এই লেখাটা আমার নিজের জীবন থেকে নেয়া। আমার নিজের ঘটনা নয়, কিন্তু আমার খুব কাছের একজন মানুষের জীবনের ঘটনা। তার মুখ থেকে শোনা ঘটনাটাই আমি সবার জন্য এখানে তুলে ধরছি, শুধু পরিচয় প্রকাশ পেতে পারে এমন তথ্য গুলো আমি পাল্টে দিচ্ছি। পাল্টে দিচ্ছি এই কারণে নয় যে এই মানুষটার সাহসের অভাব আছে এখন, বা যেই অন্যায় তার ওপর হয়েছে তাতে তার নিজের কোন অসম্মান হয়েছে। নিজের পরিচয় সে নিজেই হয়তো দিতো যদি সে নিজে এই লেখাটা লিখতো। পাল্টে দিচ্ছি কারণ সেই মানুষটা জানে না এই কথা গুলো বলা হচ্ছে এখানে। তাঁর কথা তো সে বলছে না, আমি বলছি, তাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কোনদিন যদি সে এই লেখাটা পড়ে, তাঁর চাইতে খুশি হয়তো আর কেউ হবে না। তাঁর গল্প পড়ে, আরও পাঁচ জন মানুষ যদি সাহসী হয়ে এগিয়ে আসেন, নিজেদের গল্প গুলো তুলে ধরেন, সেটাই হবে আমাদের মুল উদ্দেশ্য।
আমি নিশ্চিত, এমন ঘটনা বাংলাদেশে অনেক আছে। এই সমস্যাগুলো নিয়ে কথা না বললে এগুলো আমরা সমাধান করতে পারব না। সবার পড়ার সুবিধার্থে আমি ঘটনাটা সেই মানুষের “মুখ থেকেই” বলছি। আমি এই কথা গুলো শুনেছিলাম আমার বন্ধু রাবেয়ার কাছ থেকে আজ থেকে প্রায় ১০-১১ বছর আগে।
বাবা, মা, ও আমার একমাত্র বড় ভাই কে নিয়ে আমাদের ছোট সংসার। আমি ঢাকার একটা নাম করা স্কুলে পড়ি ক্লাস সিক্সে, আর আমার ভাই তখন ইন্টার এর ছাত্র। আমারা ঢাকায় থাকতাম তখন। দুটো বেডরুমের বাসা হলেও তেমন বড় বাসা ছিল না আমাদের। বাবা মা এক রুমে ঘুমাত, আমি আর আমার ভাই আরেক রুমে। আমাদের মধ্যবিত্ত জীবন বাকি লক্ষ বাঙালিদের জীবনের মতোই ছিল - সুখে দুঃখে মিলানো।
এমন একটা সময়ে গ্রামের বাড়ি থেকে আমার এক চাচাতো ভাই এলো ঢাকাতে আমাদের বাসায়। সে আমাদের সঙ্গে এক সপ্তাহের মতো থাকবে কারণ তার একটা চাকরির ইন্টারভ্যু আছে। সুতরাং আমাদের সঙ্গে থাকবে, ঢাকা শহর ঘুরে দেখবে, চাকরির চেষ্টা করবে, এবং তারপর ফিরে যাবে বাড়িতে। এমন জিনিষ আমাদের বাসায় নতুন কিছু না। শুধু তাই না, এই জিনিষ দেখেই আমরা বড় হয়েছি। এই অভিজ্ঞতা হতে হতে আমাদের বাসায় এমন চল হয়েছিল যে গ্রাম থেকে পুরুষ কেউ আসলে আমার ভাই এর সঙ্গে থাকতো, আর আমি চলে যেতাম বাবা মায়ের রুমের মেঝেতে বিছানা করে। আর গ্রাম থেকে মহিলা কেউ আসলে, আমার ভাই চলে যেতো বাবা মায়ের রুমের মেঝেতে। সুতরাং গ্রাম থেকে যখন নজরুল ভাই এলেন, কে কোথায় থাকবে সেটা নিয়ে বাসার কেউ মাথা ঘামাল না।
