আমার ধারনা আমাদের মধ্যে বেশির ভাগেরই জাতিস্মর শব্দটির সাথে প্রথম পরিচয় বাংলা ব্যকরণ পড়তে গিয়ে। স্কুল জীবনে এক কথায় প্রকাশ বলে একটি জিনিস ছিল এবং সেখানে "পূর্ব জন্মের কথা স্মরণ করতে পারে যে- জাতিস্মর" খুবই নিয়মিত ছিল ,পরীক্ষায় আমার অন্তত প্রায়ই "কমন" পড়ত। কিন্তু আমার আবার পড়ার বইয়ের চেয়ে গল্পের বইয়ে বেশি ঝোঁক ছিল, আমি এ শব্দের মানে প্রথম জেনেছিলাম তাই গল্পের বই থেকেই। আমার মত যারা ছোটবেলায় সত্যজিৎ রায়ের "সোনার কেল্লা" পড়েছেন তাদের নিশ্চয়ই মুকুলের কথা মনে আছে? কলকাতার আট দশ বছরের একটি ছেলে যে কিনা তার আগের জন্মের স্মৃতি মনে করতে পারত, যে জন্মে সে কোন এক সোনালী রঙের কেল্লায় থাকত। সেই সোনার কেল্লার খোঁজে ফেলুদার সাথে আমিও কত দুপুর যে যোধপুর, বিকানির আর জয়সলমীরে পার করেছি! এসব পুর্বজন্মটন্মে আমার বিশ্বাস না থাকলেও এই ধারনাটা আমাকে মুগ্ধ করেছিল বেশ। এই জন্মের মানুষ আমি মরার পরে আরেক বার জন্মাতে পারি, সেই জন্মে শঙ্খচিল শালিক হয়ে আকাশে উড়ে বেড়াতে পারি,এই ভাবনাটাই বেশ রোমাঞ্চকর!
বড় হবার পর বেশির ভাগ অলৌকিক জিনিসকেই নিশ্চিত ধাপ্পাবাজি মনে হয়েছে, কিন্তু কেন জানি জাতিস্মরদের ব্যাপারে আমি কিছুটা উদার থেকে গেছি। বোধহয় শৈশবের সেই সোনার কেল্লার মুকুলের প্রতি ভালবাসা থেকে। সে কারনে এই জিনিস নিয়ে অল্পস্বল্প পড়াশোনা করেছি ইন্টারনেটে , বোঝার চেষ্টা করেছি ধাপ্পাবাজি ছাড়া এটাকে আর কোনভাবে ব্যাখা করা যায় কিনা। আমার এই লেখা সেই আধা চিমটে পড়াশোনা আর এক মুঠো কল্পনা শক্তির ঘুটা দিয়ে তৈরী এক জগাখিচুড়ী!
জাতিস্মরদের বা পূর্বজন্মের ব্যাপারে একটি ব্যাখা হচ্ছে যে সেটি অবচেতন মনের স্মৃতি। হয়তো আপনি কখনো কোন বই পড়েছেন, কোন সিনেমা দেখেছেন বা ছবি দেখেছেন, যা কিনা আপনার মনেই নেই। কিন্তু আপনার অবচতন মনে সেটার ছাপ রয়ে গেছে এমনভাবে যে সেটাকে আপনি আপনার সত্যিকার স্মৃতির সাথে গুলিয়ে ফেলেন। তাই যে ঘটনা আপনি আসলে বইয়ে পড়েছেন,সেটাকেই আপনি নিজের
জীবনের ঘটনা ভাবতে শুরু করেন। এক ভদ্রমহিলা (সম্ভবত আমেরিকান) দাবি করতেন যে তিনি আগের জন্মে আইরিশ ছিলেন এবং সে সম্পর্কে বেশ খুঁটিনাটি বিবরণ দিয়ে আশেপাশের মানুষজনকে তাক লাগিয়ে দিতেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে- পরে জানা গিয়েছিল যে সেই মহিলার শৈশবে এক প্রতিবেশী আইরিশ মহিলা ছিলেন,তার সাথে সেই বিবরণ অনেক খানি মিলে যায়। তাই এমনটি হতেই পারে যে
