লাভার পথে উড়নচণ্ডীরা : পর্ব ২

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৬/০৩/২০১৫ - ৯:৫৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কফির কাপটা হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। শহরের উদ্বাস্তু সব কংক্রিটের মাঝে এমন মলিন সকাল পাওয়াই যায় না। আমার বুদ্ধিজীবি বন্ধুটি খালি গলায় ছেড়ে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারে। “প্রথম(0) আলোর চরণধ্বনি”র হাল্কা গুনগুনানিটা আমার কানে আসছিল ফিরেফিরে। বারবার মনে হচ্ছিল গানটার সাথে সকালটা কেমন আশ্চর্যভাবে সাত পাকে বাঁধা পরেছে।

কাল রিসোর্টের আশপাশটাই ঘুড়ে দেখেছিলাম আমরা। এক অদ্ভুত মায়ামোহ বনানী যেন এই জায়গাটাকে নিজের মধ্যে লুকিয়ে বসে আছে। কোথাও একফোঁটা তাড়াহুড়ো নেই, অযথা গাড়িঘোড়ার সাইরেন নেই, চারদিক থমথমে নিসচুপ। সেই গভীর অরণ্যে কোনো এক যোগিনী যেন ছেড়ে চলেছে তার রহস্যময় ফিসফিস...

আটটা নাগাদ গাড়ি যেমনি আসার কথা ছিল, তেমনি এল। আমরা যে যার মত তৈরি ছিলাম। শুধু বারগার একটু ঢিলেমিপ্রবণ। আসলে ওর গ্রাফটা বড্ড স্ট্যাটিক; ওর ইনপুট আর আউটপুট দুটোই সমান। তবুও আমাদের সবাইকে ডেকে আনতে কাঞ্চার (আমাদের গাড়ির ড্রাইভার) তিনটের বেশি হর্ন দিতে হল না। ডিলান শেষ মুহূর্ত অব্দি দোতলার জানালায় চেয়ে রইল, কিন্তু সবুজ কুর্তির দেখা আজ মিলল না। কাল রাতে যখন ডিলান ওর গীটারটা নিয়ে ক্যাম্পফায়ারের পাশে বসে গান করছিল, লক্ষ্য করছিলাম, সবুজ কুর্তি বিষণ্ণভাবে তাকিয়ে ছিল আগুনেরই দিকে। আগুনে তখন ঝাঁপ দিচ্ছিল একের পর এক ডানাগজানো পিঁপড়ে। ও একবারও তাকায়নি ডিলানের দিকে, শুধু আঙুল দিয়ে মাটিতে আঁকছিল আলতো আঁচর...।

লাভার রাস্তা খুব ভয়ানক, আর সেই সাথে নিচে গভীর খাদ, তাই কাঞ্চা আগেই বলেছিল সিট বেল্ট না খুলতে। আমি বসেছিলাম সামনের সিটে, মাঝে ডিলান-বারগার-বুদ্ধিজীবি, আর পেছনের সিটে গুটিসুটি মেরে বসেছিল হাড়িয়া। লাভা যাওয়ার পথে অনেকগুলো মাইলস্টোন আমাদের পার হতে হত। ছোটছোট পাহাড়ি জনপথগুলো অনেক না জানা কথা গুটিয়ে রাখে ওদের অনাহূত খেলনাঘরে। সেরকম অনেক কিছুই ভেসে উঠছিল আমদের চোখের ধূসর আলোয়।
আমদের রাস্তায় প্রথম মাইলস্টোনটা ছিল গরুবাথান।

বাসিন্দাদের কাছে এই জায়গাটি ‘সোমবারাই’ নামে পরিচিত। প্রতি সোমবার এখানে হাট (স্থানীয় বাজার) বসে। গরুবাথানের ওপর থেকে নেওরা নদীর উপত্যকার দিকে তাকালে আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে।

কিন্তু সুন্দর পাহাড়ি উপত্যকার মাঝেও আশেপাশে চোখ বুলিয়ে আমরা বারবার শিহরিত হয়ে উঠছিলাম। বাসিন্দাদের সবার মনেই যেন একটা ভয়ের আভাস। আমি উবু হয়ে ফুলের ছবি তুলছিলাম। হাড়িয়া আমাকে টেনে দেখাল ডানদিকে। সার দিয়ে চলেছে সামরিক বাহিনীর ভ্যান। দেখে ভয় হচ্ছিল। এই হাল্লা রাজার সেনারা জাদুকরের ফুসমন্তরে সবাইকে বোবা করে দেবে নাতো?