নজরুল ভাই আগেও এসেছেন আমাদের বাসায়, এবং আমাকে ছোট বোনের মতোই আদর করেছেন সব সময়। চকলেট কিনে দেয়া, দুয়েকটা গল্পের বই কিনে দেয়া, গল্প শোনানো আমাদের দুই ভাই বোনকে - উনি যা পারতেন আমদের জন্য করতেন। আমি যখন আরও ছোট ছিলাম, আমাকে কোলে কাঁধে নিয়েছেন। আমি ছোট বেলা থেকেই মোটাসোটা ছিলাম একটু, তাই আমাকে কেউ সহজে কোলে কাঁধে নিতনা। নজরুল ভাই নিতেন দেখে উনাকে আমার খুব ভালো লাগত পিচ্চি থাকতেই। সুতরাং উনি যখন এবার এলেন, আমি অন্তত খুব খুশি হলাম। সিক্সে পড়ি, কোলে উঠবো না, কিন্তু পছন্দের মানুষকে কাছে পেলে কার না ভালো লাগে? আর আমাদের পছন্দ দেখে বাবা মা ও উনাকে পছন্দ করতো অনেক।
আগের মতোই এবারো নজরুল ভাই গ্রাম থেকে তরিতরকারি এতো কিছু নিয়ে এসেছেন। বিশেষ করে আমার জন্য এনেছেন “প্যেরা সন্দেশ” নামের একটা মিষ্টি, যেটা আমার ছোট বেলা থেকেই খুব পছন্দের। আসার পর, সব কিছু রান্না ঘরে নামিয়ে রেখে সবাইকে সালাম টালাম করে আমাকে দেখে বললেন, কি রে? তুই তো দেখি আরও মটু হয়েছিস, তোকে তো আর কোলে তুলতেই পারব না! আমি লজ্জা পেয়ে একটু হাসলাম। কি উত্তর দিব?! ক্লাস সিক্সে পড়লেও আমি মোটা সোটা দেখে আমাকে আমার ক্লাসমেটদের অনেকের চাইতেই বড় লাগত, আমি সেটা জানি। বাবা মা একটু হেসে ফেললো, আর আমিও ওখান থেকে পালিয়ে বাঁচলাম।
যাই হোক। দিনের বেলা আমি আর ভাইয়া স্কুলে যাই। বাবা মা অফিসে যায়। আর নজরুল ভাই ঢাকা শহরে ইবনে বতুতা হয়। শেষ বিকেলে সবাই বাড়ি ফিরি, গল্প করি, খাই দাই, ঘুমাই। ভাইয়া আর নজরুল ভাই এক সঙ্গে ঘুমায়, আমি বাবা মায়ের রুমে, বিছানার পাশে, নিচে, মেঝেতে। তৃতীয় দিন রাতে, হঠাত আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো কেন যেন। কয়েক মুহূর্ত বুঝলাম না কি হচ্ছে। একটু নড়ে উঠলাম, তারপর বুঝতে পারলাম আমার গালে কারো হাত ছিল, এবং সে সেটা সরিয়ে নিলো। ঘুমের ঘোরেই একটু অবাক লাগলো, যে কি হল। ততক্ষণে আমি জেগে উঠতে শুরু করেছি। কিন্তু আর কিছু হল না। তাই একটু পরেই আমার ঘুমিয়ে পড়লাম। সারা দিন ক্লাস করে ঘরে ফিরবার সময় আমার মনে পড়লো ঘটনাটার কথা। একটু চিন্তা করলাম। কিন্তু সারা দিন পর মনে হল, কি না কি, হয়তো স্বপ্ন দেখেছি। পাত্তা দিলাম না তেমন।
এর দুদিন পরের কথা। রাতে ঘুমিয়েছি। কতক্ষণ পর জানি না, কিন্তু ঘুম ভেঙ্গে গেলো। প্রথমেই কানে এলো বাবার নাক ডাকার বিশাল শব্দ। নতুন কিছু না আমাদের পরিবারের জন্য। আমরা খুবই বিরক্ত হই বাবার এই নাক ডাকা নিয়ে। সপরিবারে কোথাও থাকতে গেলে আমি আর ভাইয়া প্রায়ই বলাবলি করি, যে বাবার নাক ডাকা নিয়ে না জানি মানুষ কি ভাবছে! প্রায় একই মুহূর্তে আমি বুঝতে পারলাম একটা হাত আমার বুকের ওপর খামচি দেবার মতো করছে। এমন জোড়ে নয় যে আমি ব্যাথা পাবো, কিন্তু করছে। এবং আরেকটা হাত আমার পাজামার ফিতার কাছটা দিয়ে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। ফিতাটা শক্ত হওয়াতে, বা আমি মোটা হবার কারণে, যেটাই হোক, হাতটা সুবিধা করতে পারছে না।
