হয়েছে। আর তিনি কিনা এই ভুলটাই করে বসলেন!
জলে দাপাদাপি-লাফালাফি-হুটোপুটি শেষ করে বোঝা গেল বেলা প্রায় গড়িয়ে গেছে। দুপুরের খাওয়া ভালোই হল। যার যেমন ইচ্ছে তার তেমন। কোনো বাঁধা নিষেধ নেই। কোলেস্তেরল-সুগার-প্রেসার এই শব্দগুলো বরং এই কয়েকটাদিন দূরেই থাকুক। হিজিবিজবিজ খেয়ে কতটা আরাম পেলেন জানি না, কারন ক্যামেরার শোকে তিনি তখনও কাহিল ছিলেন। ঠিক হল একটু জিড়িয়ে বিকেলে বিচে হাঁটতে যাব। নৌকাগুলো ফিরতে শুরু করেছে। দূরে ছোটো পিঁপড়ের মত লাগছে। রঙ পাল্টাচ্ছে সমুদ্রর, এখন গাড় নীল।
বিচের ওপর কয়েকটা দোকান টিমটিম আলো জালিয়ে বসে আছে। ঝিনুকের জিনিস সবই পাওয়া যায়। গেছোবউদি সপিং ওস্তাদ। বুধো-উধো বিচে বসে কালো সমুদ্র দেখে যাচ্ছে। হঠাৎ চোখ গেল অনেকদূর থেকে আসা একটা আলোর দিকে। হিজিবিজবিজ চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘লাইটহাউস...’ । একটা বিরাট গম্বুজের ওপর থেকে আলোর ছটা এসে লাগছিল চোখে। সবাই এগিয়ে চললাম তারি দিকে।
এ জিনিস এতো সামনে থেকে আরতো দেখা হয়নি আগে। দেখলাম লাইটহাউসটার ওপরে ওঠা যাবে। টিকিট কাটা হল। লম্বা চাঁপা ঘোরানো সিঁড়ি। গেছোদাদার উঠতে কষ্ট হল না, কিন্তু বাকিরা ঠ্যালাটা বুঝলাম। শেষ সিঁড়িটা টপকে যেতেই এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। পুরো গোপালপুরটাই দেখা যাচ্ছে ওপর থেকে। শুনলাম এই লাইটগুলো রাতে মাছ ধরার নৌকো, আর ছোটো-বড় জাহাজগুলোকে সঠিক পথ চেনাতেই ব্যবহার করা হয়। ওপরে উঠে আর নামতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু এখানেতো আর বসে থেকে যায় না।
লাইটহাউস থেকে ফেরার পথেই চোখে পরল অনেক পুরোনো ভাঙ্গা বাড়ি। দেখেই কেমন যেন গা’ছমছম করে। জরাজীর্ণ বাড়িগুলো যেন অনেক ইতিহাস কোলে করে বসে আছে। ঢোকার সাহস হল না। ঘুরতে এসে শেষমেশ ভূতের খপ্পরে?
রাতের খাওয়াও দারুন হল। আগে অর্ডার দেওয়া থাকলে ওরা যা খেতে চাইবেন তাই বানিয়ে দেবে। খাওয়া শেষ হলে আরামকেদারায় গা’ এলিয়ে দিলাম। সামনেই সমুদ্র। পুরো কালো জলের মাঝে সাদা ঢেউ আসে কোথা থেকে? জানি না। রাতের আলোয় সমুদ্র অনেক মায়াবি। বিচে কেউ নেই। তারাগুলো মলিন চোখে দেখছে আমাদের। সত্যি ঘরে বসে থাকলে এতো তারা, এতো জ্যোৎস্না চোখে পরত কি? ফিরে গিয়ে আবারতো সেই রোজনামচার ঘ্যানঘ্যান-প্যানপ্যান। এখানে এসে আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না। ইস, যদি এখানেই থেকে যাওয়া যেত!!!
মন্তব্য
সেখানে থেকে যাওয়া না গেলেও লেখাটার পরের পর্ব আসতে বাধা আছে কি? চমৎকার ঝরঝরে লেখা। শুধু পরেরবার কিছু বানান একটু ঠিকঠাক করে নেবেন-ঝড়ানো>ঝরানো, পরীখ্যা>পরীক্ষা, সপিং> শপিং (যদিও ইংরেজি বলে এতটা বাধ্যবাধকতা নেই), চাঁপা>চাপা (চাঁপাটা ফুলের নাম কিনা) , আরতো> আর তো।
আর লেখকের নামটাও দিলেন না? যাক, পরেরবার দেবেন নিশ্চয়ই। শুভকামনা
দেবদ্যুতি
ধন্যবাদ।।।।
পরের বার অবশ্যই বানানের দিকে নজর রাখব।
ভ্রমন কাহিনী পড়তে পড়তে একসময় মনে হল আমি নিজেও ভ্রমন করছি,ডুবে গেছি সেই সমুদ্রের দেশে.....
আব্দুল্লাহ আল ফুয়াদ
ভালো লাগা অনেক।
প্রথম ছবিটা অসাধারণ!
শুভকামনা জানবেন। অনিঃশেষ।
ভালো থাকবেন। সবসময়। অনেক।
দীপংকর চন্দ
প্রথম ছবিটা নজর কাড়া সুন্দর।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
লেখা চমৎকার লেগেছে। এবারে একটু বেসুর বাজলাম - এই লেখায় বানান ভুল কি যত্নের অভাব যে একেবারেই নেওয়া যায়না বেড়াল (তথা শেয়াল পণ্ডিত) মশাই! 'হ য ব র ল' যদি 'হ জ ব র ল' হয়ে যায় সেটা কিন্তু রুমাল-এর বেড়াল হওয়ার মত মজার হয়না, তাই না?
পরের লেখার সাগ্রহ অপেক্ষায় থাকলাম।
পুনশ্চঃ সাক্ষীর কথা থেকে জানলাম এটা সম্ভবত সচলে আপনার প্রথম লেখা। সচলে স্বাগতম। এত স্বাদু প্রথম লেখা খুব বেশী পাইনি।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আরে, দারুণ রসালো একটা লেখা। প্রথম লেখা বোধহয়, তাইনা?
বানান ভুল নিয়ে ভাববেন না, পরেরবার ঠিক হয়ে যাবে নিশ্চয়।
পা খুলে ঘুরতে থাকুন আর সাথে হাত খুলে লিখতে থাকুন।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি পেতে সামুদ্রিক সাতারের তুলনা হয়না!হয়ে যাক একটা ঢু মারা।
------------
রাধাকান্ত
রাধাকান্তবাবুকে অনুরোধ, 'ঢু' টা তাড়াতাড়ি মেরে নিন। কিছুদিনের মধ্যে গোপালপুর ঠিক ততটা অযান্ত্রিক থাকবে না, এখন যতটা আছে।
নতুন মন্তব্য করুন