গৌরচন্দ্রিকাটি ঠিক বিয়েবাড়িতে নুনের মতই, নিতেও পারেন আবার নাও নিতে পারেন;
নিজেকে শেয়াল ‘পণ্ডিত’ বলে জাহির করি ঠিকিই, তবে সেই পণ্ডিতমশাইয়ের যে এখন বানানের ‘ অ আ ক খ’ নিয়ে প্রাণসংশয়য়! আমার আগের লেখাটিতে (http://www.sachalayatan.com/guest_writer/53832) তাই পণ্ডিতমশাইয়ের পাণ্ডিত্যের দর্প বুক ফুলিয়ে খর্ব করেছ তোমারা। ইচ্ছে ছিল, তবুও সংস্করণের পথে পা রাখছি না। আমার ভুল চলুক, সেইসাথে তোমাদের কাটাকুটি খেলাও।
শেষ দিয়ে শুরুঃ
নাহ, সেবার গোপালপুরে থেকে যাওয়া যায়নি। রাকস্যাকে নীল সমুদ্রটা গুটিয়ে ঘরে নিয়ে আসতে হয়েছিল। ঘরে ফিরেই কোথা থেকে জানিনা, একরাশ মন খারাপ এসে মনের ঘরে কানামাছি খেলা শুরু করে দিল। ইঞ্জিনিয়ারিং দুনিয়ার সবকটা রোবোকিট এসে পা’দুটো জড়িয়ে ধরল সাপের মত। বুঝলাম, বিস্তীর্ণ জলরাশির সামনে ওই বেপরোয়া অনুভূতিটা কোনো এক বাধ্য ছেলে ওর টিফিন বক্সে পুরে চলে গেছে। এরপর যমরাজ সমন পাঠাল সেমিস্টারে। বুঝলেন কিনা, একদম দমবন্ধ অবস্থা!
কিন্তু গ্রীষ্মের দাপটের পর ভরা বর্ষায় যেমন কিছু কচিপাতা আবার মাথা তুলে দাঁড়ায়, ঠিক তেমনি আমিও প্রাণ পেলাম পরীক্ষার পর। দখিনের বারান্দার দরজাটা খুলে দিলাম যেন। ছাদ থেকে দেখলাম, রবার্টের(পাড়ার প্রিয় নেড়ি) আবার গা’ঝাড়া দিয়ে ওঠা। দেখলাম, একদল কচিকাঁচার মিটিমিটি লুকোচুরি। দেখলাম, কালো চশমার ছেলেটার আলতো হাতে নীল জিন্সের মেয়েটার আঙুল ছোঁয়া। অলি-গলিতে শেষ শীতের হাল্কা নেশা। আচ্ছা, বসন্ত এসে গেছে? ধুর এমন সময় ঘরে বসে থাকা যায় নাকি? কিন্তু প্রেমের খাতায় তো বরাবর গোল্লা মেরেছি। তাই ঠিক করলাম, বেড়িয়ে পড়ব।
‘হ য ব র ল’র কোস্টারেরা এখন যে যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত। তাই, ওদের এখন ঘোরার ফিরিস্তি দিলে হবে না। অগত্যা হাত পড়ল ফেসবুকে। চ্যাটবক্সে তখন আমার উড়নচণ্ডী বন্ধুগুলো সবাই হাজির। সবার তখন আমার মতই অবস্থা। বুকে দুরুদুরু, মনে ফুরুফুরু। মানে ওই খাঁচার দরজা খুলে দিলেই একেবারে ফুড়ুৎ। বুঝলাম সবার মধ্যে বেশ একটা ‘পাহাড় যাব-পাহাড় যাব’ ভাব। কিন্তু পকেটে টান। সটান বলে দিলাম-‘দেখ ভাই, ওই কাশ্মীর-টাস্মীর যেতে পারব না। বরং তোরা গঙ্গার ওপারের ছেলেগুলো একটু উত্তরের হাওয়া খেয়ে যাতো দেখি।’ একথা শুনতেই উড়নচণ্ডীরা হইহই করে উঠল।
উড়নচণ্ডী?
