কর্নেল সেয়ানার বিজ্ঞান মেলা, প্রফেসর শমশেরের গাড়ি, আর হাবুলের বিজ্ঞান স্বপ্ন ।

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০১/০৩/২০১৫ - ৫:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।
মেলায় স্টলগুলোর সামনে দিয়ে একবার ঘুরে এসে শমশের সাহেব যারপরনাই বিরক্ত হলেন। জনসমাগম ভালো, কিন্তু প্রধান অতিথির কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। জনা বিশেক স্টল, তার সামনে শ-খানেক মানুষ। বিজ্ঞান মেলায় এর চেয়ে বেশি আর কে আসবে? দু’জন বাদাম ওয়ালা ঘুরে বেড়াচ্ছে ইতস্তত। ব্যাবসা মনে হয় ভালোই। এক কোনায় একজন গ্যাস বেলুন বেচছে। বিজ্ঞান মেলা তো নয়, যেন ফাল্গুন উৎসব। যত্তসব। তিনি মুখ ভার করে গেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেন। দু’টোর সময় মেলা উদ্বোধন করার কথা ছিল। চারটা বাজে, এখনো প্রধান অতিথির খবর নেই। হাসিবকে একবার ফোন করে দেখবেন নাকি ভাবলেন। থাক, আগে কর্নেল ব্যাটা আসুক।

সোয়া চারটার সময় মাঠের মাঝখানে একটা সুদৃশ্য গাড়ি এসে থামল। কর্নেল সেয়ানা ভারিক্কি চালে গাড়ি থেকে নামলেন। রাগে তার মুখ থমথম করছে। শমশের সাহেব প্রমাদ গুনলেন। ছোটবেলা থেকেই সেয়ানার রাগ মারাত্মক। তিনি তাড়াতাড়ি তার বন্ধুর গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।

“ব্যাটা”, ফিসফিস করে বললেন কর্নেল, কিন্তু গর্জনের মত শোনা গেল, “নিমন্ত্রণ দাও প্রধান অতিথির, কিন্তু গাড়ি পার্ক করার একটা জায়গা রাখোনা আশেপাশে। খুঁজতে খুঁজতে জান কাবার হয়ে গেল। জানো না, আমি লেট করাটা একদম পছন্দ করি না? ব্লাডি সিভিলিয়ান কোথাকার! “

বিজ্ঞান মেলার আয়োজক কর্নেল সাহেব নিজেই। সামনের ইলেকশনে দাঁড়ানর চেষ্টা করছেন তিনি, তাই একটু পাবলিসিটি দরকার। আর মাসে মাসে লাখখানেক টাকা ইলেক্ট্রিসিটি বিল দেবারও কোনও ইচ্ছে নেই । তাই বিজ্ঞান মেলার থিমও দিয়েছেন, “অল্টারনেট এনার্জি” , বিকল্প শক্তিব্যাবস্থা। শমশের সাহেব প্রথমে কিছুক্ষণ গাইগুই করলেও, পরে রাজি হয়ে যান। কায়কোবাদ, ইকবাল সাহেবরা অলিম্পিয়াড দিয়ে বাহবা কুড়ালে তিনিই বা বাদ যাবেন কেন ? তাই মেলার আয়োজনের যত হেভিলিফটিং সব তিনিই করছেন।

“তাই বলে দুই ঘণ্টা লেট ? আর এই অজপারাগায়ে পারকিং স্পেস কোথায় পাবো ?”

“পনেরো মিনিট লেট হয়েছে মাত্র। চারটা টার্গেট করে এসেছি। কোন অনুষ্ঠানে দেখেছ প্রধান অতিথিদের সময় মত আসতে? কিন্তু তোমার জন্য পনের মিনিট দেরি হয়ে গেল। মানুষ এখন কি ভাববে? “

যাই হোক, গাড়িটাকে কোনরকম মাঠের মাঝখানে পার্ক করার ব্যাবস্থা করে প্রফেসর শমসের কর্নেল সাহেবকে মঞ্চে ওঠালেন।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে অনুষ্ঠান শুরু হল। হাটহাজার স্কুলের হেডস্যারের বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও কর্নেলের অগ্নিদৃষ্টির সামনে পাঁচ মিনিটেই বক্তৃতা শেষ করে দিলেন ।

