আমরা গ্রাম ছেড়ে এসেছিলাম কোনও এক ভোরে। ঘুম ঘুম চোখে মাটিতে সূর্যের প্রণতির আগেই, বাবা-মা’র সাথে আমরা মানে আমি আর আমার বোন রওনা হয়েছিলাম শহরের পথে। তখনো শহর চিনি না, জানি শুধু শহর নামে একটা কিছু আছে যেখানে যেতে চায় সবাই, যেখানে সব পাওয়া যায়। সব বলতে কী কী, সে প্রশ্ন তখন আমাদের মাথায় আসেনি নতুনের রোমাঞ্চের দাপটে। অর্জুন সাজের ধনুক-দিনের সাথে ফেলে এসেছিলাম নিজস্ব বাঁশঝাড়, বাটোয়ারার উঠোন আর অচেনা গাছের ফাঁকে প্রতিপক্ষ বোলতার ঝাঁক, মান্দারের আঠা আর ফড়িং শিকারের নৃশংসতা। একদিন কুয়াশা ঘেরা ভোরেই আমরা গ্রাম ছেড়ে এসেছিলাম, তখন ছিল শীত। হাড় কেঁপেছিল কিনা মনে নেই। তবে কে কে কেঁদেছিল তার একটা লিস্ট এখনও করতে পারব, আমি কাঁদিনি।
তখনো গোমতির দুপার পরস্পরকে বাঁধেনি কঙ্ক্রিটের সন্ধিতে। তখনো মানুষের মাঝে ছিল জলজ যোগাযোগ। তখনো বাসগুলোর নামে ‘আল’ শব্দের প্রাধান্য ছিল না। তখন বাসগুলো মানুষের সাথে মেঘনা, গোমতি নামেই পরিচিত হতো। আমরা এরকমই কোনও এক বাসে চড়েছিলাম। সে এক বিষ্ময়। প্রবল গতি, মানুষের ঘাম, তামাকের গন্ধ, শিশুর কান্না, ভারিক্কি আলাপ. . ... আমি শুধু জেনেছিলাম বাসটায় চড়ে বসেছে আস্ত একটা গ্রাম। সহসা শহর দেখার বিষয়ে উদগ্রিব ছিলাম বলে, জানালার বাইরে মাথা বের করে শহর খুঁজছিলাম আমি। মনে মনে গল্প ভাঁজছিলাম, ফিরে গিয়ে বলব বলে।
আমরা যে বাসে চড়েছিলাম তার নাম ছিল মেঘনা। তখনো এটি মেঘনা এক্সপ্রেস, মেঘনা স্পেশাল, মেঘনা প্লাস বা নিউ মেঘনা হয়ে ওঠেনি। মাঝখানে ছিল দুই ফেরির বিরতি। ডালমুট, চিনাবাদাম, চানাচুর মাখা, চালভাজা আর রকমারি আচারের লোভ জাগানিয়া সে বিরতি। আমরা বড় বড় চোখ মেলে তারচেয়েও বড় নদী দেখেছিলাম। আমাদের ভয় দেখিয়েছিল অচেনা পাগলের লাল দাঁতের হাসি। আমাদের মনে পড়ে গিয়েছিল তাহের পাগলার কথা। স্কুলে যাওয়ার পথে ছোট পোলটার উপরে তাহের পাগলা বসে থাকতো। একেবারে নিস্তরঙ্গ হয়ে। আমরা ক্ষেপাতাম, নেচে নেচে। মাঝে মাঝে দৌড়ানো ছাড়া কখনো কিছু বলত না। আমরা সেই তাহের পাগলাকে ফেলে শহরে চলে এসেছিলাম। বেড়াতে নয়, বৃন্তচ্যুত হয়ে।
কোনো এক হীম-ভোরে আমরা শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলাম। শহর দেখেছিলাম, তখন সন্ধ্যা। আমাদের সাথে ছিল অনেক বোঝা। একটা ছোট পুটলি ছাড়া আমাকে কিছুই বহন করতে হয়নি। নাজিয়া, আমার বোন, তাকে করতে হয়েছিল। সে বড় হওয়ার দরুন তাকে বড় ব্যাগ সামলাতে হয়েছিল। যদিও সে বাসে বমি করার কারণে একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। নাজিয়া এখনো বাসে উঠলে বমি করে মাঝে মাঝে। আগের মতো সব সময় না। চাকরির সুবাদে বাসে যাতায়াত এখন তার নিত্য।