ঐ মুহূর্তে বেশ কিছু জিনিষ এক সঙ্গে ঘটে গেলো আমার জীবনে, যা আমার সারা জীবন হয়তো পরিষ্কার ভাবে মনে থাকবে। অতীতের কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই আমি বুঝতে পারলাম অশুভ কিছু একটা আমার সঙ্গে হচ্ছে, বা হতে চলেছে। আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন এক লাফে আমার গলার কাছে উঠে এলো, এতো জোরে সেটা লাফ দেয়া শুরু করলো। আমার মনে হল যে কোন সময় সেটা ফেটেও যাবে। আমার দুটো হাত নিজের অজান্তেই এক সঙ্গে আমার পাজামার কাছে থাকা হাতটাকে চেপে ধরল সেটাকে আটকানোর প্রচেষ্টায়। শয়তান হৃৎপিণ্ডটা এমন ভাবে গলায় আটকে গেলো যে আমার মনে হল আমার কণ্ঠ দিয়ে কোন শব্দ বের হবেনা (আর কোনদিন), বা হচ্ছে না। কিন্তু আমি প্রাণপণে ‘বাবা বাবা’ বলে চিৎকার করতে থাকলাম। সেই ছোট বেলা থেকেই আমি ভয় পেলে বা ব্যাথা পেলে বাবা কে ডাকি, মা কে নয়। কেন আমি জানি না। সেটা যে চিন্তা করার মতো কোন বিষয়, আমার ছোট মাথায় সেটাও কখন আসে নি। কিন্তু ঐ যে বললাম, গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। এই ভাবে কতক্ষণ কেটেছে আমি জানি না। এখন পিছন ফিরে তাকালে মনে হয় হয়তো দুয়েক সেকেন্ড কেটেছিল মাত্র। তখন মনে হচ্ছিল সময় দাঁড়িয়ে আছে। অনন্তকাল ধরে।
এই সব কিছুর মধ্যে নিশ্চয়ই কোন শব্দ হয়েছিল বা কিছু, আমি জানি না। বা নড়াচড়া হয়েছিল বেশী, আমি জানি না। কিন্তু ঘরের ভিতর বাঘের গর্জন হথাৎ করেই থেমে গেলো। আমার বাবা তাঁর নাক ডাকা বন্ধ করেছে। জেগে গিয়েছে কি? আমাকে কি এখন এই বিপদ থেকে বাঁচিয়ে নেবে? আগলে নেবে তাঁর নিরাপদ বুকে? আমি জানি না, কারণ নাক ডাকা বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকের ওপর থাকা হাতটা আমার মুখের ওপর চেপে বসল। আমার দুই হাত দিয়ে অন্য হাতটা তখনো চেপে ধরা, কিন্তু ঐ হাতটা এখন আর নড়াচড়া করছে না। আমার মাথা কিছুতেই আর কাজ করছে না। মনে হচ্ছে আমার চারপাশ কেমন যেন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে - অনুভূতি গুলো। মনে হচ্ছে আমি এখন বমি করবো। মুখের ওপর হাতটা যেন আরও চেপে বসলো। বাবা দুয়েকবার কাশলো। আরো দুয়েক সেকেন্ড কেটে গেলো। তারপর আস্তে আস্তে আবার তাঁর নাক ডাকা শুরু হল। আমার মুখের ওপর তখনো সেই হাতটা চেপে বসে আছে। আমার মনে হচ্ছে আমার শরীরটা কেমন যেন হাল্কা লাগতে শুরু করেছে এর মধ্যে। কেমন যেন সব অনুভূতি-ই কেটে যাচ্ছে আমার। এতক্ষণ ধরে যে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিলাম, সেটাও আর করছিনা মনে হচ্ছে। এবং তখনি আমার মুখের ওপর থেকে হাতটা সরে গেলো।