কর্নেল সেয়ানা উঠে পড়লেন মঞ্চে। মাইকের ক্যাঁচক্যাঁচ ছাপিয়ে তার ভরাট গলার অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা শুরু হল। “সোনার দেশ… ডিসিপ্লিনের অভাব… দুই মহিলার ঝগড়া… পদ্মা সেতু… কোনও কিছুই সেই বক্তৃতা থেকে বাদ গেলো না। সুধু বিজ্ঞান ছাড়া। “ মাঝখানে একটা কাক বিরক্ত হয়ে প্রতিবাদ করায় কয়েকবার ‘ব্লাডি ব্ল্যাকবার্ড’ বলে হুঙ্কার ছাড়েন তিনি, এছাড়া মোটামুটি নির্বিঘ্নেই কেটে যায় সময়টা।

একফাঁকে শমশের সাহেব তার এককালের ছাত্র হাসিবকে ডেকে আনেন। হাসিব এখন একটা অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক।

২।
এবার স্টল পরিদর্শন।

প্রথম স্টলটা একটা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। কর্নেল সাহেব হনহন করে পার হয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু শমশের সাহেব দাঁড়িয়ে পড়লেন। দুজন ক্লাস সেভেন এইটের ছাত্রী, সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছে রোদের মধ্যে, দেখে মায়া লাগে। কর্নেলের কনুই ধরে আস্তে করে টান দিলেন তিনি।

“মায়েরা, তোমরা কি বানিয়েছ? “ কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন।

বাজখাই গলার চিৎকারেও মেয়েগুলো একটু ভয় পেলনা। দেখে শমশের সাহেব একটু অবাক হলেন।

যন্ত্রটা সুন্দর। নাগরদোলার মত একটা টারবাইন এক কোনে। সেটা দেখিয়ে মেয়েগুলো বলল, “ স্যার, এই টারবাইনটা পানি দিয়ে ঘোরে। টারবাইনটার গোঁড়ায় একটা ইন্ডাকশন কয়েল আছে, যেটা একটা শক্তিশালী ম্যাগনেটের মধ্যে দিয়ে ঘুরবে । এই ঘোরার ফলে তৈরি হবে বিদ্যুৎ।“

মেয়েগুলো আরো কি সব জিনিস সরগড় বলে যায়। ফ্যারাডেস ল, এডি কারেন্ট, হাবিজাবি অনেক শব্দ ভেসে আসে।
কর্নেল সাহেব ক্যোঁৎ করে একবার ডোক গিললেন। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে নাক খুঁটতে থাকলেন।

“আরেকবার আস্তে আস্তে বল ।” প্রফেসর শমশের বললেন।

খেপে উঠলেন কর্নেল।

“আরেকবার বলবে কেন, আমি কি বুঝিনি নাকি? পানি ঘোরে, বিদ্যুৎ বের হয় ?”

মেয়েগুলো বুদ্ধিমতী। হেসে বলল, “ ঠিক বলেছেন। “

একটা বালতি দিয়ে টারবাইনটার ওপর একটু জল ঢালতেই ম্যাজিকের মত যন্ত্রের অন্য পাশে একটা বাল্ব জ্বলে উঠল । আর জল পরা বন্ধ হতেই টিম টিম করে নিভে গেল ।

কর্নেল মুখ গোমড়া করে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষন , তারপর বললেন,
“ভালোই, কিন্তু এই জিনিশে সারাদিন ধরে পানি ঢালবে টা কে ? যাই হোক, গুড এফরট গুড এফরট।” বলেই তিনি পরেরটার দিকে পা বাড়ালেন।

“বিদেশে হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার অনেক বড় জিনিশ। নদীতে বাঁধ দিয়ে বানায়। “ কর্নেলের কানে কানে বললেন শমশের সাহেব।

“দ্যাখো, তোমাকে বললাম এমন কিছু দেখাও যেটা ক্যান্টনমেন্টে লাগাতে পারব । ক্যান্টনমেন্টের মাঝখানে নদী নিয়ে আসব কিভাবে?"

