অভিজিৎ, মসজিদ, ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম সেক্যুলারিজমঃ
১/ অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পরপরই সরকার সারা দেশে সরকারী টাকায় ৫০০ মসজিদ বানানোর ঘোষণা দিলেন। মোটামুটি রাজনীতি সচেতন সবাই বোঝেন, এইটা আওয়ামী লিগের ব্যালেন্স পলিটিক্সের অংশ। ব্লগার রাজীব খুন হবার পর হেফাজতের উত্থানের মত পরিস্থিতি ২০১৫ সালে আবার হোক সেটা সরকার মহোদয় চাননা। আমরাও চাই না হেফাজত দানবের উত্থান হোক আবার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ঘরের গর্তে লুকনো সাপ মারতে যেয়ে ঘরের ভিত দুর্বল করা কি ঠিক?
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মৃত্যুর অল্প ক’দিন আগে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ভিক্ষাবৃত্তি আমাদের মজ্জাগত। এমনকি বাংলাদেশের সব মসজিদ ও ভিক্ষার টাকায় তৈরি।
খুব বেশী লোক হয়ত একথা শোনেনি। শুনলে হুমায়ুনকেও ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানার দায়ে কোপ খেয়েই মরতে হত। যাই হোক, প্রয়াত হুমায়ূন দেখে যেতে পারেননি বাংলাদেশ সরকারের এই মহান ‘উন্নত’ কাজ। অথচ আমরা সবাই জানি, নগর জীবনে পাবলিক টয়লেট বরং বেশী দরকারী।
২/ সরকারের মসজিদ বানানোর ঘোষণার পর অনলাইনের কয়েকজন প্রগতিশীলকে দেখলাম, তারা বলছেন সরকার ধর্মনিরপেক্ষ আচরণ করেনি। সরকারের উচিত ছিল মসজিদের পাশাপাশি মন্দির, প্যাগোডা, গীর্জা ইত্যাদি বানানোর ঘোষণা দেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই 'প্রগতিশীলরা' কি আসলেই সেক্যুলারিজম বোঝেন? সেক্যুলারিজম মানে কি রাষ্ট্র কর্তৃক সব ধর্মকে সমান মর্যাদা দেয়া?
সরদার ফজলুল করিম কি বলছেন শুনুন,
’’কোনো আবেগের বশবর্তী না হয়ে সেক্যুলারিস্ট ইংরেজি শব্দের বাংলা হিসেবে ‘ইহজাগতিকতা’ ব্যবহার করা সঙ্গত। অনেকে এই ক্ষেত্রে ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ শব্দকে ব্যবহার করতে চান। ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ শব্দটিকে নিরীহ বলে বোধ হলেও তার শেষ অর্থ দাঁড়ায় ধর্মে ধর্মে নিরপেক্ষতা তথা কোনও শাসক বা শক্তির বিভিন্ন ধর্মীয় মতামত বা বিরোধের ক্ষেত্রে বিশেষ পক্ষ অবলম্বন না করার কথা প্রচার করা। কিন্তু এরূপ ব্যাখ্যা অর্থহীন। বাস্তব সমাজ জীবনে নিরপেক্ষতার কোনো অস্তিত্বের কল্পনা করা যায় না।‘
অনেক বছর আগে এই ভুল আমিও করেছিলাম। ভার্সিটির হলে লাইব্রেরি কমিটির একজন হিসেবে প্রভোস্ট মিজান স্যারকে প্রায় ৫০০ বইয়ের লিস্ট দিয়েছিলাম। বই কেনা শেষে দেখি স্যার প্রবীর ঘোষের “অলৌকিক নয়, লৌকিক” সিরিজ বাদ দিয়েছেন।
কারণ জিজ্ঞেস করায় স্যার বললেন, ‘এসব কন্ট্রোভার্সিয়াল বই কেনা যাবে না।‘
লজিক খুঁজে পেলে আমি বরাবরই ঠোঁটকাটা।
বললাম, ‘স্যার বইগুলো বাংলাদেশ সরকার ব্যান করেনি। অর্থাৎ সেগুলো কিনতে কোনও বাধা দেখি না। বরং যে বইগুলো কেনা হয়েছে সেগুলোর মাঝে ধর্মীয় কুসংস্কারযুক্ত বেশ কয়েকটা বই আছে যা নিয়ে উল্টা আপত্তি তোলা যায়।’
স্যার উত্তর না দিয়ে চোখ গরম করে তাকিয়েছিলেন। মিজান স্যারের রক্তচক্ষু মানে পরীক্ষায় খারাপ গ্রেড না, সরাসরি ব্যাকলগ। এই তথ্য আমার ভার্সিটির সব বন্ধু আর জুনিয়ররা খুব ভালোমত জানেন।
যাই হোক, মূল গল্পে আসি, স্যারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এবার বললাম, ‘স্যার হলে অনেক হিন্দু পোলাপানও আছে। এদের টাকায় ইসলাম ধর্মীয় বই কেনা কি ঠিক হল?’