আমি তখনো বুঝিনি আমরা গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছি। বেড়াতে নয়। তাই একটা অপেক্ষা থেকে গিয়েছিল মনের কোনায়। কবে ফিরব, সোহেল-টিপু-শামিম-রূপক-অরুণদের কবে গল্প শোনাব আশ মিটিয়ে। আমার মাথায় তখন নানান গল্প ডালপালা বাড়ায়। গল্পের লিস্ট বড় হতে হতে বিরাট অজগর। কিন্তু যেদিন মা-বাবা দুজন মিলে আমাকে স্থানীয় একটা স্কুলে নিয়ে যায়, স্কুলের হেডমাস্টার আমাকে নানান রকম প্রশ্ন করে, অতঃপর টেবিলের উপর দাঁড় করিয়ে জানান দেয়, ‘ক্লাস টু এর তুলনায় এই ছেলেটা ছোটো’। সুতরাং একে ক্লাস ওয়ানেই ভর্তি করা হোক। মূহুর্তেই বুঝে যাই, আমার ডিমোশন হয়ে গেল, মুহুর্তেই বুঝে যাই স্কুল মাঠটা ছোট হয়ে গেল। সবুজেরা জোট বেঁধে পাথর হয়ে গেল, টলটলে পুকুরটা হঠাৎ করে হয়ে গেল সঙ্কীর্ণ ডোবা। একেবারে ভিতর থেকে জেনে গেলাম, ফেরা হবে না আর খড়ের গাদায়, বন্ধুরা পেয়ে গেল সবকটি বেতফলের দখল। আমি নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। আমার সেই স্কুলটাও কিন্তু গ্রামের মতোই। গ্রামের মেতাই তার সাজ-পোষাক। টিনের ঘর, বড় বড় টানা বেঞ্চ, ঝাপসা হয়ে যাওয়া ব্ল্যাকবোর্ড। এমনকি তার শিক্ষকরাও সব গ্রামীণ। পান খেতে খেতে ক্লাস নিচ্ছেন, মারছেন, ধরছেন, ঘুমাচ্ছেন। আমি নতুন বলে অনেকেই আমাকে একটু ছাড় দিচ্ছেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমি সবকিছু মানতে পারলেও এক বছরের ডিমোশনটা একেবারেই মানতে পারলাম না।
তারপর আমার দিনলিপিতে কেবলই মেঘ আর ছায়া গোনার গল্প। দুপুরে নাজিয়া স্কুল থেকে ফিরে এলে আমার স্কুল শুরু। একা একা স্কুলে যেতাম। আগের মতো আমার দল নেই, সাঙাত নেই, সর্দারিতো দূরের কথা। তারপর ফিরে এলে বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে থাকা। দেয়াল থেকে শুরু করে সবকিছুর সাথে কথা বলা। জানালায় ছিল বড় বড় লোহার গ্রিল। এটা আমার কাছে একটা অহেতুক অত্যাচার মনে হতো। সেই গ্রিলে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম দৃষ্টিকে ছেড়ে দিয়ে নিয়ন্ত্রনহীন, অপলক। কিন্তু দৃষ্টি আটকে যেত পলেস্তেরাহীন দেয়ালে অথবা বিদ্যুতের তারে। আমার আর অগণন পথ পাড়ি দেয়া হতো না। তাই ছুটাতাম কল্পনার ঘোড়া এদিক ওদিক মাথার