একটা ঝটকা বুঝতে পারলাম এবং আমার দুই হাতের মধ্যে থেকে অন্য হাতটাও বের হয়ে গেলো। এবং তারপর আমাকে বহুবার কোলে পিঠে নেয়া আমার পছন্দের বড় ভাই - যিনি আবার তার নেমসেক জাতীয় কবির মতো বড় চুল রাখেন - ক্লাস সিক্সে পড়া ছোট আমাকে “আদর” করা বাদ দিয়ে ভয় পেয়ে পালালেন। এরপর আমার আর ঠিক মনে নাই। সকাল বেলা মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙল। শুক্রবার সকাল, আমাদের ভাই বোনের খুব পছন্দের একটা টিভি অনুষ্ঠান দেখাবে - দ্যা ক্রনিকেলস্ অফ নারনিয়া। মা দেখতে ডাকছে।
* * *
আমি অপেক্ষা করছি, রাবেয়া আমাকে বলবে তারপরে কি হল। দেখি ও আর কিছু বলছে না। কথা গুলো শোনার মাঝখানে আমি ওর হাত কখন চেপে ধরেছিলাম অজানা ভয়ে, আমি নিজেও জানি না। তারপর কি হল? তুমি এর মাঝে আবার ঘুমিয়ে পড়লে কি করে? বাবা মা কে জাগিয়ে তুললে না কেন? ঐ হারামিটার কি হল? এতগুলো প্রশ্ন আমি মনে হয় এক নিশ্বাসে করে ফেললাম ওকে।
রাবেয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। আমি একটু ধাতস্থ হয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিতে গেলাম। কিন্তু ও ছাড়ল না। আমার হাত ধরে রেখেই বলল, আমি ঠিক জানি না রায়হান। আমার নিজেরো খুব মনে হয় আমি কি করে ঘুমিয়ে পড়লাম? এটা কি করে সম্ভব? কিন্তু তারপরে মনে হয়, আমি হয়তো ঘুমিয়ে পড়িনি। আমার মনে হয়, আমার সেই ছোট শরীর আর মন এতো চাপ নিতে পারেনি। আমি হয়তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম ভয়ে। বা কিছু, আমি জানি না।
তাহলে ঘুম থেকে উঠে কিছু বলনি কেন তোমার বাবা মাকে?
দিনের আলোতে সব কিছু কেমন যেন অবাস্তব লাগলো আমার। মনে হল আমি স্বপ্ন দেখিনিতো এসব কিছু? পর মুহূর্তেই মনে হল, না, এটা স্বপ্ন ছিল না। কিন্তু একই সঙ্গে মনে হল আমার বাবার ভাই এর ছেলে। সবাই কত পছন্দ করে নজরুল ভাইকে। আমি যদি এগুলো এখন বলি, তাহলে উনার কি হবে? আমার বাবা মা কি উনাকে মারবে? ঘর থেকে বের করে দেবে? উনার বাবা মা কে বলে দেবে? তাহলে উনারা কি করবে নজরুল ভাইকে? নজরুল ভাই কে কি পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে? তাহলে আমার চাচা চাচী কি ভাববে? তাঁদের কী হবে? আমার তো কিছু হয়নি, আমি শুধু অনেক ভয় পেয়েছিলাম। অনেক ভয়। আজকে আমি বাবার সঙ্গে ঘুমাবো, মা কে বলব নিচে ঘুমাতে। তাহলেই হবে।
মানে? তুমি এটা নিয়ে কিছুই করনি?
না। আমার তখন মনে হয়েছিল নজরুল ভাইকে হয়তো সবাই বকবে, বা মারবে। আমার জন্য উনি বিপদে পরবেন। থাকুক। উনি আরো এক দিন ছিলেন আমাদের বাসায় তারপর চলে যান। কিন্তু আমি উনার সঙ্গে আর কথা বলিনি। রাতে ঘুমিয়েও ছিলাম বাবার সঙ্গে। কেন যেন ঐ দিন রাতে বাবার সঙ্গে বাবাকে জাপটে ধরে ঘুমানোর সময় থেকে, বাবার নাক ডাকা নিয়ে আমার আর কোনদিন কোন সমস্যা হয়নি। হাল্কা একটু হাসল রাবেয়া।
আর কখনো দেখা হয়নি তোমার সঙ্গে উনার?
