ঢাকায় নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারের গল্প

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২৩/০২/২০১৫ - ৪:৩২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সৃষ্টির মাহাত্ম্য কখনও কখনও কি সৃষ্টিকর্তাকেও আড়াল করে দাঁড়ায় না?
স্বীয় ঔজ্জ্বল্যে কি ঢেকে দেয় না সৃষ্টির দিনক্ষণ, বিবরণ?
টিকাটুলী থেকে রিকশা নিয়ে প্রেসক্লাব অতিক্রম করতে করতে ভাবতে থাকি আমরা। ভাবতে ভাবতে হাইকোর্ট পার হই। দোয়েল চত্বর অতিক্রম করে একসময় পৌঁছে যাই বাঙালির প্রাণের মিনার শহীদ মিনারে।

রিকশা থেকে নেমে পা রাখি শহীদ মিনার চত্বরে। অনেকটা উৎসবমুখর পরিবেশ মিনারের চারপাশ জুড়ে। ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকি আমরা। হাঁটার ফাঁকে ফাঁকে চোখ রাখি ভূমিপৃষ্ঠ থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে অবস্থিত মিনারের মনোমুগ্ধকর কাঠামোয়।
তিনটি দুর্বাঘাসভরা লন বিশিষ্ট এই চত্বরে মিনারের যে কাঠামোটি দৃশ্যমান বর্তমানে, তার অন্তর্তলে কিন্তু ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতিই কেবল নয়, বেশ কয়েকবার ভাঙচুরের বেদনাও বিদ্যমান।
আজকের এই শহীদ মিনারটি গড়ে উঠেছে বাঙালির তৃতীয় নির্মাণ প্রয়াসে।
ঢাকায় প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয় এ স্থানেই ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে-

১৯৫২ সালের ঘটনাবহুল ২১ এবং ২২ ফেব্রুয়ারির রেশ ধরে ২৩ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতেও কারফিউ বলবৎ ছিল ঢাকায়। পথে পথে ছিল সেনা প্রহরাও। তবু এরই মাঝে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে অবস্থানরত রাজনীতি সচেতন ছাত্ররা আকস্মিভাবে সিদ্ধান্ত নেয় ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে একটি স্তম্ভ বা মিনার নির্মাণের।
সর্বসম্মত সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র বদরুল আলম এই কলেজেরই আরেকজন ছাত্র সাইদ হায়দারের সহায়তায় প্রণয়ন করেন একটি মিনারের নকশা।
সেই নকশা অনুযায়ী সেখানে উপস্থিত সর্বসাধারণের যৌথশ্রমে একরাতেই নির্মিত হয় প্রায় সাড়ে দশ ফুট উঁচু এবং ছয় ফুট চওড়া প্রথম শহীদ মিনারটি।
পরদিন ২৪ ফেব্রুয়ারি রবিবার, অনানুষ্ঠানিকভাবে মিনারটি উদ্বোধন করেন ভাষা শহীদ শফিউর রহমানের পিতা।
২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে মিনারটি উদ্বোধন হয় আনুষ্ঠানিকভাবে। মিনারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন ।
কিন্তু সেই উদ্বোধনের পর মিনারের সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব এবং এর চেতনাবিকাশী শক্তির কথা দ্রুত অনুধাবন করে বিকেলেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী গুড়িয়ে দেয় বাঙালির প্রাণের আবেগজড়িত মিনারটি।
তবে মিনারের ভৌত কাঠামো ভেঙে দিয়ে খুব একটা সুবিধা অর্জন করতে পারল না তারা, কারণ মাত্র আড়াই দিন পরমায়ুর মধ্যেই মিনারটি তাঁর মমতার শেকড় প্রোথিত করতে সক্ষম হয়েছিল হাজার বছরের ইতিহাস সমৃদ্ধ বাঙালি জাতির চেতনার ভিত্তিভূমিতে।