ভদ্রমহিলার সচেতন স্মৃতিতে আইরশ মহিলা নেই, তাই অবচেতন মনের স্মৃতিকেই নিজের অভিজ্ঞতা ভাবছেন। আবার আরেক জাতিস্মর দাবি করেছিলেন যে তিনি ষোড়শ শতাব্দীতে আগেরবার জন্মেছিলেন, সেকালে তিনি কোন উচ্চারনে কথা বলতেন সেটাও সবাইকে শুনিয়েছিলেন। কিন্তু সেই উচ্চারন বিশ্লেষন করে ভাষাবিদরা বলেছিলেন যে কথা বলার ওই ধাঁচটা আসলে সিনেমাতেই দেখানো হয়, সত্যি সত্যি মোটেও তেমনটি ছিলনা। সুতরাং এই ভদ্রলোকের পুর্বজন্মের স্মৃতি আসলে তার দেখা কোন সিনেমার ঘটনা যা তিনি ভুলে গেছেন, এই যুক্তি একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায়না। এই উদাহরনগুলো থেকে আসলে পূর্বজন্মের এই ব্যাখাটি আমার কাছে বেশ ভাল মনে হয়েছে।
কিন্তু এই ব্যাখাটি আবার সব জায়গায় খাটেনা। যেমন আমেরিকায় দেড় বছরের এক বাচ্চা একবার বলা শুরু করল যে সে নাকি আগের জন্মে তার দাদা (কিংবা নানা, গ্রান্ডফাদারের দুটো অর্থই যে হয়!) ছিল। তার দাদার বোন ঠিক কিভাবে মারা গিয়েছিল, কিংবা দাদী (অথবা নানী) তার(মানে তার দাদার/নানার) জন্য কি কি খাবার কিভাবে বানাত সেটার নিখুঁত বর্ণনাও দিয়েছিল। তারা বাবা-মার মতে এসব ঘটনা বাচ্চাটিকে কখনোই তারা কিংবা অন্য কেউ কখনো বলেনি , তাহলে সে কিভাবে এসব জানল? ঠিক এ জায়গাটিতে এসেই আমার কাছে এ সম্পর্কে দ্বিতীয় আরেকটি ব্যাখা যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে।
ডঃ ব্রায়ান ডায়াস এবং ডঃ কেরি রেসলার এক গবেষনায় দেখিয়েছেন যে কিছু স্মৃতি আসলে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে সঞ্চারিত হতে পারে। তাদের এই গবেষনার ফলাফল ডিসেম্বর,২০১৩ এর বিজ্ঞান সাময়িকী "নেচার"এ ছাপা হয়েছে। গবেষণায় তারা একদল ইঁদুরের মধ্যে গোলাপের গন্ধভীতি তৈরী করেছিলেন। ঠিক কিভাবে করেছিলেন সেটা বিস্তারিত জানতে পারিনি, তবে এই পরীক্ষাগুলো অনেকভাবেই করা যায়। যেমন হতে পারে যে ইঁদুরগুলোকে প্রথমে গোলাপের গন্ধ শোঁকান হত, তারপর একটা ইলেক্ট্রিক শক দেয়া হত। এরকম কয়েকবার করার পর দেখা গেল যে গোলাপের গন্ধ শোঁকালেই ইঁদুরগুলো ভয় পেয়ে যায়। কারন তারা জানে এরপরেই আসছে ইলেকট্রিক শক। কিভাবে ভীতি তৈরী করা হয়েছিল সেটা বড় ব্যাপার নয়, আসল কথা হচ্ছে এক সময় ইঁদুরগুলো গোলাপের গন্ধকে ভয় পেতে শুরু করল। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল, কিন্তু আজব ব্যাপার হল সেই ইঁদুরগুলোর যখন বাচ্চা হল, তখন সেই বাচ্চাগুলোও গোলাপের গন্ধে ভয় পেয়ে যেত, অথচ তাদেরকে কখনোই শক দেয়া হয়নি! শুনতে ভুতুড়ে শোনালেও ব্যাপারটা আসলে তেমন নয়। ব্রায়ান এবং কেরি এটাও দেখিয়েছেন যে প্রথম প্রজন্মের ইঁদুরগুলকে যখন ভয় দেখানো হয়েছিল, তখন ইঁদুরগুলোর শুক্রানুতে একটা পরিবর্তন এসেছিল। আর সেই পরিবর্তনটি কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মে ঠিক ঠিক প্রবাহিত হয়েছিল। হতে পারে গোলাপের গন্ধভীতির স্মৃতিটুকু পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হওয়ার সাথে এর কোন যোগসুত্র আছে।