“দেশের নিরাপত্তার জন্য রাস্তা ঘুরিয়ে দিতে পারো, আর একটা নদীর পথ বদলাতে পারো না?” প্রফেসর শমশের ফস করে বলে ফেললেন। ক্যান্টনমেন্টের মাঝখান দিয়ে রাস্তা হলে তার ইউনিভারসিটিতে যেতে কমপক্ষে আধঘণ্টা কম লাগত।

৩।

হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা জটলার মাঝখানে গিয়ে থামলেন । বিচিত্র কলকব্জার যন্ত্রপাতির মধ্যে একজন বদরাগী দেখতে লোক বসে আছে। শমশের সাহেব লক্ষ করলেন যে জিনিশটাকে তিনি গ্যাসবেলুনের দোকান মনে করেছিলেন সেটা আসলে একটা যন্ত্র।

“সকাল থেকে এখানে বসে আছি, আর আপনারা এতক্ষণ পরে আসলেন?" কাঁচাপাকা চুল অদ্ভুত মানুষটা খেঁকিয়ে উঠল। শমশের সাহেব নেমট্যাগটা পড়লেন, “ সমুদ্র ধর - শখের বিজ্ঞানী। “

‘দাঁড়ান দাঁড়ান, দেখাচ্ছি। “ বলে কয়েকটা গ্যাসবেলুন হাতে নিলেন তিনি। এখানেও যন্ত্রের একপাশে একটা চাকার মত জিনিশ, কয়েকটা আংটা লাগানো।
“চাকাটা টারবাইনের সাথে লাগানো, চুম্বকের মধ্যে টারবাইন, কয়েল ঘোরে, আর বিদ্যুৎ তৈরী হয়।"
“কিন্তু চাকা ঘোরে কিভাবে?”
বেলুনগুলো তিনি চাকার নিচের দিকে কয়েকটা আংটায় আটকে দিলেন । বেলুনগুলো উঠতেই চাকাটা ঘুরতে শুরু করলো ।
উনি একটা তারের আগায় একটা ছোট্ট টর্চের বাল্ব হাতে নিয়ে এবার বলে উঠলেন, “দেখছেন, বাল্বটা জ্বলছে। "
বেলুনগুলো উঠতেই চাকাটা থেমে গেল । বাল্বটা জ্বলেছে নাকি বোঝা গেল না।
“দেখেছেন?"
দেখেননি, কিন্তু সেটা বলার মত সাহস কারো হল না । কিন্তু হাবভাব দেখে ধরবাবু বুঝে ফেললেন।
আবার বেলুনগুলো খুলে নিচের দিকে লাগালেন তিনি। চাকাগুলো ঘুরল, কিন্তু এবার ঠিকমত কিছু দেখা গেল না।

“আরে! বাল্বটা জ্বলছে, জ্বলছে। রোদের জন্য বাল্বটা আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না ।”

এবার বেলুনগুলো নিচের দিকে লাগিয়েই দ্রুতগতিতে বাল্বটা হাত দিয়ে রোদ থেকে আড়াল করেন তিনি।

সবাই চোখ সরু সরু করে বাল্বের দিকে তাকায়। ফিলামেন্টটা মনে হয় একটু কমলা আভা ধারণ করেছে ।

“হুম বুঝলাম, কিন্তু এই বারবার বেলুন খুলবে লাগাবে কে ?” কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন।

“কেন? দেশে অজস্র টোকাই আছে দুবেলা না খেয়ে থাকে। কয়েকজনকে দুবেলা খেতে দিলেই তো তারা খুশি হয়ে কাজটা করে দেবে। দেশেরও উপকার হবে।”

ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কর্নেল এগিয়ে চললেন।

শমশের সাহেব আমতা আমতা করে বললেন। “আইডিয়া খারাপ না, কিন্তু কর্নেল সাহেব ক্যান্টনমেন্টে টোকাই ফোঁকাই-পছন্দ করেন না । বড্ড নোংরা তো ওরা, তাই। “
উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে তিনি পা চালান কর্নেলের দিকে।

৪।

এবারের দু’জন ইউনিভারসিটির ছাত্র। স্টলে একটা ফ্যান আছে। তাই বোধহয় কর্নেল এখানে দাঁড়িয়ে আছেন।

“কি বানিয়েছ?”