ভিতরে। তখনো ঘরে নেই টেলিভিশন কিংবা টুইনওয়ান। তাই একা একা বয়ে যেত নির্জন দুপুর। বারান্দায় একা একা বসে থেকে রোজই কথা হতো চড়–ইর সাথে। নিচে একটা কুকুর এসে লেজ নাড়িয়ে তার আনুগত্য জানাতো নিয়ম করে। অজান্তেই একদিন তার নাম দিয়েছিলাম- ‘টাইগার’। বাঘের প্রতি যে আমার খুব একটা পক্ষপাত ছিল এমন নয়। তবু এ নামেই তাকে ডাকতাম আমি। মানুষের মতোই আমি নিজ দৌর্বল্য ঢাকতে বেছে নিলাম শক্তির প্রতীকী নাম। এ ছিল অবচেতন প্রয়াস। তখন কি আর বুঝে কিছু দিয়েছি। মাঝে মাঝে মা ঘুমিয়ে থাকলে গুণতির সংসার থেকে চুরি করে এনে দিতাম তাকে টোস্ট বিস্কিট। খুব একটা পছন্দ করতো বলে মনে হয়নি কোনোদিন। তবু, হয়তো আমার মুখের দিকে চেয়েই খেয়ে নিত নতমুখে। এই টোস্ট খাওয়ানোটাই বিপত্যি করে। ঘর থেকে বেরুলেই সে আমার পিছু নিত। আর আমি কুকুর তাড়া করেছে এমন আতঙ্কে তটস্থ থাকতাম সবসময়। দৌড়াতাম। সেও আমাকে বুঝিয়ে বলার বদলে সাথে সাথে দৌড়াতো। সেই ছোট থাকতেই বাজার করতে হতো আমাকেই। তাই এই নতুন আতঙ্ককে সাথে নিয়ে চলতে হতো। একদিন টাইগার নিজেই এই আতঙ্কের সমাপ্তি টানলো নির্জীব পড়ে থেকে রাস্তার ধারে। আমার আর ত্রস্তভাবে দৌড়ে ঘরে ফেরা হয়ে ওঠেনি কোনোদিন। বারান্দায় পা দুলিয়ে কারো প্রতীক্ষা করতে হয়নি আর।
স্বয়ম
মন্তব্য
কী অদ্ভুত সুন্দর লেখা! একটার পর একটা শব্দে কী দারুণ স্নেহময় বন্ধন! শৈশব টানে আমাকে, আমি বড় শৈশবপাগল মানুষ। আপনার লেখাটা পড়ে কেমন যেন করছে বুকের ভেতর। মান্দারের আঠা ছিল বুঝি আপনার শৈশবেও? ছোটবেলায় মান্দার দেখতাম-কাঁটাওলা গাছে লাল ফুল, আমার ভারি অবাক লাগতো এই ফুলই নাকি স্বর্গের ‘অপরাজিতা’! আচ্ছা, সবার কি একটা ভুলতে না পারা শৈশব থাকে? নাকি এ শুধুই গল্প?... আর হীম-ভোর>হিমভোর, ছোটো>ছোট, পরে কখনও ঠিক করে নেবেন।
দেবদ্যুতি
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। আগেই দেখেছিলাম। কিন্তু হত্যা আর রক্তপাতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নন্দনের কথা বলতে ভালো লাগছিল না।
তাই প্রতি মন্তব্য দিতে দেরী হলো।
স্বয়ম
মাহমুদুল হক এর ছায়া দেখতে পাচ্ছি!সত্যিই খুব ভাল লাগছে।কেন জানি মনে হয় লেখকের আত্মজীবনী।চলতে থাকুক।
-------------
রাধাকান্ত
এটা গল্প। আর আমাদের প্রতিটি গল্পেইতো একটু একটু করে আমরাও ঢুকে পড়ি। কখনো বেশি, কখনো কম।
ধন্যবাদ
স্বয়ম
চলুক কলমের চাকা, আমরা চড়ে বসেছি।
-------------
রাধাকান্ত
ধন্যবাদ।
স্বয়ম
নতুন মন্তব্য করুন