কি করি বলুন মেসোমশাই, সাইবার দুনিয়ার লেখা যেভাবে ছড়াচ্ছে, নতুন শব্দ খুঁজতে হলে শেষমেষ ওই ‘মা-বকুনি ডিকশনারি’ ভরসা। এইবেলা চলুন তবে, দলের সদস্যদের প্রোফাইলটা একটু ঘেঁটে দেখা যাক।
(বাস্তবের সাথে মিল রেখে কিংবা না রেখে চরিত্রদের নাম অপরিবর্তিত রইল)
প্রথম জন পুরুলিয়ার, ওকে আমরা হাড়িয়া বলি। মুখে চোখে বেশ একটা ‘লাল-পাহারির দেশে যাবি’ হাভ-ভাব। একটা তেল চিটচিটে খাটো ধুতি পরিয়ে দিলে আর হাতে একটা বর্শা ধরিয়ে দিলে সে বিরসা মুন্ডা না হয়ে যায় না।
দ্বিতীয় জন ব্যঙ্গালোরের রকস্টার, একেবারে গানের জগতের মানুষ। অন্তত আপনি যদি একটা গীটার নিয়ে চেঁচানোকে গান বলে ভাবেন তবে। ওকে আমরা নাম দিয়েছি ‘ডিলান কুমার’।
তৃতীয় জন, ‘ সমাজবাদী, গণতান্ত্রিক, নিষ্পেষিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো সমাজের অতিবাস্তবপ্রীয় সর্বহারাদের প্রতিভূ, রুলার অব প্রোলেটেরিয়েট, কালেকটিভিস্ট, অ্যাথেইস্ট, স্কেপ্টিক, ইনফিডেল,অ্যাগ্নস্টিক............’ ; একটু ছোটো করে বললে ওই ‘আঁতেল’। নন্দনের সামনে বসে একহাতে মাটির চায়ের ভাঁড় আর অন্য হাতে বিদেশী সিগারেট নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভিয়েতনামের ইতিহাস বলতে পারা আমার বন্ধুটি যাদবপুরের বাসিন্দা নিঃসন্দেহে। আমরা অকে বলি (কেউ পেছনে বলি, কেউ সামনে বলি), হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, বুদ্ধিজীবি।
ব্যাকরণ শিং কে মিস করছেন? চাপ নেই। এই দলেও খাদ্যপ্রিয় চতুর্থ সদস্য আছে। দশটা বিরিয়ানির প্লেট একবারে সাবাড় করে, হাড়গুলো শুষে বিলটা আপনার হাতে দিয়ে ও সহাস্যে বলতে পারে ‘দাদা, এরপর অম্বল হয়ে যাবে।’ ব্যাকরন শিঙের মত খাদ্যে এম.এ করার শখ তার আছে কিনা জানি না, তবে এই ঘরানায় কোনো ‘উস্তাদো কে উস্তাদ ’ তকমা থাকলে ওকেই দিতে হত। আমরা ওকে আদর করে ডাকি ‘বারগার’।
আর বাকি থাকা এক সদস্য যে এই ভাগ্নে শেয়াল, তাতো বুঝতেই পারছেন।
পিঠে ব্যাগ, হাতে ন্যাভিগেশন, বেড়িয়ে পরাঃ
শিশির ভেজা ভোর। একটা মথ কোথা থেকে উড়ে এসে জুরে বসেছে আমার রাকস্যাকের। খুব সুন্দর লাগছে সাদার ওপর লাল ছিট দেওয়া ওর ডানাজোড়া। দূর থেকে দেখলাম সাদা মখমলের মত ধোঁয়া উড়িয়ে ছুটে আসছে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস। ট্রেনটি সুন্দর এক পাহাড়ি মেয়ের মতই ডুয়ার্স মহারণ্যে তার আভা ছড়িয়ে ছুটে যেতে থাকে...
মালবাজার স্টেশনে আমি অপেখ্যা করছিলাম আমার চার উড়নচণ্ডী বন্ধুগুলোর জন্যে। আস্তে আস্তে ট্রেন এসে থামল আমার পায়ের কাছে। ওদের খুঁজে বের করতে অসুবিধে হল না। ডিলান কুমার নেমেই ঝামেলা বাঁধিয়ে দিয়েছিল। ওর গীটার ব্যাগের একটা চেন জড়িয়ে গেছিল একটা সবুজ কুর্তির সাথে।
মেয়েটা কিছুক্ষণ স্তম্ভিত থেকে, পরক্ষণেই সেটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল – ‘এটা কি হল?’
আমি ডিলানকে চিনি। সেই চেনা ছকেই সে দুম করে বলে বসল-‘বোধহয় আমার এই গোবেচারা গীটারটার আপনার কুর্তিটাকে বেশ মনে ধরেছে’।
উত্তরের শান্ত হওয়ায় এইসব কথা বেশ দুর্যোগ টেনে আনে। তবুও মেয়েটি কথা না বাড়িয়ে বাঁকা হেসে মিলিয়ে গেল ভিড়ে।
এগিয়ে গিয়ে হাল্কা চাটি মারলাম ডিলান কুমারের মাথায়, বললাম-‘ এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলি, পরেরবার...’
-‘পরেরবার আমি যাব তোকে বাঁচাতে। তুই শুধু লড়ে যা দোস্ত, আমি তোর সাথে আছি...’ আমার মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে বাদামভাজা চিবোতে চিবোতে বলল বারগার।
আমার বুদ্ধিজীবি বন্ধুটিকেও চিনতে বিশেষ অসুবিধা হল না। মুখভরতি দাড়ির জঙ্গলের মাঝে জ্বলজ্বলে চোখ। কেনযে এরা দাড়ি কামায় না, বুঝি না!