নাহ। শুধু ভয়ই যে ছিল, তাই নয়। সেই সাথে ছিল ডিলান কুমারের গান। কিন্তু রোজ রোজ যেই চিৎকারগুলো প্রায় অসহ্য বলে মনে হয়, আজ কিন্তু সেগুলোকেই গান বলে মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল গীটারের এই জিঙ্গলটা এই পাহারের বুকের মধ্যেই কোথায় যেন ছিল, এটাতো এই নদীরই গান, এই খাদেরই গান...

আমরা আবার এগিয়ে চললাম সাপের মত রাস্তা ধরে। বুদ্ধিজীবিকে আর সৈন্য-যুদ্ধ এসব নিয়ে ঘাঁটালাম না। ও আবার কি থিসিস জুড়ে দেবে কে জানে! বারগার এখানে ওর দামি র‍্যাপারের ফাস্টফুড ছেড়ে দেখলাম হ্যান্ডমেড চিপস খাচ্ছে। কিন্তু সব থেকে বিরক্ত হাড়িয়া। এই নিরুদ্দেশ যাত্রায় ওর দামি ফোনে একটুকুও টাওয়ার নেই। যদিও কারো ফোনেই ছিল না, তবুও আমরা কেউ গায়ে মাখছিলাম না। এই নির্জনে সব বাঁধন কেটে যাওয়াই ভালো। কিন্তু ‘জুতা আবিষ্কার’এর মতই আবিষ্কার করলাম যে মিসেস হাড়িয়ার খবর না পেয়েই বেচারার এই অবস্থা; এখন না পারছে বলতে, না পারছে ভুলতে।
গাড়ির থেকে গভীর খাদগুলো দেখছিলাম। ওরা যেন সবাই মিলে হাতছানি দিচ্ছিল আমাকেই। নীচে কোনো একটা নদী বয়ে যাচ্ছিল। আসলে এখানে ওই একটি নদীই অনেক নাম নিয়ে বয়ে গেছে। তাই আসলে যে কোন যায়গায় কোন নাম তা বোঝা বেশ মুশকিল। নীচের বাড়িঘরগুলো আস্তেআস্তে পিঁপড়ের মত লাগছিল।

এবার আস্তেআস্তে পেটে ছুঁচো ডনবৈঠক দেয়া শুরু করে দিয়েছিল। কাঞ্চাই দাঁড়াল একটি দোকানের সামনে। এখানকার দোকানগুলো ছোটো আর মাল্টিপারপাস। ভাত-মোমো-চা-চকোলেট যাই চাইবেন তাই পেয়ে যাবেন। জমিয়ে চা আর মোমো খাওয়া হল। এখানে মহিলারাই কাজ করেন বেশি। ওদের কদর এতটাই বেশি যে বরপক্ষকে বিয়ে করতে হলে মেয়েপক্ষকে পণ দিতে হয়। অবাক হলেন তো?
মোম খেতে খেতেই চোখে পড়ল এক বৃদ্ধা। চামড়া কোঁচকানো, হাতে লাঠি। অনেক পুরনো নথি যেন তার চোখের গোপন আস্তানায় লুকিয়ে বসে আছেন...

হঠাৎ দেখলাম ডানদিকের এক কোনে বসে আছে এখানকারি এক টিনএজার। হাতে ট্যাব। বুঝলাম, আধুনিক সরগরম দুনিয়াটা থেকে এতদূরে থেকেও এরা আমাদের থেকে একপাও কম যায় না...


খাওয়া শেষ করে আমরা গারিতে উঠলাম। আরও চার হাজার ফুট ওপরে উঠতে হবে। রাস্তায় নজরে এল এক এলোকেশীর চুল বাঁধা...মনে হচ্ছিল কোনো এক রাজকন্যে নিপুণ দক্ষতায় তার চুলগুলো মেলে ধরেছে দিগন্তে...

কাঞ্চা জানিনা কিভাবে এই সাপের মত রাস্তার সাথে যুদ্ধ করছিল! মাঝে মাঝে যে একটু আধটু বমি পাচ্ছিল না, এমনটা নয়। তবে টিম লিডার হয়ে সেটা বলা, নইব নইব চঃ।দেখতে দেখতে আমাদের গাড়ি ঢুকে গেল দেওদার বনের ভেতর...