এতসব ব্যাখা বানালাম আসলে নিজের একটা অভিজ্ঞতা বলার পটভূমি তৈরী করার জন্য। যা বলতে যাচ্ছি সেটা শুনলে আমাকে চাপাবাজ মনে হতে পারে, তাই এত ভণিতা করলাম। যাই হোক ব্যাপারটি হচ্ছে -চোখ বন্ধ করে মনোযোগ দিয়ে একটু কল্পনা করলেই আমি দেখতে পাই যে আমি কোন একটি হ্রদের পাড়ে পাহাড়ের উপর বসে আছি খালি গায়ে। বেশ গরম রাত,কিন্তু হালকা বাতাস বইছে।আমার পিঠে বিন্দু বিন্দু ঘাম,তাতে হালকা বাতাস লেগে কাঁটা দিয়ে উঠছে।আকাশে ধবধবে সাদা গোল চাঁদ,হ্রদের পানিতে চাঁদের ছায়া পড়েছে। ঝিরিঝিরি বইতে থাকা সেই হালকা বাতাসের কারনে পানিতে সামান্য আলোড়ন, তাই চাঁদের প্রতিবিম্বটি কেমন যেন কেটে কেটে গিয়ে একটা নকশার মত তৈরী করেছে। সেই নকশার সূক্ষ্মতম কাজগুলোও আমি কল্পনায় দেখতে পাই! এতটাই স্পষ্ট যে মনে হয় যেন এটি কোন কল্পনা নয়, স্মৃতি!
আমি জানি, শতকরা পঞ্চাশ ভাগ সম্ভাবনা যে এর পুরোটাই আমার কল্পনা।আমার কল্পনাশক্তি যথেষ্টই ভালো, গাঁজার কল্কেতে টান না দিয়েও গাঁজাখুরি চিন্তাভাবনা প্রায়ই করি, এটাও তেমনই একটা হতেই পারে। আর শতকরা উনপঞ্চাশ ভাগ সম্ভাবনা হচ্ছে আমি এটা কোথাও পড়েছি।ছোটবেলায় বইয়ের পোকা ছিলাম, সেবার অসংখ্য অনুবাদ আর থ্রিলার পড়েছি। বই পড়ার সময় আমি আবার দৃশ্যকল্প চিন্তা করে পড়তাম, যেন বই পড়ছি না বরং কোন নাটক দেখছি। এরকম বা তার কাছাকাছি কোন বর্ণনা বইয়ে পড়েছি বলেই কল্পনায় এত স্পষ্ট দেখি, এই সম্ভাবনাটিও তাই যথেষ্টই যৌক্তিক। কিন্তু যেটার সম্ভাবনা শতকরা এক ভাগ বা তার চেয়েও কম সেটিই সবচেয়ে রোমাঞ্চকর। আমি জানি আপনি মানতে চাইবেন না, তবু একবার ভাবুন না যে এটি আমার কল্পনা নয়, আমি কোথাও পড়িওনি। হয়তো এমনটি সত্যিই ঘটেছিল শত, সহস্র, অযুত বা নিযুত বছর আগের আমার কোন পুর্বপুরুষের সাথে। হয়তো তেমন হ্রদ কখনো পৃথিবীতে সত্যিই ছিল বা আজও আছে, আর সেই চাঁদতো আজও আছে। হয়তো এখনও সেই হ্রদের জলে চাঁদের প্রতিবিম্বে নকশা তৈরী হয়, শুধু সেই নকশার দিকে অপলক চেয়ে থাকা মানুষটিই নেই। যদিও তার এই একটুকরো স্মৃতি মহাকাল বেয়ে বেয়ে তার এই উত্তরপুরুষের কাছে এসে পৌঁছেছে।
নিজের নয়, কিন্তু অন্য একটি প্রাচীন জীবনের স্মৃতি আমি মনে করতে পারি, সে অর্থে আমিও তো একজন জাতিস্মর!
-গগন শিরীষ
মন্তব্য
"নিজের নয়, কিন্তু অন্য একটি প্রাচীন জীবনের স্মৃতি আমি মনে করতে পারি, সে অর্থে আমিও তো একজন জাতিস্মর!".........(!)
সচল আমাকে সত্যিই সচল করছে। লেখককে ধন্যবাদ।
------------
রাধাকান্ত
পড়ার এবং মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ প্রিয় রাধাকান্ত!
আমাদের মত ছোটখাট মানুষদের লেখালেখি সচল রাখাতে সচলের জুড়ি নেই!