স্টেশনের বাইরে গাড়ি পার্ক করাই ছিল। সুমো গোল্ড। আমরা তিনদিনের জন্যে গাড়িটা বুক করেছিলাম। গাড়িতে উঠেই বুদ্ধিজীবি মেপেঝুকে নিল কার কাছে ঠিক কত টাকা আছে, শীতের জামাকাপড় সবাই ঠিকভাবে নিয়েছি কিনা, এসেলারের চার্জ ঠিক কতটা আছে এসব। লক্ষ্মীছাড়া মথটা কিন্তু আমার পিছু ছাড়েনি। ব্যাগ থেকে উড়ে ওটা গিয়ে বসেছে জানালার কাঁচে।
মালবাজার থেকে প্রথমে আমাদের ডেস্টিনেশন ছিল লাটাগুড়ি। লাটাগুড়ি মালোবাজার থেকে প্রায় ২৯ কিলোমিটার। মসৃণ পিচঢালা রাস্তায় গাড়ি ছুটছিল বেলাগাম ঘোড়ার মত। মাঝে পরে নাগরাকাটার ভয়ানক জঙ্গল। নাগরাকাটা পার হতে না হতেই গাড়ি ঢুকে গেল গরুমারা ন্যাশনাল ফরেস্টের মাঝে। গরুমারা গা-শিরশিরে জঙ্গলের বুক চিড়ে চলে গেছে NH31।
গাড়ির স্পিডোমিটারের কাঁটা তখন একশো ছুঁইছুঁই। শো-শো বাতাসে হাত বের করে দিলাম আমি। মথটা কখন উড়ে গেছে খেয়ালি করিনি।
প্রায় আধঘণ্টা বাদে রিসর্টে পৌঁছলাম আমরা। রিসর্টটি আমার এক দূর সম্পর্কের মামার। শখ করে নাম রেখেছেন পাশাখা।
মামার কাছেই শুনেছি ‘পাশাখা’ একটি ভূটানী শব্দ, যার অর্থ ঘন অরণ্য। রিসোর্টে পৌঁছোবার পর গরম গরম জল-খাবার উপস্থিত। ফুলকো লুচি, আলুর দম, রসে রাঙ্গা লালমোহন আর ক্ষীরের পায়েস। তখন শুধু যে বারগারের মুখ দিয়েই জল ঝড়ছিল তাই নয়, আমাদের শুকনো মুখেও ক্লোজ-আপ স্মাইল।
হঠাৎ চোখ পড়ল দোতলার খোলা জানালায়। হাতে আইসক্রিম হাতে সেই সবুজ কুর্তি। চকোবারের হাল্কা বাইটে ঠোঁটের কোনায় বিন্দু বিন্দু ক্রিম জমেছে। চোখে আইলাইনার। চোখের দৃষ্টিবদ্ধ ডিলানের দিকে। বসন্তের আঙ্গিনায় একটা লাল কার্পেট যেন এসিয়ে আসছে ডিলানের দিকে...
লক্ষ্মীছাড়া মথটা আবার এসে উড়ে এসে বসল কি?
(পর্ব ২ অপেক্ষায় রইল)
নিক- শেয়াল পণ্ডিত
মন্তব্য
ক'দিন আগে বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গলে কয়েকজন সত্যিকার শেয়াল পণ্ডিতের সাথে সাক্ষাৎ হওয়ায়, হঠাৎ করে সচলে 'শেয়াল পণ্ডিত' নিকটা দেখে ভাল লাগল, মজা পেলাম।
লেখা ও ছবি - দুইই দারুন হয়েছে।
হুক্কা হুয়া!
****************************************
আহ হা কি সব জায়গার কথা মনে করিয়ে দিলেন - লাভা, লোলেগাঁও আর রিশপ; কতদিন আগের কথা তবু কত অমলিন।
মুদ্রা সংগ্রাহক মশাই, জেনে খুশী হলাম আপনিও আমার পথের সাথী ছিলেন।
এইডা কী হইলো? এইটুকে কেউ জিরায় নাকি? ধুর মিয়া।
ভালো লাগছে। অপেক্ষায় থাকলাম।
স্বয়ম
কোনটা যে বেশি ভালো বুঝতে পারছি না-লেখার ধরন, বন্ধুদের বৈশিষ্ট্য নাকি ঘটনাগুলো নিজেরাই! তবে মশাই, আপনি মেগা সিরিয়াল বানাতে পারতেন বেশ-এমন জায়গায় পর্ব শেষ, দর্শকদের (এখানে পাঠক) বুকের ধুকপুকুনি পরের পর্বের জন্য। অপেক্ষমান পর্বের অপেক্ষায়। আর পণ্ডিতি খর্ব করে কী হবে বলুন, থাক না হয় দু’চারটে বানান বা শব্দ ভুলভাল...
দেবদ্যুতি
নিজেই ‘অপেক্ষমাণ’ বানানটা ভুল লিখেছি উপরে। বোঝেন!
বাহ। চমৎকার লেখা। ছবি আরও বেশি থাকলে ভালো হতো। পরের পর্বের অপেক্ষায়।
পরের পর্বে আরও ছবি অবশ্যই দেব।
ভালো লাগলো লেখা এবং ছবি। সচলে স্বাগতম। লিখতে থাকুন।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
ভালো লাগলো? ভ্রমন কাহিনী পড়তে আনন্দ পাই, আর বন বাদারের গল্প পেলে তো কথাই নেই।
নতুন মন্তব্য করুন