গাড়ি হঠাৎ ব্রেক কষল, রাস্তার পাশেই আরেকটি গাড়ি খারাপ হয়ে পড়েছিল। ওরাই আমাদের হাত নাড়ছিল প্রবলভাবে। দূর থেকে দেখে মনে হল, দুজনই মেয়ে। সাজ-পোশাক অনেকটা সাংবাদিক গোছের।
কাঞ্চা নেমে দেখতে গেলো। এখানে প্রত্যেক ড্রাইভার প্রত্যেককে হেল্প করে। ফিরে এসে বলল – “দাদাসাব, খারাবি আছে, লিফটো দিয়ে দেন”
ওরা এতক্ষণ দূরে ছিল। এবার আমার গাড়ির সামনে এসে, আমার খোলা কাঁচে হাত রেখে বলল-“প্লিজ, হেল্প আস, উই হ্যাভ টু রিচ লাভা বাই টুনাইট”
ওরা আরও কিছু বলছিল। কিন্তু সব কথাই যেন আমার কানে পৌঁছোবার আগেই মিলিয়ে যাচ্ছিল হাওয়ায়...হাজার হাজার ফুট ওপরে তখন কোথা থেকে ওই লক্ষ্মীছাড়া মথটা এল জানিনা...পিছনের সিটে দেখছিলাম নির্বাক ডিলান তাকিয়ে আছে ওদেরই দিকে...
সবুজ কুর্তি আজ সবুজে নেই, আছে লাল লেদার জ্যাকেটে...তাতে কিছু এসে যায় না...ওই কার্বন ফ্রেমের পুরু চশমাটা অস্ফুটকন্ঠে বলে দেয় ওই সবুজ কুর্তি...
আমি দূরে তাকাই...তখন প্রায় নিবে যাওয়া আলোয় লিলিপুটের মত লাভা দেখা যাচ্ছে...............

(তৃতীয় পর্ব আসছে...)

নিক- শেয়াল পণ্ডিত

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

সুন্দর ছবি, সুন্দর লেখা; ঠাম্মা তো দা-রু-ণ সুন্দর হাসি । আর ইয়ে, সবুজ কুর্তি বা লাল জ্যাকেট কি আসছে পর্বেও আছে?

দেবদ্যুতি

শেয়াল পন্ডিত এর ছবি

সবুজ কুর্তি শেষ লাইন অব্দি আছে
দেঁতো হাসি

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

কয়েকটা ছবি অন্ধকার অন্ধকার লাগলো!
লেখা চলুক। চলুক

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

শেয়াল পন্ডিত এর ছবি

ইচ্ছে করেই একটু আবছায়ায়

নিক-শেয়াল পণ্ডিত

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ছবিগুলো সুন্দর। লেখায় কিছু টাইপো আছে। পরেরবার একটু খেয়াল করে।
লেখা চলুক। হাসি

নজমুল আলবাব এর ছবি

সুন্দর

সবজান্তা এর ছবি

চমৎকার! স্মৃতিকাতর হয়ে গেলাম। জীবনে প্রথম যেবার দার্জিলিং গিয়েছিলাম, সেবার মূলত ঘুরেছিলাম, লাভা, লোলেগা, আর ডেল্লোতে। ডেল্লোতে এরপর আরো দু'বার যাওয়া হলেও, রাস্তার দুরাবস্থা এবং সময়ের স্বল্পতার কারণে লাভা-লোলেগা আর যাওয়া হয়নি। সম্ভবত লোলেগাতেই মারাত্মক জোঁকের খপ্পরে পড়েছিলাম।

আমার বেশ কয়েকবার হিমালয়ের ওইদিকটাতে যাওয়ার অভিজ্ঞতাতে যেটা দেখেছি- আমজনতা কোনো একটা কারণে দার্জিলিং ডিস্ট্রিক্টের অন্যান্য জায়গা (এই যেমন, লাভা, লোলেগা, ডেল্লো) এগুলিতে অনেক কম যায়। অবশ্য একটা কারণ হচ্ছে, ভারতীয় না হওয়াতে আমাদের পক্ষে সিকিম যাওয়া অনেক ঝামেলার, প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ভারতীয়দের জন্য তো আর তা না, আর অনেকেই সিকিম/গ্যাংটককে দেখেছি লিস্টের উপরে রাখতে।

যাই হোক, আপনার লেখা ভালো লাগলো। আরো পর্ব পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।

এক লহমা এর ছবি

হাসি পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

হারিয়ে গেলাম ছবি আর লেখার সঙ্গে, দারুণ লাগল লেখক, অল্প কিছু বানান ছাড়া সবকিছু ঠিকঠাক, পরের পর্বের অপেক্ষায়

তুষার রায়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।