“সোলার প্যানেল, স্যার।” একটা ছেলে এগিয়ে এসে বলল। নাম সুমন। নেমট্যাগে লেখা ‘বুয়েট’ থেকে। “তবে নরমালের চেয়ে এফিসিয়েন্সি অনেক বেশি। কন্টাক্ট লাগানো হয়েছে পেছনে, যাতে আরও বেশি আলো ভেতরে সেলগুলোর ভেতরে ঢোকে। আর রেসিস্টেন্স কমানর জন্য একটা নতুন ভাবে সেলগুলো সাজানো হয়েছে, সেটা আমাদের মাইশার নিজের করা।” পেছনে একটা মেয়ে কি একটা মনিটরের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে একটু মাথা নেড়ে সায় দিলো। সাধারণ সৌরসেলের এফিসিয়েন্সি যেখানে বিশ ভাগ, আমাদেরটা এখানে পঁচিশ ভাগ।

“পঁচিশ ভাগ!” চোখ কপালে তুলে শমশের সাহেব বললেন। “হ্যাঁ, জার্মানি থেকে তৈরি করে এনেছি, যদিও ডিজাইনটা পুরোপুরি আমাদের। পেটেন্ট পেন্ডিং। “

“অ। লাইট কই?” কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন।

“স্যার, এই যে ফ্যানটা এটা দিয়েই চলছে।”

কর্নেল কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন, তারপর বললেন, “ ধুর, পুরানো সোলার প্যানেল ফ্যানেল দিয়ে কিছু হবে না। করলে নতুন কিছু করা উচিত। বাংগালির আসলে কোনও অরিজিনালিটি নাই।”

“কি বলছেন আপনি?” ছেলেটা রেগে গিয়ে বলল। “পৃথিবীতে এটাই প্রথম এই ডিজাইনের সেল। আপনি বুঝতে পারছেন না … যখন বোঝাচ্ছিলাম তখন তো বোধহয় নাক খুঁটছিলেন… ”

“আমি মোটেই নাক খুঁটছিলাম না । গোঁফে তা দিচ্ছিলাম একটু। “

ছেলেটা রেগেমেগে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মেয়েটা হঠাৎ ছেলেটাকে ইশারায় চুপ করতে বলল, ছেলেটাও থেমে গেল।

“হোয়াই ডোন্ট ইউ রি ইনভেন্ট দা হুইল, মাই বয় ? “ একটা বাঁকা হাসি দিয়ে কর্নেল এগিয়ে গেলেন। “ইউনিভারসিটির ছেলেমেয়েদের বড় বেশি তেজ। “

পরের প্রজেক্টটা বেশ অদ্ভুত।

(চলবে)

- সো।


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

আজ আরেকটু চললে ভাল হত।
সামনে চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

অদ্ভুত প্রজেক্টটা্ই দেখা হলো না। ইস!

অতিথি লেখক এর ছবি

বাহ। অদ্ভুত প্রজেক্টের জন্য অপেক্ষা করছি।

একটু শ্বাসের সুযোগ করে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।

স্বয়ম

অতিথি লেখক এর ছবি

এই বাকা হাসিই আমাদের গোয়ারদের সম্পদ!কিছু না পারলেও এই বাকা হাসিটা দিতে পারবে।

-------------
রাধাকান্ত

অতিথি লেখক এর ছবি

এইভাবে বাঁশ দেয়াটা কি ঠিক হইলো । হাজার হলেও উনারা দেশে রিনিউয়েবল এনার্জির প্রধাণ পৃষ্ঠপোষক । কত নাম-জানা প্রতিভাকেই না উনারা তুলে এনেছেন ।

=======
মামুনুর রশীদ

অতিথি লেখক এর ছবি

"রিনিউয়েবল এনার্জি - প্রফেসর শমশের" দিয়ে গুগলায় খালি একটা সিম্পোজিয়াম পেলাম।
রিনিউয়েবল এনার্জি যদি হয় হেকমোট, আর নাম না জানা প্রতিভা যদি হয় শাহিদ হোসেন, আর পৃষ্ঠপোষণ যদি হয় কোটি টাকার শ্রাদ্ধ, তা হলে দেশের ভবিষ্যত অন্ধকার।

- সো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।