হয়েছে। আত্মীয় না? পারিবারিক বড় কোন অনুষ্ঠানে গেলে দেখেছি। কিন্তু কথা বলিনি। গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলে উনি এসেছেন, কিন্তু আমি দূরে থেকেছি। উনিও আমার কাছে এসে কথা বলার আর আগ্রহ দেখান নি। উনার বিয়েতে আমাদের দাওয়াত দিয়েছিলেন, কিন্তু আমি পরীক্ষা-টরিক্ষা বলে যাই নি। আর তারপর তো আমি নিজেই দেশ ছেড়ে চলে এলাম। গতবার দেশে গিয়েছি, তখন উনি আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। উনি এখন ঢাকাতে থাকেন। কী যেন চাকরি করেন। আই কুডন্ট্ কেয়ার লেস্! সঙ্গে ছিল উনার বৌ, আর ফুটফুটে দুটা বাচ্চা। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। মেয়েটা আর অল্প কয়েক বছর পরেই ক্লাস সিক্সে উঠবে।
আমি আর রাবেয়া চুপ করে বসে আছি। কী বলব? ওর মনে এখন কি ভাবনা চলছে আমি জানি না। শুধু মনে হচ্ছে, ওর এই কষ্টগুলোকে ওর স্মৃতি থেকে তুলে নিতে কোনভাবে। ও ভালো থাকুক।
কিছুক্ষণ পর রাবেয়া বলল, জানো, আমার ভিতর থেকে সেদিন একজন বলল, আমি যেন গিয়ে নজরুল ভাইয়ের বৌ কে বলি এসব কথা। উনাকে যেন বলি উনার মেয়েকে বেশী করে আগলে রাখতে। বহু বছর আগে আমার সঙ্গে যা হয়েছিল, সেটার কথাতো আমি তখন কাউকে বলিনি। এখন বড় হয়েছি, অনেক কিছু ভাবতে শিখেছি, বা বুঝতে শিখেছি, এখন মনে হয় আমার বলা উচিৎ ছিল সেই দিন - আমার বাবা মাকে। মনে হল, ঐ ভাবিকে গিয়ে বলি, নজরুল ভাই কত বড় জানোয়ার। উনি নিজের মেয়ের দিকে কুদৃষ্টি দেবে না, সেটার নিশ্চয়তা কি?
বলেছিলে সেই ভাবিকে?
না, বলি নি। হয়তো উনার সুখের সংসার, আমি সমস্যা করার কে?
কিন্তু ক্লাস সিক্সের সেই ছোট বাচ্চাটি? তার এই কষ্টের কথা কেউ কোনদিন জানবে না?
এই যে, তুমি জানলে!
- - -
তারপরে আরও অনেক বছর পার হয়ে গিয়েছে। জীবন আমাকে আর রাবেয়াকে দুই দিকে নিয়ে গিয়েছে। পরম করুণাময়ের দয়ায় রাবেয়া এখন বিবাহিত, এবং ভালো চাকরি করছে। একটি উন্নত দেশের বড় একটা শহরে আছে। আমি মনে প্রাণে আশা করি, তার স্বামী তাকে গভীর ভালবাসায় আগলে রাখেন। পৃথিবীতে নজরুলদের সংখ্যা অনেক কম, সেটা বোঝান উনার ভালবাসায়, যত্নে। জীবনের বহু বছরের স্মৃতির নিচে হয়তো তার সেই ভয়ংকর রাতের স্মৃতি চাপা পড়েছে। কিন্তু মুছে তো যাবে না!
আমি এর পরেও আরো কয়েকজনের সঙ্গে এই ঘটনাটা শেয়ার করেছি। এবং তাদের কাছ থেকে তাদের অনেক কষ্টের অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি। কিছু নিজেদের, কিছু তাদের চেনা মানুষের। এবং যখনি কোন যৌন সন্ত্রাসের কথা আমি শুনেছি (বা শুনি), তখনি একটা জিনিষ আমার সবার আগে মনে পড়ে। সব সময়। বাচ্চা একটা মেয়ে নিঃশব্দে চিৎকার করছে।
“বাবা, বাবা …”
মন্তব্য
ক) ট্যাগ পছন্দ হয়েছে। যৌন নির্যাতন নয়, যৌন সন্ত্রাস। সাবাশ!
