অভিজিত হত্যার ঘটনার পর আমি শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে দুটো পক্ষ দেখতে পেলাম। দুটো পক্ষের সাথে আমার যা কথোপকথন তার মধ্যে আমি দুটো আলাপের বিবরন দেবো এখানে।
প্রথম পক্ষ কঠোর মুমিন। প্রশ্ন রাখলো, "আল্লাহ ও নবীকে নিয়ে কুৎসিত প্রচার কি মুক্ত মনের পরিচয়? সেরকম কেউ করলে তাদেরকে আঘাত করাটা কি খুব বেশী অন্যায়?"
প্রশ্নকর্তা জানে আমি মমিন না হলেও মধ্যপন্থি লোক। ধর্মকর্ম না করলেও ঈদে চাঁদে মসজিদে হাজিরা দেয় মাঝে মধ্যে। তাই আমার কাছ থেকে সমর্থনের আশায় প্রশ্নটা করলেন।
উত্তর দিলাম, "আপনিতো ঈমানদার ধার্মিক মানুষ, ইসলাম ধর্মে কি বলা আছে নিশ্চয়ই জানেন। বেহেশত আর দোজখ বলে দুটো ঠিকানার কথাও জানেন। সুতরাং নিশ্চিন্ত থাকেন কেউ আল্লাহ বা রসুলের বিরুদ্ধে বললে সে নিশ্চিত জাহান্নামে যাবে। আর যদি না যায়, তাহলে বুঝতে হবে আল্লাহ সঠিক বিচার করে না। কিন্তু এটা ঠিক যে এই বিচারের ভার কোন মোল্লার হাতে দেয়নি বিধাতা।"
এই জবাবে অসন্তুষ্ট হয়ে আমাকে নাস্তিক বলে গালি দিয়ে রেগে মেগে চলে গেলেন তিনি।
দ্বিতীয় জনের মুখোমুখি এবার। তিনি কঠোর মুমিন না, কিন্তু নামাজ রোজা করেন এবং নিজেকে আধুনিক প্রগতিশীল দাবী করেন। এনাকে মডারেট মুসলিমের দৃষ্টান্ত বলা চলে যারা ইহকাল পরকাল দুইকুলই সামলে চলে। সময়ে হিজাব, সময়ে শার্টপ্যান্ট পরেন। আমাকে প্রগতিশীল বলে মনে করে আধুনিক বিষয় আশয়ে আলাপ টানেন।
তিনি বললেন," অভিজিততো জীবনে কখনো ধর্মের বিরুদ্ধে বলেননি, তিনি বরাবর মুক্তচিন্তা করেছেন, দর্শন বিজ্ঞান নিয়ে লিখেছেন, গত দুদিন ধরে আমি তাঁর লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেছি। তিনি ধর্মের বিরুদ্ধে কিছুই লেখেননি তবু তাঁকে ধর্মের নামে খুন করা হলো কেন? আই অ্যাম রিয়েলি শকড!!"
বুঝলাম এই ভদ্রমহিলা আগে কখনো অভিজিৎ সম্পর্কে জানতেন না। এখন মিডিয়ার তোলপাড়ে বুঝতে পেরেছেন অভিজিৎ যেনতেন লোক নয় খোদ আমেরিকা জাতিসংঘ তাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। সুতরাং তাঁর সম্পর্কে একটু কথা না বললে যুগের সাথে যায় না, নিজেকে জ্ঞানী বলে জাহির করা যায় না। তবে এটাও বুঝতে পারছি অভিজিতের ধর্ম সংক্রান্ত বিশ্লেষাত্মক প্রবন্ধগুলো পড়লে বলবে -কোপাইছে খুব হইছে।
তাই তাকে বিনীতভাবে বললাম, "অভিজিত কখনো ধর্মের বিরুদ্ধে বলেনি, কথাটা ভুল। অভিজিত যে কোন ধর্মের প্রাচীন বর্ম যে বিশ্বাস সেই বিশ্বাসকে যুক্তি দিয়ে ধর্মের প্রত্যক্ষ রেফারেন্স দিয়েই ভেঙ্গে ফেলতে চেয়েছে। ইসলাম ধর্মের দুর্বলতাগুলো কোরান হাদিসের রেফারেন্স দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। অভিজিত চেয়েছিল ধর্মহীন একটি বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক সমাজ। যে সমাজে ধর্মের কুপমণ্ডুকতা থাকবে না। সেটা করতে গিয়ে ধর্মের অসারতা প্রমান করতে চেয়েছিলেন। হিন্দু মুসলিম উভয় ধর্ম নিয়েই লিখেছেন তিনি। কিন্তু মুসলিমরা অসহিষ্ণু তাই কিছু ফ্যানাটিক তাকে টার্গেট করে রেখেছিল। সুযোগ পেয়ে কোপ মেরেছে।"
কথা শুনে ভদ্রমহিলা চেতে উঠলেন যেন। বললেন- "আপনি কিছুই জানেন না!! অভিজিৎদা শুধু বিজ্ঞান দর্শন নিয়ে লিখেছেন। তিনি কোন ধর্মে বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু কাউকে আঘাতও করেননি। তিনি ছিলেন খুবই বিনয়ী। তাঁরা খুব শিক্ষিত পরিবার। আমার দুলাভাই আমেরিকা থাকে, তিনি তাদের চিনেন। তিনি কোন ধর্ম বিরোধী ছিলেন না। তিনি ছিলেন মুক্তমনা। আপনি কিছু না জেনে বাকোয়াজী করছেন।"
তিনি যখন ধরে নিয়েছেন বেশী বুঝে ফেলেছেন, তখন তো আর কথা চলে না। আমি ক্ষ্যামা দিয়ে উঠে পড়লাম।
গত কদিন যেখানেই গিয়েছি অভিজিত ইস্যুতে এরকম দুটো পক্ষ পেয়েছি এবং সত্যি কথা বলে কোন পক্ষকেই সন্তুষ্ট করা যায়নি। তখনই মনে পড়ে গেল জাকির
তালুকদারের 'মুসলমানমঙ্গল' বইটির কথা। এই বইটা প্রতিটা বাঙালী মুসলমানের পড়া উচিত। এই সময়ে সেটা আরো বেশী দরকার। মমিনদের তো পড়াই উচিত, আবার হুজুগে দৌড়ানো হঠাৎ মুক্তমনাদেরও পড়া উচিত। খণ্ডিত বিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেরুদণ্ডহীন এই মধ্যবিত্ত বাঙালীর খুব বেশী উন্নতি আশা করা যায় না যৌক্তিক কারণেই।
মন্তব্য
"খণ্ডিত বিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেরুদণ্ডহীন এই মধ্যবিত্ত বাঙালীর খুব বেশী উন্নতি আশা করা যায় না যৌক্তিক কারণেই।"
চিত্ত যেখানে দূর্বল যুক্তি সেখানে অসাড়
-----------------------------
রাধাকান্ত
সত্য এই দুটি পক্ষই আসলে দলে ভারী।
স্বয়ম
এটা সত্যিকার চিত্র। লেখায় কিন্তু লেখকের নাম কোথায়? পরেরবার অব্যশই নাম দিবেন
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
নতুন মন্তব্য করুন