১৯৫৫ সাল পর্যন্ত মানুষ কালো কাপড়ে ঘিরে রাখে স্মৃতির মিনারের বিদীর্ণ স্থানটি।
১৯৫৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি খানিকটা অনুকূল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভাষাশহীদ আবদুল আউয়ালের কন্যা বসিরনকে দিয়ে বর্তমান মিনারের স্থানে স্থাপন করা হয় শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর অনানুষ্ঠানিকভাবে।
পরদিন অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন পূর্ব বাংলার তৎকালীন মূখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার।
তারপর ১৯৫৭ সালের নভেম্বরে শিল্পী হামিদুর রহমানের নকশায় শুরু হয় মিনারের নির্মাণকাজ। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শেষ হয় ১৯৬৩ সালে। সেই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতেই সদ্যসমাপ্ত মিনারটি উদ্বোধন করেন ভাষাশহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম।

১৯৬৩ থেকে ১৯৭১- সুদীর্ঘ নয় বছর এই শহীদ মিনারই ছিল এদেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের সূচনার প্রাণকেন্দ্র, বিজয়ের অনুপ্রেরণার অকৃত্রিম উৎস। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের চরম পরিণতির প্রকাশোন্মুখ দিনগুলোয় পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমনের অন্যতম লক্ষবস্তুতে পরিণত হয় এই মিনারটি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যার পাশাপাশি তারা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয় মিনারটি আবার।
কিন্তু যে মিনারের স্থান এ জাতির চিন্তা-চেতনায়, স্মৃতির মণিকোঠায়, সে মিনার ধ্বংস করার সাধ্য কার!
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ভগ্ন মিনারেই জাতি তাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করলেও ১৯৭৩ সালেই আবার গড়ে ওঠে বাঙালি প্রাণের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠা শহীদ মিনারটি।

বর্তমান শহীদ মিনারটিতে সর্বমোট পাঁচটি স্তম্ভ।
মাঝখানের বড় স্তম্ভটি শিল্পী হামিদুর রহমানের মূল নকশার অন্তর্নিহিত ভাব অনুযায়ী বাংলা মায়ের প্রতীকি প্রকাশ। মায়ের দুই পাশে অর্ধবৃত্তাকারে দুটি করে অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের আরও চারটি স্তম্ভ তাঁর সন্তান হিসেবেই বিবেচিত।
সন্তান পাশে নিয়ে দাঁড়ানো মা খানিকটা ঝুঁকে আছেন ভাষা আন্দোলনে শহীদ সন্তানদের আত্মত্যাগের মহিমার কথা স্মরণ করে।
আত্মত্যাগের এই যে মহিমা, তার কথা কি না ছড়িয়ে পারে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে?
ভাবতে ভাবতে আমরা এগিয়ে যাই তানফিজের কাছে। বাবা খোরশেদ আলমের সাথে বাসাবো থেকে শহীদ মিনার দেখতে এসেছে তিন বছরের ছোট্ট তানফিজ। আমাদের দেখে সলাজ ভঙ্গীতে মাথা নাড়ায় সে এবং আনন্দে আন্দোলিত করে হাতের মুঠোয় ধরে থাকা বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকাটিকে।

‌ছবি: সংগৃহীত

দীপংকর চন্দ


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আবেগের ঘনঘটায় কিছু বলতে পারছি না। যখন দেখি পাড়ায় পাড়ায় শহীদ মিনার গুলো অযত্ন অবহেলায় পরে আছে তখন লজ্জায় সংকুচিত হই।শহীদ মিনার যে কি জিনিস উঠতি প্রজন্মটা তা হয়তো ভাল করে জানছেই না।

-------------
রাধাকান্ত

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই।

আমার শুভকামনা জানবেন। অনিঃশেষ।

ভালো থাকবেন। সবসময়। অনেক।

দীপংকর চন্দ

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

দেবদ্যুতি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ অনেক অনেক দেবদ্যুতি।

আমার শুভকামনা জানবেন। অনিঃশেষ।

অনেক ভালো থাকবেন। সবসময়।

দীপংকর চন্দ

এক লহমা এর ছবি

চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ অনেক এক লহমা।

অনিঃশেষ শুভকামনা জানবেন।

ভালো থাকবেন। অনেক। সবসময়।

দীপংকর চন্দ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।