ফলাফল ছিলো খুব সুদূরপ্রসারী। পরবর্তী মিটিং এ যেয়ে দেখি স্যার ব্যালেন্স করে হিন্দু ধর্মীয় বইও কিনেছেন এবার। যার মাঝে ব্রাহ্মণদের টিকিতে কারেন্ট প্রবাহিত হওয়া, গণেশের মুখ আসলে প্রাচীন আমলের সার্জারি ইত্যাদি নিয়ে বেশ মজাদার ‘বৈজ্ঞানিক’ বইও ছিলো।
এ যেন ফুটন্ত কড়াই থেকে একেবারে জ্বলন্ত উনুনে ঝাপ দেয়া। ১৪০০ বছর থেকে আরও অনেক পিছনে অর্থাৎ প্রায় ৫০০০ বছর আগে যাওয়া।
সেই থেকে আর ধর্ম নিরপেক্ষতা চাইনা, ব্যালেন্স চাই না। ইহজাগতিকতা চাই। ব্যক্তিগতভাবে যার যা ইচ্ছা মানুক, কিন্তু রাষ্ট্র হতে হবে ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত। রেনেসাঁ যুগে ‘রাষ্ট্র বনাম খ্রিস্টান ধর্ম’ সমস্যায় ইউরোপিয়ানরা অনেক রক্ত ঝড়িয়েছিল বলেই তারা সভ্যতাকে উন্নত করতে পেরেছে। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে প্রবেশের মূলমন্ত্র এই বিযুক্ততা। আধুনিক যুগ থেকে আবার মধ্যযুগে প্রবেশ ঠেকানোর মূলমন্ত্র ও তাই এইটাই।
অর্থাৎ,
যার যার ধর্ম থাকুক তার তার,
কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র হতে হবে সেক্যুলার।
অতিথি লেখকঃ আহমদ রনি
তথ্যসূত্রঃ
১/ দর্শনকোষ - সরদার ফজলুল করিম
২/ রাজনীতির অভিধান - সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধায়
৩/ ইউরোপের ইতিহাস - প্রফুল্ল কুমার চক্রবর্তী
৪/ একুশে ETV তে প্রচারিত সাক্ষাৎকার “একান্তে হুমায়ূন”
মন্তব্য
হুমায়ুন নিজেই এমন কাজকে অপরাধ ভাবেন নি, বরং এই লোকটা সেই মহৎ কাজকে বৈধতা দিয়ে গেছেন এবং ঢেউ যেদিকে সেদিকেই চিরকাল পাল ধরেছেন। হুমায়ুন আজাদকে কোপানোর পর হুমায়ুন কি বলেছিলেন জানতে হিমু ভাইয়ের এই লেখাটি পড়ে দেখতে পারেন।
লেখার বাকী অংশের সাথে সহমত।
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
হুমায়ুন এমন কাজকে অপরাধ ভাবতেন বলে আমারো মনে হয় না। প্রচুর বিভ্রান্তির জন্মদাতা তিনি নিজেই।
হঁ্যা ইহজাগতিকতা চাই। ব্যালান্স করে লাভ নাই। লাভ যে নাই, হয় না কখনো তার প্রমাণ বারবার পেলেও সরকারের টনক নড়ে না। হেফাজতি ব্যালেন্সের দায় এখনো টানতে হচ্ছে। সাথে যুক্ত হইছে ৫০০ মসজিদ। এইটা যে কই নিয়া যাইবো।--- আমরা এখন এমন এক সময় পার করতেছি যার কথা এই দেশেই কেউ ৮০’ দশকে চিন্তাও করতে পারতো না বোধ হয়। কে কেমনে কতটা মুসলমান হইবো এখন সেই দৌড় চলতেছে।
স্বয়ম
লেখার বক্ত্যবের সাথে একমত। কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষ আসলে এভাবে ভাবে না। সমস্যা শুধুই হেফাজত না। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই "ধর্মনিরপেক্ষতা" বলতে ধর্মহীনতা বুঝে। কোনও একটা অদ্ভুত কারণে মানুষ মনে করে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হলে তাদের ধর্ম পালনের অধিকার থাকবে না! সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে শুনে কিন্তু শুধু জামাত শিবিরের লোকেরাই রাস্তায় নেমে আসে নি, সাধারণ মানুষও এসেছিল। সরকার এদেরকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করলে আবারও দেখা যাবে বিএনপি-জামাতকে মানুষ বেছে নিবে।
মসজিদ নির্মানের সিদ্ধান্তটা সম্ভবত হেফাজতকে ঢাকা থেকে বিদায় করার পর নেওয়া হয়েছিল। ২০১৪ তে সংসদেও এই ব্যাপারে কথা হয়েছে। দেশে মসজিদ ভিত্তিক যে মোল্লা নেটওয়ার্ক আছে তার উপরে সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রন নেই। সব উপজেলায় মসজিদ তৈরী এই নেটওয়ার্কের উপরে একটা সরকারী নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বলেই আমার মনে হয়। দেশে মোল্লাদেরকে জোর করে নিয়ন্ত্রন করা যাবে না। কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলতে হবে।
- ঘুমকুমার
বাংলাদেশে যে হারে মসজিদ আছে সে হারে যদি স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থাকতো তাহলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার চেহারাটাই পাল্টে যেত।কিন্তু না সরকারের ও দোজখের ভয় আছে তাই স্বর্গের টিকিট ধরা দরকার।
------------------
রাধাকান্ত
নতুন মন্তব্য করুন