খ) ছবিটা নেট থেকে নেওয়া এবং অপ্রয়োজনীয়। সুত্র উল্লেখ করেননি।
গ) চমৎকার লেখা।
শৈশব টু সারাজীবন মেয়েরা এরকম অ্যাবিউজড হয় বহুভাবে। চাচা-খালু-পাশের বাসার ভাই-প্রাইভেট টিউটর-- ব্লা ব্লা ব্লা। বোঝার বয়সের আগেই হলে বোঝেই না অনেকসময়, বোঝায় বয়সে পৌঁছুলে অনেকসময় বলে না ইচ্ছে করেই। কীভাবে বলবে এইসব! লোকে জানলে কী বলবে?
তাই চেপে যায়, লুকিয়ে রাখে। লজ্জায়, ভয়ে, ঘেন্নায় আজন্ম চাপা থাকে যাতনা।
এই ট্যাবু কাটতে বোধহয় আরো বহুদিন বাকি। কিন্তু কতদিন?
যে অনাকাঙ্খিত কুৎসিত অভিজ্ঞতা আপনাকে পেতে হয়েছে, সেই দুঃস্বপ্নের ভার যেন নিজের মেয়েকে (কতিপয় ক্ষেত্রে ছেলেকে)ও বহন করতে না হয়, সেই উদ্যোগ এখন থেকে নিন। সরব হন। বলুন, বোঝান, লিখুন। নিজ নামে না হলে বেনামে লিখুন, ফেইক আইডি থেকে লিখুন। দরকারে লিখুন এরকম রাবেয়া হয়ে। নিক লতাপাতা হোক না হয়, সমস্যা নেই। কথাটা কঠিন হোক, ব্যবস্থাগুলো কাজের হোক।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
সরাসরি মেথরের ঝাড়ু মারা দরকার ছিল এই বিকৃত মনস্কটাকে।
চুপ থাকার কারণে এর/এদের সাহস কিন্তু বেড়েই চলে।
কে বলতে পারে সে আর কোনো আত্মীয়ের মেয়েদের দিকে হাত বাড়ায়নি!
আপনার বলবার ঢংটা ভালো লাগলো
ভবিষ্যত প্রজন্ম( আপনাদের মেয়েশিশু) এর কথা ভেবে ট্যাবুর মুখে ঝামা ঘষে সরব হওয়া দরকার।
আপনার মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। কেন যেন লেখাটা লিখতে খুব কষ্ট হয়েছে। নিজের হার্ট বিট এত গুলো বেড়ে গিয়েছিল।
ছবিটা ইন্টারনেট থেকে নেয়া। আমি বহু বছর আগে থেকেই এটা ব্যবহার করি আমার ইউসার নেমের জন্য।
"আপনাদের মেয়ে শিশু" চিন্তা না করে হয়তো "আমাদের মেয়ে শিশু" চিন্তা করাটা সবার জন্যই মঙ্গলজনক।
কেন কাহলিল জিবরানের এই কবিতা পড়েননি?
নিজের জীবনের একাধিক অভিজ্ঞতার সাথে টুক টুক করে মিলে যায় গল্পটা...
আমি খুবই দুঃখিত আপনার এই সব কষ্টের জন্য। যদি মনে করেন, কিছু লিখে ফেলতে পারবেন, প্লিযলিখে ফেলুন। আমার এই লেখাটার ওপর ভিত্তি করে যদি মনে করেন, আমি কোন ভাবে সহযোগিতা করতে পারবো, আমাকে জানাবেন প্লিয। আমার ইমেইল হল
ঢাকা-চাপা কথাগুলো যত সামনে আসে, অন্যায়গুলোর প্রতিরোধ হওয়ার সম্ভাবনা তত বাড়ে। তাই, এইরকম লেখা আরও আসুক।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
বলা যখন শুরু হয়েছে তখন সমাধান এ পথ ধরেই আসবে। বিকৃতি রোধের প্রাথমিক কাজটা শুরু হয়েছে, এর অস্তিত্ব স্বীকার করার মধ্যদিয়ে, এটা আরো জোরালো হতে থাকলেইে আমরা পথটা খুঁজে পেতে পারবো।
স্বয়ম
ক্লাস সিক্সের ছোট্ট বাচ্চাটার জন্য কষ্টে ভেতরটা কেমন করে উঠলো।
মেয়েটা ওইরকম একটা জন্তুর জন্যও ভাবতে পারলো, যদি মা বাবা ওই ভাইকে বের করে দেয়!