দারুণ!
দেবদ্যুতি
ধন্যবাদ দেবদ্যুতি !
চমৎকার
মহাবিশ্বের পরিব্রাজক
খুব ভালো লাগলো।
স্বয়ম
পরিব্রাজক এর টা আপনার এখানে চলে এসেছে।ধন্যবাদ স্বয়ম!
ধন্যবাদ পরিব্রাজক !
কল্পনাশক্তি সম্পন্ন প্রতিটি সুস্থ মানুষই একেকজন জাতিস্মর
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
সেরাম ডায়ালগ স্বাক্ষী ভাই
পড়ার জন্য ধন্যবাদ !
'জাতিস্মর' শব্দটি আমাকে সুধীন বাবুর কবিতাটির কথা মনে করিয়ে দেয়।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
কবিতা খুব বেশি পড়িনি রোমেল ভাই। সুধীন বাবুর কবিতাটিও পড়িনি।দু-চার লাইন দিয়ে দিন না এখানে!
দু'চার লাইন নয়, এই কবিতাটি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার ইচ্ছে করি! তবে আজ নয়, আজ মন ভালো নেই। ইচ্ছে হলে, আপনি বরং এই লেখাটি পড়ুন।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
পড়ে আসলাম এবং মনটা খারাপ করলাম।অনবদ্য!
সাক্ষী-র মন্তব্যর সাথে সহমত।
রোমেল-এর মত আমারও মনে আসছে সুধীন্দ্রনাথকে; সেই সাথে শরদিন্দুকেও।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ এক লহমা !
লেখাটা পড়ে উপকৃত হলাম জাতিস্মরের ব্যাখ্যা পেয়ে । এটা কোন সমস্যা কিনা জানি না ;আমি নিজেকে ১৯৫০-৯০ এর সাদাকালো সময়ের একজন ভাবতে ভালোবাসি । সেই সময়ের সমূহ জীবন যাপন , ভাষা প্রয়োগ আমাকে টানে, আমার প্রায়ই মনে হয় আমি ভুল দশকে জন্মেছি , সেই সময়গুলো ফিল করতে পারি। গত দশদিনে এপার-অপার মিলিয়ে প্রায় ৩৫ টা বাংলা ক্লাসিক মুভি দেখেছি ......সুচিত্রা কে মনে হচ্ছে পাশের বাড়িতে থাকে!!!!!
মজিবুর রহমান
আমার লেখাটা কিন্তু পুরোপুরি ব্যাখা না,মানুষজন কিছু কথা বলেছে আমি সেগুলোই তুলে ধরেছি।ঠিক জানিনা এসব ব্যাখা আসলে কতটুকু ঠিক।
আপনার মন্তব্যটি চমতকার!
আপনার লেখার উপস্থাপনাটা ভালো লেগেছে।
শুধু আপনি নিজে না, আমাদেরও চাঁদের আলো ভরা রাতে, কোন এক নাম না জানা হ্রদের পাড়ে বসিয়ে রেখে চলে গেলেন।
শুভেচ্ছা
অনেক ধন্যবাদ মেঘলা মানুষ! সেটা করতে পারলেই আসলে লেখালেখির মানে হয় অনুপ্রাণিত হলাম।
জাতিস্মর বিষয়টা বৈজ্ঞানিকভাবে বিতর্কিত হলেও এর পেছনে দাঁড় করানো বিভিন্ন সময়ের যুক্তিগুলো কিন্তু মজার.....তবে প্রজন্মান্তরে স্মৃতি সঞ্চারণের ব্যাখ্যাটা মনে হয় প্রথম পড়লাম কিন্তু বেশ ব্যবহারিকই মনে হল.....যদিও এতে করে ধর্মীয় বিশ্বাস ও মাহাত্ম্যে কমতি হয়না কারণ প্রচলিত সব কয়টা ধর্মেরই এমন হাজারো অলৌকিকতার লৌকিক যুক্তি আধ্যাত্মিকতাই মানে না
আপনার অবচেতন মনের চিন্তাকে অতিরিক্ত হিংসা হচ্ছে- নাইবা হলাম জাতিস্মর কিন্তু কখনো যদি এভাবে নিজেকে কল্পনা করতে পারতাম- পারতাম একাকী নিজেকে এভাবে ভাবতে আর ভালবাসতে..........
ঠিক বলেছেন ময়ুখ কিরীটি,ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন