সেফটি পিন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ০২/০৪/২০১৫ - ৯:৪৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

------সেফটি পিন-----
কাল ঈদ, মর্জিনার খুশি আর ধরে না। সন্ধ্যার ঠিক আগে, একটা শালিকের বাচ্চা খুঁজে পেয়েছে সে- খেলার মাঠে। তারে আর পায় কে? বাচ্চাশালিকটির পাখনা গজিয়েছে ঠিক, কিন্তু উড়তে শিখে নি। কিছু দূর মাঠের মধ্যে হেঁটে যায় তির তির করে, পাখা ঝাপটায় আর উড়ার চেষ্টা করে। তারপর হাঁপিয়ে উঠে থেমে যায়। মর্জিনা ফের ধরে নিয়ে আসে শালিকের ছানাটিকে। তার পর ছেড়ে দেয় । কিছু দূর যেতেই আবার ধরে আনে। যতবার ধরে আনে তত বার উল্লাসে ফেটে পড়ে সে। হাসির শব্দে মাঠের কোনার নতুন বাড়ীটি থেকে বেরিয়ে আসে আবুল নেতার স্ত্রী , কসে ধমক লাগায়।
- কুসুমের মা এই মাইয়াডারে লাই দিয়া নষ্ট করতাছে। যা বাড়ীত যা, মাথা খাইস না।
ধমক খেয়ে মিনিট খানিক চুপ করে থাকে মর্জিনা। তারপর আবার খেলা শুরু করে। ' কারো জমিত খেলছতাছি নাকি? খেলার মাঠ কারো বাপের জমি না।'
আজানের আগে মুয়াজ্জিন মোসাদ্দেক মাইক ঠিক আছে কিনা দেখে , গোটা দুই ফুঁ দিয়ে। তারপর চিকন গলায় ঘোষণা করে ঈদ মোবারক। যদিও ঈদের মানে মর্জিনা জানে , কিন্তু ঈদ বলার পর সবাই কেন মোবারক চাচার নাম বলে , সেটা সে বুঝে উঠতে পারে না। টিপুরা, সুমনরা মিলে একটা মিছিল বের করেছে- 'কালকে ভাই ঈদের দিন, ঈদগাহ্ মাঠে যোগ দিন'। মর্জিনা ছেলেগুলোর পেছন পেছন যায়। তার বড় ইচ্ছে হয় মিছিলে যোগ দেয়ার । কিন্তু কোন মেয়ে মিছিলে নেই। তাই যোগ দেয়ার চিন্তা বাদ দেয় সে। ফের ফিরে আসে মাঠে। আলো কমে এসেছে মাঠের। শালিকের বাচ্চাটিকে এদিক ওদিক খুঁজে, কিন্তু পায় না। ইজ্জত আলীর টং দোকানের সামনে এসে, বিদ্যুতের খুঁটি ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। আম্মা এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছে। "এইহানে দাঁড়াইয়া থাকবি, মাইনষের আনাগোনা আছে এইহানে। বড় হইতাস, বুঝস না। মাইয়া মাইনসেরে অনেক বুইঝা চলতে অয়।" কি বুঝবে, মর্জিনা বুঝে না।
শেখ বাড়ি থেকে কাজ শেষে ফিরলে এক সাথে বাড়ী ফিরবে তারা। কাল ঈদ তাই আজ শেখ বাড়িতে মেলা কাজ। মসলা বাটতে হবে । বাসনকোসনও ধুইতে হবে অনেক। দেরী হবে আসতে। তাহমিনার পুতুল চুরি হয়ে যাওয়ার পর মর্জিনার শেখ বাড়িতে যাওয়া নিষেধ। আজ সকালে লুকিয়ে গুড় খেয়েছে বলে আফসোস হয় মর্জিনার । 'গুড়ের কারণে রক্ত এহন মিঠা। মশাগুলান টের পাইয়া গেছে'। মশা এসে হামলে পড়ে তার পায়ে। সে ইজ্জত আলির দোকানে গিয়ে খালি বেঞ্চিতে বসতে পারে। কিন্তু আম্মা বলছে লোকটা ভাল না। ' লোকটা কেন ভাল না, তাও মর্জিনার বোঝে আসে না। মর্জিনাকে দেখলেই সে বিস্কুট দিতে চায়। পিঠে হাত দিয়ে আদর করে।'
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে প্রায় ঘুম এসে যায় । অবশেষে মর্জিনার মা আসে। হাতে একটা গামলা। ঘুম কেটে যায় মর্জিনার।
-কি ছালুন দিছে , আম্মা?
-মুরগীর ছালুন।
- দেহি আম্মা
- বাড়িত গিয়া দেহিস।
তবু বায়না ধরে মর্জিনা। গামলা নামিয়ে দেখায় তার আম্মা। সাদা ভাত। মুরগীর মাংস এক পাশে। জিভে পানি আসে মর্জিনার। গরম মসলার গন্ধে ঘুম কেটে যায়। ' রানের মাংস কোন দিন দেয় না।' রানের মাংস খাওয়ার ভীষণ শখ মর্জিনার। একটু মন খারাপ হয়।
ঘরে ফিরে মর্জিনার মা, তার কোমরে লুকিয়ে রাখা পলিথিন থেকে একটা লেবু, দু'টো পেঁয়াজ , একটা শসা আর কয়েকটা কাঁচমরিচ বের করে। মর্জিনা জানে তার মা এগুলো তাহমিনার মায়ের চোখের আড়ালে লুকিয়ে এনেছে। এনিয়ে কোন কথা হয় না দু'জনের। লেবু , শসা, পেঁয়াজ কাঁটা হয়। তারপর মর্জিনার যখন খেতে বসে, তখন মসজিদে এ'শার আযান শোনা যায়। খাওয়া শেষ হলে, কয়টা শক্ত পলিথিন বের করে। মর্জিনা জানে , কেন এগুলো বের করেছে তার মা।
- মাইনষের বাড়িত গিয়া কোরবানীর মাংস টুকাইতে আমার শরম লাগে আম্মা। সবাই যেন কেমন কইরা চাইয়া থাহে।
- তর বাপে মরার সময়, জমিদারী থুইয়া মরছে, না? এতো মান অইলে আমরার চলবো?
মর্জিনার মা রাগ করে । মর্জিনা কিছু আর বলে না।
মর্জিনার আম্মা ট্রাংক খুলে। ট্রাংকের ভেতরে ন্যাপথালিনের গন্ধ। ন্যাপথালিনের গন্ধ মর্জিনার ভীষণ ভালো লাগে। খোলা ট্রাংকের সামনে এসে বসে। মর্জিনার মা জামা বের করে ট্রাংক থেকে। গত বছরের ঈদের জামা। এই বছর ঘরের চালে ছানি দিতে গিয়ে সব টাকা শেষ । ছোট ঈদেও এই জামা পরেছিল মর্জিনা। 'সবে দেখেই বুঝবে, এইডা নতুন জামা না' ভাবতেই কান্না পায় মর্জিনার।
-পইরা দেখ । সব ঠিক আছে নি।
মর্জিনা জামা পরে ভীষণ অবহেলায়। পেছনের দিকে বোতাম লাগাতে গিয়ে তারা টের পায় উপরের বোতামটা নাই। ট্রাংকের ভেতর মা মেয়েতে মিলে বোতাম খুঁজে । না, নাই ওখানে। ধোওয়ার সময় পরে গেছে হয়তো। মর্জিনার মা কোমর থেকে একটা সেফটি পিন খুলে বোতামের জায়গায় লাগিয়ে দেয়।
মর্জিনা ঘুমাতে যায়। পাশেই সরিষার খেত থেকে, অদ্ভূত সুন্দর হাওয়া আসে । আর মন পাগল করা গন্ধ। তারপরও সেফটি পিনটা বুকের মাঝে খচ খচ করে। ঘুমিয়ে যায় মর্জিনা। ফজরের ওয়াক্তে মোয়াজ্জিন মোসাদ্দেকের আযানে ঘুম ভাঙে মর্জিনার । আজ ঈদ। সেফটি পিনটা খচখচিয়ে উঠে সাথে সাথেই।