রাবেয়া ভাল থাকুক, যেখানেই থাকুক।
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
বাস্তব ফুটে উঠেছে বিশ্বাসযোগ্যতার সাথে! তবে শুধু কিশোরীরা নয়, কিশোররাও এমন নিপীড়নের শিকার হয়ে অনেক সময়!!! বিকৃত মানসিকতার মানুষরুপী জন্তগুলো কাউকেই ছাড় দেয় না!
আর তিথীডোরের সাথে একমত, বহুল ব্যবহৃত ছবিটির কোন দরকার ছিল না!
সবশেষে, সচলকে ধন্যবাদ, সময়োপযোগী উদ্যোগের জন্য! আমরা সচলকে এভাবেই দেখতে চাই, সচল শুধুমাত্র নিছক একটা সাহিত্যব্লগ নয়, সচল একটা আন্দোলনও বটে!
।।।।।।
অন্ধকূপ
লেখাটার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
বাচ্চারা সবচে বেশি অ্যাবিউজের শিকার হয় একেবারে চেনাজানা লোকদের দিয়ে। আর বাকিসবকছু বাদ দিলেও এইসবের দীর্ঘমেয়াদি মানসিক প্রভাব অনেক সুদূরপ্রসারী।
কৈশোরে দেখতাম আমার এক বন্ধু, সে ছেলে, বয়স্কদের সাথে খুবই বেয়াড়া দুর্বিনীত ব্যবহার করে। বিশেষ করে পরিবারের লোকজনের সাথে। কথায় কথায় গালিগালাজ এইসব আরকি। এজন্য অনেকেই ওকে ভাল চোখে দেখতো না। আমরা বড় হওয়ারও অনেক অনেক দিন পরে আমি জানতে পারি ওর আপন চাচা নাকি ওকে প্রায় রেগুলারলি অ্যাবিউজ করতো। সেই থেকে বয়স্কদের প্রতি ওর যে ঘেন্নাটা জন্মে গেছে, সেইটা সাসটেইন করছে। যদিও কখনও কাউকে সে বলে নাই ঘটনাগুলো।
এখনও সে অনেকটাই ওইরকম। ছেলে দেখে হয়ত ওর প্রতিক্রিয়াটা এইরকম হয়েছে। মেয়ে হলে হয়তো সে আরো চুপচাপ হয়ে যেতো। কি জানি।
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
এই ঘটনাগুলো খুব কমন। অল্প এক-আধজন ভাগ্যবানকে বাদ দিলে সম্ভবত কেউই এগুলোর হাত থেকে নিস্তার পায়নি - না কন্যাশিশু, না পুরুষশিশু। এই ব্যাপারে আমরা নিজেরা কিছু precautionary ব্যবস্থা নিতে পারি।
১। কোন অবস্থাতে নিজের বাচ্চাকে (লিঙ্গ নির্বিশেষে) কোন আত্মীয়স্বজনের সাথে এক বিছানায় বা এক ঘরে ঘুমাতে না দেয়া।
২। কোন অবস্থাতে নিজের বাচ্চাকে (লিঙ্গ নির্বিশেষে) কোন আত্মীয়স্বজনের সাথে একা কোথাও না ছাড়া।
৩। বাচ্চাকে ছোটবেলা থেকে শেখানো যে, কেউ যদি তার মুখ-বুক-জননাঙ্গ-পশ্চাতদেশ স্পর্শ করে বা সেখানে কিছু করতে চায় তাহলে চিৎকার করা এবং মা-বাবাকে সাথে জানানো।
এবং এই প্রকার ঘটনায় কোন ফেরেশতাতুল্যকেই বিশ্বাস করবেন না। ঐ ফেরেশতাকে আচ্ছাসে জুতাপেটা করে তার ঘাড়ের শয়তান হঠান।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এই অংশটা কাবিননামায় লিখে দিয়ে বিয়ের আগে সব ছেলেমেয়েকে মুখস্ত করানো দরকার!
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
যে নির্যাতনের কথা আমরা শুনিনা, সেগুলো এরকমই হয়। পরিচিত জনের, দেবতূল্য মানুষের হাতে! কত সহজদর্শন মানুষের ভেতরেই যে একটা ইতর বাস করে!
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
খুবই দুঃখজনক! কাল থেকে লেখা গুলো পড়ছি আর ভীষণ কষ্ট বোধ করছি।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
নতুন মন্তব্য করুন