স্নেহাশীষ রায়
টরোন্টো


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

খুব ভালো লেগেছে গল্পটা। চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুণ গল্প চলুক

দেবদ্যুতি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

ভালো লেগেছে।

কিছু কিছু জায়গায় একবার করে এন্টার বাটনটা চেপে প্যারা করলে ফরম্যাটিং দেখতে ভালো লাগবে। লিখতে থাকুন।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। টিপসের জন্যও।

অতিথি লেখক এর ছবি

অভাব, এই অভাব জড়িয়ে থাকে যুগে যুগে, তাদের জন্যই লেখা। শুভ কামনা লেখক

আদি কোষ

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ।

নজমুল আলবাব এর ছবি

ভালো গল্প পড়লে একটা আরামবোধ হয়। অনেকদিন পর আজ হলো।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ

রানা মেহের এর ছবি

আপনার সাদামাটা গল্পটা পড়ে খুব ভাল লাগলো।
বানান একটু খেয়াল রাখবেন।
দুটো জায়গা বুঝতে পারিনি।

"কুসুমের মা এই মাইয়াডারে লাই দিয়া নষ্ট করতাছে। যা বাড়ীত যা, মাথা খাইস না।"
এখানে কুসুম কিংবা কুসুমের মা কে? মর্জিনার মা হবে? নাকি কুসুম মর্জিনার বড়বোন?

"মর্জিনার মা কোমর থেকে একটা সেফটি পিন খুলে বোতামের জায়গায় লাগিয়ে দেয়।"

এর পর মর্জিনার জামা বদলানোর কথা। সে কি এই জামা পরেই ঘুমিয়েছিল? এই জায়গার জন্য গল্পের সৌন্দর্যের ঘাটতি হয়নি, তাও দেখে মনে হল তাই বললাম।

আরো লিখবেন।

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

অতিথি লেখক এর ছবি

নিরাসক্ত ভাবে গদ্য লেখার চেষ্টা করেছি। কম শব্দে বেশী বোঝানোর চেষ্টা ছিল।
মর্জিনার বড়বোন কুসুম।
ধন্যবাদ আপনাকে।

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারন। সত্যিকার ছোটগল্পের পুরো স্বাদ পেলাম আপনার লেখায়। চমৎকার লেখনী।
আমাদের "ঈদ আনন্দ" টা আসলে অনেক মানুষের জন্য "ঈদ কষ্ট" সেটা আমরা জানি। কিন্তু সেটা জেনেও কিচ্ছু করার চেষ্টা করি না। আমরা সবাই আসলে আপনার গল্পের "শেখ বাড়ির মানুষ" বা "আবুল নেতার বউ"। মন খারাপ

কিরো

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ।

মেঘলা মানুষ এর ছবি

ভালো লাগলো, গল্পটা। আরও লিখুন।
শুভেচ্ছা হাসি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

এক লহমা এর ছবি

গল্পের বিষয় ভাল লেগেছে। আয়তন ছোট করতে গিয়ে গল্প কিছুটা চোট খেয়ে গেছে। লিখতে লিখতে এগুলো ঠিক হয়ে যাবে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সচলে স্বাগতম স্নেহাশীষ রায়!

গল্পে যৎসামান্য খামতি রয়ে গেছে, তবে সেটা সম্পাদনার অভাবে। পরের গল্পটা পোস্ট করার আগে আরেকটু সতর্কতার সাথে সম্পাদনা করলে আর এসব খামতি থাকবে না। এমনিতে গল্পটা ভালো লেগেছে। কেন ভালো লেগেছে? কারণ -

১। গল্পের কাহিনীকে স্বচ্ছন্দ্যে বয়ে যেতে দেয়া হয়েছে। জোর করে কোন ট্রাজেডি/কমেডি/মরাল ঢোকানোর বা চাপানোর চেষ্টা করা হয়নি।

২। গল্পের ভাষা, ফরম্যাট, কাহিনী বিন্যাস ন্যাচারাল। এখানে কোন কেরদানি করে পাঠকের মাথা ঘুরানোর চেষ্টা করা হয়নি।

৩। গল্পকে মেগাসিরিয়ালের মতো অহেতুক টেনে লম্বা করা হয়নি। এতে কাহিনী টান টান ছিল, ঝুলে পড়েনি।

আশা করি পরের গল্পগুলোতেও এই ধারাটা বজায় রাখবেন।

নিয়মিত লিখে যান। যেটা পাঠকের পাতায় দেয়ার যোগ্য মনে করবেন নির্দ্বিধায় সেটা এখানে পোস্ট করে দেবেন।

পুনশ্চঃ লেখা বা কমেন্ট - সর্বত্র শেষে নিজের নাম/নিকটা লিখবেন। নয়তো পাঠক বুঝতে পারবেন না ওটা কে লিখলেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। কোন বিশেষ দিকগুলো পাঠককে স্পর্শ করে, তা জানা ভীষণ জরুরী।

স্নেহাশীষ রায়

মরুদ্যান এর ছবি

চমৎকার! চলুক

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ভাল লাগলো।

স্বয়ম

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

ভাল লেগেছে। ষষ্ঠ পাণ্ডবদার মতো গুছিয়ে বলতে পারছি না কেন ভাল লেগেছে। শুধু বুঝতে পারছি অনুভূতির তীব্রতা ফুটে উঠেছে। নিয়মিত লিখুন। শুভকামনা রইল।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

এক লহমা এর ছবি

আবারও পড়লাম। আরো একবার ভাল লাগা জানিয়ে গেলাম।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।